আমি কেবলই আমার মতো
আমাদের দেশে কতিপয় মানুষ আছে যারা মনে করে,
অমুক এম এ পাশ আমিও এম এ পাশ। কাজেই দু'জন সমান।
অমুক মুক্তিযোদ্ধা আমিও মুক্তিযোদ্ধা। কাজেই দু'জন সমান।
অমুক এমপি আমিও এমপি হয়েছি।
কাজেই দু'জন সমান।
অমুক মন্ত্রী আমিও মন্ত্রী ছিলাম। কাজেই দু'জন সমান।
অমুক প্রধানমন্ত্রী আমিও ছিলাম। কাজেই দু'জন সমান।
অমুক রাষ্ট্রপতি ছিল আমাদের তমুকও ছিল। কাজেই দু'জনেই সমান।
অমুক ওই দলের প্রধান তিনিও একটি বড় দলের প্রধান। কাজেই দু'জন সমান।
আহাম্মকি আর কাহাকে বলে!!!
এমন নানান উদাহরন দেয়া যাবে।
নানান ভাবে বোঝানো যাবে যে, একই চেয়ারে বসেছিল বা একই বিছানায় একসঙ্গে বা আগেপরে শুয়ে বসে ছিল বা একই জেলে দুজন ছিল বা একই সঙ্গে পাশাপাশি কবরে শুয়ে আছে... ফলে দুজনেই সমান সম্মানিত। এরকম মনে করে অনেক হীনমন্যরাই নিজেদের এবং তাদের পূর্বসূরিদের মহান বানিয়ে তোলে। যা হাস্যকর তো বটেই ইতিহাসের অবান্তর প্রসঙ্গও।
এক্ষেত্রে একটি উদাহরন দিচ্ছি।
১৯৬২ সালে প্রয়াত হলেন বাংলার এককালের অত্যান্ত জনপ্রিয় নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক।
উনি ঢাকা হাইকোটের প্রথম সারির এবং খ্যাতিমান আইনজীবি ছিলেন। ছিলেন গণমানুষের নেতা। ফলে হাইকোর্টের সম্মতিতেই উনাকে সমাহিত করা হলো হাইকোর্ট সংলগ্ন রমনা রেসকোর্স ময়দানের দক্ষিন পশ্চিম প্বার্শে।
১৯৬৩ সালে প্রয়াত হলেন বাংলার গনতন্ত্রের মানসপুত্র খ্যাত হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী। উনিও ঢাকা হাইকোর্টের অত্যান্ত প্রভাবশালী আইনজীবি ছিলেন।
ছিলেন গণমানুষের প্রিয় নেতা এবং নেতা তৈরির কারিগর। ফলে হাইকোর্টের সম্মতিতেই শেরে বাংলা সাহেবের সমাধির পাশেই উনাকেও সমাহিত করা হলো।
উল্লেখ্য, এই দুই কিংবদন্তির কবরের মাঝখানে ফাঁকা যায়গা রাখা হয়েছিল কোরআন তেলাওয়াত এবং দোয়া মাহফিলের জন্য। এই দু’জনের কবর স্থান নির্ধারণের জন্যই লাখো জনতার দাবী ছিল। ফলে ফৌজি শাসক আইয়ুব শাহীর নিয়ন্ত্রিত ঢাকা হাইকোর্টও স্থান দিতে বাধ্য হয়েছিল।
১৯৬৪ সালে মারা গেলেন খাজা নাজিম উদ্দিন। চেয়ারের বিবেচনায় উনিও উপরোক্ত দুজনের সমকক্ষ নেতা ছিলেন। এমনকি উনাদের চেয়ে গুরুত্বপুর্ণ পদেও আসীন ছিলেন। ফলে উনার সমসাময়িক দু’জন নেতার কবরের একই সারিতে উনাকেও দাফন করার দাবী জানালেন উনার অনুসারি মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীরা। কিন্তু বাধা দিলেন বাঙালি অসাম্প্রদায়িক নেতারা।
ভাষা আন্দোলনে বিরোধীতা করায় অসাম্প্রদায়িক বাঙালি নেতারা বললেন খাজা সাহেবের কবর শহীদ মিনারের এত নিকটে হতে পারেনা। উনি নিজেকে কখনো বাংলার মানুষ বলে মনে করেন নি, স্বীকারও করেননি। নিজেকে মনে করতেন ও ভাবতেন কাশ্মিরী হিসেবে। বাংলার গণমানুষের নেতা হিসেবে কখনো নিজেকে মনে করেন নি। এহেন টানাপোড়েনে হাইকোর্ট কর্তৃপক্ষের অসম্মতিতেই মুসলীম লীগাররা শেরে বাংলা ও শহীদ সাহেবের কবরের মাঝখানের ফাঁকা যায়গায় দাফন করলেন।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই খাজা সাহেবকে বলতেন রাজনীতিতে Perpetual Minor বা চির নাবালক।
এখন পাঠক হিসেব করে দেখুন মানুষ কাদেরকে মনে রেখেছে? তিন জনই একই কাতারে শুয়ে আছেন। দু’জনের ক্ষেত্রে ছিল গণমানুষের দাবী আর অপরজনকে জোর করে কাতারভুক্ত করা হয়েছিল। কাজেই আবারো বলি, একই কাতারে বসলেই বা একই মাটিতে পাশাপাশি শুয়ে থাকলেই মানুষের সম্মান পাওয়া যায়না। সমগ্র জীবনের কাজের ভিত্তিতেই মানুষ ঠিক করে কাকে কতটুকু মর্যাদা দেবে।
আজকে একটি কথা না বললেই নয়। বাংলাদেশকে যে যেভাবেই ভাবুক না কেন, স্বাধীন বাংলাদেশ মূলত ১৯৭১ সাল থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে গড়ে উঠতে বদ্ধপরিকর এবং এটাই রাজনৈতিক মূলধারার দর্শন। যতদিন বাংলাদেশে ১৯৭১ এর চেয়েও বড় কোন বিপ্লবী পরিবর্তন না ঘটবে ততদিন এই ধারা বহমান থাকবে। ফলে এই ধারার অনুসারীরাই এখানে নতুন ধারার পূর্ব নাগাদ সম্মানিত হবেন, মর্যাদা পাবেন। এটাই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক মানবিক বাস্তবতা।
এর বাইরে অন্য দর্শনে যারা বিশ্বাস রাখেন তারা খাজা সাহেবের মতো পরিণতি বহন করবেন এটাই রাজনৈতিক নিয়তি।
একই চেয়ারে বসলেই একই সম্মান ও মর্যাদা পাওয়া যায় না।
সাধু সাবধান! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।