অবিনশ্বর প্রেমের জন্য প্রার্থনা
“চল না বাবা, কতদিন হল যাস না”
মায়ের এমন কথাতে না করতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু কি করবো আমি? এত্ত পরীক্ষা! সময় কোথায়?
“মা, মাফ করা যায় না? পরের ঈদে নাহয় নানার বাড়ি গেলাম”
“আচ্ছা, কিন্তু তোর জন্য এবারো আমার যাওয়া হলনা”
একটু মন খারাপ হল আমার। আমাকে ছাড়া মা কোথাও ঘুরতে যান না। আমি যেতে পারিনা বলে আজ ৪ বছর নানা বাড়ি যাওয়া হয়না মায়ের। যদিও নানা বেঁচে নেই, নানী তো আছেন।
তাই আর রাজি না হয়ে পারলাম না। কিন্তু শর্ত দিলাম, আমি ২ দিনের বেশি থাকতে পারবো না। অগত্যা মা আমার শর্তে রাজি হলেন।
আমরা যখন গ্রামে পৌঁছলাম, তখন রাত ৯ টা। এরমাঝে পুরো গ্রাম ঘুমের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে।
চারদিক নীরব নিস্তব্দ। সেই রাতে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
আমার ঘুম যখন ভাঙল তখন ভোর ৪ টা বেজে ২৭ মিনিট। এমনিতে গ্রাম, তার উপর শীতের সকাল, বাইরে বের হওয়া নিরাপদ নয় ভেবে লেপটা ভালমতো মুড়ি দিলাম। আহ! কি আরাম, কি শান্তি।
না আসলে মিস হয়ে যেত, মনে মনে ভাবলাম। কিন্তু এত আরামেও ঘুম আর আসলোনা। বাধ্য হয়েই গৃহত্যাগ করে বাইরে হাঁটতে গেলাম।
কুয়াশা আর কুয়াশা। কুয়াশার চাদরে ঢাকা সবকিছু।
কয়েক হাতের বেশি নজরই যায় না। একটু গা ছমছম করতে লাগলো। শুনেছি এই গ্রামে নাকি ভুত-প্রেত আছে। অবশ্য সব গ্রামেই এই গল্প শুনা যায়। এ আর নতুন কি।
হাঁটতে হাঁটতে কতদুর গেলাম মনে নেই। হঠাৎ দেখি ফুলের সুবাস! শিউলি ফুল হবে, অনুমান করলাম। কিন্তু সাথে কার যেন শব্দ পাওয়া গেলো। আরেকটু সামনে এগুতেই বুঝলাম কান্নার শব্দ। কোনও এক নারী কাঁদছে।
ভুত নাকি পরী বুঝলাম না। কিন্তু কৌতূহলের কাছে ভয় পরাজিত হল। আমি সামনে এগুতেই থাকলাম।
একটি শিউলি গাছ। গাছে অনেক ফুল।
তবে বেশিরভাগ ফুলই মাটিতে পড়ে গেছে। আর চারপাশ ছড়ানো ফুলের মাঝে দেবীর ভঙ্গিতে বসে আছে এক মেয়ে। কোলের উপর অনেকগুলো শিউলি ফুল। মেয়েটার বয়স বড়োজোর ১৮ হবে। চুলগুলো এলোমেলো।
কাপড়ও তাই। দেখেই বুঝা যাচ্ছে সদ্যই ঘুম থেকে উঠে চলে এসেছে। চোখে কাজল দেওয়া। কিন্তু কান্নায় সব কাজল নষ্ট হয়ে গেছে। এখন সে আস্তে আস্তে কাঁদছে তবে আমাকে দেখনি।
আমার কেন জানি তার কান্না দেখতে ভালো লাগছে! তাই অনেকক্ষন তাকে লক্ষ্য করতে লাগলাম।
১৫ মিনিট হবার পরও তার উঠার নাম নেই। আমিই এগুলাম। আস্তে করে বললাম,
“আমার জন্য কিছু ফুল রেখেছেন? নাকি একাই সব নিয়ে যাচ্ছেন?”
চমকে গেলো মেয়েটি। মায়াবী চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল।
আবার আমার চমকানোর পালা। দূর থেকে চোখ ভালো মতো দেখতে পাইনি। এখন দেখছি। অসাধারন। এই মেয়ের এই চোখের জন্যই অনেক ছেলে প্রান দিতে পারে।
“সব ফুল নিয়ে নিন। ফুল দিয়ে আমি কি করবো?” উত্তর দিল সে।
“আমি আপনাকে অনেকক্ষন ধরে খেয়াল করছি। দুঃখিত। তবে আপনি মনে হয় কাঁদছিলেন”
“অনেকক্ষণ ধরে যেহেতু দেখেছেন, তাহলে মনে হয় সত্যই দেখেছেন”
“আচ্ছা, তাই? আমি অভি, আর আপনি............”
