আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একা এবং একদম একা

যে জানেনা এবং জানে যে সে জানেনা সে সরল, তাকে শেখাও। যে জানেনা এবং জানেনা যে সে জানে না, সে বোকা-তাকে পরিত্যাগ কর। জহিরের প্রতিটা মুহূর্ত রিমোট কন্ট্রোল নিয়ন্ত্রিত এটা ভেবেই সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে। প্যান্টের পকেটে নিরীহ মোবাইলটা ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ বেজে উঠলো।

জহির রিসিভ করে। অপর প্রান্তে কোনো সাড়াশব্দ নেই। কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করে লাইন কেটে দেয়। এই যে অনর্থক একটা কল এলো এর কোনো মানে হয়! জহির কোন টাওয়ারের কাছ থেকে কল রিসিভ করেছে তা বের করা নিশ্চিত সম্ভব। জহির একজন দাগী আসামী হলে তাকে ধরা যেতো।

যাকে বলে 'মাইনকা চিপা'য় ফেলে ধরা। মোবাইল ট্র্যাকিং করে সিলেটের গৃহবধুকে গাজীপুরে উদ্ধার করা হয়েছে। রুপগঞ্জের এক প্রতারককে মোবাইল ট্র্যাকিং করে ঢাকায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মোবাইল ট্র্যাকারের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির সারাদিনের কর্মকাণ্ড ইচ্ছে করলেই দেখে নেওয়া সম্ভব। কার কার সাথে কথা বলেছে।

কোন টাওয়ারের আওতায় কতক্ষণ ছিল, তা নিমিষেই বুঝে নেওয়া সম্ভব। বর্তমান পদার্থ বিজ্ঞানীদের মতানুসারে প্রতিটি পদার্থেরই নাকি একটি প্রতি পদার্থ (অ্যান্টি ম্যাটার) থাকে। এই প্রতি পদার্থ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথাও না কোথাও আছে। তারমানে জহিরেরও একটা প্রতি পদার্থ আছে। এই অ্যান্টি ম্যাটারটাই জহিরের চরম শত্রু।

কেমন ছায়ার মতো পিছনে লেগে আছে। জহির রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিষয়টি বুঝার পর থেকেই একটা শিরশিরে অনুভূতি চেপে বসেছে জহিরের কাঁধে। জহিরের প্রতি পদার্থই বোধ হয় এই রিমোট ডিভাইসটি নিয়ন্ত্রণ করছে। এ মুহূর্তে মোবাইলটাকেই জহিরের কাছে প্রতি পদার্থ বলে মনে হচ্ছে। এ মনোভাবটা বেশ কিছুদিন হলো দেখা দিয়েছে।

একা থাকলে মোবাইলটাকেই তার চরম শত্রু মনে হয়। কোনো নিয়ম কানুন নেই, যখন তখন বেজে উঠে। অনেক সময় অপরিচিত নাম্বার থেকেও বিরক্তিকর সব ফোন আসে। হয়তো ইচ্ছে করলেই কেউ কল লিস্ট দেখে বুঝে নিতে পারে জহির কার সাথে, কখন, কতোক্ষণ কথা বলেছে। কোথায় বসে বলেছে।

মোবাইল ফোনটিই জহিরের নিয়ন্ত্রক বলে মনে হওয়ার পেছনে কিছু কারণ আছে। এই প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হওয়ার পর মানুষের নৈকট্য বাড়লেও বিশ্বাসের ভিত নড়বড়ে হয়ে গেছে। সেদিন গুলিস্তান বাসের মধ্যে টুপি দাঁড়িওয়ালা এক হুজুর মোবাইলে অপর প্রান্তে বলছে- ভাই আমি তো এখন টঙ্গী। রাস্তায় অনেক জ্যাম। পল্টন আসতে আসতে রাত হয়ে যাবে।

জহির অবাক হয়ে যায় যখন কলেজ ড্রেস গায়ে একটি মেয়ে বলছে- এইতো মা, আমি কোচিংয়ে আছি। অথচ পাশে তার বয়ফ্রেন্ড বসা। মোবাইলের কারণেই সম্পর্কের ভিতও অনেক নড়বড়ে হয়ে যায়। স্ত্রীর মোবাইলে গভীর রাতে পুরুষ কণ্ঠের ফোন পেয়ে স্বামীর সন্দেহ, পরিণতিতে ঝগড়া এবং স্ত্রীর আত্মহনন। স্বামীর মোবাইলে অন্য নারীকন্ঠ শুনে স্ত্রীর সন্দেহ, পরিণতিতে ঝগড়া এবং জীবন দুর্বিষহ।

তারপরও এই মোবাইল ফোনটিই নিয়ন্ত্রণ করছে সবকিছু। বিশ্বাসের ভিত হুড়মুড় করে ধসে যেতে পারে একটু অনিয়ন্ত্রিত হলেই। এই প্রতি পদার্থকে খসিয়ে দিয়ে জহির একটু একা হতে চায়। মোবাইলের লাল বাটনটা টিপে বন্ধ করে দিলেই জহির একা। একা হয়ে জহির জনসমুদ্রে থেকেও একাই হয়ে যাবে।

