আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মতে, পদোন্নতি ও নতুন কর্মসংস'ান সৃষ্টির ক্ষেত্রে সরকারি চাকরির বয়স বাড়ানোর বিষয়ে কোনো সমস্যা হবে না। কোন যুক্তিতে তিনি এরকম বললেন তা মোটেই বোধগম্য নয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলা হয়েছিল, এমনিতেই দেশে লাখ লাখ মানুষ বেকার। চাকরির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হলে আগামী দুই বছর নতুন নিয়োগ বন্ধ হয়ে যবে। এ ছাড়া প্রমোশনের পথও বন্ধ হয়ে যাবে।
তখন কর্মচারীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হবে। এসব কথা বলার পর সভায় মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়া এবং দক্ষ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার বিষয়টি বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি হিসেবে উপস'াপন করা হয়।
পাবলিক সার্ভেন্ট রিটায়ারমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৭৪-এ সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়স ৫৭ বছর। ১৯৭৪ সালে যখন এই আইন হয়, তখন বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৬ দশমিক ২ বছর। বর্তমানে গড় আয়ু ৬৭ বছর।
গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় যুক্তি দেখিয়ে সরকার চাকরির বয়সসীমাও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে, মানুষের আয়ু ও উৎপাদনশীলতা বাড়ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের চরম উন্নতির কারণে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমে যাওয়ায় মানুষের গড় আয়ু বাড়লেও প্রকৃত আয়ু কমে যাচ্ছে। আগের তুলনায় আজকের দিনে বয়স্ক মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। আগে দেখা যেত দাদা মারা যেতেন ৯০ কিংবা ১০০ বছর বয়সে।
কিন' ১৩ বছরের পুত্রবধূ সন্তান প্রসবের সময়েই মারা যাওয়ার হার ছিল অনেক উচ্চ। ফলে তখন বয়সের গড় কম ছিল। আর বর্তমান সময়ের দাদারা ৬০ কিংবা ৭০ বছর বয়সে নানা জটিল রোগে মারা গেলও পুত্রবধূর বয়স ১৩ না হওয়ায় কিংবা চিকিৎসা বিজ্ঞানের চরম উন্নতির আশীর্বাদে সন্তান প্রসবের সময়ে মারা যাওয়ার হার অনেক কমে এসেছে এবং বিভিন্ন রোগে মৃত্যুর হারও কমে এসেছে। এসব কারণে গড় আয়ু বাড়লেও সর্বোচ্চ আয়ু কমেছে।
আওয়ামী লীগ আবারো প্রমাণ করল, তারা তরুণবান্ধব নয়।
যেখানে দক্ষদের চুক্তিভিত্তিক কাজে লাগানোর সুযোগ বিদ্যমান, সেখানে বয়স বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ৫৫ বছরের পরে বেশির ভাগ প্রবীণের কর্মক্ষমতা থাকে না, যেটুকু অভিজ্ঞতা থাকে তা-ও সঠিকভাবে কাজে লাগান না অনেকেই। বর্তমান প্রজন্মের তরুণেরা অনেক বেশি মেধাবী ও কর্মক্ষম খুবই অল্প সময়ের মধ্যে তারা যেকোনো কাজ আয়ত্ত করতে পারে। অভিজ্ঞতার প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না, কিন' এর দোহাই দিয়ে বেকারত্বের এই দেশে শিক্ষিত মেধাবী তরুণ প্রজন্মকে বঞ্চিত করে দুই বছর চাকরির বয়স বাড়ানোর কী যৌক্তিকতা? তা ছাড়া বয়স বাড়ানোর কারণে একজনের পেছনে যে ব্যয় হবে, তা দিয়ে কমপক্ষে তিনজন তরুণের কর্মসংস'ান করা যেত।
উচ্চশিক্ষিত বেকার যুবক মোহামেদ বুয়াজিজি (২৬) শিক্ষাজীবন সমাপন ঘটিয়ে অনেক চেষ্টা করেও বেঁচে থাকার মতো সামান্য একটি চাকরি জোগাড় করতে ব্যর্থ হন।
