হরবোলা
সহকারী অধ্যাপক মুবারক আলীর মন ভাল নাই। ভাল থাকার কথাও নয়। বউ বাপের বাড়ী চলিয়া গিয়াছে। যাইবেনাইবা কেন! বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের চাপে বউকে সময় দিতে পারেন না। বিভাগে মাত্র ৮ জন শিক্ষক।
প্রতিদিন ৩ টা থিওরী ক্লাস ও সকাল-বিকাল দুই বেলা ল্যাব। তাছাড়া থাকেন মীরপুরে। প্রতিদিন সকাল ৬ টায় তৈরী হতে শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ধরার জন্য। আবার রাত ৮ টায় বাসায় পৌঁছান ক্লান্তি নিয়া। একটু ফ্রেশ হইয়া নাস্তা খাইয়া বসেন পরের দিনের লেকচার নোট তৈরীতে।
রাত ১১ টায় খাইয়া ১২ টায় যান ঘুমাইতে। ঘুম থেকে উঠিয়া আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার তাড়া। বউ যে তালাক দেয়নি এই ঢের।
শীতের রাত। বউ নেই।
সকালে ঘুম ভাঙ্গিলে দেখিলেন ৭ টা বাজে। নস্তা না খাইয়া স্নান না করিয়া রওনা দিলেন বাস ধরার নিমিত্তে। মীরপুর ১০ নং গোল চক্করে আসিয়া দেখিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ছাড়িয়া গিয়াছে। সকাল ৯ টায় ল্যাব। পৌঁছাইতে হইবে সময়মত।
শীতের সকালে ল্যাব অ্যাটেন্ডডেন্ট দেরী করিয়া আসে। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা এসে ল্যাবের সামনে বসিয়া থাকে। এটা মুবারক আলীর ভাল লাগেনা।
সময়মত পৌঁছাতে সিএনজি এর কোন বিকল্প নাই। তাছাড়া আজকাল যানজটটা বিরক্তির পর্যায়ে।
সিএনজি ওয়ালাকে বাপ ডাকিয়া ২০০ শত টাকা হাদিয়া দিয়া সকাল ৯ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাইলেন। ল্যাবে আসিয়া দেখিলেন তার প্রিয় ছাত্রী রনি, জনি ও মনি দরজায় দাঁড়িয়ে। তাহারা আজ আরসি ব্যান্ড পাস ফিল্টারের ফ্রিকোয়েন্সি রেসপন্স স্টাডি করার পরীক্ষণটি পারফর্ম করিবে। এই পরীক্ষণটি মুবারক আলীর সহযোগিতা ছাড়া ছাত্র-ছাত্রীরা করিতে পারেনা।
আজ সকালে স্নান করেন নাই।
গায়ে ঘিন্ ঘিন্ করিতেছে। একটা উটকো গন্ধও যেন টের পাইতেছেন। ছাত্রীরা না ডাকলে আজ তাদেরকে দেখিয়ে দিতে যাবেন না। এমন সময়ে ডাক পড়িল। বেকায়দায় পড়িলেন।
যাওয়া ছাড়া উপায় নাই। ছাত্রীরা ২টা ক্যাপাসিটরের কানেকশানে ভুল করে। ইতস্ততঃ চিত্তে ধীর লয়ে ছাত্রীদের কাছে গেলেন। কানেকশান ঠিক্ করিলেন। কিন্তু অসিলোস্কোপে সিগনাল পাইতেছেন না।
আজ সকালেই কুফায় ধরিয়াছে। মুবারক আলী নাস্তিক মানুষ। এই সবে বিশ্বাস নাই। তবুও যেন খটকা লাগে।
এমন সময়ে বিভাগের চেয়ারম্যান মানব বন্ধনে অংশ নেয়ার জন্য ডাকিলেন।
গতকাল রাতে এই বিষয়ে একটি ম্যাসেজও পাইয়াছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রী বন্ধন হওয়া উচিত, মানব বন্ধন না। তবুও সবার সাথে মানব বন্ধনে গেলেন। ঠায় দাঁড়িয়ে ভাবছেন, ছাত্র-ছাত্রীদেরকে এত ভালবাসেন তবুও ওরা ধাস্তাধস্তি করে কেন? ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কতো মধুর হয়া উচিত? কিন্তু গরল হয় কেন?