এই পৃথিবীতে সেই সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী- যে সবচেয়ে একা। এই পৃথিবীর মায়ার বন্ধন ছেড়ে একা হয়ে যাওয়াটা খুবই কঠিন। একা মানে একদম একা। কোনো মায়ার বন্ধন নেই। কোনো পিছুটান নেই।

শুধুই সামনে এগিয়ে চলা। মহামানবের পক্ষেই শুধু সম্ভব পিছুটান ফেলে একা হয়ে যাওয়া। জহির মহামানব নয়। তারও কামনা বাসনা আছে। স্ত্রী সংসার পরিজন নিয়ে সে জগত সংসারেরই একজন হয়ে বেঁচে আছে।

আসলে সত্যিই কি সে বেঁচে আছে? জহির বির বির করে। আপন মনে কাকে উদ্দেশ্য করে যে বকা দেয়। ফুটপাথে উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটি জহির বেশ উপভোগ করে। শীতের নরম রোদে ঢাকা শহরের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে বেশ লাগে। আজ শীতের সকালটা জহিরের কাছে অন্যরকম ঢাকা বলে মনে হয়।

কেমন একটা চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। গুজব বয়ে বেড়াচ্ছে ঢাকা সহ দশটি জেলায় বোমা, ককটেল ইত্যাদি বিস্ফোরিত হয়েছে। ঢাকার মতিঝিলে ককটেল বিস্ফোরণে একজন মারা গেছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশ, র্যাব, আধা সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি থেকে কিছুটা অনুমান করা যায়। আতঙ্ক সত্ত্বেও লোকজনের কমতি নেই।

চারিপাশে শত শত লোক হাঁটছে। কেউ পিছন থেকে দ্রুত হেঁটে জহিরকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়। কেউ সামনে দিয়ে হেঁটে এসে পাশ কাটে। মতিঝিল থেকে পল্টন পর্যন্ত ফুটপাথটুকু এখন ব্যস্ত বিপণীবিতান। আশে পাশে জনগণের সমুদ্রস্রোত।

এই স্রোতে জহির সম্পূর্ণ একা হয়ে হাঁটতে থাকে। হেঁটে হেঁটে ঢাকা শহর দেখার মজা আলাদা। ব্যস্ত সময়ে কেউ কাউকে ঢুঁস মেরে, কারো বা পা মাড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে নির্বিকার। দু:খ প্রকাশ করারও সময় নেই- এমন তাড়া। সবাই ছুটছে।

এই ছুটাছুটিটা একেকসময় একেক রূপ ধারণ করে। অফিস শুরুর সময় একরকম আবার অফিস শেষে অন্যরকম। মাঝখানের সময়টা আবার একেবারেই অন্যরকম। মতিঝিলে একরকম তো প্রেসক্লাব মোড়ে অন্যরকম। কাকরাইলে একরকম আবার ফার্মগেটে আরেকরকম।

একেকটি গাড়ি গড়গড়িয়ে স্টপেজে থামে আর পেট উগড়ে কিছু মানুষকে নামিয়ে দেয়। আবার কিছু মানুষকে পেটের ভেতর সেঁধিয়ে নিয়ে চলে যায়। জহির ঘোরলাগা চোখে সবকিছু তাকিয়ে দেখে। এই মানুষগুলোর সবাই কি কর্মের পিছনে ছুটছে? জগত সংসারে এই কর্মক্রিয়া চলতেই থাকবে? এর মধ্যে কেউ বয়স হয়ে বুড়িয়ে যাবে। কর্ম থেকে অবসর নেবে।

দুনিয়া থেকেই চিরবিদায় নেবে কেউ কেউ। তারপরও কর্ম থেমে থাকবে না। সচিবালয় থেকে খাদ্যভবন হয়ে শিক্ষাভবন। এই পথটুকু জহিরের কাছে নিউইয়র্কের ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রীট’ বলে মনে হয় মাঝে মাঝে। এই রাস্তাটিতে প্রতিদিন তদবিরের জন্য যত ভীড় হয় এর অর্ধেক লোক জড়ো করে বাংলাদেশের এই ওয়াল স্ট্রীট দখল করে ফেলা যায়।

কিন্তু এখানে যারা আসে তারা দশ পার্সেন্ট। তারা আসে নিজেদের কাজের জন্য। কাজ সেরে সন্তুষ্টি নিয়ে চলে যায়। তাদের এই ওয়াল স্ট্রীট 'অকুপাই' বা দখল করার দরকার নেই। যাদের দরকার সেই নব্বুই পার্সেন্ট এই এলাকার ধারে কাছেও ভিড়তে পারে না।

