আমার এ যাবৎকালের সকল ভালোলাগাগুলোর সাথেই আমি আমার ছেলেবেলায় যত ভালো লাগা, তার যোগসুত্র খুঁজি আর আমাদের দেশে এমন কাউকে মনে হয় খুঁজে পাওয়া যাবেনা যার ছেলেবেলার স্মৃতিতে নানুবাড়ির মধুর স্মৃতি নেই। ঠিক তেমনি আমার খুব ছোটবেলার স্মৃতি মাধুরীমার একটি, নানীমা কাপড়ের আলমারী গুছাচ্ছেন আর আমরা সব মামাতো, খালাতো ভাইবোনেরা ও ছোটখালা চারিদিকে গোল হয়ে বসে দেখছি। আজও আমার সেই পুরোনো মলিন স্মৃতি দৃশ্যে ভাসে নানীমার নানারকম বিচিত্র বর্ণের ও গন্ধের শাড়ি, জামা পেটিকোট সমূহের এক মহা চাকচিক্যময় বর্ণীল স্বপ্ন স্বপ্ন দৃশ্য। সবগুলো শাড়ীর ভেতর এক শাড়ি, সোনার জরীসুতোয় কাজ করা জরীদার জমকালো কালো রঙ। শাড়িটা দেখে আমি মহা মুগ্ধ এবং নির্বাক!!!
নানীমা বললেন এটা মসলিন শাড়ী।
খাঁটি সোনার জরীতে নাকি কাজ করা। খুব মূল্যবান। তার বাবা নাকি বিয়েতে নানীমাকে দিয়েছিলেন। ধরতে দেয়না নানীমা। বলে সাবধান ছিঁড়ে ফেলবি।
নানীমা আরও শুনালেন আরও আগের আমলে এই মসলিন শাড়ি নাকি এতই সুক্ষ আর পেলব কোমল সুতোয় বোনা হত যে, তা ভাঁজ করলে বিশাল ১৩ হাত শাড়ীটাও নাকি ঠিকঠাক ভরে ফেলা যেত একটি ছোট্ট দিয়াশলাই বাক্সে। সেই কথা শুনে তো আমার তখন বিস্ময়ের উপর বিস্ময়!!! আমার কাপড়ের পুতুলের ছোট্ট একরত্তি শাড়িটাও তো আমি দিয়াশলাই বাক্সে ভাজ করে ঢুকাতে পারিনা কোনোভাবেই। আর নানীমা কিনা বলছে আস্ত এক ১৩ হাত শাড়ির কথা!!! ছোট খালা বললেন শুধু তাই নয়। আরো ভালো সুতোর মসলিন শাড়ী তো একটা ছোট আংটির মধ্যে দিয়েও ঢুকিয়ে নেওয়া যেত ঈসা খা এর আমলে!! তেমনি নাকি শুনেছেন তিনি।
যাইহোক পরে জেনেছি এমনই নানা রকম কিংবদন্তী ছড়িয়ে আছে ঢাকাই মসলিন নিয়ে।
মসলিন নিয়ে গল্প-গাঁথা আর কিংবদন্তীর কোনোই শেষ নেই । এছাড়াও শোনা যায় মসলিন কারিগর যাতে তার শিক্ষা আর কাউকে না শিখিয়ে দিতে পারে তার জন্য নাকি তাদের আঙুল কেটে ফেলা হত। এসব কতটুকু সত্যি আর কতটুকু মিথ্যা তার কোনো হদিস প্রমান অবশ্য পাওয়া যায়না।
যাইহোক ইতিহাস বলে মসলিন শব্দটির উৎপত্তি নাকি বাংলাদেশে নয়। মসলিন শব্দটি এসেছে সুদূর ইরাক দেশ হতে।
জানা যায় সে আমলে ইরাকের প্রখ্যাত ব্যবসা কেন্দ্র মসূলে তৈরি হত সূক্ষ্ম সব কাপড় । তাই ইংরেজরাই আমাদের এই সূক্ষ্ম কাপড়কে নাম দিয়েছিলেন মসলিন। মুঘল আমলে সতেরো শতকে মসলিন শিল্প বিকাশ লাভ করেছিল ঢাকার সোনারগা আর তার আশেপাশের অন্চলগুলোয়। এই মসলিন রপ্তানি হতো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনকি ইউরোপেও।
