আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকারঃ আমি যেভাবে আহত হলাম

আমি বিজয় নিয়ে তবেই বাড়ি ফিরব মা... ১৯৭১ সালের ২০শে নভেম্বর, এলন্দরী অপারেশন ক্যাম্পে ৯৪ এনার্গ একটি গোলা বিস্ফোরিত হলো দুর্ঘটনায়। নিভিয়ে দিল তিন তিনটি মুক্তি পাগল, বাংলার সুর্য্য সন্তানের জীবনের আলো। আহত হলাম আমি সহ আরও কয়েকজন। আত্মীয় স্বজনের রোনাজারী পুত্রহারা পিতা-মাতার করুণ আর্তনাদ, ভারী করে তুলছিল ক্যাম্পের আকাশ-বাতাস। প্রায় ঘন্টা দুয়েক আগে, বিশ্বস্ত সূত্রে সংবাদ পেলাম, মেজর নাসির স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনা করে বেশার মাষ্টার সাহেবের অপারেশন ক্যাম্প নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে বড়গ্রাম বিওপি পর্যন্ত পৌঁছাবে, আগামীকাল সকাল ১০টায়।

মাষ্টার বেসার উদ্দিন আহম্মদ বড়গ্রাম ক্যম্পের ইনচার্জ। সুতরাং তাঁর নির্দেশ মতেই ২৫শে অক্টোবর ভোর ৫টায় আব্দুল ওয়াহেদ ও দক্ষ ১১ যোদ্ধা সহ মোট ২৪ জনের একটি দল নিয়ে, আমরা ছাইতন কুড়ি গ্রামে পজিশন নিলাম। সামরিক সদস্য আব্দুল ওয়াহেদ সাহেবের নেতৃত্বে ৪টা এল,এম,জি সহ সম সংখ্যক সদস্য দিয়ে স্কুলের পূর্ব পার্শে বাঁশ আড়ায় তার পজিশন দেওয়া হলো। আমি নিজে সাহাব উদ্দীন সহ স্কুলে পজিশন নিলাম। সঙ্গে একটা এল,এম,জি।

সকাল ৯টায় প্রথম ট্রাক এর আওয়াজ শোনাগেল বড়গ্রাম এলাকায়। ২টা ট্রাকে জনা পঞ্চাশের পাক বর্বর সেনা ও একটি জীপে মেজর নাসির বড়গ্রাম পুকুরপাড়ে এসে সমবেত হলো। মাঝখানে ১০০০ গজ সবুজ ধানক্ষেত। পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিলাম বর্বর সেনাদের কার্য্যকেলাপ। মেজর সাহেব ছোট একটি ব্রিফিং দেওয়ার সাথে-সাথে ১৫/১৬ জন সেনা আইলের রাস্তা দিয়ে বেশার সাহেবের পাড়ার দিকে রওনা হলো।

স্কুল ঘরে আমার পজিশন। রুদ্ধ শ্বাসে অপেক্ষা করছি। চলতে চলতে বর্বরেরা এস,এম,জির একটি পূরো ম্যাগাজিন ফায়ার করলো স্কুল ঘরের জানালা গুলোতে। উদ্দেশ্য স্কুল ঘরে কেউ থাকতে পারে। আমি কোন প্রতি উত্তর দিলামনা।

ওরা বুঝুক, স্কুল ঘরে কেউ নেই। হঠাৎ একটা সমস্যা দেখা দিল। শত্রু পক্ষ দুই ভাগে ভাগ হয়ে, একদল স্কুল ঘরের দিকে, অপর দল বেশার সাহেবের বাড়ির দিকে রওনা হলো। আমি টার্গেট স্থির করতে দ্বিধাদ্বন্দে পড়েগেলাম। যেহেতু ওয়াহেদ একজন সামরিক সদস্য পরবর্তী সিদ্ধান্ত তারই উপর ছেড়ে দিলাম।

আমি স্কুলের এডভান্স দলটিকে টার্গেট নিলাম। সময় এতক্ষণ লাগেনী। পাক বর্বর দলটি আমার দুইশত গজ দূরে থমকে দাঁড়ালো, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত দলটিতে রকেট লাঞ্চার ৯৪ এনার্গা ছিল। ভাবলাম ওর এক্ষুনি একটা গোলায় আমাকে সমেত স্কুল ঘরটি উড়িয়ে দিবে। ওরা ধরেই নিয়েছিল স্কুল ঘরে কেউ নেই।

