আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শুভ জন্মদিন হে বিদেশী মুক্তিযোদ্ধা ডব্লিউএএস ওডারল্যান্ড বীরপ্রতীক

তাশফী মাহমুদ মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালী জাতির জীবনে শ্রেষ্ঠ অহঙ্কার। আর মুক্তিযোদ্ধরা হলেন বাঙালী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পাশাপাশি এক বিদেশী নাগরিক যিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন, তিনি হলেন ডবিস্নউএএস ওডারল্যান্ড। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন ও সংগ্রামকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে যখন পাকিস্তানী সামরিক শাসক ও তার বর্বর বাহিনী এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন হাজার হাজার বাঙালী প্রতিরোধযুদ্ধে নেমে পড়ে। এর মধ্যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

হাজার হাজার বাঙালীর সঙ্গে বাঙালীপ্রেমিক বিদেশী নাগরিক ডবিস্নউএএস ওডারল্যান্ড পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। শুধুমাত্র অবস্থান নয়, রীতিমতো যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। জীবন বিপন্ন করে বাঙালী সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। গুঁড়িয়ে দিয়েছেন শত্রুর স্থাপনা ও আস্তানা। সেই বাঙালীপ্রেমিক ডবিস্নউএএস ওডারল্যান্ডকে স্মরণ করছি শ্রদ্ধাভরে বিনম্রচিত্তে।

আজকের প্রজন্মকে জানানোর জন্য উ্েলস্নখ করছি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বিদেশী কিংবদনত্মিতুল্য মুক্তিযোদ্ধা হলেন ডবিস্নউএএস ওডারল্যান্ড। তিনি কেবল মুক্তিযোদ্ধা নন, তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পথিকৃৎও। তাঁর ছিল বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা। ওডারল্যান্ডের স্বদেশ অস্ট্রেলিয়া। তিনি ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডসের(হল্যান্ড) রাজধানী আমস্টারডামে জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা তেমন ছিল না। যখন বয়স সতেরো তখন তিনি বাটা সু কোম্পানিতে সু-শাইনার বা জুতো পলিশকরের চাকরি নেন। দু'বছর পর চাকরি ছেড়ে ১৯৩৬ সালে তিনি জাতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর রয়্যাল সিগন্যাল কোরে সার্জেন্ট পদে কর্মরত থাকেন। এরপর তিনি ওলন্দাজ বাহিনীর গেরিলা কম্যান্ডো হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) অংশগ্রহণ করেন। ঢাকায় বাটা সু কোম্পানির প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে ওডারল্যান্ড ১৯৭০ সালের শেষের দিকে প্রথম ঢাকায় আসেন।

কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি নির্বাহী পরিচালক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। মার্চের উত্তাল দিনে বাঙালীদের সাহস দেখে মুগ্ধ হন তিনি। টঙ্গী তাঁর কর্মস্থল হবার কারণে তিনি ৫ মার্চ, ১৯৭১ মেঘনা টেঙ্টাইল মিলের সামনে শ্রমিক-জনতার মিছিলে ইপিআর-এর সদস্যদের গুলিবর্ষণের ঘটনা কাছে থেকে প্রত্যৰ করেছেন। শ্রমিক-জনতা মেঘনা টেঙ্টাইল মিলের সামনে শহীদ শ্রমিকদের লাশ ছিনিয়ে নিতে তৎকালীন ইপিআর-এর সদস্যদের সঙ্গে যেভাবে লড়েছিলেন তা তিনি প্রত্যৰ করে বাঙালীর সাহসের পরিচয় পেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরম্ন হওয়ার পর পরই ওডারল্যান্ড যেন নিজের মধ্যে আবিষ্কার করেন নতুন এক যুদ্ধের মুখোমুখি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশগ্রহণকারী সৈনিক ওডারল্যান্ডকে।

