বাঙলা কবিতা বাঙলায়ন : রহমান হেনরী
--------------------------
তারপর, আমার দিকে তাকালো, সে। মনে হলো, সে হয়তো, এই প্রথম আমাকে দেখছে । কিন্তু এর পরপরই, যখন সে প্রদীপটার ওপাশে গেল, আর আমার কাঁধের ওপরে, তার তৈলাক্ত পিচ্ছিল দৃষ্টি অনুভব করলাম, বুঝতে পারলাম, আমি নিজেই প্রথমবারের মত দেখছি তাকে। তারপর, একটা সিগ্রেট জ্বাললাম, আমি। দু'পায়ের একটাতে দেহের ভারসাম্য রেখে, চেয়ারে সেঁটে যাবার আগে, বেধড়ক একটা টান দিয়ে, ব্যাপক ধোঁয়া উদগীরণ করলাম।
তাকে দেখতে পেলাম ওখানে, প্রদীপটার পাশে, যেন বহু দিন ধরে এভাবেই প্রদীপের পাশে দাঁড়িয়ে, প্রতিটি রাতে সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছিলো আমাকে। এর পরবর্তী কয়েক মিনিটে, আমরা যা যা করলাম, সংক্ষেপে সেটা হলো এই যে : চেয়ারে বসেই, এক পায়ে ভারসাম্য রেখে, তাকালাম তার দিকে। তার দীর্ঘ বাহু তুলে, দাঁড়িয়ে, প্রদীপের ওপর দিয়েই, সেও তাকালো আমার দিকে। দেখলাম, প্রতিটি রাত্রির মতই তার আঁখি-পল্লব আলোকিত হয়ে উঠলো। তখন, যে কথাটা সচরাচর মনে করতে পারি না কিন্তু মনে করার আপ্রাণ চেষ্টা করি আমি, সেটাই মনে পড়লো, আর তাকে বললাম : " নীল কুকুরের চোখদুটি "।
হাতের বাতাসে প্রদীপটা না নিভিয়েই, বললো সে : "সেটাই। কথাটা আমরা ভুলতে পারবো না কখনই। " চোখ বুঁজে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, সে : " নীল কুকুরের চোখদুটি। সর্বত্রই লিখে রেখেছি এই একটা কথাই। "
তাকে হেঁটে যেতে দেখলাম ড্রেসিং টেবিলের দিকে।
সামনে-পেছনে দুদিকেই জাজ্বল্যমান একটা গাণিতিক আলোর ঝলকানির মধ্যে, ডিম্বাকৃতি আয়নায়, লক্ষ করলাম তার মুখটা, এখন আমাকেই দেখছে সে। লক্ষ করলাম, তপ্ত-কয়লার মত দুটি চোখ মেলে, আমাকে দেখাই অব্যাহত রেখেছে: ছোট্ট একটা বাক্স, যার পীঠে গোলাপী মুক্তা বসানো, সেটা খুলতে খুলতে, বারবার তাকাচ্ছে আমার দিকেই। আমি তার পাউডার দেখলাম, নাকটাও দেখলাম। যখন তার সাজগোজ শেষ হলো, বন্ধ করলো বাক্সটা, আবার উঠে দাঁড়ালো, আর আরও একবার হেঁটে এলো প্রদীপটার কাছে, বললো : " আমার ভয় হচ্ছে, কেউ একজন স্বপ্ন দেখছে এই রুমটার; আর সে আমার গোপনীয়তাও ফাঁস করার চেষ্টা চালাচ্ছে। " আর সেই একইভাবে সে তার শীর্ণ ঋজু বাহুদুটি প্রদীপের ওপর মেলে ধরলো, যেন, আয়নার সামনে বসার আগে, সে তার হাত দুটো সেঁকে নিচ্ছে।
এবং সে প্রশ্ন করলো : "ঠাণ্ডা লাগছে না তোমার?" জবাবে বললাম : " মাঝে মাঝে লাগছে। " আর সে বললো : " এখন নিশ্চিত শীত লাগছে তোমার। " এটা শুনেই, আমার উপলব্ধি হলো, কেন একাকী বসে থাকতে পারি না আমি। এই শৈত্যবোধই আমার নির্জনতাকে প্রকট করে তোলে। " এখন, সত্যি ঠাণ্ডা অনুভব করছি," বললাম আমি, " আর খুব অদ্ভূত ব্যাপার, কেমন নিস্তব্ধ এই রাত।
