আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দেশ, ধর্ম ও কতিপয় নারী

আহ অমরত্ব, তোমার উষ্ণ ঠোঁটে রাখি ঠোঁট, চোখ বন্ধ করে সবটুকু আনন্দ ভোগ করি। তোমার উষ্ণতায় বারেবারে বিলীন হয়ে যাই, দিতে পারিনি কিছুই, শুধু নষ্ট করে যাই। "এই জারজ পোলার কি ব্যাবস্থা নিবেন আপনারা। বিবেচনা আপনাদের, তয় এই গেরামে এইসব জারজদের কোন ঠাই নাই। " চিৎকার করে বলে সোবাহান মোল্লা।

তার চোখ দুটো ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসছে। সে কপাল থেকে ঘাম মুছে উপস্থিত জনতার দিকে তাকায়। এক দুইজন মাথা নাড়ে। কেউ মাথা চুলকায়, কেউ যৌনাঙ্গ চুলকায়। কি বলবে কেউই ভেবে পাচ্ছেনা।

সোবাহান মোল্লা আবার চেঁচিয়ে উঠে, "ধর্ম মোতাবেক ব্যাবস্থা নিতে হইব, কি বলেন ইমাম সাব?" ইমাম সাহেব নিচ দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার মনে হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় অন্যায়টা তাকে আজ করতে হবে। নিজেকে তাঁর অসহায় মনে হয়। এক পাশে বসে আছেন সুফিয়া খাতুন। তাঁর মাথা উঁচু হয়ে আছে।

তাঁর চোখে তীব্র ঘৃণা। আজ তার প্রতিবাদ করার কিচ্ছু নেই। তাঁর তখন এতটুকু খারাপ লাগা বোধ হয়নি, যখন পাকিস্তানী সৈন্যরা তাঁর ঘরে ঢুকেছিল। এই সোবাহান মোল্লাই নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর অপরাধ ছিল , তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করে খাইয়েছিলেন।

অভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে সুফিয়া আর থাকতে পারেননি। তিনি তার ঘরে যা ছিল, তাই দিয়েই তাড়াতাড়ি ব্যাবস্থা করেন। তাদের তৃপ্ত মুখ এখনো তার চোখে ভাসছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা যখন তাঁকে ধর্ষণ করেছিল, তখন তাঁর মনে হয়েছিল এও এক যুদ্ধ। সুফিয়া খাতুন নিজেকে ভেবেছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা।

সবশেষে যখন সোবাহান মোল্লা তাঁর ঘরে প্রবেশ করে তখন তাঁর প্রায় অজ্ঞান প্রায় অবস্থা। একটা পশু তা বুঝেনি। হরিনাথ দাশও বোঝেননি। ভেবেছিলেন এ দেশটা তারও, তাই সবাই চলে গেলেও তার মেয়ে তৃষ্ণাকে নিয়ে থেকে যান এ দেশেই। আশেপাশের সবাই তাঁর আপনজন , কে তাঁর ক্ষতি করবে।

যুদ্ধের প্রথম দিকে তেমন একটা কিচ্ছু হয়নি। একদিন শুধু সোবাহান মোল্লা এসে বলেছিল যে পাকিস্তানীরা গ্রামে আসতেছে। হরিনাথ নিজের ঘরে ঢুকে জং ধরে যাওয়া রামদা টা নিয়ে আসেন। সেটাকে শান দিতে দিতে বলেন ,"আসুক , তবে মরার আগে দুইজন কে নিয়ে মরবো। " সোবাহান মোল্লা আর কিছু না বলে চলে যায়।

হরিনাথ মাথার ঘাম মুছেন। সেদিন তৃষ্ণাও রেহাই পায়নি পাকিস্তানী সৈন্যদের হাত থেকে। তাঁর কিছুই করার ছিলোনা। তাঁর দৃষ্টি ঘোলা হয়ে যায়। পাকিস্তানী সৈন্যরা চলে গেলে, হরিনাথ উঠে দাঁড়ান।

তিনি সেই রামদাটা বের করেন। মেয়ের জাত চলে গেছে, তাই হরিনাথ সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করলেন না। মেয়ের মাথাটা এক কোপে আলাদা করে ফেলেন। মেয়ে মারা গেলেও ধর্ম তাঁর বেঁচে রইলো, এটাই তাঁর তৃপ্তি। রোদের তেজ বাড়ছে।

সোবাহান মোল্লা তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিতে বলে। সে ইমাম সাহেবকে কানেকানে কি বলে। প্রথমে ইমাম সাহেব রাজী হন না। পরে উঠে দাঁড়ান। " এই পোলা যেহেতু জারজ, তাই এই পোলার বাইচ্যা থাকার অধিকার নাই।

এরে জীবন্ত কব্বর দেয়া হইব। " সুফিয়া খাতুন তাঁর কোলের শিশুটাকে আঁকড়ে ধরেন। তার রক্ত মাংসে বেঁড়ে উঠা এই শিশু জারজ নয়। সুফিয়া খাতুনই এর বাবা, তিনিই এই শিশুর মা। বিচারে জমা হওয়া সব মানুষ ফিসফাস করে।

গুঞ্জন উঠে বিচারস্থলে। সোবাহান মোল্লার চীৎকারে সব গুঞ্জন থেমে যায়। "ইমাম সাব যেহেতু ব্যাবস্থা দিছেন, আমরা সেই অনুযায়ীই বিচার করবো। ' কয়েকজন শক্ত সামর্থ্য লোক এগিয়ে যায়। সুফিয়া খাতুন কয়েকবার বাঁধা দিতে চেষ্টা করেন।

কিন্তু তিনি আটকাতে পারেন নি। বিচার সম্পন্ন করে ধর্ম রক্ষা করে ধর্মের বাহকেরা। সুফিয়া খাতুন উঠে দাঁড়ান। তাঁর অস্তিত্ব যেন আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই সন্তান যদি জারজ হয় তাহলে এই দেশও জারজ।

এই সন্তানকে যেমন তিনি জন্ম দিয়েছেন, ঠিক তেমনি জন্ম দিয়েছেন এই দেশকে। কিন্তু হায় আজ দেশ একটি বিপন্ন অস্তিত্বের নাম। দেশ আজ এক ভোগ্যপণ্য। সবাই শুধু ভোগ করতে চায়। দেশের উপর সবাই ঝাপিয়ে পড়ছে, কেউ ধর্মের নামে, কেউ মিথ্যে দেশপ্রেমের নামে।

দেশ কিছুই বলতে পারেনা। দেশ আজ সুফিয়া খাতুনের মত, অসহায়, নির্বাক। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।