বিখ্যাত ভূগোলবিদ সোলায়মান লিখেছিলেন- 'সিলসিলাত উত তাওয়ারীখ' ।
তাতে রুমী নামের এক দেশের কথা আছে যেখানে এত সূক্ষ কাপড় তৈরি হত যে চল্লিশ হাত লম্বা আর দুইহাত চওড়া কাপড়ের একটি পুরো টুকরো প্রবেশ করানো যেত একটি সাধারণ আংটির মধ্যে দিয়ে। ধারনা করা হয় রূমী হচ্ছে আজকের বাংলাদেশ। যদিও রুমী নামের দেশটি কি করে বাংলাদেশ হয় এটা আমার মন মেনে নিতে পারেনা তবুও বুঝা যায়, সবমিলিয়ে এই কাপড়ের ঐতিহ্য বহু বছরের পুরানো।
মুঘল আমলে ঢাকা যখন রাজধানী হয় তখন থেকেই নাকি এই মসলিনের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে নানাদিকে । সম্রাট নবাবদের কাছে এই মসলিন কাপড়ের কদর ছিলো অনেক বেশী।
সে যুগে মসলিন তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল ঢাকা, ধামরাই, সোনারগাঁ, টিটবাদি, জঙ্গলবাড়ি আর বাজিতপুর। জঙ্গলবাড়ি থেকে কিছু দূরে বাজিতপুরে জন্মাতো উচুঁমানের কার্পাস আর তাই থেকে তৈরি হতো সেই জগৎ বিখ্যাত মসলিন। জানা যায় ঢাকাতে সাতশ' ঘরের বেশি ছিলো এই মসলিন কারিগর।
মসলিন তৈরি করার জন্য দরকার হতো বিশেষ ধরনের তুলা বা কার্পাস। এই কার্পাস জন্মাতো মেঘনা নদীর তীরে।
কাপাসিয়া জায়গাটির নামটাও নাকি এসেছে এই কার্পাস হতেই।
মসলিন কাপড় বুনতে সাধারনত মেয়েরাই সুতা কাঁটা আর সূক্ষ্ম সুতা তোলার কাজগুলো করতো। সুতা তোলার সময় কম তাপ এবং আর্দ্রতার দরকার হতো। তাই একেবারে ভোর বেলা আর বিকালের পরে এ কাজ করা হতো। অবাক করা ব্যাপার শোনা যায় আর্দ্রতার খোঁজে নাকি অনেক সময় এমনকি নদীতে নৌকার ওপর বসে সুতা কাটার কাজ চলত।
মেয়েদের বয়স ২০ পেরিয়ে গেলেই তাদেরকে দিয়ে নাকি মসলিন কাপড় বানানো হত না। মসলিন কাপড় বোনার জন্য চাই কোমল পেলব হাত। ২০ বছরের পরের বয়সী মেয়েদের হাতে নাকি সেই পেলবতা পাওয়া যায়না। আর তা ছাড়াও মসলিনে সূক্ষ্ম সুতা কাটার জন্য তরুণী মেয়েদের ব্যবহার করার আরেকটি কারণ তাদের তরুন দৃষ্টিশক্তি ও হাতের সাহায্যে যে সূক্ষ্মতা অনুভূত হয় তা মসলিন তৈরীর জন্য বিশেষ জরুরী। বয়স বাড়লে সেই অনুভূতিগুলো নাকি নষ্ট হয়ে যায় এমনি ধারনা ছিলো তখনকার মসলিন কারিগরদের।
যাইহোক মসলিন তৈরির কাজটি ছিল ভীষন জটিল, কঠিন, সময়সাধ্য- তারচেয়েও বড় কথা, সেটা তৈরির জন্য দরকার হতো অসামান্য নৈপুণ্য আর পরম ধৈর্য।