নব্বুই পার্সেন্ট লোক জানেই না যে তারা বাংলাদেশের এই ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রীট’ দ্বারাই পরিচালিত। নিউইয়র্কের এই আন্দোলন নিয়ে জহিরের মাথা ব্যাথা নেই। জহিরের মাথা ব্যাথা নিজের মাথাটা নিয়েই। জহিরের মাথার মধ্যেই যত্তসব গণ্ডগোল। কী সব উদ্ভট উদ্ভট চিন্তাভাবনা কিলবিল করে মাথায়।

এই যেমন কিছুদিন ধরে চিন্তায় এসেছে অবসরের অনুভূতি কেমন তা দেখতে। পনের বছর সামনে তাকিয়ে দেখে জহির এখন সম্পূর্ণ কর্মহীন। এতদিন সে তার মেধা, দক্ষতা দিয়ে সরকারি চাকুরিতে শ্রম দিয়েছে। জনগণের সেবক হয়ে কাজ করেছে। আজ তার বয়স ফুরিয়ে গেছে।

এ রাষ্ট্র তাকে কর্মক্ষম নয় ঘোষণা করে অবসর দিয়েছে। মধ্য বয়স থেকে এই পনের বছর শুধু টাকার মেশিন হিসেবেই কাটিয়ে দিয়েছে। রাইয়ান আর রাইশা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে বিদেশ চলে গেছে। স্ত্রী নীলিমা নীল আকাশের তাঁরা হয়ে হারিয়ে গেছে। অবসরের পর থেকে সে একেবারে মূল্যহীন হয়ে গেছে।

এই বিশ্ব সংসারে জহির সম্পূর্ণ একা। ছেলে মেয়ে দুটো বিদেশেই ঘর সংসার পেতেছে। মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে রাখার কেউ নেই। এই বিষয়টি বোঝার পর জহির শেষবারের মতো ঘর পালায়। আহ্! কী শান্তি!! শেষবার ঘর পালানোর আগে জহির আতঙ্কে অস্থির হয়ে থাকতো।

অহেতুক এই অস্থিরতা নিয়ে জহির অনেক ভেবেছে। প্রখ্যাত একজন মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন ও হয়েছে। স্ত্রীর সাথে মানসিক দূরত্ব ক্রমাগত বাড়তে থাকলে মনোচিকিৎসকেও কাজে দেয় না। মনের কথা নিয়েই মনোচিকিৎসকদের কারবার। একপক্ষ মনের কথা খুলে বললে কি হবে? উভয়পক্ষকেই কথা বলতে হবে।

একজন কাউন্সেলর উভয়পক্ষের কথা শুনে দু’জনের মধ্যে দূরত্বটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করে। স্ত্রী নীলিমার সহযোগিতা পায় না এক্ষেত্রে। কাউন্সেলিংয়ে যাওয়ার জন্য জহিরের পীড়াপীড়িতে নীলিমার নির্লিপ্ত জবাব- তুই পাগল, তোর চৌদ্দ গোষ্ঠী পাগল। তুই চিকিৎসা কর। তারপর জহির সত্যিই কিছুদিন পাগল হয়ে গিয়েছিল।

সারাক্ষণ বিরবির করে বলতো...হুম! আমি পাগল...আমার চৌদ্দ গোষ্ঠী পাগল...ঘেউ ঘেউ। পাগল হয়ে গেলে কি মানুষ ঘেউ ঘেউ করে! শেষ দিকে জহিরের ঘেউ ঘেউ করার মাত্রাটা বেড়ে যায়। অবস্থা এমন চরমে দাঁড়িয়েছে জহির গায়েবী আওয়াজ শুনছে- -জহির... -ঘেউ। -তুমি পাগল। -ঘেউ ঘেউ... -তোমার চৌদ্দ গোষ্ঠী পাগল।

-ঘেউ ঘেউ ঘেউ... -তুই উন্মাদ। নরম সুরে ‘তুমি’ ‘তোমার’ থেকে কঠোর সুরে তুই এ নেমে আসে এবার গায়েবী আওয়াজটা। -কুইঁকুঁইকুঁই...ঘেউ ঘেউ ঘেউ। -তুই প্রতারক। - ঘেউ ঘেউ ঘেউ... -তুই একটা ঠগ।

তুই তোর স্ত্রী-সন্তানদের ঠকাচ্ছিস। -ঘেউ ঘেউ ঘেউ... -তুই তোর কর্মস্থলে বসে দেশ উদ্ধারের জন্য বালের কাজ করিস। - কুইঁকুঁইকুঁই...ঘেউ ঘেউ ঘেউ। - তুই একটা কুত্তা। - কুইঁকুঁইকুঁই...ঘেউ ঘেউ ঘেউ।

গায়েবী আওয়াজ শোনার দিন সকালবেলা জহির অফিসে গিয়েছে। অফিসে গিয়ে শুনছে জহিরের সমপর্যায়ের এক কর্মকর্তা এক পেনশন আবেদন কারীর সাথে কথা বলছেন। জহির স্পষ্ট শুনতে পায় কর্মকর্তা বলছেন- -ঘেউ ঘেউ। -স্যার আমার পেনশনের টাকাটা কবে পামু? মেয়ের বিয়ে দিতে পারছি না। -ঘেউ ঘেউ।

