আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টাক বিড়ম্বনা

রামকানাই পন্ডিত আমার কপালটা বেশ বড়। না, ভাগ্য ভাল নয়। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় যে, আমার মাথার সামনের দিকে চুল বেশ কম। অনেকেই বলে পাতলা চুল। আমি বলি টাকের পুর্বাবস্থা।

এই টাক নিয়েই হয়েছে যত সমস্যা। সমস্যাটা আমাদের বংশগত। আমার ছোট ভাইয়ের অবস্থা আরও খারাপ। চুল অনেক কম, দেখেতে অনেকটা সদ্যজাত শিশুর মত। আমার দাদার মাথা নাকি এতটাই ফাঁকা আর তেলতেলে ছিল যে, দুপুর বেলা রাস্তায় তিনি হেঁটে গেলে, দোতলার ছাঁদ থেকে তার মাথায় পুর সুর্য মামাকে দেখা যেত।

আব্বার অবস্থা অবশ্য কোন অংশেই কম না। আব্বা যে দোকানে চুল কাটেন, সেই দোকানদার খুব সমঝদার লোক। তিনি সবার কাছ থেকে ত্রিশ টাকা নিলেও, আব্বার কাছে থেকে নেন দশ টাকা। তার যুক্তি অকাট্য। আব্বার চুল মাথার তিনভাগের একভাগ।

তাই পুরা মাথার চুল কাটার টাকা নেওয়া হবে অমানবিক। কিন্তু তার পরও আমার আব্বার পকেটে সবসময় একটা ছোট্র চিরুনি থাকে। চুল না থাকলেও তিনি, ঐ চিরুনি দিয়ে অবশিষ্ট চুলগুলো আঁচড়াতে পছন্দ করেন। ঘটনাটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মাঝামাঝি সময়। টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে আমি বাসায় গেছি।

মা আমার মাথার চুল পড়া দেখে আঁতকে উঠে বললেন, বাবা এই ভাবে চুল পরতে থাকলে তুই ত কিছু দিনের মধ্যেই টাক হয়ে যাবি। আমি বললাম সমস্যা কি? মাথা ফাঁকা হলে মাথা আলো বাতাস পাবে। সব সময় ঠান্ডা থাকবে। তোমার ছেলে আরও ভাল রেজাল্ট করবে! মা বলল, তুই ন্যাড়া কর। আমি বললাম পাগল হইছ নাকি? ন্যাড়া করলে ক্লাসে যাব কি করে? বন্ধু বান্ধবরা এমনিতেই টোকাটুকি করে, ন্যাড়া মাথা পাইলে ত আর আস্ত রাখবে না! আর যাই হোক জেনেশুনে এই ভুল করা ঠিক হবেনা।

কিন্তু, মাতঃ আদেশ শিরোধার্য। আমি মাথা কামালাম। কিন্তু কথায় আছে লেজ কখনও একা কাটতে নেই। কাউকে না কাউকে সাথে নিয়েই কাটতে হয়। আমি হিসাব করে দেখলাম আমাদের ক্লাশে তেষট্রি জন ছাত্র-ছাত্রী।

তের জন বান্ধবি বাদ দিলেও বাকি থাকে পঞ্ছাশ জন বন্ধু যাদের বেশ কয়েকজন খাটাশ টাইপের। যদি প্রত্যেকে দিনে গড়ে একটা করে টোকাও মারে তাও প্রায় পঞ্ছাশ টোকা । মাথা আস্ত থাকার কোনই সম্ভাবনা নাই। (আমার স্থির বিশ্বাস ছিল বান্ধবিরা আর যাই করুক, আমার টাক মাথা নিয়ে অন্তত তামাশা করবে না)। রিঙ্কু থাকত আমার পাশের রুমে।

আমি গিয়ে বললাম দোস্ত, তোর মাথার চুল পরে যাচ্ছে। অল্প দিনের মধ্যেই তুই টাক হয়ে যাবি। তোর কিন্তু বিয়ে হবে না। তুই ন্যাড়া কর। সে রাজি হয় না।

মাথার সব চুল ফেলে মাথাটাকে শশ্মান বানান খুব সাহসের কাজ। অনেক চেস্টার পর তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাজি করানো গেল। দুই বন্ধু ন্যাড়া মাথা নিয়ে ক্লাস শুরু করলাম। বিপদ-আপদ যা আসলো দুইজনে ফিফটি ফিফটি শেয়ার। (দুইয়ে মিলে করি কাজ, টোকাটুকিতে নাহি লাজ টাইপের)।

পাশ করার দুই বছরের মাথায় রিঙ্কুর বিয়ের প্রস্তাব। পাত্রী সুন্দুরী, ডাক্তার এবং আমেরিকা প্রবাসী। আর কি লাগে! রিঙ্কুর ছবি দেখতে চাইছে । বিভিন্ন পোজে তোলা অনেকগুলো ছবির মধ্যে ছবি বাছাই প্রক্রিয়া চলল । আমি সাহায্যকারী।

