আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সি ও পি ডি-জানা অজানার অন্তরালে

এটি একটি চিকিৎসা সেবা সংক্রান্ত ব্লগ বৈশ্বয়িক উষ্ণতা, জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান পরিবেশ দূষণ এবং মানুষের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অসংক্রমন ব্যাধি। যেমন: ডায়াবেটিস, হার্টের রক্তনালীর রোগ প্রভৃতি। এ রোগ দুটির সাথে এ দেশের সাধারন মানুষ সু-পরিচিত। কিন্তু ফুসফুসের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ রোগ, যাতে ভুগছে এ দেশের লক্ষ মানুষ, তা থেকে যাচ্ছে পর্দার অন্তরালে। ইংরেজিতে রোগটির নাম (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারী ডিজিজ) যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী শ্বাস রোধক রোগ।

ফুসফুসের দীর্ঘস'ায়ী শ্বাসরোধক রোগের পরিচিতিঃ এটি একটি প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিৎসাযোগ্য রোগ। ফুসফুসের বাইরে শরীরের অন্যান্য অংশকেও (মাংসপেশী, কিডনী, হাড় প্রভৃতি) এটি আক্রান- করে, যা রোগের ব্যাপকতা বাড়িয়ে দিতে পারে। ফুসফুসের শ্বাস রোধক প্রক্রিয়াটি ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং তা মূলত হয়ে থাকে দূষিত শ্বাস গ্রহনের কারনে, ফুসফুসে সৃষ্ট প্রদাহের জন্য। এই প্রদাহের কারনে ফুসফুস দুইভাবে ক্ষতিগ্রসত হয়, প্রথমতঃ ফুসফুসের ছোট ছোট শ্বাসনালীর ভিতরের দেয়াল ক্ষতিগ্রস- হয়, স'ায়ীভাবে সংকুচিত হয় এবং সেখানে অতিরিক্ত শ্লেষা তৈরী হয়ে বায়ু রোধক প্রক্রিয়াটি বাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয়তঃ ফুসফুসের বায়ুকুঠুরির (ধষাবড়ষর) অস্বাভাবিক প্রদাহের কারনে ক্ষতিগ্রস- হয়।

এর ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে এর সংকোচন-প্রসারন ক্ষমতা নষ্ট হয় এবং রক্তে অক্সিজেনের প্রবাহ কমে যায়। ২০০৭ অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল সি ও পি ডি স্টাডি অনুযায়ী ৪০ বৎসর বয়সী জনসংখ্যার মধ্যে এই রোগের প্রার্দুভাব শতকরা ২১.২৪ ভাগ। সেই হিসাবে ফুসফুসের শ্বাসরোধক রোগে আক্রান- র"গীর সংখ্যা প্রায় ৬০ লক্ষ। পুরো জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই রোগের প্রার্দুভাব শতকরা ৪.৩২ ভাগ। আমাদের দেশে বক্ষব্যাধির জন্য একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনষ্টিটিউটে প্রতিদিন যে সংখ্যক র"গী ভর্তি হয়, তার প্রায় এক-চতুর্থাংশ ফুসফুসের দীর্ঘস'ায়ী শ্বাস রোধ রোগে (সি ও পি ডি) আক্রান-।

এটি মারাত্মক রোগগুলির মধ্যে চতুর্থ, যা পৃথিবী ব্যাপী অধিকাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী। এক পরিসংখ্যাণে দেখা গেছে প্রশান- মহাসাগরীয় এশিয় দেশগুলিতে এ রোগে মাঝারি ও খারাপভাবে আক্রানে-র হার ৩.৫% থেকে ৬.৭% পর্যন-। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশ প্রতি বৎসর এই রোগের পিছনে সরাসরি খরচ করে প্রায় ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং পরোক্ষ ভাবে খরচ হয় আরো ১৪ বিলিয়ন ডলার। কি কি কারনে আমাদের দেশে রোগটি বেড়ে যা"েছঃ এর প্রধান কারনটি হলো, এই দেশে প্রতিনিয়ত বেড়ে যা"েছ ধূমপায়ীদের সংখ্যা। এবং পৃথিবী ব্যাপী এটাই মূল কারন।