হয়তো তুষার পড়বে। " সে কোনও জবাবই দিলো না। আবারও সে আয়নার দিকে এগোতে লাগলো, আর আমি, চেয়ারটা ঘুরিয়ে তার দিকে পেছন ফেরালাম। ওর দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারছিলাম কী করছে সে। জানতাম, আবারও আয়নার সামনে বসে, ও তাকিয়ে দেখছে আমার পেছন দিকটা, কেননা, আয়নার ভেতরে এখন অনেক সময় ধরে প্রতিফলিত হচ্ছে আমার বিপরীত বিম্ব, আর সে, হাতের রঞ্জনী ছোঁয়ায়, নিজের ঠোঁট রক্ত-লাল করে তুলতে তুলতে বার বার দেখে নিচ্ছে, পেছন-ফেরা এই আমিটাকেই।
আমি নিজেই দেখলাম, বিপ্রতীপ আমাকে, মসৃন দেয়ালে, যেটা আসলেও এক অন্ধ-আয়না, আমার উল্টো দিকে বসা ওকে, দেখা যাচ্ছে না যদিও এই আয়নায়, তবু মনে হচ্ছে, দেয়ালের বদলে এখানে যেন একটা আয়নাই টাঙানো আছে, যার ভেতরে তাকিয়ে, আমি ওর ছবিটা আঁকতে পারি, কোথায় কীভাবে সে বসে আছে, এখন। বললাম : "দেখতে পাচ্ছি তোমাকে। " আর দেয়ালের মধ্যে দেখতে পেলাম, সে যেন, তার চোখদুটো তুললো আর ওর দিকে পেছন ফিরে চেয়ারে বসা আমিটাকে, একবার আয়নায়, আরেকবার বাস্তবে দেখে নিলো, সে। তারপর, দেখতে পেলাম, মাথা নিচু করে, সে তার কাচুলির দিকেই তাকিয়ে আছে, বার বার তাকাচ্ছে সে দিকেই, কোনও কথা বলছে না। আবারও বললাম : " তোমাকে দেখতে পাচ্ছি আমি।
" আর সে, তার কাঁচুলি থেকে আবারও চোখ তুললো, বললো, " সেটা অসম্ভব"। কেন নয়, জানতে চাইলাম আমি। আর সে, চোখদুটো কাঁচুলিতেই নিবদ্ধ রেখে, বললো, " কেননা, তোমার মুখ দেয়ালের দিকে ফেরানো"। তখন চেয়ারটা ঘোরালাম। মুখে গুঁজে নিলাম সিগ্রেট।
যখন আয়নার দিকে তাকালাম, দেখলাম, সে, প্রদীপের পেছনে দাঁড়ানো। একটা মুরগীর মত ডানা মেলে, শীর্ণ ঋজু হাতদুটো সেঁকে নিচ্ছে, আগুনে। আর তার মুখে, পড়ে আছে, নিজেরই আঙুলগুলোর ছায়া। " মনে হয় সর্দি লেগে যাবে আমার", বলে উঠলো, সে । "এটা, আদতে, একটা বরফ নগরী"।
সে তার দেহ-বল্লরী ও ত্বকের দিকে নজর ফেরালো, তামাটে থেকে লাল বর্ণে রূপান্ন্তরিত হতে হতে, হঠাৎ বিষণ্ণতা গ্রাস করলো তাকে। " এ ব্যাপারে, কিছু একটা করো", কণ্ঠে বিপন্নতা ঝরে পড়লো তার। আর সে, নিজেকে উন্মুক্ত করতে শুরু করলো, একটার পর একটা পোষাক খুলতে লাগলো, শুরু করলো ওপরের দিক থেকে, কাঁচুলি থেকে। আমি বললাম, " অন্যদিকে, দেয়ালের দিকে, মুখ রাখছি আমি"। " না, যা কিছুই করো না কেন, আমার দিকে পেছন ফিরেও, যেভাবে দেখতে পাচ্ছিলে আমায়, ওই একইভাবে তুমি ঠিকই দেখবে আমাকে"।