প্রথমদিকে তিনি দখলদার পাকিসত্মানী বাহিনীর পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের গোপন তথ্য সংগ্রহ করে আগেভাগেই মুক্তিযোদ্ধাদের তা জানিয়ে দিতেন। একজন বিদেশী হিসেবে পাকিসত্মানী বাহিনীর নিকট তার নিঃসংশয় গ্রহণযোগ্যতা ছিল বলে তিনি সেনা সদরে অনেকটা অবাধ বিচরণের এবং প্রায়শ সেনানিবাসে সামরিক অফিসারদের আলোচনা সভায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ, আর্থিক সহায়তা এবং বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গেরিলা কম্যান্ডো হিসেবে স্বীয় অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে এবং স্বয়ং ২নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা শাখার সক্রিয় সদস্যরূপে অকুতোভয় ওডারল্যান্ড বাটা ফ্যাক্টরি প্রাঙ্গণসহ টঙ্গীর কয়েকটি গোপন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত গেরিলা রণকৌশলের প্রশিক্ষণ দিতেন। এর পাশাপাশি তিনি মুক্তিযুদ্ধের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে পাকিসত্মানী বাহিনীর নৃশংস নির্যাতন ও গণহত্যার আলোকচিত্র তুলে গোপনে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন তথ্যমাধ্যমে পাঠাতে শুরম্ন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখেন।

এ বিষয়ে তিনি নিজেই লিখেছেন, ইউরোপের যৌবনের অভিজ্ঞতাগুলো আমি ফিরে পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে বিশ্ববাসীকে সেসব জানানো উচিত। ইউরোপে ফেলে আসা যুদ্ধস্মৃতির ২৯ বছর পর ১৯৭১ সালে টঙ্গীতে বর্বর পাকিসত্মানী সেনাদের মধ্যে আবার তিনি সাৰাত পেলেন নাৎসি বাহিনীর। টঙ্গীতে বর্বর পাকিসত্মানী বাহিনী দ্বারা নৃশংস হত্যাকা-, বীভৎস মারণযজ্ঞ প্রত্যৰ করে তিনি ব্যথিত ও ৰুব্ধ হন। তাই ওডারল্যান্ড ছবি তোলা রেখে সরাসরি যুদ্ধে অংশ্রগহণের সিদ্ধানত্ম নেন।

যুদ্ধকালে তিনি প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। সে সময় তিনি ঢাকাস্থ অস্ট্রেলিয়ান ডেপুটি হাইকমিশনের গোপন সহযোগিতা পেতেন। রক্তৰয়ী নয়মাস মুক্তিযুদ্ধের শেষে টঙ্গীতে ফিরে আসেন বিজয়ীর বেশে। ডবিস্নউএএস ওডারল্যান্ড ১৯৭৮ সাল পর্যনত্ম বাটা সু কোম্পানিতে চাকরিরত ছিলেন। তখন তিনি কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর।

এরপর তিনি ফিরে যান তাঁর নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় পার্থের এক হাসপাতালে ২০০১ সালের ১৮ মে তিনি মৃতু্যবরণ করেন, রেখে যান তাঁর স্ত্রী মারিয়া ও একমাত্র কন্যাকে। জীবনের শেষদিনগুলোতে প্রায়ই তিনি তাঁর স্ত্রী ও কন্যাকে বলতেন, বাংলাদেশ আমাদের ভালবাসা; পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি আবেগের এই ধারা অব্যাহত রেখো। এতে অনুভব করা যায় বাংলাদেশ ও বাঙালীদের প্রতি তাঁর কি গভীর মমতা ছিল।

ডবিস্নউএএস ওডারল্যান্ড-এর স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁর নামে বাংলাদেশেরে রাজধানী ঢাকার গুলশানের একটি রাসত্মার নামকরণ করা হয়েছে। অন্যদিকে এ বছর অস্ট্রেলিয়ায় কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে ওডারল্যান্ডের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। অস্ট্রেলিয়ার পার্থে রয়েছে তাঁর সমাধি। ওডারল্যান্ডকে ইতিহাস মনে রাখবে। মনে রাখবে বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম।

এই প্রত্যাশায় জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই ওডারল্যান্ডকে।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।