তেরোর ব্লগ মানেই হাবিজাবি !! “দেখলেন মামা ......নদীটা মইরা গেছে”।
হু বলে ঘাড় ঘুড়িয়ে মৃত নদীটা দেখতে লাগলাম। একেবেকে চলা বিশাল সাপের মতো তার লাশটা পড়ে আছে। তিড় তিড় বাতাস বইছে। সেই বাতাসে মরা নদীর মৃদু গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।
মাঝে মাঝে কিছু বিশাল দৈত্যাকৃতির ট্রাক সাই সাই করে যাচ্ছে। ঠিক তখনই রহিম মিয়া ফট করে এই কথা বলে উঠলো, “দেখলেন মামা ......নদীটা মইরা গেছে”।
রহিম মিয়ার সাথে আমার পরিচয় আরো পাঁচ মাস আগে। তার রিকশাতে উঠে বলি, “চলো মামা ধানমন্ডি,জলদি”। মামা ডাকাটা আসলে অভ্যাস হয়ে গেছে।
নইলে বয়সে সে আমারই সমান নয়তো আরো ছোট।
সে বলে, “টাইট হইয়া বসেন মামা। রিকশা স্টার্ট দিয়া নেই”।
তার ভাষায় রিকশা স্টার্ট দিয়ে নিজেই নানান গল্প বলতে লাগলো। বুঝা গেলো আড্ডাপ্রিয় মানুষ।
জানা গেলো এইট পর্যন্ত পড়াশোনা। আঞ্চলিকতা কম কথাবার্তায়। যথাসম্ভব চেষ্টা করে শুদ্ধভাবে কথা বলার। কিন্তু এখনো ‘প’ এর জায়গায় ‘ফ’ বলে ফেলে। এর মাঝে আবার তার মোবাইল বাজছে।
কথা বলা শেষ করে আমার দিকে তাঁকিয়ে লাজুক হাসি দিয়ে বলে, “আফনের মামীর ফোন। বাড়ি আসতে বলে তাড়াতাড়ি। কি জানি পাক করছে”।
“আরে মামা মামীও দেখি আছে। বাহ বাহ”।
“মামারে বিয়া না কইরা উফায় আছে? আফনের মামীরে আরেক জায়গায় বিয়া দিয়া দিবো। না পালায় তো উফায় নাই। আইসা পড়লাম শহরে”।
এভাবে নানান গল্পে রহিম মিয়ার সাথে আমার ভালোই আলাপ জমে গেলো। সে আমাকে কখনো বলে ভাই কখনো বলে মামা।
অদ্ভুত চরিত্র।
এরপর থেকে রিকশার দরকার হলে রহিম মিয়াকে ফোন দেই সে যেখানে থাকুক চলে আসে, তারপর তার রিকশাতে ঘুড়ে বেড়াই। পথে সে নানান গল্প বলে এর মাঝে অর্ধেকই তার স্ত্রীর বর্ণনা,রান্নার কথা। তাদের কিভাবে পরিচয়। কিভাবে চিঠি লিখতো।
অনেক কাহিনী আমার বহুবার শোনা। তাও আমি বার বার শুনি। তার কাছে আমি দাওয়াত চেয়ে রেখেছি। একদিন হুট করে তাদের বস্তিতে চলে যাবো। প্রচন্ড ঈর্ষা হয় মাঝে মাঝে এত আনন্দ কোথা থেকে পায়? এই মৃত নগরীতে আনন্দ কোথায়? এই নগরীতে সবার আত্না মরে যায়, জীবিত লাশ হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
তাও কেউ মৃত নগরী ছেড়ে যায় না। মৃত নগরী চুম্বকের মতো আকর্ষন করে সবাইকে। এক অদ্ভুত জালে এরপর ঘিরে ফেলে আমাদের। আমরা এই জাল ছিড়ে যেতে পারি না। মাকড়সার মতো এরপর চুষে ফেলে আমাদের আনন্দ।
মেরে ফেলে আমাদের আত্না। আমাদের মৃত লাশ এরপর নগরীর এখানে সেখানে ঘুড়ে বেড়ায়। নিজেকেও লাশ মনে হয়। হয়তো আমিও তা। এর মাঝে ব্যতিক্রম হিসেবে রহিম মিয়াকে দেখে কেনো জানি ভালো লাগে।
একদিন মিলির সাথে দেখা। আমি আর রহিম মিয়া তখন মনের আনন্দে সিগারেট টানছি। মিলি আমাদের ক্লাসের সুন্দরীদের মাঝে একজন। বাবার এয়ারকন্ডিশনড গাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। আমার সাথে ইদানীং কেনো জানি খাতির করছে।
সুন্দরীদের মতিগতি। নারীমন বোঝা দায়। এই নিয়ে আমি আর রহিম মিয়া প্রায়ই আলোচোনা করি। কিন্তু আলোচনা শেষে দুইজনকে দেখা যায় বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে হুম বলতে। মিলি আমাকে দেখে গাড়ির গ্লাস নামিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে “কি অন্তু? এখানে কি করছো এখন?”