আর, এই বলাটুকু শেষ হতে না হতেই, সম্পূর্ণ নগ্ন হলো সে, প্রদীপের শিখা চাটতে লাগলো তার দীর্ঘ শরীরের তামাটে ত্বক। " এভাবেই, সব সময় দেখতে চেয়েছি তোমাকে, এই যে, তোমার পেটের চামড়া জুড়ে গর্তময় ক্ষতচিহ্ন, যেন কেউ বেদম পিটিয়েছে তোমাকে। " এবং তার নগ্নতা দেখে, আমার কথাগুলো যে জড়িয়ে যাচ্ছে, সে কথা বুঝে ওঠার আগেই, সে নিশ্চল হয়ে, প্রদীপ-শিখায় সেঁকে নিতে লাগলো নিজেকে, আর বললো, " মাঝে মাঝে মনে হয়, ধাতু-নির্মিত এক মানুষ আমি"। ক্ষণকাল নিশ্চুপ থাকলো। প্রদীপ-শিখায় ন্যাস্ত তার হাতের ভঙ্গিমা বদলে গেল, কিছুটা।
বললাম, " কখনও কখনও, অন্য কোনও স্বপ্নের ঘোরে, আমার মনে হয়েছে, তুমি কেবলি ছোট্ট এক ব্রঞ্জমূর্তি, যা কোনও যাদুঘরের এক কোণায়, নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। হতে পারে, সে জন্যই নির্বিকার আর শীতলা তুমি"। এবং সে বললো, "মাঝে মধ্যে, যখন হৃৎপিণ্ডের গভীরে নিদ্রারত থাকি আমি, অনুভব করি, শরীরটা ফাঁপা হয়ে উঠছে আর আমার দেহের ত্বক যেন হয়ে ওঠে ধাতব পাত। তারপর, যখন দেহের ভেতরে শুরু হয় রক্ত চলাচল, সেই রক্ত-স্পদনে, মনে হয়, কেউ একজন পাকস্থলীতে টোকা দিয়ে ডাকছে আমায়, আর আমার সমগ্র শয্যাময়, আমি আপন শরীরের তামার ঝনৎকার শুনতে পাই। এটা এরকম একটা ব্যাপার যে___ কী বলে একে ডাকবে তুমি___ মসৃন, প্রলেপমাখা ধাতু ।
" প্রদীপটার আরও নিকটবর্তী হলো সে। " তোমার কথাগুলোই শুনতে ভালো লাগবে আমার," সায় দিলাম, আমি। তখন, সে বলতে শুরু করলো, " মাঝে সাঝে যদি দেখা হয় আমাদের, তুমি আমার পাঁজরে কান পেতে শুনো, যখন বামে পাশ ফিরে শোবো আমি, দেখবে, আমার ভেতরে একটা প্রতিধ্বনি শুনতে পাবে। আমি সব সময়ই চাইতাম, মাঝে মাঝে এটাই করবে তুমি। " যখন, সে এই কথাগুলো বলছিলো, তার ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছিলো আমার কানে।
আর সে বলছিলো যে, অনেক বছর ধরে, এই কাজটা ছাড়া অন্য কিছুই করেনি, সে। তার জীবন উৎসর্গীকৃত ছিলো, বাস্তবে, কেবলি আমাকে খুঁজে বের করবার কাজে, এই সুপরিচিত বাগধারাটি দিয়েই, সে, খুঁজে বের করতে চেয়েছে আমাকে : " নীল কুকুরের চোখদুচটা"। আর সে, রাস্তায় রাস্তায়, উচ্চস্বরে, এটাই বলতে বলতে হেঁটে বেড়াতো, যেন, এই বাগধারা শুনেই, সেই একমাত্র মানুষটি, বুঝতে ও চিনতে পারে তাকে:
" আমিই সেইজন, যে প্রতিটি রাত্রিতে তোমার ঘুমের ভেতরে আসতো, আর তোমাকে বলতো : 'নীল কুকুরের চোখদুটো'। " সে আরও বললো, যখন সে কোনও রেস্তোরায় যেতো, বেয়ারাকে খাবারের অর্ডার দেবার আগে, বলতো : 'নীল কুকুরের চোখদুটো'। কিন্তু ওয়েটার যথারীতি তাকে কুর্ণিশ করে ফিরে যেত, আর এমন একটা ভঙ্গি করতো, যেন কোনওদিনও কোনও স্বপ্নের ভেতরেও তারা শোনেনি এমন কথা।
