অরুণালোক ‘বিত্ত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ -ধন বা সম্পদ। এ ধন বা সম্পদের প্রাচুর্যের ওপর নির্ভর করে তিনটি শ্রেণী বা পর্যায় ভাগ করা যায়। জনগণের বিভিন্ন পেশা সংশ্লিষ্ট আয়ের ওপর অর্জিত সম্পদ বা বিত্ত নির্ভর এ শ্রেণীগুলো যথাক্রমে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। সুদূর অতীতকাল থেকে এদেশে তিনটি শ্রেণীর সহাবস্থান চলে আসছে। তবে কেউ কেউ মধ্যবিত্তকে আবার দু’টি উপশ্রেণীতে ভাগ করে নিম্নমধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত বলে উল্লেখ করেন।
মধ্যবিত্তের উপশ্রেণী থাকলেও ঠিক কতোদিন আগে থেকে এর উদ্ভব হয়েছে, তার সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঃ গবেষক ডঃ ইদ্রিস আলীর গবেষণামূলক গ্রন্থ “বাংলা সাহিত্যে মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ ঃ বিকাশ ও ক্রমধারা”র উদ্ধৃতি দিয়ে ঢাকার যাত্রাবাড়ির ব্রাইট স্কুল এন্ড কলেজের বাংলা প্রভাষক জনাব আশিক-ই-ইলাহী বলেন, ‘ভারত উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনামলের শুরুতে এ মধ্যবিত্ত শ্রেণীটির উদ্ভব হয়। যাদের কাজ ছিলো রাজকার্যসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহযোগিতা করা। ” জানা যায়, এ সহযোগিতাটি করতে গিয়ে তারা স্বদেশের দরিদ্র ও ধনী স্বজাতিদের কাছ থেকে পৃথক হয়ে আলাদা একটা শ্রেণী হিসেবে চিহ্নিত হয়। কেননা জীবিকার তাগিদে এরা যেমন ধনী জনগোষ্ঠির সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যায় ঠিক তেমনি দরিদ্র শ্রেণীর লোকজনের সাথে একটি পার্থক্য সৃষ্টি হতে থাকে।
দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় কর্মরত বিশিষ্ট কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক জনাব আকন আব্দুল মান্নানের মতে, ‘‘ভারত উপমহাদেশে ঠিক কত আগে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয় তার তথ্য না পাওয়া গেলেও মোঘল শাসনামলে এ শ্রেণীরটির অস্তিত্ব ছিলো। যারা শাসনকার্যে ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিভিন্ন শাখায় কর্মরত থেকে দেশকে গতিশীল রাখতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলো এবং যার ধারা আজও বহমান। ’’
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক এবং ঢাকা পোস্ট সম্পাদক অধ্যাপক ওমর ফারুকের মতেÑ, ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভবের সঠিক তথ্য না পাওয়া গেলেও এ কথা ঠিক যে, অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে যারা দরিদ্র জনগোষ্ঠি থেকে খানিক ওপরে এবং উচ্চবিত্ত বা ধনী শ্রেণীর জনগোষ্ঠি থেকে নীচে বসবাস করেন। যারা পেশা হিসেবে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসা, সরকারী ও বেসরকারীভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থেকে জীবিকা নির্বাহ করেন। যাদের অস্তিত্ব মধ্যযুগে ইতিহাসে পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে নগরায়ণ সভ্যতার ফলে এ শ্রেণীটির দ্রুত বিকাশ লাভ হয় এবং যাদের সামাজিক অবস্থান ধনী ও দরিদ্রের মাঝামাঝি পর্যায়ের। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালন, সার্বিক উন্নয়ন, তত্ত্বাবধান ইত্যাদি কাজের জন্য শাসকগণ প্রয়োজনের তাগিদেই সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকের শক্তি ও মেধাকে কাজে লাগিয়েছে। বর্তমানেও এ শ্রেণীটির জীবন চিত্র প্রায় একই রকম রয়ে গেছে’।