তাই তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে এনার্গেয়ে চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল আমার আমার এল,এম,জি। একঝাক গুলি দন্ডয়মান ৮জন বর্বর সেনাকে শুয়ে দিল মাটিতে। এনার্গার গোলাটি চোঁ করে আকেশের দিকে উড়েগেল। ওয়াহেদ ওস্তাদের চার চারটি এল,এমজি পরবর্তী দলটিকে ধরাশায়ী করল।

ইতিবৎসরে আমি আমরা স্কুলের পজিশন ছেড়ে, মাটিয়া লাইব্রেরী ঘরটার স্তুপাকুত উঁচা মাটির ঢিবির আড়ালে পজিশন নিয়েছ। মেজর নাসির বড়গ্রাম উঁচা পুকুর পাড় থেকে, আমাদের যুদ্ধের মহড়া প্রতক্ষ করছিল। আমার পরবর্তী টার্গেট মেজর নাসির ও সেনারা। পরপর ৪টি ম্যাগাজিন আমি বড়গ্রাম পুকুর পাড়ের উদ্দেশ্যে খালি করলাম। পরে অবশ্য জানতে পারি ঐ অপারেশনে ১১ জন খান সেনা নিহত হয়।

মেজর নাসিরের উরুতে গুলি লাগে। নিহত লাশ ও আহতদের সংগ্রহ করতে খান সেনাদের সন্ধ্যা পর্যন্ত লুটোপুটি খেতে হয়েছিল বড়গ্রাম এলাকায়। ২০শে নভেম্বর ১৯৭১ সালে যে রোকেট লাঞ্চার ৯৪ এনার্গা গোলাটি দুর্ঘটনায় পতিত হয় এলোন্দরী ক্যাম্পে, আমি সহ আহত হই আরও ৩/৪ জন। এই সেই গোলা, যা ২৫ শে অক্টোবর ছাইতনকুড়ি (বেশার মাষ্টার পাড়া) স্কুলে খান সেনারা আমাকে মারতেযেয়ে আকাশের দিকে উড়ে গিয়েছিল। এক কৃষান ধান কাটতে যেয়ে কাদা থেকে কলার মোচার মত সবুজ গোলাটি ক্যাম্পে এনে জমা দেয়।

আমি তা ডিফিউজ করে ইব্রাহীম নামে এক মুক্তিযোদ্ধার হাতে দেই অস্ত্রাগারে রাখার জন্য। ছেলেটি মোটামুটি জেদী কিন্তু উৎসাহি ছিল। আমি তাকে রি-এসেমব্যান্ড করতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু সে করলো তাই। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘটলো বিস্ফোরণ।

গোটা ক্যাম্পটা আলোক উজ্জ্বল, কানে তালি দেয়া এক বিকট আওয়াজ। আমরা ৩/৪ জন অস্ত্রাগারের পার্শ্বে চেয়ারে বসা ছিলাম, কিন্তু নিজেকে যখন আবিস্কার করলাম, তখন আমার পাগুলো স্তুপাকৃত টিনের উপর, মাথাটা নেচে ঝুলানো। গাঁয়ের বিভিন্ন জায়গাদিয়ে রক্ত ঝরছে। আস্তে আস্তে নেমে এলাম। একটা কুট গন্ধ।

গোটা ক্যাম্পটা ধোঁয়ায় অন্ধকার। যত্র-তত্র মানুষ পড়ে আছে। প্রথমে গিয়ে ঢুকলাম অস্ত্রাগারে, সেখানে ইব্রাহীম নাই। তার পা দুটো মাথার সাথে সংযোগ রক্ষা করছে, শকুনে খাওয়া গরুর শিরদাড় হাড়গুলোর মত। বের হয়ে পার্শ্বের তাবুতে ঢুকলাম, মফিজ নামাজ পড়ছিল।

তার গলাটা জবাই করা গরুর ম কাটা। ডান পার্শ্বের বাহুটা অর্ধেক ধসেগেছে। মুখে উচ্চারিত হচ্ছে " আর রাহমান, আল্লামুল কুরআন, খালাকাল ইনাসান, আল্লামাহুল বাইয়ান"। কমলপুর জুম্মার নামাযে প্রায় দুইশত মুসুল্লি নামায পড়ছিল। পাহারা দিচ্ছিলাম আমরা তিনজন।

