আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের সব কাজ কি ধর্মে উল্লেখিত হতে হবে

তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা পৃথিবীর বুকে একটি পরম সুন্দর ও চিরসত্য ধর্মের নাম হচ্ছে ইসলাম। ব্যাপকতা এবং ন্যায়পরায়ণতা হচ্ছে এর সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্য। মহান আল্লাহর অপার দয়ার অপূর্ব নিদর্শন প্রকাশিত হয়েছে এ ধর্মের বিধিবিধানের সরলতা ও সৌন্দর্যের মাধ্যমে। কিন্তু নিজেদের অজ্ঞতা ও হীনমন্যতার কারণে আমরা যেমন এর সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছি তেমনি এ পবিত্র অঙ্গনে অন্যদের প্রবেশের দ্বার বন্ধ করে রেখেছি। ইসলামের প্রথম বাণীর সূচনা হয়েছিল, পড় তোমার রবের নামে যে তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।

এই একটি বাণীর মধ্যেই লুকিয়ে আছে পুরো ধর্মের সব সমাধান। এখানে পড়তে বলা হয়েছে রবের নামে। শুধু পড়া নয়, নিজের চাহিদা মতো বেছে বেছে পড়া নয়, বরং রবের নামে তথা মহান আল্লাহর নির্দেশনা মাফিক পড়তে বলা হয়েছে। পৃথিবীর অন্য সব ধর্মের সাথে এখানেই আমাদের তফাত। অন্য ধর্মগুলো তখনই বিভ্রান্ত হিসেবে গণ্য হয়েছে যখন তাতে অনুসারীদের ইচ্ছা ও লালসা তাদের আক্বীদা ও বিশ্বাসের দিকনির্দেশক হয়েছে।

তাদের খেয়ালখুশী মতো তাদের বিশ্বাস ও ধর্মকে সাজিয়েছে, বদলে দিয়েছে এর কোনো কোনো অংশ যা তাদের ভালো লাগত না। আর ইসলাম ঠিক এর উল্টেটি শিখিয়েছে আমাদেরকে। আমাদের বিশ্বাস ও আক্বীদা আমাদের ইচ্ছা ও আকাঙ্খাকে পথ দেখায়, আমাদের লোভ লালসা ও প্রবৃত্তিকে সীমাবদ্ধ করে। আর তাই আমাদের জীবন মরণের প্রতিটি পদে পদে আমরা পথ চলি ইসলামের ঐশী আলোয় আলোকিত হয়ে। আর এ আলোয় আলোকিত হতে গিয়ে আমরা না বুঝে সংকীর্ণ করে ফেলি আমাদের জীবনব্যবস্থাকে।

সমস্যাটা এখানেই। পবিত্র কুরআন আমাদের সংবিধান, এ কথার মর্ম আমরা সহজ ভাবে না বুঝে কুরআনকে আজ দুর্বোধ্য মহাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত করেছি সাধারণ মুসলমানদের কাছে। আর তাই আমাদের সমাজের মুসলমানরা আজ ইসলাম মানতে গিয়ে কেউ শংকিত, কেউ উদভ্রান্ত। ব্যাপরটি কি সত্যিই এরকম? আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ কি তন্ন তন্ন করে কুরআনের পাতায় এর বৈধতা খুঁেজ খুঁজে হয়রান হতে হবে? ফতওয়ার জন্য দৌড়াতে হবে এখানে ওখানে? সাধারণ সামান্য বিষয়েও কি দ্বারস্থ হতে হবে ধর্মের কাছে? নিজেদের বিবেক ও মনের কোন কার্যকারিত কি তবে ইসলামে সম্পূর্ণ রূপে বিবর্জিত? যে সহজ সত্যটি আমরা আজ ভুলে আছি, তা হচ্ছে- আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ইসলামে উল্লেখিত হতে হবে, অনুমোদিত হবে এমন ধারণা অমূলক। বরং আমি যে কাজগুলো করছি, যে পথে জীবন চালাচ্ছি, যে ব্যবস্থায় অর্থ উপার্জন করছি, যে উপায়ে আনন্দ বিনোদন লাভ করছি, খুঁেজ দেখতে হবে যে ইসলামী শরীয়ত এ পথ ও ব্যবস্থাকে নিষিদ্ধ করেছে কিনা? যদি নিষেধ প্রমাণিত হয় তবে তা মাথা পেতে মেনে নিব, এ থেকে হাত গুটিয়ে বিরত থাকব।

