আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জোর করে সেকুলার বানানোর চেষ্টা

॥ মুহাম্মদ আমিনুল হক ॥ গত ৮ ডিসেম্বর বায়তুল মোকাররম মসজিদে ইমাম সম্মেলন উদ্বোধন করতে এসে আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, ‘হজরত মুহাম্মদ সা:-এর মতো ধর্মনিরপেক্ষ চিন-াচেতনার মানুষ পৃথিবীতে দেখা যায় না। কেননা তিনি হুদাইবিয়ার সন্ধিতে নিজ হাতে রাসূল শব্দটি কেটে দিয়েছিলেন’ (আমার দেশ, ০৯.১২.২০১১)। ওদিকে গত ১০ ডিসেম্বর ইফা আয়োজিত এক সম্মেলনে ধর্মপ্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শাহজাহান মিয়া দাবি করেন, রাসূল সা: মসজিদের অর্ধেক জায়গা হিন্দুদের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। বর্তমান সরকারও সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এই কথার সাথে সুর মিলিয়ে ইফা ডিজি বলেন, ‘রাসূল সা: ইহুদিদের জন্য মসজিদের অর্ধেক জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলেন’ (নয়া দিগন- ১১.১২.২০১১)।

আমাদের দেশে ‘সেকুলারিজম’ শব্দের ভুল অনুবাদ করে বলা হয় ‘ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ’। এর আসল অর্থ হচ্ছে, ইহজাগতিকতাবাদ। Secularism ল্যাটিন শব্দ Seculum থেকে উদ্ধৃত। Seculum শব্দের অর্থ ইহজগৎ। এ মতবাদের সব চিন-াভাবনা ও কার্যকলাপ ইহজগৎকেন্দ্রিক।

তাই একে ইহজাগতিকতাবাদ বলাই উচিত। যাই হোক, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বলতে আমরা এখন সেকুলারিজমকেই বুঝি। হোলিওক (Holyoake) যিনি ‘সেকুলারিজম’ নামকরণের প্রথম উদ্যোক্তা, তার লিখিত A Confession of Belief বইতে সেকুলারিজমের সংজ্ঞায় বলেন, ‘এ ফর্ম অব ওপিনিয়ন হুইচ কনসার্নস ইটসেলফ অনলি উইথ দি কোয়েশ্চেনস, দি ইস্যুজ অব হুইচ ক্যান বি টেস্টেড বাই দ্য এক্সপিরিয়েন্স াব দিস লাইফ’। অর্থাৎ ‘সেকুলারিজম হলো এক ধরনের মতামত যা ইহজগৎকে, এই জীবনের অভিজ্ঞতায় পরীক্ষা সম্ভব এমন বিষয়গুলোকে স্পর্শ করে’। এনসাইক্লোপেডিয়া বা বিশ্বকোষে secularism-এর দু’টি সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে : 01. Secular spirit or tendency especially a system of political or social philosophy that rejects all form of religious faith. অর্থাৎ ‘সেকুলারিজম হচ্ছে এমন একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক দর্শন যা সকল ধর্ম বিশ্বাসকেই প্রত্যাখ্যান করে’।

02. The view that public education and other matters of civil society should be conducted without the introduction of religious element. ‘সেকুলারিজম এমন একটি ব্যবস'া যেখানে সাধারণ শিক্ষা ও সামাজিক সংস'া পরিচালনায় কোনো ধরনের ধর্মীয় উপাদান অন্তর্ভুক্ত হবে না’। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে সেকুলারিজমের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে : ‘সেকুলারিজম এমন একটি মতবাদ, যে মতবাদে মানবজাতির ইহজগতের কল্যাণ চিন-ার ওপর গড়ে উঠবে এমন এক নৈতিক ব্যবস'া, যেখানে থাকবে না কোনো ধরনের আল্লাহ ও পরকাল বিশ্বাসভিত্তিক বিবেচনা’। প্রত্যেক নবী ও রাসূল দাওয়াতি কার্যক্রম ও তাদের কর্মগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, প্রত্যেক নবী ও রাসূলের শরিয়ত ভিন্ন ভিন্ন থাকলেও তাদের সবার ধর্ম ছিল এক ও অভিন্ন। প্রত্যেক নবী-রাসূলই স্ব স্ব জাতিকে নিম্নোক্ত দাওয়াতগুলো পৌঁছে দিয়েছেন : এক. তাঁর জাতিকে আল্লাহর একত্ববাদের দিকে আহবান করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত থেকে নিরাপদ থাক’ (সূরা নাহল : ৩৬)।