রোগটি যে শুধু ধূমপায়ীর নিজেরই হয় তা নয়, তারা আশে পাশে নির্দোষ মানুষকেও আক্রান- করছে। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন এবং নগরায়নের ফলে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী রয়েছে ঝুঁকির মুখে। বিশেষ করে আমাদের শ্রমিক জনগোষ্ঠী যারা যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যাবস'া না নিয়ে ক্রমাগত শ্বাসের সাথে টেনে নি"েছ কারখানার সৃষ্ট ধূলিকণা এবং রাসায়নিক দ্রব্য পুড়ে সৃষ্ট বাষ্প। অপরদিকে আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের মহিলারাও আছেন বিপদের মধ্যে, বিশেষ করে যারা বদ্ধ ঘরে রান্নার কাজটি সারেন লাকড়ি কিংবা অন্য কোন জৈব জ্বালানীর মাধ্যমে। এছাড়া এই রোগের ক্ষেত্রে অন্য যে বিষয়গুলি বিশেষ প্রভাব বিস-ার করে থাকে তা হল, ক্রমাগত বয়স্ক লোকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, ফুসফুস এবং শ্বাসনালীতে জীবানুর সংক্রমন হওয়া অথবা ফুসফুস যক্ষ্মা রোগে আক্রান- হয়ে থাকলে এই রোগের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

কখন সন্দেহ করবেন আপনি ফুসফুসের দীর্ঘস'ায়ী শ্বাসরোধক রোগে আক্রান- হয়েছেন আপনি যদি দীর্ঘ দিন যাবত ধূমপানে অভ্যস- হয়ে থাকেন, আপনার কর্মক্ষেত্রে যদি বায়ু দূষণের মাত্রা বেশি থাকে, আপনার বয়স যদি চল্লিশের বেশী হয়, আপনি যদি আলো বাতাসহীন ঘরে রান্নার কাজ করতে অভ্যস- হয়ে থাকেন এবং এর সাথে যদি নিম্ন লিখিত শারিরীক সমস্যাগুলি রেখা দেয়, তাহলে হয়তবা আপনি ফুসফুসের দীর্ঘস'ায়ী শ্বাসরোধক রোগে আক্রান- হয়ে থাকতে পারেন। এর মধ্যে গুর"ত্বপূর্ন শারিরীক লক্ষণগুলি হলঃ ১. শ্বাসকষ্ট, যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে, পরিশ্রমে শ্বাসকষ্ট আরো বেড়ে যায় এবং প্রতিদিনই অল্পস্বল্প শ্বাসকষ্ট থাকবেই। ২. অথবা র"গী প্রায়ই কাশিতে আক্রান- হয় এবং মাঝে মাঝে ক্রমাগত কফ তৈরী হতে থাকে। আপনি যদি ঝুঁকিতে থাকা একজন ব্যাক্তি হন এবং উপরোক্ত শারিরীক লক্ষণগুলি (এক বা একাধিক) আপনার মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তবে অবশ্যই আপনার উচিত একজন বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে শ্বাস মাপন যন্ত্রের (স্পাইরোমিটার) মাধ্যমে শ্বাস মেপে নেয়া (যাকে বলে স্পাইরোমেট্রি)এবং এই প্রক্রিয়ায় আপনি নিশ্চিত হতে পারেন রোগটি সম্পর্কে। এই ক্ষেত্রে মহাখালীতে অবসি'ত জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনষ্টিটিউট ও হাসপাতালকে একটি বিশ্বসত প্রতিষ্ঠান হিসাবে বেছে নিতে পারেন।

এখানে রয়েছে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা পরিমাপের পূর্ণাঙ্গ এবং সর্বোত্তম ব্যাবস'া। সেই ক্ষেত্রে আপনাকে যোগাযোগ করতে হবে অ্যাজমা সেন্টারের দ্বিতীয় তলায় অবসি'ত রেসপিরেটরী ল্যাবে। রোগটির চিকিৎসা না করালে আপনি নিম্নলিখিত জটিলতায় আক্রান- হতে পারেনঃ ১. শ্বাসকষ্ট এতটাই বেড়ে যেতে পারে যে আপনি সামান্য পরিশ্রমেই শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকবেন এমনকি আপনি দৈনন্দিন কাজ করার ক্ষমতাও হারিয়ে বসতে পারেন যেমনঃ বাথর"মে যাওয়া, কাপড় পরা প্রভৃতি। ২. আপনার ফুসফুস দেহের অক্সিজেনের চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা অথবা কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে । ৩. ফুসফুসে অক্ষমতা থেকে, হার্টের কার্যক্ষমতা নষ্ট হতে পারে ।

