আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মা কা ব্যাটা!!!

মিলে মিশে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ! ছোটবেলা থেকে আমার স্বপ্ন ছিল কার্জন হলে পড়বো। গণিত গবেষক হবো। টিভির নাটকে সবুজ চত্বরের মাঝে লাল লাল দালানগুলো দেখে দেখে কার্জন হলের প্রেমে পড়ে গেছিলাম। আর স্কুল লাইফে গণিত পরীক্ষার দিনটা সবসময়ে ছিল আমার ঈদের দিন। একেবারেই রিলাক্স থাকতাম সেদিন।

ইদানীংকালে এই বড় বেলায় এসে মনে হয় কিছুই গণিত পারি না, কিসব কঠিন কঠিন সমীকরণ! মাথার মগজ সব খুলে খুলে পড়ে! এদিকে আমার বাবা-মায়ের গতানুগতিক শখ, মেয়েকে ডাক্তারী পড়াবে, আর সব বাবা-মারা যেমন চায় আর কি! আমি তো মনে মনে প্রমাদ গুণি, নিজের মনের ইচ্ছে মনেই থাকে। কাউকে মুখ ফুটে বলি না। ধীরে ধীরে সে সময় ঘনিয়ে এলো। মানে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হলো। এবার ঢাকায় এসে মেডিকেল কোচিং-এ ভর্তি হতে হবে।

ঢাকায় এসে মিরপুরে নানার বাসায় উঠলাম। ফার্মগেটের শুভেচ্ছা কোচিং সেন্টারে ভর্তিও হলাম। ক্লাস করছি, আসছি যাচ্ছি, ডেইলি ডেইলি ২০ মার্কের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে, মাঝে মাঝে মডেল টেস্ট... কিন্তু এর মাঝেও নিজের মনের সুপ্ত ইচ্ছেটা কিছুতেই গেল না, কেবল ঐ কার্জন হলই আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। একসময়ে কোচিং-এর প্রতি আগ্রহ কমে এলো, পরীক্ষাগুলো দিচ্ছি বটে, তবে কোন পড়াশোনা না করেই। কাউকে অবশ্য কিছু বলি না।

এদিকে মাঝে মাঝেই আমি আর ছোট খালা বেরিয়ে পড়ি ঢাকা শহর ঘুরে দেখতে, একেকদিন একেক জায়গায়, মজা করেই দিন কেটে যাচ্ছে, আম্মা প্রতি মাসে মাসে এসে আমাকে দেখে যায়, এই প্রথম মেয়ে ঘরের বার হলো, বাবা-মার কাছ থেকে দূরে থাকছে। আমার তেমন মন খারাপ হয় না, নতুন নতুন বান্ধবী জুটেছে কোচিং-এ, মনিপুর স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রী। একজনের বাসা নানার বাসার কাছেই, সে সহই আসা যাওয়া করি। নতুন নতুন মানুষ চিনছি, মাঝে মাঝে একা মিরপুর থেকে ফার্মগেট যাই, এক ধরণের থ্রিল কাজ করে। উপভোগ করছি ঢাকায় আমার প্রথম বাস।

ধীরে ধীরে আসল সময় ঘনিয়ে এলো। মেডিকেলে পরীক্ষা দিলাম, যেহেতু ফাঁকিবাজি করেছি, ফলাফল সমানুপাতিক! ওয়েটিং লিস্টে তিন নম্বরে আছি। এর মাঝে একটা চালাকি করেছি, ফরম ফিল আপ করার সময় পছন্দের কলেজের তালিকায় লিখেছি র‌্যাংকিং-এ এগিয়ে থাকা মাত্র প্রথম চারটা মেডিকেল কলেজের নাম। ইচ্ছেটা এই যে একান্তই যদি মেডিকেলে পড়তে হয় তাহলে কেবল ভাল যে কোন একটাতে পড়বো, নয় তো নয়। সবাই বলছিল খুলনা মেডিকেলে চান্স হয়ে যেতে পারতো, কিন্তু যেহেতু আমার চয়েস দেয়া নাই, তাই আর হলো না।

বাসার সবার মন খারাপ, কিন্তু আমার একটুও না, বাইরে বাইরে মন খারাপের ভাব দেখাচ্ছি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে খুশি! আমার আর মেডিকেলে পড়তে হলো না। আব্বাকে করুণ ভাষায় ক্ষমা চেয়ে একখানা পত্র লিখলাম অনুশোচনা করে যে আমার আরেকটু প্রস্তুতি নেয়া দরকার ছিল, আরেকটু ভাল পরীক্ষা দিতে পারলেই হতো। স্যরি। ইতির অংশে লিখেছিলাম আপনারই অযোগ্য মেয়ে। আব্বা তো ঐ চিঠি পড়ে গলে গিয়েছে, তেমন একটা আর বকাঝকা করেনি।

এরপর ঢাবির আর জাবির পরীক্ষাগুলো মনোযোগ সহকারে দিলাম। জাবিতে গণিতে, প্রাণীবিজ্ঞানে আর উদ্ভিদবিজ্ঞানে হলো, কম্পিউটার সায়েন্সে চান্স পেলাম না। এদিকে ঢাবিতে 'ক' ইউনিটে মোটামুটি সামনের দিকে থাকায় এখানেই ভর্তি হবার সিদ্ধান্ত নিলাম। মোটামুটি নিশ্চিত গণিত তো পাবই। আমার এক কাজিন তখন পদার্থবিজ্ঞানে পড়তো, উনি সিরিয়াল দেখে বললেন ফলিত পদার্থ বা রসায়ন পর্যন্ত পাবার চান্স আছে, ট্রাই করিস, পছন্দের লিস্টে নাম লিখবি সবগুলোর।

