"আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে, কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে"-শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্যারিসের চিঠি ১ - বেদুঈনের ঘোড়া
আমরা সময় নিয়ে সময়কে খুঁজে বৃথাই সময় নষ্ট করে
শেষে সবকিছু সময়ের হাতে ছেরে দিতে ভালোবাসি।
আমরা জানি সময় মরুর বালুক ঝড়ে পড়া বেদুঈনের ঘোড়া,
আমরা এও জানি আমাদের মাঝে বেদুঈনের মত শক্তিশালী স্বত্বা আছে।
তবুও জানা স্বত্বে আমরা ঈশ্বরের দারস্থ হয়ে সময়ের অনুযোগে
ঈশ্বর ঈশ্বর বলে ঈশ্বরকে উৎকোচ দেয়ার মত জঘন্যতম অপরাধ করি।
অতঃপর যখন সূর্য হাসিয়া বলে_"যা আকাশে উড়ে দেখ, আকাশ দেখ। "
আমরা যারপনাই আনন্দিত হয়ে ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে কার্পণ্য করি।
একবার নয়, বার বার, ঈশ্বর কত সহ্য করবে?
তুমি প্রেমিক হয়ে প্রেমিকার জ্বালা সহ্য করতে পারো না,
ঈশ্বর তবে কেমনে অপমান সহ্য করবে বলো?
প্যারিসের চিঠি - ২ - মধ্যবিত্ত প্রেম
আমাদের তখন ছিল মধ্যবিত্ত প্রেম আর ভীরু বুক
আমরা লোকলজ্জার চশমা পড়ে দুজন দুজনের আড়াল।
তোমায় ভেবে বুকের ভিতরে কেমন শুন্য শুন্য লাগে
তুমি অভিমানী চোখে তাকিয়ে বলতে_"একেবারেই ভালোবাসো না"
আমরা তখন দুপুর রোদে দুটি ছায়া দেখি
একটি ছায়া হাত নাড়িয়ে বলতো ভালোবাসি,
কেউ তখনি বড়শি দিয়ে মেঘ টেনে দেয় রোদে
একটি ছায়া হারিয়ে গেলো, অপর ছায়া কাঁদে।
মধ্যবিত্ত প্রেমের চাহিদা মধ্যবিত্তের আয়ত্তে থাকেনা
চাহিদা আর আয় ব্যায়ের ছকে প্রেমের বিন্দু হারিয়ে যায়,
আমাদের শহরের বাজারে আজকাল প্রেম বিক্রি হয়
অথচ সেই বানিজ্যিক প্রেমও মধ্যবিত্তের আয়ত্তের বাইরে।
প্যারিসের চিঠি ৩ - ছারপোকার পাখা নেই
ট্যাবের টপ টপ জলকেলিতে মুগ্ধ হওয়ার চাইতে
অবাক হওয়ার ঘটনাই বেশী ঘটে ঠিক তখনি শীতের
চাদর বিছানার উপরে পদ্মাসন নিয়ে বসে আর বিছানা
আরামের ঘুমে রাত কাভার করে নেয়ার চিন্তায় বিভোর।
ছারপোকা বাসা বাধে সমস্ত শরীরে, হেঁটে চলে।
তখন
শরীরে আগুন দিয়ে দেখা হয় ছারপোকার পাখা নেই,
আলোতে দিকভ্রান্ত হয়ে শেষে নিজেরি মৃত্যু ডেকে আনে।
আমরা পদ্মাসনে বসা চাদর মেলে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
প্যারিসের চিঠি ৪ - অরণ্যের পথিক
পথটার দুপাশে সবুজ ঘাসেরা রেসিং ট্রাকের মত
মাঝে সে জায়গাটুকু রেখেছে সেখানে প্রতিনিয়ত
আমরা প্রতিযোগিতায় ব্যাস্ত। কিন্তু নিয়ম মোতাবেক