উপায়ান্তর না দেখে তিনি তিউনিসিয়ার একটি বাজারে সবজি বিক্রি শুরু করেন। সবজি বিক্রি করে তার আয়-রোজগার ভালোই হচ্ছিল। কিন' এটা সে দেশের সরকারের পছন্দ হয়নি। সরকার তার ব্যবসা বন্ধ করে দেয়। ফলে বুয়াজিজি চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেন।
কিন' তিনি দমে যাওয়ার পাত্র নন। সরকারের এই অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে বুয়াজিজি নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। তার এই আত্মাহুতি তিউনিসিয়ার জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলে। বুয়াজিজি অচিরেই তিউনিসিয়ার ৩০ শতাংশ শিক্ষিত বেকার যুবকের প্রতিনিধিতে পরিণত হন। তার আত্মাহুতি দিকে দিকে বিদ্রোহের আগুন জ্বেলে দেয়।
এই আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় তিউনিসিয়ার একনায়ক দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা প্রেসিডেন্ট জাইন আল আবেদিন বেন আলীর সোনার সিংহাসন। একপর্যায়ে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে সৌদি আরবে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। বুয়াজিজির আত্মত্যাগ শুধু তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিবর্তন করেনি, গোটা আরব বিশ্বের রাজনীতিতে বিরাট ঝাঁকুনি দিয়েছে। তারই প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে চলছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। কিছুদিন আগেও যেখানে গণতন্ত্র ছিল স্বপ্নের মতো, আজ সেখানেই বইতে শুরু করেছে গণতন্ত্রের সুবাতাস।
বুয়াজিজির চাচা রিদাহও একজন ফল বিক্রেতা। তিনিও পুলিশের হাতে নিত্য নির্যাতনের শিকার হওয়া একজন। ‘এই সরকারের ইন্সপেক্টররা জোর করে আমাদের পণ্য নিয়ে নিত। আমাদের কাছ থেকে অবৈধভাবে ঘুষ নিত। কিছু বললেই অকথ্য নির্যাতন করত আমাদের ওপর।
’ এভাবেই তিনি পুলিশি নির্যাতনের কথা বলেন।
বুয়াজিজির শরীরের ওই আগুনের তাপে পুড়ে যায় বেন আলীর মসনদ। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরো তিউনিসিয়া। মাত্র এক মাসের মাথায় ক্ষমতা থেকে নেমে যেতে বাধ্য হন তিউনিসিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জাইন এল আবেদিন বেন আলী।
মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক নীতিনির্ধারকেরা ভাবতেই পারেননি, বুয়াজিজির শরীরের আগুন দাবানলের মতো এতটা দূর ছড়িয়ে যাবে।
কারণ তিউনিসিয়ার এই বিপ্লবের ছোঁয়া লাগে মিসরে। অভ্যুত্থান সামাল দিতে না পেরে ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকা হোসনি মোবারক।
পাশাপাশি আরব বিশ্বের আরেক প্রান্তের দেশ ইয়েমেনেও শুরু হয় বিদ্রোহের প্লাবন। সেই বিদ্রোহে নতিস্বীকার করতে হয় প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহকেও। উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সমঝোতায় ক্ষমতা হস্তান্তর চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
সেই জাগরণের ঢেউ গিয়ে লাগল মিসর, সিরিয়া, লিবিয়াসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে।
বুয়াজিজির শরীরের আগুনে এখনো জ্বলছে অনেক দেশের ‘চেপে বসা’ ক্ষমতার মসনদে।