তখন, সে ন্যাপকিনে আঁকতো আর বার্ণিশ করা টেবিলে চাকু দিয়ে লিখতো : " নীল কুকুরের চোখদুটো"। আর হোস্টেলে, স্টেশনে এবং সকল সরকারী ভবনে, ঠাণ্ডায় ঘেমে ওঠা জানালার কাচে, তর্জনী দিয়ে সে লিখে রাখতো : ' নীল কুকুরের চোখদুটো'। এবং সে, এও বললো, একবার এক ওষুধের দোকানে গিয়ে, সেই একই রকম ঘ্রাণ পেয়েছিলো সে, স্বপ্নের মধ্যে আমাকে দেখার পর, এক রাতে, যে ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছিলো তার গোটা কক্ষময়; " এখানেই কোথাও, নিশ্চয় আশেপাশেই, থেকে থাকবে ও", ওষুধের দোকানের ঝকঝকে সুন্দর টাইলসগুলোর দিকে তাকিয়ে, এ কথাই মনে হয়েছিলো তার। তারপর, সে, দোকানের হিসাব-কেরানীর কাছাকাছি হাজির হয়ে, তাকে বলেছিলো : " সব সময়ই আমি একজন মানুষকে স্বপ্নে দেখি, যে কিনা, আমার উদ্দেশ্যে বলে : 'নীল কুকুরের চোখদুটো'। " আর সে বললো, তখন ওই কেরানী, তার দিকে চোখ রেখে বলেছিলো, " সত্যি বলতে কী, মিস, আপনার চোখগুলো দেখতে ওরকমই।
" এবং তখন, সে ওই কেরানীকে বলেছিলো, " সেই মানুষটাকে আমার খুঁজে বের করতেই হবে, যে আমাকে, স্বপ্নের ভেতরে এই কথাগুলো বলে"। এ কথা শুনে, ওই কেরানী লোকটা হাসতে শুরু করেছিলো আর চলে গিয়েছিলো বিক্রয় কাউন্টারের অন্য পাশে। সে তখন, হতভম্ব হয়ে, ঝকঝকে টাইলসগুলোর দিকে তাকিয়ে, ওই সুবাসটাই টেনে নিয়েছিলো নিঃশ্বাসে। এবং তার ভ্যানিটি ব্যাগটা খুলে, লাল লিপস্টিক বের করে, স্বচ্ছ টাইলসে, রক্তিম হরফে লিখে দিয়েছিলো : ' নীল কুকুরের চোখদুটো'। কেরানীটা যেখানে ছিলো, সেখান থেকে এগিয়ে এসে বলেছিলো, " ম্যাডাম, আপনি টাইলসগুলো নোংরা করলেন"।
তারপর তার হাতে একটা ন্যাকরা ধরিয়ে দিয়ে, বলেছিলো, "সাফ করে দিন"। এবং সে প্রদীপের পাশে দাঁড়িয়েই বলতে লাগলো, তারপর, সারাটা বিকেল সে তার চার হাত-পায়ে ভর রেখে, টাইলসগুলো পরিস্কার করছিলো আর মুখে উচ্চারণ করছিলো : 'নীল কুকুরের চোখ দুটো'; যতক্ষণ না দোকানের দরোজা পথে লোক সমাগম বেড়ে একটা জটলা হয়ে উঠেছিলো আর ওই জটলা থেকে আওয়াজ উঠেছিলো ভারি পাগলাটে এই মেয়ে। মেয়েটি, সত্যি, খুব খ্যাপা।
এখন, যখন শেষ হলো তার কথা বলা, আমি, সে-রকমই এক কোণে বসে, চেয়ারটায়, দুলতে থাকলাম। বললাম, " প্রতিদিন এই বাগধারাটাই স্মরণ করার চেষ্টা করি আমি, যেটা দিয়ে খুঁজতে হবে তোমাকে।
এখন মনে হচ্ছে, কাল ঘুম থেকে উঠে, হয়তো আর ভুলে যাবো না কথাটা। যদিও, সমস্ত স্বপ্ন জুড়ে, আমি, একই কথা বারবার বলি, আর যখনই ঘুম ভাঙ্গে, কোন কথাটা বলে খুঁজতে হবে তোমাকে, সেটাই বেমালুম ভুলে যাই, আমি। " আমার এ কথায়, সে বললো, " প্রথম দিন, তুমি নিজেই তো উদ্ভাবন করেছিলে কথাটা"। বললাম, " কথাগুলো উদ্ভাবন করেছিলাম, কেননা, তোমার চোখ দুটো দেখে, আমার মনে হয়েছিলো, ছাইচোখ; কিন্তু পরদিন সকালে, ঘুম ভাঙতেই, বিস্মৃত হয়েছিলাম সে কথা। " সে, অতঃপর, প্রদীপের পাশে, মুঠো মেলে ধরেই, একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেললো, " অন্তত এটুকু যদি মনে রাখতে পারতে তুমি, কোন শহরে বসে, এই কথাটা লিখে রাখলাম আমি।