আমাদের ভিক্টরি লাইন কিংবা ফিতা নেই।
আমরা নিরন্তর দিবারাত্রির প্রহসনে দৌড়ে যাচ্ছি
জয় নিশ্চিত করার লোভে।
আমরা ক্ষুধার্ত থাকি,
থাকি পিপাসার্ত। রোদে ঘেমে দৌড়াই আবার
বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি বাঁধিয়ে ভাবুক আনন্দে
ব্ল্যাঙ্কেটের নীচে শুয়ে বলি_"হোয়াট এ লাইফ"
শকুনি দুচোখে খুঁজে বেড়াই কাঙ্খিত লাল ফিতা।
প্যারিসের চিঠি ৫ - মোমের শিখা
শহরের রুটিন মাফিক লোডশেডিংয়ে বাম পকেটের
দিয়াশলাই আর ড্রয়ারে রাখা মোমবাতি যখন ভরসা
সেখানে প্রেম কোনদিন অন্ধকারে আলো ছড়ায় না।
অথচ জ্বলন্ত মোমবাতির শিখায় প্রেম ঝাপিয়ে পড়ে
কীটের মত। প্রেম আগুন কিংবা জ্বালা কখনোই সহ্য
করতে পারে না।
বার্ন ইউনিটের ডক্টর প্লাস্টার করে
দেয় আমাদের প্রেমের উপরে। কিন্তু জ্বালা কমাতে
সস্তা মলম আমাদের ভরসা যেখানে সেখানে প্রেম
আরও জ্বলবে, প্রেম আরও জ্বালাবে।
তবুও আমরা লোডশেডিংয়ের আশায় থাকি,
জ্বলন্ত মোমবাতিতে প্রেম নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে।
প্যারিসের চিঠি ৬ - স্বপ্নের কঙ্কাল
সাদামাটা স্বপ্নেরা রঙিন হওয়ার জন্যে বিদ্রোহ করে
ট্রাফিক সিগন্যালের লাল, সবুজ, হলদ বাতির সাথে।
স্বপ্নেরা রঙ চায়, আমাদের সমীপে অনশন করে রঙ
ঢেলে দেবার দাবী জানায়।
আমরা রঙ ঢালি না, যদি
স্বপ্নেরা বাস্তবতাকে টপকে যায়! দিনে দিনে অনশনে
থাকা স্বপ্ন আর স্বপ্নবাজের দল শুষ্ক হতে থাকে।
আমরা স্বপ্নের হাড্ডিসার কঙ্কাল দেখে চমকে উঠি।
তবুও আমরা রঙ দেই না, আমরা বাস্তবতাকেই
মূল্যায়ন করে স্বপ্নের হাহাকারে কানে হাত দেই।
আমাদের শহরের স্বনামধন্য গোরস্থানে শ্রদ্ধাভরে
শেষকৃত্য হয় স্বপ্ন আর স্বপ্নবাজের দলের।
প্যারিসের চিঠি ৭ - জোনাকির অভ্যুথান
গাছেরা ঘুমিয়ে পড়লে পরীরা নেমে আসে_
পা টিপেটিপে এগিয়ে যায়, তারপরে পাড়াগাঁয়ের
এক কবির জানালায় পরীরা উঁকি দিয়ে
দেখতে পায় ছেঁড়া কবিতার মেঝেতে গরাগরি।
অশরীরী কিছুর শব্দে কেঁপে উঠে দুরুদুরু বুক,
জানালায় দাঁড়িয়ে নামহীন কবি শুনতে পায়_
ঝুমঝুম নূপুরের ধ্বনি আর আলোর দিকে তাকিয়ে
মনে হয় শত শত জোনাকির অভ্যুথান।
কবি সাদা কাগজের বুকে শুরু করে কবিতার চাষ,
কলমের বল ঘষে একে একে বেড়িয়ে আসতে থাকে
ফসলি কবিতার শব্দমৈথুন। কবি শিশি উল্টে
সমস্ত আবেগ ঢেলে দেয় রোলটানা খাতায়_
বিদায়রাতে প্রসব ঘটে পৃথিবীর এক শ্রেষ্ঠ সাহিত্য।
উচ্ছ্বাসিত কবি দরজা খুলে দৌড়ে পরীদের
কবিতা শোনাতে যেয়ে আবিষ্কার করে