মফিজ জেদ ধরেছিল সে নামাজ পড়বে। আমি তাকে নিষেধ করলাম। বললাম, আল্লাহকে আমি জবাব দেব। এতগুলো মানুষ আমাদের উপর নির্ভর করে নামাজ পড়বে। তুমি বলিও লুৎফর ওস্তাদ আমাকে নামাজ পড়তে দেয়নি।

আপনারা(সহযোদ্ধরা) বলতে পারেন, আমি আল্লাহর কাছে জবাবদেব? পার্শ্বেই শুয়ে ঘুমাচ্ছিল সোহরাব আলী নামে একজন সহযোদ্ধা। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছে তার সর্বাঙ্গ। আজও তার ঘুম ভাঙ্গেনি। ওখানথেকে বের হয়ে পার্শ্বের পুকুর পাড়ে বাঁশ আড়ায় গেলাম, দেখি ইব্রাহীমের হাতের একটি আঙ্গুল সোনার আংটিসহ নাড়ি ভুড়ির কিছু অংশ বাঁশ ঝাড়ে। ডালিতে করে মাংসের টুকরোগুলো একত্রিত করা হলো।

দুইটা কাফন তৈরি করা করলাম, কিন্তু আমরা অপেক্ষা করছিলাম মফিজের জন্য, কারণ তার মুখ দিয়ে তখনও উচ্চারিত হচ্ছিল " সুরা-রহমান"। যৌবনে অর্জিত দুই দুইটি পুত্র সন্তান আমি ভারতের মাটিতে সমাহিত করেছিলাম। কারণ যুদ্ধচলাকালিন সময়ে তারা মারা যায়নির্মম, নির্দয় কলেরা, পর পর দুটি সন্তানকে এমনভাবে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়, আমি তাদের শেষ দর্শনটুকু পর্যন্ত দেখে যেতে পারি নাই। কারণ আমি তখন পীরগঞ্জের গোদাগাড়ি অপারেশন পরিচালনা করছিলাম। ১৬ই ডিসেম্বর বাংলার মাটিতে পা দিতে পেরে পুত্র বিয়োগের ব্যাথা ম্লান হয়ে যায়।

৩০ লক্ষ কোরবানী হওয়া মানুষের মাঝে আমারও দুটি পুত্র ছিল, এটা আমার জন্য কম গর্বের নয়। মুক্তিযোদ্ধার নাম শুনলেই যেন মনে করে " এরা ভিক্ষুকের জাত" ওরা কিছু চাইতে এসেছে যেন। তাই যারা দাতা, যারা দিচ্ছেন, একটু তলিয়ে দেখুন " কোথা হতে এল ধন,করেছ কি নিরুপন, কোথায় তোমার বাসা"। অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। মুক্তি যোদ্ধরা যার যার স্ব-স্ব পূর্ব স্থানে ফিরে গেলেন, হাজারও সমস্যায় নিপতিত বাংলার মানুষ।

২০শে ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের স্বর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর এম,এ,জি ওসমানীর নির্দেশে ঢাকা সেনানিবাসে হাজির হলাম, শুরু হলো আমার সেই সামরিহ জীবন। ১৯৭২ সালের ১০ জুলাই বাংলার নয়নমনি শেখ মুজিবর রহমান, পাকিস্তানের মৃত্যুকুপ থেকে নিস্কৃতি পেয়ে স্বাধীন বাংলার মাটিতে পত্যবর্তন করলেন্ তদানিস্তন ভারতের রাষ্ট্র প্রধান শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, বাংলার রেডক্রস ময়দানে কৃতঙ্গ বাঙালীর শ্রদ্ধার্ঘ্যে পুজিত হলেন। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে শুরু হলো মিত্র বাহিনীর দেশ প্রত্যাবর্তনের কার্য্যক্রম। সেই দিনের খবরের কাগজ গুলোতে বড় বড় অক্ষরে ছাপা হয়েছিল " আবার আসিব ফিরে"- জগজিৎ সিং আরোরা। মোঃ লুৎফর রহমান যুদ্ধকালীন অপারেশন কমান্ডার বড়গ্রাম অপারশেন ক্যাম্প দিনাজপুর।

 ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।