ভাইভাতে গিয়ে পছন্দের ক্রম নির্ধারণের ফর্মে ঠিকই আমি গণিত আগে লিখে বাকীগুলো পরে লিখেছি। আশে পাশে সবাই দেখি মাইক্রোবায়োলজি, ফার্মেসী, ফলিত পদার্থ, বায়োকেমিস্ট্রি এসব ধরণের সাবজেক্ট লিখছে, কম্পিউটার সায়েন্স ততক্ষণে ফিল আপ, আমাদের আর পছন্দ করার উপায় নেই। আশপাশ দেখে একটু উসখুস লাগছে, আবার কাজিনের কথাও মনে পড়ছে, তিনি ফলিত পদার্থের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছেন, বলেছেন ঐটা ভাল সাবজেক্ট। মনের মাঝে দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই স্যারদের কাছে গেলাম, খোদাদাদ স্যার দেখে বললেন তুমি তো এখন ফলিত পরিসংখ্যান পেতে পার, ফলিত পদার্থ পেতে একটু সিরিয়ালে থাকতে হবে, গণিত পেতেই পার, তবে আরেকটু ভেবে দেখ। ফলিত সাবজেক্টগুলোর কিন্তু বাজারে ডিমান্ড বেশি।

এবার পুরোপুরিই কনফিউজড। শেষ পর্যন্ত বাস্তবতার কাছেই আমার স্বপ্ন হার মেনে নিল। গণিত কেটে পরের দিকে নিয়ে গেলাম, পেলাম ফলিত পরিসংখ্যান, এর দুইদিন পরেই মাইগ্রেশনে ফলিত পদার্থ পেয়ে গেলাম, ঐটাই শেষ পর্যন্ত কপালে সেঁটে গেল! আমার আর গনিতজ্ঞ হওয়া হলো না। মনে মনে একটা আফসুস লাগছিল। কিন্তু যখন মাইনর হিসেবে কিছু গণিটের ক্লাশ করতে হলো, আর কেমন যেন ভাষায় লিখে ক্যালকুলাসের অংক করতে হলো মানে তত্ত্বীয় কিছু, তখন মনে হলো বেঁচে গেছি! তার চেয়ে ফলিত পদার্থের লেখাপড়া অনেক সহজ মনে হলো, মজা পেয়েছি পড়ে।

এবার আসি আসল ঘটনায়, আমি যে মেডিকেলে পড়তে চাইনি বলে নানারকম ফন্দি-ফিকির করেছি এটা কিন্তু আমি কারো সাথে সেভাবে শেয়ার করিনি, আব্বা-আম্মাকে তো একদমই না। পরের বছর নানু জোরাজুরি করছিল আবার পরীক্ষা দেবার জন্য, কিন্তু আমি রাজি না, বইগুলো উনাদের বাসা থেকে হলে পড়ার নাম করে এনে পরের ভ্যাকেশানেই নোয়াখালীতে রেখে এসেছি। আমার ছেলের কান্ড শোনেন। তারা একটা কিন্ডারগার্টেনে পড়তো। এবার ক্লাস ফাইভে সরকারী স্কুলে ভর্তির জন্য চেষ্টা করা হলো, কিন্তু আমার ছেলে কিছুতেই আগের স্কুল ছেড়ে যাবে না, সেখানে তার বন্ধুরা আছে, নতুন স্কুলে তো সে কাউকে চিনবে না।

তাকে আমিসহ তার নানা-নানু নানারকম কথা বলে বুঝিয়ে শুনিয়ে পরীক্ষা দেয়ালাম। সে কি করলো? ১০ মার্কের জ্যামিতি পারা সত্ত্বেও খাতায় লিখলো না। এদিকে প্রশ্ন নাকি সহজ হয়েছে, পরীক্ষার্থী প্রায় ১৬০০, নিবে মোটে তিনশত। অনেকেই ৯৯-১০০ পাবার মতো পরীক্ষা দিয়েছে, আমার ছেলে গর্বের সাথে ফেল্টুস হয়েছে। এবং এতে সে বেজায় খুশি।

তার আর জিলা স্কুলে পড়তে হবে না, পুরোনো বন্ধুদের সাথে আগের স্কুলে পড়বে। আমি ভাবি আমার ছেলের মাথায় এই কুটবুদ্ধি আসলো কিভাবে? এদিকে অবশ্য আরেক ক্যারফা লেগেছে, তাদের বাবা তাদের চাঁদপুরে ভর্তি করানোর প্ল্যান করেছে, নিজের মতো করে নেয়া সিদ্ধান্ত। আমি প্রমাদ গুণছি! বছরের শুরুটায় ভালই ঝামেলায় পড়লাম। আমার ছেলেটা আবার আমার ভীষণ ভক্ত! বিভিন্ন সময়ে তারই বারবার প্রশ্ন থাকে আমি কবে দেশে ফিরবো, আর কতদিন লাগবে? আর এইবার যখন আমি বললাম, আব্বু আমার মন খারাপ, তোমাদের কতদিন দেখি না! আমার আম্মুকে দেখি না। সেই আমাকে সান্ত্বনা দেয়, আর বেশিদিন না তো! এই তো আর অল্প কয়দিন।

তুমি মন খারাপ করো না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।