-স্যার আমি খুব অসুস্থ। চিকিৎসা করানোর টাকা নেই। -ঘেউ ঘেউ ঘেউ। পেনশন আবেদনকারী ছিটকে বের হয়ে আসে রূম থেকে। এবার যায় এই অফিসের সবচেয়ে বড় কর্তার কাছে।

-ঘেউ ঘেউ... -স্যার আমি এসেছি আপনার কাছ থেকে একটু সুপারিশ চাইতে...স্যার আমার পেনশনের টাকাটা... -ঘেউ ঘেউ ঘেউ ঘেউ... জহির আশ্চর্য হয়ে যায়। এ কী করে সম্ভব? জহির না হয় ঘরে ঘেউ ঘেউ করেছে। এখন দেখি অফিসেও এর বিস্তার ঘটেছে। পর পর কয়েকদিন জহির পরীক্ষা করে দেখেছে ব্যাপারটা। যখন সে নিশ্চিত হয়েছে যে অফিসে সবারই ঘেউ ঘেউ রোগে ধরেছে, জহির অফিস ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

নাহ্! এখান থেকেও পালাতে হবে। কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায়? -পালাও জহির পালাও... -না আমি পালাবো না। -তোমার নিয়তি এটাই...তুমি পালিয়ে বাঁচবে... -না, আমার নীলিমা আছে...রাইয়ান আছে...রাইশা আছে...। -আরে মূর্খ! ওঘরে তোমার মর্যাদা তো কুকুরের সমান। -ঘেউ ঘেউ ঘেউ... চাকুরিতে আর যায় না জহির সবার মধ্যে‘ঘেউ ঘেউ’ রোগটা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে।

ঘরেও আর ঘেউ ঘেউ করতে ইচ্ছে করে না। এবার সে প্রবল বেগে ঘর পালায়। ঘর পালিয়ে নিজের ঘরের মধ্যেই থাকে। স্ত্রী নীলিমার কথা মনে হয়। রাইয়ান আর রাইশার কথা মনে হয়।

ওরা কেমন আছে কে জানে! পৃথিবীটা এমন নিষ্ঠুর কেনো? জহিরই কি পৃথিবীটাকে নিষ্ঠুর করেছে, নাকি নিয়তিই জহিরকে নিষ্ঠুর পৃথিবীর কোলে টেনে এনে ফেলেছে। জহির নিয়তিকেই সাপোর্ট করে। নাহলে ঘরটা কারাগার হয়ে যাবে কেন? রাইয়ান রাইশাকে নিয়ে কি সুখের ঘরটাই না ছিল জহিরের। জহিরের কাছে সুখের ছিল কিন্তু নীলিমার কাছে কি সুখের ছিল? নীলিমার কাছে বোধহয় জহিরের প্রথম ঘরটা কারাগার ছিল। নীলিমার ধনুর্ভঙ্গ পণ ছিল এই ঘর ছেড়ে সে চলে যাবে।

চলে যাওয়ার আগের দিন ছোট্ট রাইশা এসে বাবাকে বলেছিল, বাবা আমি আর আম্মু অন্য বাসায় চলে যাচ্ছি। তুমি ভাইয়াকে নিয়ে তোমার বাসায় থাকবে। জহিরের তখনই প্রথম মৃত্যুটা হয়েছিল। সন্তানদেরকে আবার কিভাবে ভাগাভাগি করা যায়? সন্তানদের বিচ্ছেদ সইতে পারবে না ভেবে প্রথম ঘর পালিয়ে ছিল। নীলিমাকে নিয়ে আকাশ সমান উঁচুতে গিয়ে দ্বিতীয় ঘর বেঁধেছিল।

কিন্তু প্রথম ঘরটার কথা জহির ভুলতে পারে না। প্রথম ঘরে জহিরের শৈশব, কৈশোরের গন্ধ লুকানো আছে। প্রথম ঘরে জহিরের মমতাময়ী মা আছে। প্রথম ঘরে জহিরের পরম নির্ভর বাবা আছে। সম্রাট জহিরুদ্দিন বাবরের সাম্রাজ্য তার প্রথম ঘরকে ঘিরেই।

পল্টন থেকে হাঁটতে হাঁটতে মতিঝিল এসে জহির ভাবে একটু চা বিরতি নেওয়া যাক। মতিঝিল সেনাকল্যাণ ভবনের সামনে ফুটপাথে চায়ের দোকান। ঢাকা শহরের চা দোকানে সবসময়ই একটা জটলা থাকে। এখানে একটু জটলাটা বেশিই মনে হয়। দূর থেকে ঝগড়ার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।

এক মহিলা আক্রোশে গালাগাল করে যাচ্ছে তার রিকশাচালক স্বামীকে। কুত্তার বাচ্চা ভাত-পিন্দন দিবার পারস না, বিয়া করার শখ জাগছিল ক্যা? তুই রিকশা চালাইয়া পারস, চুরি-ডাকাতি কইরা পারস খরচ দিবি। আমি কি তোর রক্ষিতা রে খানকির বাচ্চা। তুই আমারে চিনস আমি কোন বংশের মাইয়া...উফ! আবারও ঝগড়া-ঝাটি, অশ্লীল-অশ্রাব্য গালাগাল। জহিরের হৃদপিণ্ডটা আবারও ধুকপুক করে উঠে।