পরীরা ভোরের আলো গায়ে মাখে না।
কবিতা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে উঠোনে
উড়িয়ে দেয় কবি।
অগোচরে খুন হয়
বিশ্বসাহিত্য মাতার এক সাহিত্য সন্তান।
প্যারিসের চিঠি ৮ - ধোঁয়ার রিং
পাহাড়ের সাথে মেঘের অবৈধ প্রেমের ব্যাপারটা
নিয়ে যখন কুয়াশার সাথে চুক্তি হয় পাহাড়ের,
আমরা কিছু বন্ধু মিলে তখন টং দোকানে
পায়ে পা তুলে সিগারেটের ধোঁয়ায় রিং ছড়াই।
পাহাড় আর মেঘের অজান্তেই কুয়াশার বদৌলতে
আমাদের নাগালে আসে সমস্ত এগ্রিমেন্ট পেপার।
আমাদের মাঝে সহিংস স্বত্বা জেগে উঠে আর
আমরা খন্তা নিয়ে খুঁড়তে থাকি পাহাড়ের বুক।
শেষে ঝর্ণার কাছে এসে পাহারের অশ্রুতে ধুয়ে নেই হাত মুখ।
এখন পাহাড় কাঁদে, কাঁদে মেঘ।
আর আমরা টং দোকানে বসে
সিগারেটের ধোঁয়ায় আয়েশি রিং ছাড়ি।
প্যারিসের চিঠি ৯ - প্রস্টিটিউট
ডালের আড়াল থেকে দিনব্যাপী ক্ষুধার্ত চাঁদ
উঁকি দিয়ে আলোর বিনিময়ে খাদ্য চায়,
শহরের নষ্ট মানুষেরা সেই আলো শরীররে জড়িয়ে
সুখনিদ্রা যায় আর ক্ষুধার্ত চাঁদ রসদের বন্দোবস্তে
আনন্দিত হয়ে সাধুবাদ জানায় ঈশ্বরকে।
অথচ আমাদের নীতিশিক্ষা বইতে আছে_
অবিনশ্বর ঈশ্বরও ঘৃণা করে চাঁদকে,
অথচ জ্ঞাত অজ্ঞাত সকল বিষয় নাকি ঈশ্বরের নির্ধারিত।
পাড়ার মুরুব্বি চাঁদকে "প্রস্টিটিউট" বলে গালি দিলেও
রোজকার সন্দেশে নেই তার সন্তান পূর্বরাতে বাড়ি আসেনি কেন?
আমরা 'নীতি' নামের শব্দটি মেনে চলি_
যতক্ষন ধর্মশিক্ষা বই সম্মুখে উন্মুক্ত থাকে,
বই বন্ধের পরপরই আমাদের নীতিও
দুই পাতার ভাঁজে ঘাপটি মেরে থাকে।
প্যারিসের চিঠি ১০ - অভিশপ্ত অপদেবতা
কিশোরী যেদিন মানুষ রূপি অপদেবতার দেখা পায়,
সেদিন ভয়ানক আমাবস্যার রাত।
কিশোরী অপদেবতার গায়ের আগুন স্বর্গীয় আলো ভেবে
এগিয়ে যায় একটু ছুঁয়ে দেখার লোভে।
রাত যত গভীর হয় পথ তত নিকটে আসে আর
আগুনের ঔজ্বল্য দিপ্ত শিখায় আরও বেশী দ্যুতি ছড়ায়।
কিশোরী চাপা আতঙ্ক আর অপরিমেয় কামনা নিয়ে
দাঁড়ায় অপদেবতার সন্নিকটে।
কিশোরী সম্মুখ থেকে আগুনের তেজ দেখে বিচলিত হয় না,
হাত বাড়িয়ে দেয় অগ্নিদেবতার পানে।
রূপকথার গল্পের মত অপদেবতা
সমস্ত অগ্নি নির্বাপন করে হাত ধরে না দুরন্ত কিশোরীর।
অপদেবতা সন্তপর্নে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়,
অপদেবতা অস্পৃশ্য অধরা,
কিশোরী তবুও আশায় হাত বাড়িয়ে রাখে।
ছবিঃ আমার ওয়াল স্ট্রিট ফটোগ্রাফি এ্যালবাম থেকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।