আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব-কে দেখি নি এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে উনার জনপ্রিয়তা কি রকম ছিলো সেটাও আমি দেখি নি বা দেখলেও তা ঐ বয়সে তেমন মনে থাকার কথা না। পরে বড়-দের মুখে শুনেছি যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে শেখ মুজিব বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ মানুষের চোখের মনি ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে উনার বন্দী থাকার দিন গুলো-তে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অনেক মা-ই পাকিস্তানী-দের হাতে বঙ্গবন্ধুর নিরাপদ থাকা এবং নিরাপদ ভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার জন্য নফল রোজা রাখতেন, নফল নামাজ পড়তেন, দান খয়রাত করতেন। এ থেকেই বোঝা যায় যে, স্বাধীনতার আগে শেখ মুজিব কি অসম্ভব রকম জনপ্রিয় ছিলেন বাংলাদেশের সাধারন মানুষের কাছে এবং সাধারন মানুষ উনাকে কি পরিমান ভালোবাসতো।
জিয়াউর রহমানের ছবি প্রথম দেখেছিলাম আমাদের আর্মী-দের প্রকাশিত একটা ম্যাগাজিনে; সাদা কালো ছবির ম্যগাজিনের নাম-টা এখনো মনে আছেঃ গাঢ় সবুজ রং-এর শক্ত মলাটের উপর টকটকে লাল কালিতে লেখা ’হও আগুয়ান’।
সাদা-কালো প্রিন্টের সেই ম্যাগাজিনে মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার-দের বড় করে ছবি (এক পৃষ্ঠায় চার জন-এর ছবি) এবং নাম ছিলো। মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর মঞ্জুর, মেজর রফিকুল ইসলাম- এই রকম ছবি এবং নামের পাশেই ছিলো মেজর জিয়াউর রহমানের ছবি এবং নাম- কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছাড়াই।
আমার সেই হাফ প্যান্ট পরা বয়সে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে আমি তিন-টা সাধারন বিষয় প্রত্যক্ষ করেছি যা স্পষ্ট ভাবে আজও আমার মনে আছেঃ
১. বঙ্গবন্ধু-কে হত্যা করার পর সর্ব সাধারনের সতঃস্ফূর্ত উল্লাস।
২. সর্ব সাধারনের মাঝে জিয়াউর রহমানের অসম্ভব জনপ্রিয়তা। এবং
৩. জিয়াউর রহমানের শবযাত্রায় অভূতঃপূর্ব মানুষের ঢল।
যে বয়সে আমি বিষয় গুলো প্রত্যক্ষ করেছি, সেই বয়সে রাজনীতি বোঝা-তো দূরের কথা, বাসায় খাবার-দাবার যে কোথা থেকে আসে- সেটাও চিন্তা করার কথা না। বঙ্গবন্ধু-কে সপরিবারে হত্যা করার পর আমি আমার ঐ বয়সে শুধু একজন মানুষ-কেই দুঃখিত হতে এবং চোখের পানি ফেলতে দেখেছি- তিনি হচ্ছেন আমার মা। তবে সেই কান্না-টা রাজনৈতিক কান্না ছিলো না, উনি কেঁদেছেন মানবিক কারনে, শুধু এই কথা বলে- ”একটা মানুষ-কে এই ভাবে গুষ্ঠি শুদ্ধ কি ভাবে মেরে ফেললো!” আমাদের বাসায় টাংগানো বঙ্গবন্ধুর মুজিব কোট পরা সেই সাদা-কালো বিখ্যাত ছবিটার (যা এখনো আছে) সামনে গিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে দেখেছি আমার মা-কে।
সামান্য একটু বড় হওয়ার পর (টিন এজ) আমার মনের এই সব স্মৃতি এবং বড়-দের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলো গুলো আমাকে বেশ গোলক-ধাঁধায় ফেলেছে এবং দুই-টা প্রশ্ন আমাকে বার বার তাড়া করছিলোঃ
১. এতো অসীম জনপ্রিয় একজন মানুষ (বঙ্গবন্ধু) কি কারনে দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র চার বছরের মাথায় জনগনের কাছে এতো অজনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন যে, সাধারন মানুষ উনার সপরিবারে নিহত হওয়ার খবর শুনে রাস্তায় নেমে উল্লাস করেছে! কি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু এই চার বছর যা দেশের সাধারন মানুষ-কে উনার সম্পর্কে এতো-টা বিপরীতমুখী অবস্থানে নিয়ে গেছে!