সরকারি চাকরির বয়স বাড়ানোর ডিজিটাল সিদ্ধান্ত অনুমোদন; সিদ্ধান্তটি মোটেই যৌক্তিক ও তরুণবান্ধব হলো না।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আকবর আলি খান বলেন, চাকরির বয়স বাড়ানোর নেতিবাচক দিক আছে। এই সিদ্ধান্তে কিছু সময়ের জন্য নতুন চাকরি সৃষ্টি কমে যাবে।
স্কিলমিক্সডও (দক্ষতার মিশ্রণ) কঠিন হবে। একজন টাইপিস্ট, বর্তমান ব্যবস'ায় যার কাজের সুযোগ অনেকটা কম। তিনি অবসরে গেলে সরকার তার জায়গায় একজন কম্পিউটার অপারেটর নিয়োগ করতে পারত। এটি এখন কিছু সময়ের জন্য পিছিয়ে যাবে।
গত এক দশকে বাংলাদেশে বেকারত্ব বেড়েছে ১.৬ শতাংশ, কর্মসংস'ান প্রবৃদ্ধির হার কমেছে ২ শতাংশ।
আর বর্তমান হার বজায় থাকলে ২০১৫ সালে মোট বেকার হবে ছয় কোটি। এ সময়ে শিক্ষিত বেকার বাড়ানোর হার সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।
ঘুষ ছাড়া আওয়ামী লীগ মেধাবীদেরও চাকরি দিচ্ছে না : অনিয়ম ও দলীয়করণে প্রতিবন্ধী হওয়ার পথে দেশ : মেধাবীরা হতাশ। এক দিকে ৫৫ শতাংশ নিয়োগ দেয়া হচ্ছে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের, বাকিটা সুধা সদনের মাধ্যমে হয় দলীয়করণ নতুবা দুর্নীতি। বলতে গেলে বর্তমান সরকারের আমলে বিসিএসে শতভাগ অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে।
মেধাবী তরুণেরা বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ডে সরকারি চাকরির আশা অনেকটাই বাদ দিয়েছেন। কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই ২৮তমের মতো ২৯তম বিসিএসের গেজেটেও নজিরবিহীনভাবে বাদ দেয়া হয়েছে অসংখ্য মেধাবীকে। উল্লেখ্য, পিএসসির ইতিহাসে অন্যতম ফেয়ার ২৮তম বিসিএসেও পুলিশের প্রতিবেদন ভালো থাকার পরেও এনএসআইয়ের রিপোর্টের বায়বীয় আপত্তি তুলে বাদ দেয়া হয় ৬৪ জন মেধাবীকে। (উল্লেখ্য, সরকারি চাকরিতে পুলিশ প্রতিবেদনের বিধান থাকলেও এনএসআইয়ের প্রতিবেদনের কোনো নিয়ম নেই। আওয়ামী লীগ সরকারই কেবল নিয়মবহির্ভূতভাবে এনএসআইকে দিয়ে ভেরিফিকেশন করাচ্ছে)।
এ ক্ষেত্রে চলছে ব্যাপক লেনদেন। যারাই এটি করতে বা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন, তারাই নিয়োগ থেকে বাদ পড়ছেন।
পাকিস্তান আমলে বৈষম্য থাকার পরেও যে দক্ষতা ছিল, আজ তাও নেই। তখন জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ আমরা হওয়ার পরেও চাকরিতে আমরা পেতাম হয়তো ৩০-৪০ শতাংশ। তবে তার পুরোটাই পেতেন মেধাবীরা।
আর এখন ১০০ শতাংশ পেলেও সংবিধান লঙ্ঘন করে কোটার মাধ্যমে এর ৫৫ শতাংশ অযোগ্য, বাকিরা দলীয়করণ অথবা দুর্নীতি। কোনো সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণীকে যেখানে সহযোগিতা করার অনেক উপায় রয়েছে, সেখানে অসংখ্য মেধাবীকে বাদ রেখে কম মেধাবীদের সুযোগ- ড্রাইভার রেখে হেলপারকে চালকের আসনে বসানোর নামান্তর মাত্র।
হাতে ক্ষমতা থাকার কারণে প্রবীণেরা তাদের সুযোগ বাড়িয়ে নেয়ায় তা মোটেই তরুণবান্ধব হলো না। এ সিদ্ধান্তের কারণে বেকারত্ব আরো প্রকট হওয়ার পাশাপাশি দক্ষতাও হ্রাস পাবে। একবিংশ শতাব্দীর অগ্রসরমান বিশ্বে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে অযৌক্তিক আবেগ পরিহার করে বাস্তবমুখী হওয়া দরকার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।