শিক্ষা গ্রহনের চেষ্টা চলছে বিশ্ববাজারে একসময় বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত দ্রব্যের একক আধিপত্য ছিল। দেশের রফতানি আয়ের বড় খাত ছিল এটি। মাঝে এর অবস্থা সঙ্গীন হলেও সম্প্রতি কৃষকরা পাট চাষে আগ্রহী হয়েছেন। এতে পাটের নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনাও হচ্ছে।
তবে কয়েক দিন ধরে পাট নিয়ে যে সংবাদগুলো দেখা যায়, তার কোনোটাই কৃষকের অনুকূল নয়— কৃষকের উত্পাদন খরচের তুলনায় পাটের বাজারদর প্রায় অর্ধেক। কৃষকরা বলছেন, পাটের বর্তমান দাম কমার কারণ সরকারি মিলগুলো তাদের পাট কিনছে না। আর সরকার বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের দাম কমে গেছে।
পাটকে বলা হয় সোনালি আঁশ। এ সোনালি আঁশের গৌরবময় অতীত রয়েছে।
১৮৩১ সালে ইংল্যান্ডের ডান্ডিকে কেন্দ্র করে ভারতীয় উপমহাদেশে পাটশিল্প গড়ে ওঠে। এ দেশে ১৮৫৫ সালে প্রথম পাটকল প্রতিষ্ঠা হয়। দিন দিন পাটের চাহিদা বাড়তে থাকে। ১৯৩৮-৩৯ সাল পর্যন্ত বাংলায় পাটকলের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১০-এ। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের প্রচুর চাহিদা সৃষ্টি হয়।
পাটের দামও অনেক চড়া হয়। চাষীরা ব্যাপকভাবে পাট চাষ করতে থাকেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় অনেক পাটকলই পশ্চিমবঙ্গের ভাগে পড়ে। অন্যদিকে প্রধান পাট উত্পাদনকারী জেলাগুলো পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে। ফলে দ্রুতই পূর্ব পাকিস্তানে পাটকল স্থাপিত হয়।
তখন বিশ্ববাজারের ৮০ শতাংশ পাট বাংলাদেশ থেকেই রফতানি হতো। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭২-৭৭ সাল পর্যন্ত মোট রফতানি আয়ের ৯০ শতাংশ আসতো পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে। পাটকলগুলোকে জাতীয়করণ করে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) আওতাধীন করা হয়। সে সময় ৭৩টি পাটকল থেকে বেড়ে হয় ৭৮-এ। আর মোট তাঁত ছিল ৩৪ হাজার ৮৩৬টি।
বর্তমানে এ সংখ্যা কমে হয়েছে ২২। অর্থাত্ এর মধ্যে ৫৬টি পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় আদমজী জুট মিল বন্ধ হয়েছে ২০০২ সালে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা এ তিন জোনে বর্তমানে বেশির ভাগ পাটকল অবস্থিত। সারা বিশ্বে বর্তমানে পাটের চাহিদা ৫০ লাখ টন।
১৯৯০ সালে এর চাহিদা ছিল ৩০ লাখ টন। তখন বাংলাদেশ ১৪ লাখ টন পাট রফতানি করত। বর্তমানে চাহিদা বাড়লেও বাংলাদেশের রফতানি কমেছে। ভারত বর্তমানে পাট উত্পাদনে শীর্ষ দেশ। ২০০৮ সালের তথ্যানুযায়ী, তাদের পাট উত্পাদন বছরে প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ টন।
একই সময়ে বাংলাদেশের উত্পাদন সাড়ে ৮ লাখ টন। ভারতে বর্তমানে পাটকলের সংখ্যা ৭৮। তারা এখন সবচেয়ে বেশি পাটও রফতানি করে। ভারতে পাট রফতানির আয় গোটা অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আমাদের পাটের বর্তমান অবস্থার জন্য বিশ্বব্যাংককে দায়ী করা হয়।
তাদের পরামর্শে এ শিল্পের সংকটাবস্থা থাকতেও সরকার এর ওপর থেকে ভর্তুকি তুলে নেয়। বিপরীতে একে বিরাষ্ট্রীকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়। শুরু হয় এ শিল্পে ধস। ১৯৮২ সালে প্রথম দফায় ৩৫টি এবং এর পরে আরও ২৪টি পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়। সরকারকে পাট খাত থেকে ফিরিয়ে নেয় বিশ্বব্যাংক।
বিশ্বব্যাংকের একমুখী কৃষিব্যবস্থা চালু করে সরকার। সরকারের কাছে পাট অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে পাট কেনেনি। কৃষকরা পাট চাষে অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন। লোকসানের কারণ দেখিয়ে বন্ধ করা হয় পাটকলগুলো।