দুই. মানুষকে আখিরাতের ওপর বিশ্বাস ও সেখানে হিসাব-নিকাশ সম্পর্কে বিশ্বাস স'াপনের দাওয়াত দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে মৃত্তিকা থেকে উদগত করেছেন। অতঃপর তাতে ফিরিয়ে নেবেন এবং আবার পুনরুত্থিত করবেন’(সূরা নূহ : ১৭-১৮)। তিন. তাদের জাতিকে চারিত্রিক উৎকর্ষসাধনের আহবান জানিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তাদেরকে (আগের আয়াতে উল্লিখিত নবীদের) নেতা করলাম।

তাঁরা আমার নির্দেশ অনুসারে পথ প্রদর্শন করতেন। আমি তাঁদের প্রতি ওহি নাজিল করলাম সৎকর্ম, নামাজ কায়েম এবং জাকাত দান করার। তাঁরা আমার ইবাদতে ব্যাপৃত ছিল’ (সূরা আম্বিয়া : ৭৩)। চার. প্রত্যেক নবী-রাসূল তাদের কওমকে ইবাতদের মৌলিক ভিত্তির দিকে দাওয়াত দিয়েছেন। তাঁরা সবাই একমাত্র আল্লাহর জন্যই ইবাদত-বন্দেগি করতে বলেছেন।

পাঁচ. মানুষের মধ্যে সত্য, সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছেন। ছয়. তাঁরা সবাই নেক আমলের উত্তম প্রতিদান প্রদান ও খারাপ কর্মের শাসি- প্রদানের মৌলিক নীতিমালা প্রকাশ করেছেন। সাত. তাঁরা আরো বর্ণনা করেছেন যে, একমাত্র সৎকর্মশীলরাই এই জমিনে নেতৃত্ব প্রদান করবেন। আট. খারাপ ও অন্যায় কাজ যেমন- শিরক করা, হারাম খাওয়া, মূর্তি পূজা ইত্যাদি সম্পর্কে উম্মতদের সতর্ক করেছেন। উপরোল্লিখিত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কোনো নবী-রাসূলই ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না।

কেননা সব নবী-রাসূলের চেতনা আর ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। একমাত্র জ্ঞানপাপীরাই পারে নবী-রাসূলকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলতে। এটি একটি চরম মিথ্যাচার। হজরত আদম আ: থেকে শুরু করে সব নবী-রাসূলই ছিলেন একই ধর্মের অনুসারী। তাদের সবার ধর্মই ছিল ইসলাম।

আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর জন্য শ্রম স্বীকার কর, যেভাবে শ্রম স্বীকার করা উচিত। তিনি তোমাদেরকে পছন্দ করেছেন এবং ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোনো সঙ্কীর্ণতা রাখেননি। তোমরা তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের ধর্মে কায়েম থাক। তিনিই তোমাদের নাম মুসলমান রেখেছেন আগেও এবং এই কুরআনেও, যাতে রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষ্যদাতা এবং তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমণ্ডলীর জন্য। সুতরাং তোমরা নামাজ কায়েম কর, জাকাত দাও এবং আল্লাহকে শক্তভাবে ধারণ কর।