৪. মাঝে মাঝেই শ্বাসকষ্ট প্রচন্ড রকম বেড়ে যেয়ে আপনি শয্যাশায়ী হয়ে যেতে পারেন, এমনকি হাসপাতালেও ভর্তি হতে পারেন ৫. কদাচিত ফুসফুস ফেটে গিয়ে জীবন সংহারী অবস'ার উদ্ভব হতে পারে। কোন কোন রোগের সাথে আমরা সি ও পি ডি -কে গুলিয়ে ফেলতে পারিঃ ১. অ্যাজমা/হাঁপানী ২. হৃদপিন্ডের অক্ষমতা বা হার্ট ফেইলিউর ৩. ফুসফুসের যক্ষ্মারোগ প্রভৃতি সি ও পি ডি রোগটি আমরা সবচেয়ে বেশী মিলিয়ে ফেলতে পারি অ্যাজমার সাথে। অ্যাজমা সাধারনত যে কোন বয়সে হতে পারে। কিনতু সি ও পি ডি সাধারনত ৪০ বৎসর বয়সের পর হয়ে থাকে। অ্যাজমার র"গীরা সাধারনত আক্রান- সময় ব্যতীত অন্যান্য সময়ে, সম্পূর্ন ভাল থাকে।

কিন' এই রোগের র"গীরা সব সময় কিছু না কিছু শ্বাস কষ্টে ভুগে থাকেন। সি ও পি ডি রুগীর ইতিহাস নিলে বুঝা যায়, তাদের প্রায় সবাই ধূমপান করেন অথবা কোন না কোন ভাবে তার বায়ু দূষণের শিকার। অপর দিকে অ্যাজমা র"গীদের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় এলার্জির ইতিহাস। এছাড়া শ্বাস মাপন যন্ত্রের মাধ্যমে আপনি নিশ্চিত হতে পারেন যে, আপনি অ্যাজমাতে ভুগছেন, নাকি ফুসফুসের দীর্ঘস'ায়ী শ্বাসরোধক রোগে আক্রান- হয়েছেন। চিকিৎসা নিলে আপনি কিভাবে উপকৃত হতে পারেন ১. রোগটির ক্রমাগত বাড়তে থাকার প্রবনতা কমে আসবে।

২. ঘন ঘন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এড়াতে পারবেন। ৩. অকাল মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হতে পারে। ৪. রোগে আক্রান- হয়েও, কর্মক্ষম জীবন যাপন সম্ভব হতে পারে। রোগটি কি প্রতিরোধ যোগ্য অবশ্যই! পূর্বেই রোগটির পরিচিতির মধ্যে এ কথা বলা হয়েছে। আমরা সমন্বিতভাবে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি নিতে পারিঃ ১. ধূমপান ছাড়তে হবে, ছাড়াতে হবে, প্রতিরোধ করতে হবে।

২. পরিবেশ দূষণ কমিয়ে আনতে হবে, পরিবেম দূষণকারী কলকারখানাগুলি শহরাঞ্চল থেকে সরিয়ে নিতে হবে। ৩. কারখানার শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাবস'া নিতে হবে। ৪. আপনার রান্না ঘরটিতে আলো বাতাস যাতায়াতের ব্যবস'া থাকতে হবে। আসুন, ফুসফুসের দীর্ঘস'ায়ী শ্বাসরোধক রোগ এর সাথে পরিচিত হই, নিজে ভুগছি কিনা জেনে নিই, দ্র"ত চিকিৎসা শুর"র ব্যাবস'া নিই এবং রোগটি প্রতিরোধ করার জন্য সামাজিক উদ্যোগ গ্রহন করি। পরিসংখ্যান কি বলে দুঃখের বিষয়, রোগটির ব্যাপকতা আমাদের দেশে বাড়তে থাকলেও সঠিক পরিসংখ্যাণ অনুপসি'ত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।