আমি হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলি, “গোল্ড লিফ খাই।
আজকে রহিম মিয়ার ট্রিট। পরের দিন আবার আমার দিতে হবে। তুমি খাবা মিলি? তোমার জন্য একটা বেনসন লাইট এনে দিবো? আমার তরফ থেকে ট্রিট!”
মিলি তীব্র দৃষ্টি দিয়ে বুঝার চেষ্টা করে সে যা শুনছে তা ঠিক নাকি? যখন বুঝতে পারলো যে ঠিকই শুনেছে তখন আমার দিকে প্রচন্ড ঘৃনার দৃষ্টি দিয়ে তাঁকায়। ওর দৃষ্টিতে ভস্ম করে দিতে চায় আমাকে। আমি দেখতে পাই আমাকে সে ছুরি দিয়ে কুচিয়ে কুচিয়ে মারছে।
অবশেষে মিলি চলে যায়। আমি আবার ধোঁয়ার রিং বানাতে থাকি। রহিম মিয়া বলে, “আফা তো অনেক সুন্দর। এমন করলেন কেন? কইরেন না। ভালোবাসে আফনেরে”।
আমি হা হা করে হাসি। বলি তুমি বুঝলা কেমনে?
বলে, “আমি চোখ দেখে বুঝছি। একদিন বুঝবেন, পছন্দের মানুষ চইলা গেলে কিরাম কষ্ট লাগে”। আমি বলি, “ সিগারেট আরেকটা খাইবা মামা?”
শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেট ছুড়ে ফেলে দিয়ে সে বলে, “নাহ !! আফনের মামী আমাকে ডেইলী একটার বেশি খাইতে নিষেধ করছে”।
রহিম মিয়া চলে গেছে কিছুক্ষন।
আমি ব্যস্ত নগরীর রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। শীত শীত বাতাস। সেই বাতাসে ভর করে আমিও বাড়ি ফিরি।
.
.
একদিন ঠিক করলাম আজ রহিম মিয়ার বাড়ি যাবো। বাড়ি কোথায় তা সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা আছে।
সেখানে গিয়ে রহিম মিয়ার কথা জিজ্ঞাসা করলেই হবে।
খুঁজে খুঁজে চলে গেলাম তার বস্তিতে। দেখি বিস্তর মানুষ। কোথাও বিয়ে শাদী হচ্ছে। এদিক সেদিক বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে।
বাবা জানলে খবরই আছে। এসব জায়গা সম্পর্কে তার ধারনা এরা নোংরা, এরা খারাপ মহা খারাপ। তাদের সাথে মিশলে তার দামী কোটের মতো স্ট্যাটাসে কাঁদা লেগে যাবে। সমাজে আমাদের কি বলবে? আমি রিকশাচালকের বন্ধু। ছি ছি।
এক লোক দেখি মহা আরামে চা খাচ্ছে। গিয়ে বললাম আচ্ছা চাচা?? রহিম মিয়ারে চিনেন?? এইখানেই তো মনে হয় থাকে। দেখলাম চিনে ফেললো। অবশ্য তাকে না চিনলেই অবাক হতাম। লোকটা একটা ৯-১০ বছরের বাচ্চাকে ডেকে বললো, যা তো... রহিম মিয়ার ঘরে লইয়া যা।
তার মেহমান।
বাচ্চাটা বললো, “কেডার ঘরে? চিনি না”।
লোকটা বললো, “আরে দুইমাস আগে যে বেডার বৌ মরলো হের ঘরে”।
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যেনো। বললাম, “মানে?? তার বৌ কবে মারা গেলো? আপনি ভুল বুঝছেন।
উনি মনে হয় অন্য কেউ”।
“আরে ভুল কেন হইবো? আমি এই বস্তির সবডিরে চিনি। ঐযে শুদ্ধ কইরা কথা কইবার চায়। নতুন বিয়া কইরা ঢাকায় আইছে ছয়মাস হইছে। হেই তো।
হেরে খুঁজতাছেন না? হের বৌ দুই মাস হইলো গলায় ফাঁস দিয়া মরছে। পোলাডার লাইগা কষ্ট হয়। এখনো বইলা বেড়ায় তার বৌ মরে নাই”।
সাতদিন আগেও তো রহিম মিয়া কতো কিছু বলে গেলো। কানে কিছুই আসছে না।
শুধু একটা লাইনই ঘুরছে, “একদিন বুঝবেন, পছন্দের মানুষ চইলা গেলে কিরাম কষ্ট লাগে”।
আমি এলোপাথারী হাঁটতে থাকি। রহিম মিয়ার ঘরে যাইনা আর। ফিরে আসি। মৃত নগরীকে অভিশাপ দেই আবার ।
এই নগরী ধীরে ধীরে গিলে ফেলছে আমাদের। রহিম মিয়াকেও গিলে ফেললো। মৃত নগরী মিশে যাক মাটিতে, আমি আমরা সবাই মিশে যাই।
হাটতে হাটতে মরা নদীর গন্ধ পাই।
সূর্য কিছুক্ষন পরই ডুববে।
আমি প্রাণভরে মরা নদীর গন্ধ টেনে নেই।
মোবাইলটা বেজেই চলেছে। মিলির ফোন। অবশেষে ধরলাম।
এত ভালোবাসা ফেলে দিতে কষ্ট হচ্ছিলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।