১৮৫১ সালে লন্ডনে এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে এই মসলিনের এক পাউন্ড সুতা প্রায় আড়াইশো মাইল দীর্ঘ ছিল !! আরও মসলিন সম্বন্ধে, "মর্নিং ক্রনিকল" পত্রিকায় লিখা হয়- হাবিবুল্লাহ তাঁতির বোনা দশ গজ লম্বা একখন্ড মসলিনের ওজন নাকি ছিলো মাত্র তিন আউন্স !! 'India of Ancient and Middle Age' বইটিতে পাওয়া যায়, ঘাসের ওপর বিছানো একটি সুদীর্ঘ মসলিন শাড়ি নাকি একটা গরু খেয়ে ফেলেছিল। এর কারণ ছিলো কাপড়টির স্বচ্ছতা !!! অবশ্য গরুটির মালিককে তার জন্য দন্ডিত করা হয়।
মসলিন কাপড় ধোয়াটাও নাকি এক বিশেষ যত্নের ব্যাপার ছিলো। সম্রাট আকবর এর আমালে সোনারগাঁ'র কাছে এগোরো সিন্ধুর পানি কাপড় ধোয়ার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল।
আসলে এটা যে শুধু পানির গুনে হতো তা নয়, এর সাথে ছিল ভাল ক্ষার বা সাবান আর ধোপার দক্ষতা। কোন কোন মসলিনে ছুঁচের বা চিকনের কাজও করা হতো।
মসলিনের মূল্যমান নির্ধারিত হত সুতার সূক্ষ্মতা, বুনন আর নকশা বিচারে। সবচেয়ে সূক্ষ্ম সুতার তৈরি, সবচেয়ে কম ওজনের মসলিনের কদর ছিল সবার চেয়ে বেশি, দামটাও ছিল সবচেয়ে চড়া। সূক্ষ্মতা, স্বচ্ছতা বা মানের ওপর ভিত্তি করে মসলিনের বিভিন্ন নামকরণ করা হতো।
যেমন_মলমল (সূক্ষ্মতম বস্ত্র), তানজেব (দেহের ভূষণ), আবই-রওয়ান (প্রবহমান পানির তুল্য বস্ত্র), খাস (মিহি বা জমকালো), শব-নম (ভোরের শিশির), আলাবালি (অতি মিহি), ডোরিয়া (ডোরাকাটা) ইত্যাদি। "মলবুস/মলমল খাস" ছিল সবচেয়ে নামী, সেরা মসলিন। সম্রাটের জন্য তৈরি হত এই মসলিন।
দশ গজ লম্বা আর এক গজ চওড়া মলমল খাসের ওজন হত মাত্র ছয় তোলার মতো, যা অনায়াসে ছোট্ট একটা আংটির ভিতর দিয়ে গলে যেত! মলবুস খাসের সমগোত্রীয় আরেকটি মসলিন "সরকার-ই আলা"। দশগজ লম্বা আর একগজ চওড়া 'সরকার-ই আলা'-র ওজন হত দশ তোলার মতো।
ঝুনা মসলিনে সুতার পরিমান থাকতো কম- দেখতে হত অনেকটা জালের মত। ঝুনা হিন্দী শব্দ যার অর্থ 'সূক্ষ্ম'। নকশা করা মসলিনকে বলা হতো জামদানি, কিন্তু আজকের জামদানির সাথে আদি জামদানির বলতে গেলে কোনো মিলই পাওয়া যাবেনা।
১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর ইংরেজরা বছরে আট লাখ টাকার মসলিন রপ্তানী করতো। সেই সময়ে ফরাসিরা কিনেছিলো প্রায় তিন লাখ টাকার মসলিন।
এরা ছাড়াও ইরানি, তুরানি, আর্মেনীয়দের পাশাপাশি দেশী ব্যবসায়ীরাও এ নিয়ে ব্যবসা করতেন।
পরবর্তীতে মসলিন রপ্তানীর ব্যবসা প্রায় পুরোটাই করায়ত্ত করে নেয় ইংরেজ কোম্পানি। তাদের রপ্তানী হত মূলত ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে। পলাশীর যুদ্ধের আগ পর্যন্ত দালালরা বিভিন্ন জায়গা থেকে দামি মসলিন সংগ্রহ করে কোম্পানিতে সরবরাহ করতো। ইংরেজরা নাকি মসলিন তাঁতীদের আঙুল কেটে ফেলতো।