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবন চিত্র ঃ যেহেতু এ শ্রেণীটির অর্থনৈতিক অবস্থা মধ্যম মানের তাই, সামাজিকভাবে এ শ্রেণীটির জীবনযাত্রাও ‘না ধনী না দরিদ্র’ এমন একটা অবস্থানে আবর্তিত হয়। বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিম-লে এ শ্রেণীর জনসাধারণকে খুব সহজেই চিহ্নিত করা যায়।
খাদ্যাভ্যাস, বাসস্থান, পোশাক, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা গ্রহণ পদ্ধতি, সংস্কার ও ধর্মীয় অনুভূতি ইত্যাদি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এ শ্রেণীর পূর্ণাঙ্গ জীবনটাই একটা ছকে বাঁধা। গোনা পয়সা উপার্জনের কারণে এ শ্রেণীটির জীবন যাপনের জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যয়ের বাজেট নির্ধারণ করতে হয়। ইচ্ছে করলেই এরা এ ছক থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। যে কারণে মাপা খাদ্যাভ্যাস, সাধারণ বাসস্থান ও পোশাক, দেশের মধ্যেই গড়ে উঠা বিভিন্ন শিক্ষালয় পর্যন্ত নির্দিষ্ট পর্যায়ের শিক্ষা গ্রহণ ও অসুখ বিসুখে কেউ কেউ সরকারী হাসপাতাল এবং অতি নগন্য সংখ্যক লোক বিভিন্ন বেসরকারী ক্লিনিক পর্যন্ত যেতে পারে। নাগরিক জীবনের বিভিন্ন উৎসব উদ্যাপন উপলক্ষে এদের প্রতিটি কেনাকাটা করতে হয় খুব হিসেব করে।
হিসেবের বাইরে গেলেই জীবন নির্বাহের ছন্দপতন ঘটে। কোন কারণে ব্যয় আধিক্যের প্রভাবে এ ছন্দপতন দীর্ঘস্থায়ীও হতে পারে। আয়ের সীমাবদ্ধতার কারণে নাতিস্বচ্ছল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত এ শ্রেণীটি তাই দেশে পণ্যমূল্যের উর্ধ্বগতির সাথে নিজেদের খাপ খাওয়াতে সর্বক্ষণই তটস্থ থাকে।
ব্যক্তিজীবনে এ শ্রেণীটি বিবেক, ধর্মীয় মূল্যবোধ, নৈতিকতা ইত্যাদিকে খুব প্রাধান্য দেয়। আদর্শকে জলাঞ্জলি দিতে এরা সব সময় কুণ্ঠিত এবং অনৈতিক সব ধরণের কাজকে এরা অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখে।
সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি, দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ ইত্যাদির বিরুদ্ধে এরা সব সময় সোচ্চার থাকে। ফলে বাকী দু’টি শ্রেণীর কাছ থেকে এরা খুব সহজেই সমীহ আদায় করে নেয়। তবে এদের কারো কারো মধ্যে যে লোভ নেই তাও বলা যাবে না। ভোগী জীবন আস্বাদনের জন্য কিছু কিছু মধ্যবিত্ত নৈতিকতার বিপরীতেও অবস্থান করে। এ কারণে মধ্যবিত্তের মাঝে একটা আভ্যন্তরীণ অপ্রকাশ্য বিরোধ লক্ষ্য করা যায়।
যা-ই হোক, যেহেতু এ শ্রেণীটি একটি সীমাবদ্ধ আয়ের গ-িতে বসবাস করে তাই দেশের অর্থনৈতিক মন্দাভাব, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ইত্যাদি বৈরিতার কারণে বিভিন্ন ভোগান্তি পোহায়।
ঈদ উৎসব ও বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী ঃ বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি আজও পর্যন্ত নিজস্ব একটা স্বকীয়তা নিয়ে বাস করছে। অত্যন্ত বাস্তববাদী, প্রখর নীতিবোধ, ধর্মীয় নিষ্ঠা, উত্তম আচার আচরণ, সত্যবাদিত্য এসব সদগুণগুলো এ শ্রেণীর মাঝে আজও বিদ্যমান। এ শ্রেণীর জনসাধারণের মাঝে অপরাধ প্রবণতা কম। সুযোগ পেলেও এরা বিভিন্ন অনাচার, অবিচার, দুর্নীতি থেকে সযতনে নিজেদের ফিরিয়ে রাখ।
ফলে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরি-লে এ শ্রেণীর জয়জয়কার সর্বত্র দেখা যায়। দেশ গঠনে এ শ্রেণীটির ভূমিকা অসাধারণ। এদের কর্তব্যপরায়ণতা, আদর্শ ও সততার কারণে দেশ পরিচালনা সহজতর হয়েছে। এ শ্রেণীটির অবস্থান মাঝামাঝি হওয়ার দরুণ ধনী ও দরিদ্রের মাঝে সমন্বয় রক্ষা হয়েছে।
কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ত্রাহী মধুসূদন অবস্থা চোখে পড়ার মতো।
