৪০ বছর দীর্ঘ সময়। ৪০ বছর আগে আমার জীবনে যেসব ঘটনা ঘটেছিল, তার বেশির ভাগ স্মৃতিই আমার কাছে ঝাপসা হয়ে গেছে। কিন্তু ঠিক কী কারণে, তা জানা নেই। বিজয় দিবসের প্রতিটি মুহূর্তের ঘটনা আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে, মনে হয় মাত্র সেদিনের ঘটনা। মাঝেমধ্যেই আমার মনে হয়, আমাদের প্রজন্ম একই সঙ্গে এই পৃথিবীর সবচেয়ে হতভাগ্য এবং সবচেয়ে সৌভাগ্যবান।
আমরা হতভাগ্য; কারণ, মানুষ কত নৃশংস হতে পারে, কত অবিশ্বাস্য নির্লিপ্ততায় আরেকজনকে হত্যা করতে পারে, কত সহজে দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে বিদেশি প্রভুর পদলেহন করতে পারে, পৃথিবীর সেই সবচেয়ে কুশ্রী রূপটি আমাদের নিজের চোখে দেখতে হয়েছিল। আবার আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান প্রজন্ম। কারণ, ভয়ংকর দুঃসময়ে মানুষ কীভাবে একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে বুক আগলে রক্ষা করে, দেশকে স্বাধীন করার জন্য কীভাবে অকাতরে নিজের প্রাণ দিতে পারে, সেই অভূতপূর্ব দৃশ্যগুলোও আমাদের হূদয় দিয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, নয় মাসের অবিশ্বাস্য সেই পাকিস্তানি বিভীষিকার পর একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর যখন উচ্চকণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি প্রথমবার উচ্চারিত হতে শুনেছিলাম, সেই মুহূর্তটুকুর তীব্র আনন্দ এই দেশের অন্য কোনো প্রজন্ম অন্য কোনো কালে অনুভব করবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। সদ্য মুক্ত হওয়া দেশটি কোনো বিমূর্ত বিষয় ছিল না, আমাদের কাছে সেই দেশটি ছিল ধরা যায়, ছোঁয়া যায়, বুক আগলে রক্ষা করা যায়, ভালোবাসা যায় সে রকম একটি শিশুর মতো, যাকে আমরা হিংস্র একটা পশুর মুখ থেকে রক্ষা করে এনেছি।
নিজের দেশের জন্য সেই তীব্র গভীর ভালোবাসা যারা অনুভব করতে পারে, তাদের চেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান আর কে হতে পারে?
তারপর কত দিন পার হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, সেনাশাসক এসেছে, রাজাকারেরা গর্ত থেকে বের হয়েছে। দেশ অন্ধকারে ঢুকে গেছে; সেই অন্ধকারে প্রজন্মের পর প্রজন্ম জন্ম নিয়েছে। তাদের বোঝানো হয়েছে, একাত্তরে এই দেশে ‘গন্ডগোল’ হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধ আসলে বড় কিছু নয়, যুদ্ধ হয়েছিল হিন্দুস্তান আর পাকিস্তানে। জাতীয় পতাকা এক টুকরা কাপড়, দেশ বলে কিছু নেই, ক্রিকেট খেলোয়াড় দিয়ে দেশের পরিচয়, মুখে পাকিস্তানের পতাকা আঁকা যায়, জাতীয় সংগীত না জানলে ক্ষতি নেই, মেয়েদের বোরকা পরে থাকাই ভালো।
অতীতকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা ঠিক না, রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা ভাই ভাই—আরও কত কী! সেই কালো অন্ধকার সময়ে জন্ম নেওয়া প্রজন্মের পর প্রজন্মের নির্লিপ্ত বোধশক্তিহীন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমাদের খুব সৌভাগ্য, তার মধ্যেও দেশের জন্য গভীর মমতা নিয়ে নতুন তরুণ প্রজন্মের জন্ম হয়েছে। আমি অবাক হয়ে দেখি, তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধকে হূদয় দিয়ে অনুভব করতে পারে। এই দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দেশকে গ্লানিমুক্ত করার আন্দোলনে এখন তারা সবচেয়ে বড় শক্তি।
যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে আলাপ-আলোচনার শেষ নেই। যে কথাটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়, ‘আন্তর্জাতিক মানের বিচার’, আমি সেই কথাটিই বুঝতে পারি না।
বিচারের কি দেশীয় মান এবং আন্তর্জাতিক মান বলে কিছু আছে? পৃথিবীর অনেক দেশে মৃত্যুদণ্ড নেই, অনেক দেশে চুরি করলে হাত কেটে ফেলে—তার কোনটি আন্তর্জাতিক? দেশীয় মান কি আন্তর্জাতিক মান থেকে আলাদা? আমাদের দেশে এত দিন যে বিচার হয়েছে, সেগুলো কি সব ভুল, নাকি আন্তর্জাতিক কোনো মাতবরদের এনে তাদের সার্টিফিকেট নিতে হবে? সবচেয়ে বড় কথা, এই আন্তর্জাতিক মান সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য সেই মোড়ল-মাতবরেরা কোন দেশে থাকেন? সার্টিফিকেট দেওয়ার ক্ষমতাটা তাঁদের কে দিল?
বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়েছিল যে যুদ্ধাপরাধীদের এই বিচার তারা মানে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে যে কোনো দল বা কোনো মানুষ আর টিকে থাকতে পারবে না, বিএনপি এই সহজ সত্যটা এখনো জানে না দেখে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। বিএনপি খানিকটা টের পেয়েছে; দ্রুত তাদের কথা ফিরিয়ে নিয়ে বলছে, যুদ্ধাপরাধীর বিচার তারা মানে কিন্তু সেটি হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। এই দেশের আর কোন কোন দেশি বিষয় আন্তর্জাতিক মানের হওয়া উচিত, আমি সেটা জানতে খুব কৌতূহলী।
আন্তর্জাতিক মানের বিচারের কথা শুনে আমার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সেক্টর কমান্ডারদের একটি মানববন্ধনে আমি গিয়েছি, সেখানে একজন হঠাৎ আমাকে একটা কঠিন প্রশ্ন করে বসলেন। তিনি উত্তেজিত গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই রাজাকারের দল একাত্তরে যখন আমার বাবাকে মেরেছিল, তখন কি তারা আন্তর্জাতিক আইনে তাঁকে মেরেছিল? তাহলে এখন কেন তাদের আন্তর্জাতিক আইনে বিচার করতে হবে?’
আমি তাঁর প্রশ্নের উত্তরে কিছু একটা বলতে পারতাম, কিন্তু তাঁর অশ্রুরুদ্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারিনি। এই মানুষটির মতো এই দেশের অসংখ্য মানুষের বুকে ধিকিধিকি করে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার শেষ করে কখন আমরা তাদের বুকে একটুখানি শান্তি দিতে পারব?
১৫.১২.১১
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।