বললাম দোস্ত, আমার কয়েকটা ছবি পাঠা। পাত্রীর অপশন থাকা ভাল। (আমি জানি রিঙ্কুর ওই গ্লেসি চেহারা আর লেডি কিলার হাসির কাছে আমি প্রথম রাউন্ডেই বাদ, তাও ক্ষীন আশা!) রিঙ্কু সারা জীবন ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে আসছে। বিবাহের মত এমন গুরুত্ত্বপূর্ন বিষয়ে সে কোনো রিস্ক নিতে চাইল না। মাথা টাক করানোর মত এবার তাকে ভুলানোও গেল না।

খেলায় অংশগ্রহন না করেই আমি বাদ। নিজে উপস্থিত থেকে বন্ধুকে পাত্রীর হাতে সমর্পণ করলাম। বিয়ের পর রিঙ্কু মহাখুশি। এখন ফেসবুকে বিভিন্ন রঙে, ঢঙে সঙে,ছবি দেওয়া শুরু করেছে যা বন্ধু বান্ধব মহলে বিবাহ চুলকানি জাগিয়ে দিয়েছে। বিবাহ ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে এখন প্রায়ই মিটিমিটি হাসে।

চুল নিয়ে তার আর কোনো টেনশন নাই। কিন্তু আমার ঝামেলাটা শুধু থেকেই গেলো না বরং দিন দিন বাড়তে শুরু করল। মাথার চুল এখন আর কিছুতেই আটকানো যচ্ছে না। ন্যাড়া করেও না। কিছুদিন আগের ঘটনা, মা বললেন আমার জন্য পাত্রী খুঁজে পাইছে।

মেয়ের উচ্চ বংশীয়, চেহেরা ভাল এবং ডাক্তার। আমি বললাম খুব ভাল। এখন থেকে তোমার আর পা ব্যথা, মাথা ব্যথা, কোমর ব্যথা, হাত ব্যথা এসবের জন্য রেগুলার হাসপাতাল যেতে হবে না। ঘরের মধ্যে হাসপাতাল। খালি একটা নার্স হলেই হয়।

ছোট পুত্রর জন্য না হয় একটা নার্স দেখ। তাহলেই পরিপূর্ণ সেট। আমি বললাম একটা বিষয় খোঁজ নেও। পাত্রী রাত্রে মশারী টানায় কিনা? মা বললেন, এত কিছু থাকতে এটা জেনে কি হবে? আমি বললাম সারা জীবন আব্বাকে মশারী টানাতে দেখছি, আর যাই হোক, আব্বার এই গুনটা আমি বহন করতে চাই না। মা বলেন তুই বাসায় আয়, পাত্রী পক্ষ তোকে দেখতে চাইছে।

আমার তখন নরসিংদির ঘোড়াশালে সাইট চলে। কাজের ভয়াবহ চাপ। এক মাসের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। না হলে চাকরি নিয়ে টানাটানি। বিয়ে নিয়ে চিন্তা করার সময় নাই।

আমি দু’কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু মা বললেন তুই কোর্ট, টাই পরে ছবি তুলে পাঠা। এ ত মহা বিড়ম্বনা। আমার কোর্ট নাই, টাইও নাই। গেলাম এক লোকাল স্টুডিওতে।

বললাম ভাই, আমার বিয়ের কথা বার্তা চলতাছে। পাত্রী পক্ষ কোর্ট, টাই পরা ছবি দেখতে চাইছে। একটা ব্যবস্হা করা যায় নাকি? স্টুডিওর ছেলেটা একটা কোর্ট আর সাথে ম্যাচ করা টাই নিয়ে আসল। সপ্তাহ খানিক পর আমি দু’কপি বড় ছবি পাঠিয়ে দিলাম। এরপর অনেক দিন বিয়ে সংক্রান্ত কোন খোঁজ খবর নাই।

আমি একদিন মাকে জিজ্ঞাস করলাম, মা আমার বিয়ের খবর কি? আম্মা বললেন, বাদ। আমি বললাম কেন? সুন্দুরী ডাক্তার। বাদ দিলে কেন । এরকম পাত্রী কিন্তু সহজে পাওয়া যাবে না। মা বললেন, পাত্রী তোর আব্বাকে পছন্দ করে নাই।

আমি আঁতকে উথলাম। বলে কি! আব্বা কেন? বিয়ের কথা হচ্ছে আমার, এখানে আব্বা কেন! মা বললেন, আব্বার মাথায় টাক দেখে পাত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছে টাক বংশে বিয়ে করবে না। আমি বললাম, মন্দ বলে নি! মেয়ের পছন্দ মাশাল্লাহ। কি আর করবা! এবার থেকে টাক বাবার মেয়ে দেখ। তাহলে টাকে টাকে কাটাকাটি।

মা ধমক দিয়ে ফোন রেখে দিলেন। পুনশ্চঃ আমার মা দ্বিগুণ উৎসাহে তার বড় পুত্রের জন্য সুপাত্রীর সন্ধান করছেন আর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পাত্রী দেখার সময় আমার আব্বাকে আর কখনই সঙ্গে নিবেন না। পাত্রী দেখার মত একটা বিড়ম্বনাকর কাজ থেকে মুক্ত হয়ে আমার আব্বা এখন বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছেন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।