নাহ্, এখান থেকেও পালাতে হবে। তারপর জহির দ্বিতীয়বার ঘর পালিয়েছিল আবারও নীলিমাকে নিয়েই। প্রথমবার অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে প্রথম ঘরে ফিরেছিল কিছুদিনের জন্য। ঢাকা শহরে নিজেদের থাকার নিশ্চিন্ত এবং নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে কাছেই ভাড়া বাড়িতে গিয়ে ওঠাটা জহিরের মনটাকে ভেঙ্গে দিয়েছিল। নীলিমাকে একদিন ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞেস করেছিল- "তুমি যে আমার বুড়ো বাবা-মা’র কাছ থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে নিতে চাচ্ছ একদিন আমাদের রাইয়ান ও তার বউ নিয়ে বুড়ো বাবাকে ফেলে ফেলে চলে যাবে।

" চলে গেলে চলে যাবে- এটাই জগতের নিয়ম। নীলিমার নির্লিপ্ত জবাব। জগতের এই নিয়মকে মানতে গিয়ে জহিরের দ্বিতীয়বার মৃত্যু হয়। কালের চক্রে জহির একদিন বুড়ো এবং কর্মহীন হয়ে যাবে। এখন যেমন জহিরের বাবা মা বুড়ো হয়ে গেছেন।

একদিন রাইয়ান রাইশা বড় হয়ে বুড়ো এই বাবা-মাকে ছেড়ে দূরে চলে যাবে...জহিরের মনে হয় এ দুনিয়া আসলেই মায়ার বাঁধন। তৃতীয়বার জহির ঘর পালিয়েছিল রাইয়ান আর রাইশাকে নিয়ে। দুধের শিশু বিধায় রাইশাকে রেখে রাইয়ানকে নিয়েই ঘর পালিয়েছিল বলা যায়। রাইয়ানও বাবার সাথে ঘর পালিয়ে বেশ আমোদেই ছিল। বাপ ব্যাটায় ঘর করেছিল কিছুদিন।

তোর কুত্তার বাচ্চা দুইডা লইয়া ভাগ! আমারে বাঁচতে দে! এরকম এক গায়েবী আওয়াজে তৃতীয়বারের ঘর পালানো। ঘরমুখী মানুষের কি ঘর পালানো সম্ভব? রাইয়ান রাইশার মমতায় জহিরকে আবারও ঘরে ফিরতে হয়েছিল। চতুর্থবার ঘর পালিয়েছিল জহির অনেকটা অপমানে বিধ্বস্ত হয়ে। সশব্দে একটা গায়েবী চড় যখন জহিরের বাম গালে পড়েছিল প্রচণ্ড আক্রোশ নিয়ে, জহির ঠান্ডা চোখে শুধু তাকিয়ে থেকেছিল। মনে মনে বোধহয় ভেবেছিল নারীরও অধিকার আছে রাগে অন্ধ হয়ে পুরুষকে চড় মারার।

জহিরের যখন ঘোর ভাঙ্গলো তখন বুঝলো পৌরুষত্বের মেরুদণ্ডটা একেবারেই ভেঙ্গে গেলো। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। তখন নীলিমার সাথে সম্পর্কটা কেমন যেনো ভালোবাসাহীন হয়ে উঠছে দিন দিন। কোথায় যাবে? কার কাছে গেলে এই সমস্যার সমাধান হবে? কে পারবে তাদের দু’জনের এই দূরত্ব ঘুচিয়ে দিতে? একই ছাদের নিচে থেকেও যোজন যোজন দূরত্ব। একই বিছানায় পাশাপাশি থেকেও জিন্দালাশ হয়ে থাকা।

ঘরটাকে তখন থেকেই নিষ্ঠুর এক কারাগার মনে হতে থাকে জহিরের। এই কারাগারে থেকে থেকে জহির হাঁপিয়ে উঠছিল। নীলিমার বড় ভাইকে মধ্যস্থতা করে দু’জনের দূরত্বটা ঘুচিয়ে দেওয়ার আকূল অভিপ্রায় জানিয়েছিল জহির। মতিঝিলের ফুটপাথ ধরে ইত্তেফাক অভিমুখী পথ ধরে হাঁটতে থাকে জহির। মানসিক অস্থিরতা কিছুটা কম এখন।

আপাত স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়া জহিরের ভাবনায় পেয়ে বসে এই যে রাস্তায় শত শত মানুষের ব্যস্ত পদচারণা, সবাই কর্মে ছুটছে। জহির একাই শুধু কর্মহীন। কর্মহীন থাকলে মস্তিষ্ক অলস হয়ে যায়। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। মস্তিষ্ক খাটাতে হবে- সে ভালো কাজে হোক আর খারাপ কাজে হোক।

