বাঙলা কবিতা -------------------
নৌকাগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে তাকে, বাতাস পেরিয়ে যাচ্ছে, তাকে পেরিয়ে যাচ্ছে সকল অভিঘাত...
অর এখন,
নিঃসঙ্গ নদীর কিনারে, সে এক নির্জন মানুষ
যে জানে না, কীভাবে কথা বলতে হয় জলতরঙ্গের সাথে।
২.
তারা ফিরে গেল,
একের পর এক ফিরে গেল,
আর কক্ষের ভেতরে ফেলে গেল তাদের ছায়াগুলি, ভ্রূক্ষেপহীন
সেই বৃদ্ধলোক তার দুলুনীপ্রবণ চেয়ারে বসে
তামাক-পাইপে আগুন জ্বালছে আর একঘেয়েমীর কামড়-জর্জরিত ছায়াগুলোর সাথে
শুরু করে দিচ্ছে অন্তহীন আলাপচারিতা...
একের পর এক।
৩.
কুঁজো পরিব্রাজকটি হেঁটে গেল,
তাকে সেই শ্রমিকের মতই দেখাচ্ছিলো, যে পিঠে করে বয়ে নেয় খনিজ সীসার বোঝা।
যতবার সে বিশ্রামের জন্য থামছিলো, ঘাম মুছে, বিড়বিড় করছিলো:
"কত বিশাল এই স্বদেশ আমার!"
৪.
হেমন্ত নগ্ন করে দিচ্ছে গাছপালাদের।
কোনও তুষারপাত নেই, নেই ঝাঁক ঝাঁক পাখির ডানা,
লজ্জা আড়ালের জন্য, নেই কোনই অবগুণ্ঠন।
৫.
সে খুলে রেখেছিলো দরোজাগুলো, জানালাগুলো আর তার হৃদয়- প্রসারিতভাবে
ওইসব দর্শনার্থীর উদ্দেশ্যে, যারা বলেছিলো আসবে তারা।
আর এখানে ঘনিয়ে এলো মধ্যরাত, এখনও অপেক্ষায় আছে সে,
নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো, এই বলে : " হয়তো, আকস্মিক জারিকৃত কোনও জরুরী অবস্থার দরূন বিলম্ব হচ্ছে ওদের!"
যতদিন ধরে ওরা তাকে ছেড়ে গিয়েছে,
এভাবেই ভাবছে ব্যাপরগুলোকে, এভাবেই কথা বলছে সে নিজের সঙ্গে...
৬.
দূরে, কম্পিউটারের পর্দায়, রমণীটি দাঁড়িয়ে আছে জানালার ওপাশে
তার পরীর মত মুখ তৈরি করেছে এক সম্মোহন, যে মুখের শুভ্রতা বিষণ্ণতায় হয় না ম্লান,
সেই চোখের অশ্রুবিন্দুগুলি আলতো গড়িয়ে পড়ছে শূন্যতায়, যেন
গুড়ি গুড়ি মহাজাগতিক আলোক-বৃষ্টি।
দূর থেকে, জানালার ওপাশে ক্রন্দরত এক রমণীর,
অদৃশ্য উপস্থিতি লক্ষ করছে সে।
৭.
গোধূলি বেলায়, সেই রমণীর চোখের সামনে প্রবর্ধিত হচ্ছে ভূমণ্ডল, ধূসরবর্ণ একটা গালিচা যেন দ্বিখণ্ডিত করে দিচ্ছে দিগন্তকে; যার একপাশে দিন, রাত্রি অন্যপাশে।
বসন্তকালীন শুভ্রতার মত শ্বেতদূর্বায় মিশে যাচ্ছে তারা, আর ওখানে, অগণিত মাঠের কিনারা জুড়ে, হারিয়ে যাওয়া আত্মাগুলি ছোটাছুটি করছে, খুঁজে ফিরছে আশ্রয়।
গ্রীষ্মের পর গ্রীষ্ম,
এরকম এক সময়ে, সেই বৃদ্ধা রমণী দাঁড়িয়ে তার আছে উন্মুক্ত দরোজার সামনে, বারবার তাকাচ্ছে পথের দিকে আর দিগন্তকে করাচ্ছে স্তন্যপান, যেন দিগন্তই বয়ে আনে তার শিশুদের ফিরে আসবার এক আগাম বার্তা, যখনই সে পেয়ে যাবে তার শিশুগুলোর পদচারণের ঘ্রাণ।
গ্রীষ্মের পর গ্রীষ্ম,
গোলাপশোভিত করছে সে তার শাদা চুল, যেন তার অনন্ত নিদ্রার মধ্যে, শিশুরা তার, দরোজায় কড়া না-নেড়েই, ফিরে না যায়।
৮.
তার দুর্গটি যথেষ্ট সুরক্ষিত নয়।
প্রতারণা-খোচিত চাবির অনুপ্রবেশ ঠেকাবার পক্ষে,
সেটা ছিলো মেঘের মত নাজুক ও ভঙ্গুর।
৯.