এদিকে ভারত আন্তর্জাতিক পাটের বাজার দখল করে ফেলে তখন।
১৯৯৬ সালের আগস্টে বিশ্বব্যাংক পাঁচটি পাটকল বন্ধ, একটি সংকুচিত এবং ২ হাজার ৭০০টি তাঁত বন্ধের জন্য সরকারকে চাপ দেয়।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির চাপে ২০০২ সালের ৩০ জুন বিশ্বের বৃহত্তম পাটকল আদমজী বন্ধ করে দেয় সরকার। পাট খাতে বিশ্বব্যাংকের পলিসি অনুসরণ এবং এ শিল্পের প্রতি মনোযোগ না দেয়ায় (আরও অন্যান্য সমস্যা রয়েছে বটে) বিজেএমসির জমে থাকা লোকসান ও দেনার পরিমাণ ১৯৯৮ সাল নাগাদ দাঁড়ায় যথাক্রমে ২৮ বিলিয়ন ও ১১ মিলিয়ন টাকা বেশি।
সম্প্রতি ভালো খবর হলো, ২০১১-১২ অর্থবছরে হালনাগাদ দৈনিক পাট উত্পাদনের পরিমাণ ১৪৭ টন বেড়েছে।
বর্তমানে দৈনিক মোট উত্পাদন ৭০০ টন। ৩০ বছর পর প্রথম এ খাতে নিট লাভ ১৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকায় পৌঁছেছে— বলছে বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ)। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ২২ নভেম্বর ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশে কাঁচা পাট রফতানি করা যাবে না বলে সার্কুলার দেয় পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়। অথচ ব্রিটিশ আমলেও এভাবে কাঁচা পাট রফতানির নির্দেশনা দেয়া হয়নি। পাট রফতানিকারক বা এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কেউই ভারতে কাঁচা পাট রফতানির সুযোগ দেয়ার জন্য দাবি বা আবেদন করেনি।
এ সুযোগে ভারতে কাঁচা পাট চোরাই পথে পাচার হতে পারে। এতে অর্থনৈতিকভাবে দেশ চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাটের আন্তর্জাতিক বাজার এমনিতেই ভারতের দখলে, এতে তাদের আধিপত্য আরও বেড়ে যাবে। দেশের যে কয়েকটি জুট মিল আছে, তাও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে।
আমাদের পাটের বাজার বহির্বিশ্বের ওপর নির্ভরশীল।
ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের দাম কমলে কিংবা চাহিদা কমলে কৃষকরা টাকা পান না বা তার উত্পাদন খরচও ওঠাতে পারেন না। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বণিক বার্তার কিছু সংবাদ ছিল, এবার পাটের উত্পাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে। কারণ কৃষকরা ভালো দাম পাচ্ছেন। হঠাত্ এ রকম দাম পড়ে যাওয়া তাদের জন্য এবং অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। এতে কৃষক উত্সাহ হারাবেন, পরবর্তী সময়ে উত্পাদন কমিয়ে দেবেন।
এখন সরকারের কাজ হবে বিষয়টা বিবেচনার সঙ্গে নেয়া। গেল বছর জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কারের পর পাট নিয়ে ব্যাপক তোড়জোড় আমরা লক্ষ্য করেছি। ২০১০ সালের ১৭ জুন পাটজাত দ্রব্য ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন করে সরকার। এ ক্ষেত্রে ভারত প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তারা নিজেদের বাজারে পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা বাড়িয়েছে।
ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে সংকট হলেও নিজেদের বাজার দিয়েই তা মোকাবেলা করছে। পাটশিল্পের সংকট মোকাবেলায় এর বহুমুখী ব্যবহারে গবেষণা, নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং বিদেশে পাটের নতুন বাজার খোঁজা গুরুত্বপূর্ণ। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষকের আস্থা অর্জন। এ জন্য কৃষককে ন্যায্য মূল্যের নিশ্চয়তা দিতে হবে। সরকারকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।