এটুকুই ইসলামের শিক্ষা। আমরা যদি আমাদের প্রতিটি কাজের বৈধতার জন্য কুরআন ও হাদীসে এর উল্লেখ থাকাকে বৈধতার মাপকাঠি বানিয়ে বেঁচে থাকতে চাই, তবে নিশ্চিতভাবে তা যেমন আমাদের জীবনকে সংকুচিত করে দিবে তেমনি আমাদের কাঁটাছেড়ায় কুরআনের সৌন্দর্য পরিবর্তিত হবে দুর্বোধ্যতায়। পাশাপাশি এ কথাও অনস্বীকার্য সত্য যে, আমাদের বিশ্বাসের মূলভিত্তি এবং জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় বিধান, যেগুলো আমাদের বুদ্ধিবিবেক দিয়ে অনুধাবন করা কিংবা সমাধানে পৌছা সহজ নয়, সেগুলো যথারীতি পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে এবং এর সামান্যতম বিন্দুও অস্পষ্ট কিংবা দুর্বোধ্য নয়। আমরা যদি আমাদের জীবন চলনের সাধারণ সহজ কাজগুলোর বৈধতার জন্য নিজেদের বিবেক ও বোধকে উপেক্ষা করে ইসলামের পাতায় পাতায় এর নির্দেশ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তবে গোটা ইসলামটাই এলোমেলো হয়ে এক হযবরল অবস্থার জন্ম দেবে আমাদের মনমানসে। হাদীসের কিতাবসমূহ থেকে জানা যায়, রাসূল মদীনায় হিজরত করার পর দেখলেন মদীনাবাসীরা ফলন ভালো হওয়ার জন্য পুলিঙ্গ খেজুর গাছ থেকে স্ত্রীলিঙ্গ খেজুর গাছে সংযোগ ঘটায়, (আরবীতে এ কাজকে তালকীহ বলে আর আমাদের দেশের কোথাও তা কলব করা নামে পরিচিত) রাসূল তেমন পছন্দ করলেন না তাদের এ পদ্ধতিকে।

তার অপছন্দ শুনে সাহাবারা এ কাজ ছেড়ে দিলেন। কিন্তু সে বছর তেমন আশানুরূপ ফলন হলো না। বাগান মালিকরা এসে রাসূলকে এ হতাশার কথা জানালে তিনি তাদেরকে বললেন, তোমাদের দুনিয়াবী কাজের ব্যাপারে তোমরাই বেশী ভাল বলতে পারো। প্রমাণিত হচ্ছে, এ সাধারণ প্রাকৃতিক ব্যাপারগুলোর সাথে শরীয়তের হুকুমের কোন সম্পর্ক নেই। ইমাম নববী এ হাদীসের শিরোনাম করতে গিয়ে লিখেছেন, রাসূল দুনিয়াবী ব্যাপারে যা নিজের ধারণা থেকে বলেছেন তা শরয়ী নির্দেশের মতো অবশ্য পালনীয় নয়।

বরং নিজেদের উপকারিতার দিকে খেয়াল রেখে নিজেদের বিবেচনা এখানে অগ্রগণ্য। তবে তিনি যেগুলো হুকুম হিসেবে স্পষ্ট করেছেন, সেসব অবশ্য পালনীয় চাই তা দুনিয়াবী কারবারে হোক কিংবা ইবাদাতের অর্ন্তভুক্ত হোক। (শরহে নববী, খন্ড-১৫, পৃষ্ঠা-১১৬) বদর যুদ্ধের প্রক্কালে রাসূল যখন রণাঙ্গনে পৌঁছে এক জায়গায় ছাউনী স্থাপন করতে চাইলেন, তখন সাহাবী খাব্বাব বিন মুনযির তার কাছে আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি যে এ জায়গা থেকে কাফেরদের মুকাবিলা করতে চাচ্ছেন, তা কি আল্লাহর হুকুমে নির্বাচন করেছেন নাকি যুদ্ধ কৌশল হিসেবে নিজের পক্ষ থেকে নির্বাচন করেছেন? তিনি বললেন, না এটি আমি নির্বাচন করেছি, আল্লাহর হুকুমে নয়। তখন সাহাবী বললেন, তবে এ জায়গা নয়, আমরা আরও একটু সামনে ছাউনী ফেলতে চাই। আর কৌশলগত হিসেবে ঐ জায়গাটি এ জায়গার চেযে বেশী সুবিধাজনক।

কালবিলম্ব কিংবা ওহীর অপেক্ষা না করে রাসূল তার বিবেচনা মেনে নিলেন এবং সেখানেই ছাউনী ফেললেন। অবশেষে ঐ জিহাদে মুসলমানদের জয়ও সুনিশ্চিত হল। প্রতিটি কর্ম ও পদক্ষেপের জন্য আমাদের বিবেক ও আত্মা আমাদের প্রধান বিচারক যদি এ আত্মা পরিশুদ্ধ হয় এবং বিবেক ন্যায়পরায়ণ হয়। এজন্যই রাসূল ওয়াবিসা বিন মাবাদ রা.কে বলেছেন, তুমি তোমার আত্মা তথা মনের কাছে ফতওয়া চাও। দেখো, তোমার মন তাতে সায় দেয় কিনা? যা তোমার মনে সায় দিবে সেটাই পূণ্যময়, আর যা সঙ্কোচবোধ জাগাবে, তা পাপ।

(মুসনাদে আহমদ, ১৭৫৪৫) সুতরাং, ইসলামের ব্যাপকতা ও এর উদ্দেশ্য বুঝে সাজাতে হবে আমাদের দৈনন্দিন জীবন। সেইসাথে নিজের বুদ্ধি বিবেক ও হৃদয়কে কার্যকর করতে হবে পাপ পূণ্যের পার্থক্য বিবেচনায়। মানুষ হিসেবে আমাদের যে শ্রেষ্ঠত্ব সেই শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র কারণ আমাদের বিবেক ও বোধ। এ মহান নেয়ামতকে অন্ধকারে রেখে ইসলাম ধর্ম পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়লে পথ পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনা মোটেও অমূলক নয়। এ দুটোর সমন্বয়ে যে সোনালী সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন সাহাবায়ে কেরাম, এ দুটোর বিচ্ছেদের ফলে আজ সেসব শুধুই ইতিহাস।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।