অনেক মানুষ এসেছে আবার চলে গেছে।
অনেক স্বপ্ন এসেছে আবার ফিরে গেছে।
আর সেই পুরনো বাড়িটা এখনও ধুলার পৃষ্ঠপোষক, যখন আইভি লতাগুলো তার বিশাল ফাঁকা ফাঁকা কক্ষগুলো জুড়ে হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে।
ঠিক এখানেই, মার্বেল পাথরের মেঝেতে, লেপ্টে আছে কথার সুবাস; সিঁড়ির ধাপগুলোতে লেগে আছে কফি আর ধূপের চিহ্ন, আর উঠানের ঠিক মাঝখানে, অনন্তকালের জন্য দাঁড়িয়ে আছে এক আপেল গাছ,
পাহারা দিচ্ছে, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তার এই বিস্তৃত ভূসম্পত্তি।
১০.
মৌন অগন্তকটি চলে যাচ্ছিলো পাশ দিয়ে, সমুদ্রশৈবাল আর ফেণামাখা কাঁধে।
কাঠবাদামের বৃক্ষসারিতে পৌঁছালো সে, তার আখেরি বাসনা লিখে রাখতে:
"যখন মরে যাবো আমি, সমুদ্রে নিও আমাকে... নিজের ভূসম্পত্তি বিষয়ে এতোটা আত্মপ্রত্যয়ী এই দেশের মাটিতে, কবর দিও না আমাকে।
"
১১.
ডালিমগাছের কাণ্ড থেকে, এক রমণীর মাথার ওপরে, ঝুলছিলো অসংখ্য ডালিম,
নারীটি, তার হারানো ছেলের জন্য সেলাই করছিলো ছিঁড়ে যাওয়া শার্ট।
ডালিমগুলো ঝুলছিলো সেই এক নারীর উপস্থিতির জুড়ে, যে
তার ছেলেকে একটা দুধশাদা জামা দেবে বলে
নেমে যাচ্ছিলো বিগতদিনের সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে।
১২.
রৌপ্যখোচিত রাত
ডানাময় আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে চক্রান্ত আঁটছিলো, আর
টোকা দিচ্ছিলো সেই নারীটির মুঁদিত আঁখি-পল্লবে, যে ছিলো বনভূমির সুবাসতলে নিদ্রিত।
১৩.
সর্বত্রই আছে সমুদ্র-
সামনের খোলা প্রান্তরে, উঠোনে-আঙ্গিনায় আর ঘর-বাড়িগুলোর ভেতরেও।
সমুদ্র আছে সেই নিদ্রিতার স্বপ্নের ভেতরে যার চোখের পাতাদুটি লবণে সমাহিত।
১৪.
সেই বৃদ্ধা তার নাতিনাতনিদের চোখের মণিতে সেলাই করছিলো ছিঁড়ে যাওয়া অন্ধবিশ্বাস, যে শিশুরা একটা গোলকধাঁধার মধ্যে ঢুকে পড়ার উপলব্ধি নিয়ে ঢুকে পড়ছে এই গল্পের ভেতরে।
আর এই গল্প তার পরিসমাপ্তিকে ছুঁয়ে দেবার আগে
নিদ্রালুতা, তার স্বপ্নভেজা কোমল ডানায় স্পর্শ করছে ওই শিশুদের চোখের পাতাগুলো।
১৫.
মাঠময় ফাঁদ পেতে সন্ধ্যাতারাদের সন্ত্রস্ত করতে করতে
আলতো পায়ে, ওরা অতিক্রম করে যাচ্ছে সন্ধ্যাটিকে।
ধীরে ধীর, ওরা জ্বেলে দিচ্ছিলো এক কলুষিত কৌতুক,
ওদের চোখের মণিগুলো,
শিয়ালের চোখের মত সবুজাভ আলোয় জ্বলে ঊঠলো।
---------------
আমিন সালেহ :
পুরো নাম : আমিন সালেহ মাজাজ।
জন্ম : রামাল্লার এক খ্রিস্ট-পরিবারে, ২১ মার্চ ১৯২১। পেশায় : শিশুপুষ্টি বিশেষজ্ঞ চিকিঃসক ছিলেন। ২ জানুয়ারি ১৯৯৯ তারিখে জেরুজালেমে মৃত্যুবরণ করেন। প্রচলিত অর্থে, যাকে কবিতা লেখা বলা হয় বা কবি বলা হয়ে থাকে; কবিতার সাথে তেমন কোনও সংশ্লিষ্টতা ছিলো না তার। শখের বশে খণ্ড খণ্ড কিছু কবিতা লিখেছিলেন; সেগুলোও সংখ্যায় ৩০টির অধিক নয়।
কিন্তু রচিত কবিতাগুলো পাঠান্তে, পাকাপোক্ত এক কবি হিসেবেই সমীহ জাগে তার প্রতি।
-------
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।