তিনিই তোমাদের মালিক। অতএব তিনি কতই না উত্তম মালিক এবং কতই না উত্তম সাহায্যকারী”(সূরা আল হজ : ৭৮)। যে নবী সা: প্রেরিত হলেন ইসলাম ধর্ম নিয়ে, আজীবন মানুষকে ডাকলেন সেই পথে, তিনি কী করে ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারেন? এটি একটি জঘন্য মিথ্যাচার এবং তাঁর ওপর অপবাদও বটে। কোনো মুসলিম ব্যক্তি জেনে শুনে এ ধরনের মন-ব্য করতে পারেন না। আইন প্রতিমন্ত্রী কাফেরদের সাথে হুদাইবিয়ার সন্ধিকে ধর্মনিরপেক্ষতার সপক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন।

আসলে অমুসলিমদের সাথে ওঠা-বসা, লেন-দেন এবং চুক্তি-বাণিজ্য করা আর ধর্মনিরপেক্ষতা এক জিনিস নয়। নবী সা: নিজ ধর্মবিশ্বাসকে ত্যাগ করে কারো সাথে চুক্তিবদ্ধ হননি। তবে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা আল্লাহর রাসূলের ওই চুক্তি থেকে যে বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেন না, সেটি হচ্ছে, ইসলামের অধীনেই সব ধর্মের নিরাপত্তা রয়েছে। একজন অমুসলিম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করেও তার ধর্মকর্ম নিয়ে ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারেন। এটিই আল্লাহর রাসূল সা: প্রমাণ করেছেন।

অন্য ধর্মের অধিকার সম্পর্কে এত চমৎকার আদর্শ অন্য কেউ দেখাতে পারেনি, পারবেও না। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ও ইফা ডিজির দাবি তো আরো অসার। এ রকম অবাস্তব কথা আমরা এর আগে কখনো শুনিনি। ‘নবী সা: কবে কোথায় কোন মসজিদের অর্ধেক জায়গা হিন্দু ও ইহুদিদের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন? মূর্তি পূজা করা আর আল্লাহর সাথে শিরক করা সমান। ইসলাম ধর্মে শিরক করা কবিরাহ গুনাহ।

আল্লাহ তায়ালা সব কিছু মাফ করলেও শিরকের অপরাধকে ক্ষমা করবেন না। তিনি শিরককে ‘জুলমুন আজিম’ তথা মহা অন্যায়-অবিচার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সব নবী-রাসূল আলাইহিস সালাম শিরক ও মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। নবী সা: বলেন, ‘কিয়ামতের দিন ভাস্কর্য ও মূর্তি নির্মাণকারীকে সবচেয়ে বেশি আজাব দেয়া হবে, তাদের বলা হবে, তোমরা যারা মূর্তি তৈরি করেছ তার মধ্যে এখন প্রাণ দাও’ (সহিহ বুখারি)। এ হাদিস থেকেই অনুমান করা যায়, আল্লাহর রাসূল সা: কত কঠোর ছিলেন এ ব্যাপারে।

সেই রাসূল সা: কি না মূর্তিপূজার জন্য মসজিদের পুরো অর্ধেকটাই দিয়ে দিলেন হিন্দুদের! এর চেয়ে জঘন্য মিথ্যাচার আর কী হতে পারে? তা ছাড়া ওই সময়ে আরবে হিন্দু ছিল কি? ইহুদিরা কি মূর্তিপূজক ছিল? আল্লাহর নবীর বিরুদ্ধে এসব বিদ্বেষপূর্ণ মন-ব্যের নিন্দা জানানোর ভাষা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমরা সবাই মর্মাহত, ব্যথিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়! ইসলামের শত্রুরাই কেবল এই ধরনের শঠতাপূর্ণ মন-ব্য করতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশের ধর্ম প্রতিমন্ত্রী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ডিজি এবং আইনপ্রতিমন্ত্রী যেভাবে রাসূল সা:-এর ব্যাপারে অমূলক উক্তি করেছেন, তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। রাসূলের নামে অসত্য মন্তব্য এবং ইসলামের সঠিক ইতিহাসকে বিকৃত করার কারণে এদেরকে এখনই তাদের স্ব স্ব পদ থেকে অব্যাহত দেয়া উচিত। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, অতি দ্রুত ব্যবস'া নেয়ার জন্য।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।