"
ঘনবদ্ধ তার দাঁতগুলো, ঝলমল করে উঠলো প্রদীপের আলোয়। " তোমাকে ছুঁতে ইচ্ছে করছে এখন", বললাম আমি। চোখ তুললো সে, তাকালো প্রদীপ-শিখার দিকে; সেই দৃষ্টি আগুনে সেঁকা। পুড়ছে, মচমচে হচ্ছে, তার সমগ্র দেহের মতই; আগুনে সেঁকা তার বাহু দুটোর মতই, আর আমি অনুভব করলাম, এক কোণায়, চেয়ারে বসে, আমার এই যে দুলতে থাকা, সেটাই গভীরভাবে লক্ষ করছে, সে। বললো, " সে কথা তো কখনও বলোনি আমাকে"।
" এখন বলছি তোমাকে, আর, এটাই সত্য কথা ", বললাম আমি। প্রদীপের ওপাশ থেকেই, একটা সিগ্রেট চাইলো সে। আমার দু' আঙুলের ফাঁক থেকে নিঃশেষিত সিগ্রেটের মোথা খসে পড়লো। মনেই ছিলো না, এতোক্ষণ সিগ্রেট টানছিলাম আমি। " জানি না, কেন মনে করতে পারছি না, এই কথাটা, কোথায় লিখেছি আমি", সে বলে উঠলো।
আমি বললাম, " এই একই কারণে, কাল সকালে, কথাটা আর মনে রাখতে পারবো না আমি। "
" না, আমার মনে হয়, মাঝে মাঝে, স্বপ্নে আমি এটাও দেখি যে, তুমি আর স্মরণ করতে পারছো না কথাটা। " তার কণ্ঠস্বর বিষণ্ন শোনালো। আমি উঠে দাঁড়ালাম, এগিয়ে গেলাম প্রদীপটার দিকে। সে একটু দূরে ছিলো; আর আমি সিগ্রেট ও দেশলাই হাতে অব্যাহত রাখলাম তার দিকে হেঁটে চলা।
সিগ্রেট বাড়িয়ে ধরলাম তার উদ্দেশ্যে। সিগ্রেটটা সে তার দু'ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে দিয়ে চেপে ধরলো, আর আমার দেশলাই জ্বালানোর ফাঁকে আয়েশ করে হেলান দিলো, প্রদীপ-শিখা থেকে আরও খানিকটা পেছনে। " দুনিয়ার কিছু কিছু শহরে, সবগুলো দেয়াল জুড়ে এই লেখাটাই ফুটে উঠবে : ' নীল কুকুরের চোখদুটো'; যদি কাল সকালে, স্মরণ রাখতে পারি কথাটা, তোমাকে খুঁজে বের করতে পারবো", বললাম আমি। আবারও সে মাথাটা তুললো, এইবার তার ঠোঁট দুটোর ফাঁকে পুড়ন্ত এক খণ্ড কয়লা। একটা চোখ আধো বোঁজা করে, গালের পাশ দিয়ে সিগ্রেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে, আর বিড়বিড় করে বললো, যেন স্মরণ করার চেষ্টা করছে : 'নীল কুকুরের চোখদুটো'।
আঙুলের ফাঁকে ধরা সিগ্রেটে টান দিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো সে, " এটা এখন সম্পূর্ণ আলাদা একটা ব্যাপার। উষ্ণতা ফিরে পাচ্ছি আমি। " আর এই কথাগুলো সে বললো অনেকটা মৌমাছির গুঞ্জনের মত, যেন, বাস্তবে সে আদৌ বলেনি কথাগুলো, যেন এক টুকরো কাগজে লিখেছে আর মেলে ধরেছে প্রদীপ-শিখার ওপর, যেন আমি নিজেই পড়ছি সেই লেখাটা : 'উষ্ণতা ফিরে পাচ্ছি'। আর সে, তার বৃদ্ধাঙুলি ও তর্জনীর ফাঁকে ধরে রাখা কাগজের টুকরোটা প্রদীপ-শিখার ওপর ঘোরানো অব্যাহত রেখেছে, পুড়ে নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে ওটা, আর আমি পড়ছি, ".... ফিরে পাচ্ছি"। সম্পূর্ণ পুড়ে, আলো আর ছাই হয়ে মেঝেতে ঝরে পড়ে, রূপান্তরিত হবার আগেই , বললাম, " খুবই ভালো কথা।