২. কি কারনে এবং কি ভাবে একজন সাধারন মেজর (কিছুটা পরিচিত কালুরঘাট বেতার থেকে স্বাধীনতার ঘোষনা দেওয়ার জন্য) মাত্র বছর দুয়েকের মধ্যে দেশের মানুষের কাছে এতো অভাবনীয় রকম জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন! প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর কেনো লক্ষ লক্ষ মানুষ উনার শবযাত্রায় এসেছিলেন?
এই দুই টা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই আমাকে এই ব্যপারে পড়াশোনা করতে হয়েছে অনেক, স্মৃতি-কথা শুনতে হয়েছে অনেক মানুষের মুখ থেকে এবং শেষ পর্যন্ত এটুকু বুঝেছি যে, জনগন, ক্ষমতা, দেশপ্রেম, সততা এবং প্রাজ্ঞতা-র সংমিশ্রনে দেশ শাসন করতে পারলে খুব অল্প সময়ে একজন সাধারন মানুষও সফল এবং জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক হতে পারেন। আর এই গুলোর অভাব থাকলে এমন কি অত্যন্ত অভিজ্ঞ, জনপ্রিয় এবং বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা-ও খুব দ্রুত ব্যর্থতার পঙ্কিল গহ্বরে নিজেকে এবং দেশ-কে নিয়ে যেতে পারেন; এমন কি মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই সেই রাষ্ট্রনায়কের জনপ্রিয়তার মাপ-কাঁটা আকাশ থেকে শুধু মাটিতে না- একেবারে মাটির গভীরে চলে যেতে পারে।
আজ আমরা শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমান-কে নিয়ে অনেক কথা বলি। একজন-কে দেশপ্রেমিক বলে আরেক জন-কে দেশদ্রোহী বলে গলা ফাটাই। কিন্তু দেশের সাধারন মানুষের চেতনার সাথে এই সব হাইপোথিটিক্যাল তর্ক-বিতর্কের তেমন কোন যোগাযোগই নেই। সাধারন মানুষ হচ্ছে সাধারন, তাই তাদের স্মৃতি-তে শেখ মুজিব এবং জিয়াউর রহমানের সময়ের যে সব ঘটনা প্রবাহ মনে আছে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে যে সব ছবি এবং তথ্য স্বাক্ষী হয়ে থেকে যাবে, সেগুলোর উপরই আগামী প্রজন্ম এবং ইতিহাসের কাছে মূল্যায়িত হবেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমান।
আইন করে সব যায়গায় ছবি টাঙ্গিয়ে, পয়সায় ছবি খোদাই করে বা নাম ফলক মুছে ফেলেই যদি ইতিহাসে কাউকে প্রতিষ্ঠিত বা ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যেতো- তাহলে মানব সভ্যতার ইতিহাসে ’ইতিহাস’ বলে কিছু থাকতো না।
এই রকম ব্যর্থ চেষ্টা ইতিহাসে আরো অনেকেই করেছেন কিন্তু কোন লাভ হয় নি; ইতিহাস চলেছে ইতিহাসের নিজের গতি-তে। কাজেই, মান্না দে’র সেই বিখ্যাত গান-এর কথায় বলতে হয়-
’যদি কাগজে লিখ নাম- কাগজ ছিঁড়ে যাবে
পাথরে লিখ নাম- পাথর ক্ষয়ে যাবে
হৃদয়ে লিখ নাম- সে নাম রয়ে যাবে। ’
মুজিব এবং জিয়া তাঁদের নাম দেশের মানুষের মনে যে ভাবে লিখে গেছেন, তাঁরা সেভাবেই মূল্যায়িত হবেন যুগের পর যুগ এবং হয়তো শতাব্দির পর শতাব্দি; বাকি সব ক্ষয়ে যাবে, ছিঁড়ে যাবে, ঝরে যাবে, মুছে যাবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।