আজ সারাদিন বুকে কালো তেনা বাঁধিয়া ক্লাসে পড়াইয়াছেন, ল্যাব করাইয়াছেন, পরীক্ষা নিয়াছেন আর ভাবিতেছেন। বিকালে একরাশ ক্লান্তি ও রাজ্যের ভাবনা নিয়ে বাসায় ফিরলেন।
ক্ষিধা পাইয়াছে। বাসায় বউ নাই। শরীরটাও ভাল নাই। তাছাড়া মানসিক অবসাদ। রান্না করিতে ইচ্ছা করিতেছেনা।
বউয়ের রান্না করা পুরানো খাবার খাইয়া ঘুমিয়া পড়িলেন।
ঘুমের ঘোরে দেখিতেছেন। বামে-ডানে মিলিয়া ৩০০০ টাকা উন্নয়ন ফি বাতিলের দাবীতে তুমুল ছাত্র আন্দোলন করিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করিয়া দিল। তাহার এখন ক্লাসে যাইতে হয়না। বউ শ্বশুড় বাড়ী হইতে ফিরিয়া আসিল।
তিনি প্রতিদিন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে একটি ক্লাস নিয়া বাসায় আসিয়া গবেষণায় মনোঃনিবেশ করেন। বিকালে বউয়ের হাত ধরিয়া বেড়াইতে যান। এইভাবে ৬ মাস বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকিল। প্রতিমাসে তাহার একাউন্টে বেতনের টাকা জমা হইল। ২টা রিসার্চ পেপার ফিজিক্যাল রিভিউ ও ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারে প্রকাশিত হইল।
তিনি প্রমোশন পাইয়া সহযোগী অধ্যাপক হইলেন। সিল বানাইলেন। মুবারাক আলী, সহযোগী অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ডার্কমেটার বিশ্ববিদ্যালয়।
এই আন্দোলনে গুরত্বপূর্ন ভূমিকা রাখিয়া কুদ্দুস স্যার শিক্ষক সমিতির সভাপতি হইলেন। করিম স্যার পত্রিকায় কলাম লিখিলেন।
হরেন স্যার, দিদার স্যার ও কাশেম স্যার সিন্ডিকেট মেম্বার হইলেন। ডানেরা নিজ নিজ দলে পদ-পদবী পাইলেন। বামেরা জেলে গেলেন। জেল হইতে বাহির হওয়ার সময়ে গান্ধা ফুলের মালা পাইলেন। মুবারক আলীও ছাত্র জীবনের একটা সময়ে বাম করিতেন।
আজকাল আর থিওরীটিক্যাল রাজনীতি ভাল লাগেনা।
নীলফামারী হইতে বাবার সহিত ডার্কমেটার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইতে আসিয়া সুলতানা ৩ দিন ঢাকা শহরে থাকিয়া ১৫,০০০ টাকা লস করিয়া ভর্তি হইতে না পারিয়া নীলফামারী ফিরিয়া গেল। বিশ্ববিদ্যালয় খুলিলে আবার হয়ত ভর্তি হইতে আসিবে। বাবার ইচ্ছা বেগম রোকেয়ায় ভর্তি করিয়া দেওয়া। ডার্কমেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তিনি বীতশ্রদ্ধ হইয়াছেন।
মুবারক আলীর ছাত্র ফরহাদ মার্কশীট সত্যায়িত করিবার জন্য তাহার বাসায় আসিল। তিনি তাহার সিল খানা টেবিল হইতে নিতে গিয়া ফেলিয়া দিলেন। সিল পড়ার শব্দে ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। তাড়াতাড়ি সিলটা নিয়ে দেখিলেন উহাতে মুবারক আলী, সহকারী অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান লেখা। ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন। সেকেন্ড ইয়ারে সেকেন্ড সেমিস্টারে সেকেন্ড পিরিয়ডে স্পেশাল থিওরী অব রিলাটিভিটি পড়াইবেন। ক্লাসে গিয়া দেখিলেন তাহার প্রিয় ছাত্রী মানসী ও উর্বশী আধা-পাঁকা চুলে এক কোনে বসিয়া আছে। অপর কোনে প্রিয় ছাত্র খোরশেদ ও তোহিদ দাঁড়ী-টুপিতে। এই সব দৃষ্টিভ্রম না নতুন কোন প্যারাডক্স! মুবারক আলীর কাছে সবই প্যারাডক্স বলিয়া মনে হইতেছে।
তিনি টোয়াইন প্যারাডক্স, বাগ্-রিভেট প্যারাডক্স ও শ্রোয়েডিংজার ক্যাট ইত্যাদি প্যারাডক্সের সহিত পরিচিত। কিন্তু সিল প্যারাডক্স, আধা-পাঁকা চুল প্যারাডক্স, দাঁড়ী-টুপি প্যারাডক্স তাহার কাছে নতুন মনে হইতেছে।
ক্লাস রুমটা লাটিমের মত ঘুরিতেছে। ক্লাস না নিয়া বাসায় ফিরিয়া আসিয়া সিলটি আবার দেখিলেন। লেখা আছে, মুবারক আলী, সহকারী অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ডার্কমেটার বিশ্ববিদ্যালয়।
রাগে, ক্ষোভে চিৎকার দিয়া উঠিলেন মুবারক আলী। শুনিয়াছি বউ তাহাকে হেমায়েতপুর পাঠানোর ব্যবস্থা করিতেছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।