তোমাকে এভাবে একটা প্রদীপের পাশে বসে থাকতে দেখে, কাঁপতে দেখে, মাঝে মাঝে ভয় হয়, আমার"।
প্রদীপের দিকে মুখ রেখে, তখনও দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ তার দিকে নজর পড়তেই দেখলাম, পর পর দুটো টান দিলো সে, সিগ্রেটে। তার আগাপাশতলায় নজর বুলিয়ে, পরখ করলাম, তখনও তাকে একটা তামার মূর্তিই মনে হচ্ছিলো; কঠিন ও ঠাণ্ডা কোনও ধাতবতা নয়, বরং হরিদ্রাবর্ণ, কোমল আর ঘাতসহ ধাতু-নির্মিতই লাগছিলো তাকে। আবারও বললাম, " তোমাকে স্পর্শ করতে চাই আমি"। "সব কিছু ধ্বংস করতে চাইছো তুমি", জবাব দিলো সে।
বললাম, "এই পর্যায়ে, সেটা আর কোনও ব্যাপারই নয়। আমাদের যা কিছু করতে হবে, তা হলো, শুধু ওই বালিশটা ঠিকঠাক মত উল্টে-পাল্টে আবারও বসাতে হবে বিছানায়, যেন মিলিত হতে পারি আমরা"। বলেই, হাতটা বাড়িয়ে দিলাম প্রদীপের দিকে। কোনও নড়াচড়ার আভাসমাত্র লক্ষ করা গেল না তার ভাব-ভঙ্গিমায়। তাকে স্পর্শ করার আগেই, আবারও বললো, সে, " সব কিছু শেষ করবে তুমি।
যদি প্রদীপের এপাশে চলে আসো তুমি, হয়তো, আমরা এক আতঙ্কের মধ্যে জেগে উঠবো, কে জানে, এই দুনিয়ার নাম না জানা কোনও এক অচেনা ভূখণ্ডের ভেতরে"। তবু আমি পীড়াপীড়ি করতে লাগলাম, " কোনও ব্যাপারই নয় সেটা"। এবং সে বললো, " যদি আমরা বালিশটা উল্টিয়ে ঠিকঠাক করি, আমরা হয়তো, আবারও মিলিত হতে পারবো, কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙতেই সব কিছু ভুলে যাবে তুমি"। আমি ঘরের সেই কোণাটার দিকে সরে আসতে লাগলাম। পেছনে থেকে গেল সে, প্রদীপ-শিখায় গরম করতে থাকলো তার দীর্ঘ ঋজু হাত আর বাহুদুটি।
তখনও, চেয়ার পর্যন্ত পৌঁছতে পারিনি, শুনতে পেলাম, আমার পেছন দিক থেকে, সে বলছে, " যখন মধ্যরাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়, আর বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে থাকি, বালিশটা গুঁজে দিই আমার দুই হাঁদুর চিপায়, পা দুটো জ্বালা করে আমার, আর ভোর না হওয়া অব্দি, বারবার, আমি বলতে থাকি: 'নীল কুকুরের চোখদুটি'।
তখন দেয়ালের দিকে মুখ ফেরানো আমার। " এরই মধ্যে, ভোর হতে শুরু করেছে। " ওর দিকে না তাকিয়েই বললাম," যখন ভোরের আলো এসে পড়বে আমাদের দুজনেরই চোখে, জেগে উঠবো আমরা, ততক্ষণে পেরিয়ে যাবে বেশ কিছু কাল"। তারপর, দরোজার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি।