জহির খারাপ কাজে মস্তিষ্কটা খাটাতে চায়। মস্তিষ্কটা খারাপ কাজে লাগিয়ে প্রথমে কি চাইতে পারে? টাকা। হ্যাঁ, টাকাই হচ্ছে প্রথম চাওয়া। ভালো কাজে হোক খারাপ কাজে হোক টাকা লাগবেই। নীলিমা একদিন খুব আহ্লাদী সুরে জহিরের কাছে টাকা চেয়েছিল।

বায়তুল মোকাররমের সমস্ত জুয়েলারী উল্টেপাল্টে দেখছিল একজোড়া ঝুমকা খুঁজতে গিয়ে। কিন্তু টাকার অভাবে দিতে পারে নি। বিষয়টি ভেবে জহিরের আফসোস জাগে। ফাইলের প্যাঁচে কাউকে ফেলে সহজেই টাকাটা আদায় করে নিতে পারা যেতো। জুয়েলারী দোকানের সেলসম্যানের সামনে নীলিমাকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হতো না।

টাকা বানাতে হলে লাগবে লাগসই যোগাযোগ। রাজনৈতিক কানেকশনও থাকতে হবে। জহিরের এগুলো কিছুই নেই। কর্মহীন সময়টুকুতে জহির বর্তমান রাজনীতির পাঠ নিতে যায় এক হাইব্রীড নেতার কাছ থেকে। কাছে থেকে বুঝে এতো রক্তচোষা ছারপোকা! এই ছারপোকাকে বেষ্টন করে আরো ছারপোকা আছে।

জহিরের রাজনীতির পাঠ শেষ হয়ে যায় এটুকুতেই। হাঁটতে হাঁটতে জহিরের মুখ দিয়ে একটি একটি শব্দ বের হয়- শালার হাইব্রীড নেতা...। এই হাইব্রীড নেতারাই সব আমলের সুবিধাভোগী। তেলতেলে মসৃন একটা ভাব থাকে এই হাইব্রীড নেতাদের গায়ে এবং কথায়। সামনেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বিল্ডিং।

বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে জহির চমকে উঠে। শত শত ছারপোকা বিল্ডিংটি ঘিরে আছে। চোখে ভুল দেখছে না তো! আবারও তাকায়। ইদানীং জহিরের সামনে কি সব অদ্ভূত জীবজন্তু দেখা দিচ্ছে। সেদিন দিলকুশা ব্যাংক পাড়ায় গিয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিল।

সবগুলো ব্যাংকে বিরাট হা করা মুখ নিয়ে বিশাল বিশাল অজগর সাপেরা পুরো ব্যাংক প্যাঁচিয়ে আছে। ব্যাংকের মধ্যে প্রবেশরত মানুষগুলোকে টপাটপ গিলে নিচ্ছে। জহির ভয়ে আর ও মুখো হয়নি। সরকারি অফিসগুলোতে গেলে প্রায়ই দেখতে পায় কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে। করপোরেট অফিসগুলোতে গেলে দেখে অদ্ভূত সব দু’পেয়ে জীব।

জীবন্ত রোবট যেনো একেকটা। স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে আসলে জহির বিমর্ষ বোধ করে। এই ছারপোকাগুলো লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত চুষে খেয়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে সর্বস্ব হারানো কিছু বিনিয়োগকারী জটলা পাকিয়েছে। ছারপোকাগুলোকে তারা দেখতে পাচ্ছে না।

জহির স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ১৯৯৬ সালের কথা মনে পড়ে। নীলিমাই যেচে কিছু টাকা দিয়েছিল জহিরকে শেয়ারে বিনিয়োগের জন্য। তখন এই এক্সচেঞ্জের সামনে ফুটপাথেই শেয়ারের সার্টিফিকেট বিক্রি হতো। কার্ব মার্কেট বলা হতো এটাকে।

জহির কার্ব মার্কেট থেকে কিছু সার্টিফিকেট কিনেছিল। শেয়ার বাজারে হুড়মুড়িয়ে ধস নেমে সেই টাকাগুলো বেমালুম গায়েব হয়ে গেলো। তখন থেকেই একটা সুক্ষ্ম ঋণগ্রস্ততার দায়বোধ থেকে মেরুদণ্ডহীন হয়ে যাওয়ার ভাবনা অনুভূত হয় জহিরের। স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে ফুটপাথ থেকে কোম্পানির শেয়ার কিনে এই ফুটপাথেই যে এটা গায়েব হয়ে গেছে এই হাস্যকর যুক্তি কিভাবে দেয়! নীলিমার প্রশ্নের জবাবে জহির সতর্কভাবে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যায়। ঋণগ্রস্ততা আরও বেড়েছে জহিরের।