জীবন যাপনের বিভিন্ন ব্যয় নির্বাহ করতে যেয়ে এ শ্রেণীটির নাভিশ্বাস উঠেছে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে যারা নগরে বাস করছে তাদের অবস্থা আরও করুণ। কোন প্রকার নোটিশ ছাড়াই বাসাভাড়া, পরিবহণ ভাড়া বৃদ্ধি, দফায় দফায় পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং খাদ্যসহ নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধি মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে বিপর্যস্থ করে ফেলেছে। আয়ের সীমাবদ্ধতার কারণে এরা জীবন চলার পথে হোঁচট খাচ্ছে বারবার। উপরন্তু, ছিনতাই, নীরব চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার ফলে এ শ্রেণীটির পরিস্থিতি নাজুক হয়ে দেখা দিয়েছে।
এছাড়া সামাজিক বিভিন্ন অবক্ষয়, যৌতুক ইত্যাদি কারণে এ শ্রেণীটির পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জনসাধারণের বসবাস। প্রতিটি ধর্মের লোকজনই বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করে থাকে। সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে এসব উৎসবগুলোর উদ্যাপন চাঞ্চল্য নজর কাড়ে। সংখ্যাগুরু মুসলমান বছরে দু’টি ঈদ উৎসব ধর্মীয় উপহার হিসেবে উদ্যাপন করে থাকে।
কিন্তু বছরের এ দু'টো ঈদ উৎসব উদ্যাপন করতে গিয়ে বরাবর এ মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি দূর্বিপাকে পড়ে। উৎসবের সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রতিটি সরঞ্জামের প্রকৃত মূল্যের তিন-চারগুণ বেশি দিতে হয়। ফলে আয়ের সাথে বেড়ে যায় ব্যয়ের ব্যবধান। নাড়ীর টানে এ শ্রেণীটি যখন বাড়ির পথ ধরে, পরিবহণের বাড়তি মাশুল গুণতে গিয়ে খায় আরেক ধাক্কা। সবকিছু সামলাতে একটু ঝিমুনি এলেই অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক অসন্তোষে উৎসবের আনন্দ ম্লান হয়ে যায়।
তবে মধ্যবিত্তের সবার ক্ষেত্রেই যে একই চিত্র দেখা যায় তা নয়, বরং কোথায় কোথায় পার্থক্যও চোখে পড়ে। তবে খানিকটা পার্থক্যের জন্য সমাজের সার্বিক রূপের কোন পরিবর্তন ধরা পড়ে না।
বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্তের জন্য আয় ও ব্যয়ের সমন্বয় সাধন করা দরকার। চারিদিকে বিলাসবহুল জীবনের লোভনীয় হাতছানি থেকে অতি যতেœ নিজেদের সরিয়ে রাখার অভ্যাস করতে হবে। আবেগের বশে কিংবা প্রতিবেশিদের সাথে প্রতিযোগিতা করে অতিব্যয় পরিহার করতে হবে।
কেনাকাটা করতে গেলে পণ্যসামগ্রির চটকদার বিজ্ঞাপন ও পণ্যের বাইরের চাকচিক্য দেখে আকৃষ্ট না হয়ে গুণাগুণ ও ব্যবহারের স্থায়ীত্বের দিকে খেয়াল করতে হবে। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া সবধরণের অপচয় বন্ধ করতে হবে। এদের জন্য বর্তমান প্রতিযোগিতার বাজারে মান সম্ভ্রম নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য অল্প প্রাপ্তিতে তুষ্ট থাকার দৃঢ় মনোবল তৈরি করা জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছে। তা নইলে লোভ-লালসা এসে মধ্যবিত্তের দীর্ঘ দিনের লালিত সংযম, নীতিবোধ, আদর্শ, ধর্মীয় অনুশাসন ইত্যাদির পর্দা ছিঁড়ে সমগ্র জীবন ধারাকে অনৈতিক ও অন্ধকার পথে নিক্ষেপ করবে।
তারিখ ঃ ১০ আগস্ট ২০১১
তৈয়ব খান ঃ কবি, লেখক
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, পাক্ষিক তৃতীয় বাংলা
গ্রাফিক ডিজাইনার, ইংরেজি সাপ্তাহিক ঢাকা পোস্ট ও নিহাল পাবলিকেশন
ঊ-সধরষ: ধঁৎড়হধষড়শ৭০@ুধযড়ড়.পড়স
ফোন ঃ ৮৪১০২৭২, মোবাইলঃ ০১১৯-১১৫৬৮৭৬, ০১৭১-৬৫২৮৭৫৭, ০১৯৩৯-৮৫৩৯০২
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।