আবার এও শোনা যায় যে- তাঁতীরা নিজেরাই নাকি নিজেদের আঙুল কেটে ফেলতো, যাতে করে এই অমানুষিক পরিশ্রম আর কম পারিশ্রমিকের কাজে তাদের বাধ্য না করা হয়।
আজ কালের গর্ভে নিশ্চিহ্ন হয়েছে সেই অসামান্য যাদুকরী সৌন্দর্য্য! সেই জগৎ বিখ্যাত মসলিন আর নেই । মসলিনের এমন বিলুপ্তির কারন কি? ১৮৪৪ সালে ঢাকার কমিশনার আই. ডানবার সাহেবের মতে মূল কারণগুলো ছিলঃ
১) ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে সস্তায় সুতা আর কাপড় উৎপন্ন হতে থাকে। ফলে দামি মসলিনের চাহিদা কমে যায়।
২) বিলেতের সস্তা সুতা ঢাকায়, ভারতে আসতে থাকে, সে থেকে তৈরি হতে থাকে কাপড়, হারিয়ে যেতে থাকে মসলিন।
৩) বিলাতে ঢাকাই মসলিনের ওপরে উচ্চহারে কর আরোপ করা হয়, ফলে মসলিনের দাম ওখানে বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। স্বভাবতাই বিক্রি কমে যায় মসলিনের।
মসলিনের পড়তির সময়টায় পতন ঘটতে থাকে আমাদের নবাব-সম্রাটদেরও। তাছাড়া মুঘল সম্রাট, নবাব, ব্যবসায়ী-কেউই এ শিল্প রক্ষা কিংবা প্রসারে কোন সময়ই তেমন কোন উদ্যোগ নেননি, সব সময় চেষ্টা করেছেন কিভাবে কৃষক-তাঁতীদের যতটা সম্ভব শোষণ করে নিজেরা লাভবান হওয়া যায়- এই সব মিলিয়ে এভাবেই ধিরে ধিরে আমাদের আরও অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের মত হারিয়ে গিয়েছে মসলিনের গৌরব মন্ডিত সেই গোল্ডেন এইজ!!!।
ঢাকাই মসলিন শাড়ির কথা লিখতে গিয়ে, মনে পড়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাঁশী কবিতা।
এ গান যেখানে সত্য
অনন্ত গোধূলী লগ্নে
সেইখানে
বহি চলে ধলেশ্বরী,
তীরে তমালের ঘন ছায়া ---
আঙ্গিনাতে
যে আছে অপেক্ষা ক'রে, তার
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর ।
সেই যাদুকরী ঢাকাই মসলিন হয়তো হারিয়ে গেছে কালের বিবর্তনে তবে বেঁচে থাকুক বাংলার তাঁত যাদুকরেরা! বেঁচে থাকুক তারা সহস্র কোটী বছর বাংলার নানা ঐতিহ্যবাহী জামদানী, টাঙ্গাইল, রাজশাহী সিল্ক, মিরপুরী কাতান, খাদি ও আরও নানা রকম বর্ণ ও বৈচিত্রের শাড়ী নিয়ে। সাজুক বাঙ্গালী রমনীরা বাংলার সকল পালা পার্বন আর উৎসবে শাড়িতে, চুড়িতে আর বেলফুলের মালায়।
বিয়ের অনুষ্ঠানে মিরপুরের লাল বেনারসী
হলুদে সবুজ শাড়ি
উৎসবে মিরপুর কাতান
বিখ্যাত রাজশাহী সিল্ক
আড়ং এর টাঙ্গাইল সুতী শাড়ি
লাল সাদা পাড় পহেলা বৈশাখ
বাসন্তী রঙ পহেলা ফাল্গুন
রবিঠাকুরের গান- নাচ আর শ্বাসত বাংলার শাড়ি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।