কী সব উল্টাপাল্টা কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে। ঘর পালিয়ে গিয়েছিস ব্যাটা আবার ঘর-সংসার কর। নাহ্! আবার সেই গায়েবী আওয়াজ... -সম্রাট জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর... -জ্বী জনাব। -তুমি তো সম্রাট বংশের। তোমার সাম্রাজ্য কোথায়? তোমার সম্রাজ্ঞী, রাজপুত্র, রাজকন্যা তারা কোথায়? -আমি সাম্রাজ্য ত্যাগ করেছি জনাব।

আর তাই সবাই আমাকে ত্যাগ করেছে। -তুমি ঘর ত্যাগ করে সেই ঘরে গিয়েই তো উঠেছ। তারমানে তুমি ঘর পালানো ঘরেই উঠেছ। -জ্বী জনাব। -তাহলে তুমি নতুন করে ঘর-সংসার শুরু কর।

-না জনাব। -তাহলে তুমি কি করবে? -আমি অনেক ঋণগ্রস্ত হতে চাই এবং অনেক ধনী হতে চাই। -দু’টো তুমি কখনোই একসাথে হতে পারবে না। -কেন জনাব? বাংলাদেশে ঋণগ্রস্তরাই সবচেয়ে ধনী। তাদেরকে ঋণখেলাপী বলা হয়।

-ওহে মূর্খ! তোমার মনে নেই ঋণের দায়ে একবার জেলে যেতে বসেছিলে। থানার দারোগা এসে বসে থেকেছিল তোমার অফিসে- আমিই তোমাকে বাঁচিয়েছিলাম। -তুমি কে প্রভু? -আমি টাকা। -ও টাকা প্রভু...তুমি কিভাবে আমায় বাঁচিয়ে ছিলে? -ব্যাংকের আসল ঋণ, সুদ, মামলার খরচ, উকিলের খরচ সব তোর কাছ থেকে নিয়ে মেটালাম। তুই যে ব্যবসায় মানুষের কাছে প্রতারিত হলি সেই ঋণের টাকাটা মেটালাম।

-ওহ্, টাকা প্রভু! ইউ আর দ্য গ্রেট! তা কীভাবে তুমি এই অসাধ্য সাধন করলে? -আরে মূর্খ! আমার নিজের কি সে ক্ষমতা আছে? তোর পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রয় করে আমাকে তুলে দিয়েছিস পাওনাদারদের হাতে। -তাহলে টাকা প্রভু, আমার হাতে কি রইল? -তোর হাতে রইল শুধু ঋণ। পিতার কাছে ঋণ, বন্ধুর কাছে ঋণ, স্ত্রীর কাছে ঋণ, সন্তানের কাছে ঋণ...শুধু ঋণ আর ঋণ...শুধু ঋণ আর ঋণ...শুধু ঋণ আর ঋণ... -টাকা প্রভু আমাকে এই ঋণের হাত থেকে বাঁচাও। -তাহলে আমাকে সাধনা কর। -কিভাবে সাধনা করবো সে উপায় বাতলে দাও টাকা প্রভু।

-নাহ্! তুই সত্যিই মূর্খ। গায়েবী আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। জহির চিৎকার করে বলে...প্রভু! প্রভু!! আমাকে সাধনা করার উপায় বাতলে দাও প্রভু। আমি ঋণগুলো সব ধুয়েমুছে পরিস্কার করে ফেলতে চাই। আমি আবার মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে চাই।

আমি তোমাকে চাই টাকা প্রভু, আমি তোমাকে চাই। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে ঘিরে এবার টাকা প্রভুকে দেখে জহির। টাকা প্রভুর চুল দাঁড়ি গোফ সবই টাকা। এমনকি গায়ের জামাটা পর্যন্ত। এই ২০১১ সালে আবারও শেয়ার বাজারে ধস নেমেছে।

কিছু বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারী প্রতিদিনই এখানে জড়ো হয়। মাঝে মাঝে শ্লোগানে উত্তেজনা দেখা দিলে টায়ার জ্বালিয়ে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। প্রায় পঁচিশ লক্ষ বিনিয়োগকারী এখানে এসে টাকা হারিয়েছে। হারানো টাকার খোঁজে এরা এখানে আসে। কিছুক্ষণ সময় কাটায়।

শেয়ার দরের উঠানামা দেখাই তাদের কর্ম। শেয়ারের দাম চড়চড় করে বাড়তে থাকলেই তারা খুশী হয়। আর যদি দাম নামতে থকে তাহলে তাদের কপাল বেয়ে ঘাম ঝরে দুশ্চিন্তায়। জহির সতর্কভাবেই এই এলাকাটি এড়িয়ে চলে। স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ারের দর উঠানামা কল্পনা করে জহিরের সমুদ্রের ঢেউয়ের কথা মনে পড়ে।

একবার সবাই মিলে কক্সবাজার গিয়েছিল। সমুদ্র সৈকতে সবাই মিলে ঢেউয়ের সাথে খেলায় মেতেছিল। নীলিমা আর জহির উঁচু হয়ে ধেয়ে আসা ঢেউয়ে লুটোপুটি খেলেছিল অনেক্ষণ। রাইয়ান আর রাইশা ঢেউয়ের অদূরে বসে বালু দিয়ে ঘর বাঁধছিল। ঢেউয়ের তোড়ে বারবার তাদের ঘর ভেঙ্গে যাচ্ছিল।