দরোজার নবে হাত রেখে, নবটা ঘোরাতেই, আবারও তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, সেই একই নির্বিকার ও অপরিবর্তনীয় সুর। " দরোজাটা খুলো না, " সে বলে উঠলো, " হলরুমের প্যাসেজ ভরা জটিল সব স্বপ্ন"। " কীভাবে জানলে তুমি?" প্রশ্ন করলাম। আর সে জবাব দিলো, "কারণ এক মুহূর্ত আগেই ওখানে ছিলাম আমি, এবং যখন আবিষ্কার করলাম, আমি আসলে আমার হৃৎপিণ্ডের গভীরে নিদ্রারত, তখন ফিরে আসতে বাধ্য হলাম"। অর্ধেক খুলে ফেলেছিলাম দরোজাটা।
আরও একটু ফাঁক করলাম, আর অম্নি, ঠাণ্ডা মিহিন এক ঝটকা বাতাস, বয়ে আনলো সব্জিক্ষেত, খোলা মাঠ ও জলাভূমির টাটকা ঘ্রাণ। আবারও একই কথা বললো সে। দরোজাটা টেনে বন্ধ করলাম, যতক্ষণ না পাহাড় নীরবতায় জমাট বাঁধে কক্ষের স্তব্ধতা, তারপর বললাম, " আমার মনে হয় না, বাইরে কোনও হলরুম বা করিডোর আছে; গ্রামাঞ্চলের টাটকা ঘ্রাণ পাচ্ছি আমি"। এবং তখন, সে, একটু দূরেই দাঁড়ানো, বললো, " সেটা তোমারও চেয়ে অনেক ভালো করেই জানি আমি, কিন্তু ঘটনা হলো এই যে, বাইরে এক নারী আছে, গ্রামাঞ্চলের স্বপ্নে বিভোর। প্রদীপ-শিখার ওপর তার হাত দুটি আড়াআড়ি মেলে ধরলো সে, চালিয়ে যেতে লাগলো কথা, " এ হলো সেই মেয়ে লোকটা, যে সব সময়ই পল্লী এলাকার স্বপ্ন দেখতো অথচ কোনও দিনও শহর ছেড়ে যেতে পারেনি"।
আমার স্মরণ হতে লাগলো, এর আগে কোনও এক স্বপ্নের মধ্যে, নিশ্চয়, আমি দেখে থাকবো, মেয়েটিকে। কিন্তু আধোখোলা এই দরোজার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো, আমি জানি, আর আধা ঘন্টার মধ্যেই আমাকে জেগে উঠতে হবে, সকালের নাস্তা তৈরি করবার জন্য। এবং বলরাম, " সে যা কিছুই হোক না কেন, জেগে ওঠার জন্য এই জায়গাটা একটু পর ছাড়তেই হবে আমাকে"।
জানালার বাইরে একটানা কোনও এক পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ হতে লাগলো, তারপর সব নীরব, স্তব্ধ হয়ে পড়লো, আর কোনও একজনের শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ শোনা গেল, যে কিনা এই মাত্র বিছানায় পাশ ফিরছে। মাঠের দিক থেকে উড়ে আসা বাতাস, থেমে গেছে।
আর কোনও ঘ্রাণও আসছে না। " ওটা দিয়েই কাল তোমাকে চিনে নেবো ," আমি বলে উঠলাম, "যখন দেখবো রাস্তার পাশে, একটা মেয়ে, দেয়ালে দেয়ালে লিখছে : 'নীল কুকুরের চোখদুটো', আমি চিনে নেবো তোমায়"। একটা বিষণ্ণ হাসি দিয়ে___ যে হাসি ইতোমধ্যেই হয়ে উঠেছে অসম্ভবের দুয়ারে আত্মসমর্পণের হাসি___অধরার পায়ে লুটিয়ে পড়ার হাসি__ সে বললো,
" এখনও, দিনের বেলায় আর কিছুই স্মরণ করতে পারবে না তুমি"।
তারপর, সে তার করতলদ্বয় রাখলো প্রদীপ-শিখার ওপর, যেন ঘন মেঘে ঢেকে গেল তার সমস্ত অবয়ব আর দৃশ্যমানতা।
"তুমিই সেই একমাত্র মানুষ, যে, স্বপ্নে যা কিছু দ্যাখে, যখন সে জেগে ওঠে, আর স্মরণ করতে পারে না কিছুই"।
-----------------
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।