অন্য কোনো নিরাপদ জায়গায় গিয়ে আবারও তারা ঘর বানানো খেলায় মেতে উঠেছিল। আবারও সেই ঘরের কথাই মনে পড়ছে। উফ! এই ঘর থেকে কি কোনোকালেই মুক্তি নেই! জহিরের ভাবনাগুলো এলোমোলো হতে থাকে আবারও। ঘর-সংসার-চাকুরি-অবসর-চিরবিদায়। জহির কবে এই বিশ্ব সংসার থেকে চিরবিদায় নেবে।

একদিন না একদিন চলে যেতে হবে নিশ্চিত। জহিরের পূর্ব পুরুষরা চলে গেছে। জহির কিছুদিনের জন্য আছে। জহিরের পরবর্তী প্রজন্ম কিছুকাল থাকবে। মাঝখানে কিছুদিন মায়ার বাঁধনে কাটিয়ে যাওয়া।

বুম! বুম!! হঠাৎ পরপর দুইটি পটকার আওয়াজ পাওয়া যায়। পটকার আওয়াজ নাকি ককটেলের আওয়াজ জহির ঠাহর করতে পারে না। ফুটপাথে চলাচলরত জনসমুদ্র থেকে একা হয়ে জহির হেঁটে স্টক এক্সচেঞ্জের রাস্তাটা ধরেছিল। একটা পটকা নাকি ককটেল উড়ে এসে জহিরের মাথায় আঘাত হেনেছে। পদার্থ আর প্রতিপ্রদার্থ একত্র হলে নাকি প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটে এবং উভয়টিই ধ্বংস হয়ে যায়।

জহিরের মাথায় আঘাত করা প্রতিপদার্থটা দেখতে কিরুপ ছিল জহিরের মনে পড়ে না। শুধু এইটুকু মনে পড়ে জহির কল্পনায় শূন্য বাটনটি চেপে দিয়েছে। জহির ক্রমশঃ শূন্য হয়ে যাচ্ছে। সমান্তরাল আরেকটি বিশ্বে চলে যাচ্ছে। সংঘর্ষের মুহূর্তটা জহিরের কাছে অন্যরকম এক অনুভূতি নিয়ে হাজির হয়।

প্রচণ্ড ঢেউয়ের তোড়ে জহির উল্টে যায়। আবারও স্থির হয়। পৃথিবীর বাতাসে মিশে থাকা শেষ অক্সিজেনটুকু নিতে জহির সর্বশেষ চেষ্টা চালায়। নীলিমার কথা মনে হয়। রাইয়ান রাইশার কথা মনে হয়।

রাইয়ান রাইশা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে যে ঘর বানাচ্ছিল আর ঢেউ এসে বারবার তা ভেঙ্গে দিচ্ছিল সে কথা মনে হয়। আরেকবার মাত্র নিঃশ্বাস নিতে পারলে জহির রাইয়ান রাইশার হাত ধরে সে ঘরে চলে যাবে। ঢেউয়ে ওদের ঘর বানানোকে ভেঙ্গে যেতে দেবে না। নীলিমাকে কি সে ঘরে নিয়ে যাবে? রাইয়ান রাইশা তো ওদের মাকে নেবেই। তাহলে জহিরের আবারও ঘর পালানোর কি হবে? আহ! চারিপাশে এত ভিড় হৈ চৈ কেনো! কি হয়েছে? কে মারা গেছে? জহির ভিড়ের মধ্যেই উঁকি দিয়ে দেখে।

আরে! এযে জহিরেরই প্রতিরূপ। মাথার মগজ বেরিয়ে গেছে। রাস্তায় ছিটকে আছে খানিকটা। এগুলো তো মগজ নয় এগুলো নিউরন। কোটি কোটি নিউরন রাজপথে কিলবিল করতে থাকে।

কয়েকজন ধরাধরি করে জহিরের লাশটাকে ফুটপাথের একপাশে এনে রাখে। চিত হয়ে শুয়ে থাকা লাশটির চোখ দুটো সম্পূর্ণ খোলা। লাশের চোখ খোলা থাকলে দেখতে ভয়ংকর লাগে। কেউ একজন লাশের চোখ বন্ধ করে দেয়। চিরতরে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে লাশটি নীল আকাশটা একবার দেখে নেয়।

আকাশটা আজ এত বেশী নীল কেনো? বিষণ্নতার রঙই বা নীল কেনো? নীলিমার নীল নিয়ে কি আকাশটা সেজেছে? নীলিমাকে একটা ফোন করা দরকার। সাহায্যকারীদের একজন লাশের প্যান্টের পকেট হাতড়ে মোবাইলটা নিয়ে নেয়। একজন মানিব্যাগ হাতড়ে নেয়। লাশটি নাম পরিচয়হীন লাশ হয়ে চিরতরে ঘর পালায়- একা এবং একদম একা। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।