এবার অবাক হলাম।
৩০ সেকেন্ড কোনও কথা বলল না মেয়েটি। তারপর হঠাৎ করে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। আমার কি হল জানিনা, আমিও তার পেছনে পেছেনে গেলাম। কিন্তু কুয়াশার কারনে হারিয়ে ফেললাম। কি আর করা।
কিছুক্ষন উদভ্রান্তের মতো হেঁটে রুমে চলে এলাম।
ঘটনাটা কাউকে বললাম না। বললে আমাকে জীনে ধরেছে মনে করতে পারে। আর মা ভয়ে আমাকে আর থাকতেই দিবেনা এখানে। সারাদিন গ্রামে ঘুরলাম।
আর অপেক্ষা করলাম কখন ভোর হবে।
পরদিন বেশ আগেই আমি ওই শিউলিতলায় চলে গেলাম। একটু পর বুঝলাম কেউ একজন আসছে। হ্যাঁ, সেই মেয়েটিই। এসে আমাকে দেখে মোটেও চমকাল না।
ধরেই নিয়েছিল যে আমি থাকবো।
“আজ কাঁদবেন না?” প্রশ্ন করলাম আমি।
“নাহ, কেঁদে আর কি হবে। আমার বোধহয় বিয়ে করতেই হবে”
এবার কাহিনী বুঝলাম। মেয়ে বিয়েতে রাজি না।
মনে হয় প্রেম টেম করে।
“দাওয়াত দিবেন না? ”
মেয়েটা অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকাল।
“আমার বোধহয় আত্মহত্যা ছাড়া গতি নেই”
হায় হায়, সুন্দরী বলে কি। মনে মনে ভাবলাম আমি।
“আমি যাই” বলে আবার দৌড়ে চলে গেলো।
এবার আর আমি পিছু নিলাম না। আমি জানি , কাল সে আবার আসবে ।
কিন্তু পরদিন আশপাশ খুঁজেও পেলাম না তাকে। শেষ পর্যন্ত পুকুরঘাটে গেলাম। বিস্ময়ে হতবাক হলাম।
মেয়েটি পানিতে নামছে ! আত্মহত্যা করবে নাকি?
এখন আমার উচিত মেয়েটাকে বাঁচানো। কিন্তু আমি যে সাঁতার জানি না। যা হবে হোক , ভেবে পানিতে ঝাপ দিলাম। এবার আমি পড়লাম বিপদে। ওকে বাঁচাবো কি, আমি নিজেই ডুবে যেতে লাগলাম।
মেয়েটা কিছুক্ষণ দেখল। তারপর আমাকে টেনে উঠালো।
“আপনি সাঁতার জানেন?”
“নাহ” লজ্জায় উত্তর দিলাম আমি।
“তাহলে সাঁতার কাটার সখ হল কেন?”
“আমি ভাবছিলাম আপনি বোধহয়............”
“আত্মহত্যা করতে যাচ্ছি?” “আরে বোকা, আমাকে নানু পুকুরে নামতে দেয় না, আম্মুও না, তাই লুকিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আপনি ১২ টা বাজিয়ে দিলেন”
আক্ষরিকঅর্থেই আমি বোকা সেজে গেলাম।
হিরো সাজতে গিয়ে ভিলেন!
উঠে দাঁড়ালো মেয়েটি। ভেজা কাপড়ে অপূর্ব লাগছে তাকে। কারন ভোর বেলা পুকুরঘাটে একা একটি ভেজা নারীর সাথে দাঁড়াতে কেমন লাগে, আগে জানতাম না। আমি মনে হয় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। হুশ ফিরল ধমকে।
“কি দেখেন?” কোমরে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করল সে। এবার আমি আরও মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আর লজ্জাও পেলাম। ইস! ধরা খেয়ে গেলাম।
“না, কিছুনা”
“বুঝতে পারলাম, এখন বাড়ি যান।
লোকজন দেখলে আমার ১২ টা বাজবে। কি ভাববে ওরা বুঝতে পারছেন? আপনারও ১২ টা বাজাবে”
“আচ্ছা আপনার নাম............”
“ভাগেন তো, পরে কথা হবে”
আমি পুলকিত হলাম। যাক, পরে কথা হবে বলেছে।
পরদিন সকাল নয়, সেদিন বিকালেই দেখা হল মেয়েটির সাথে। তারপর? জনলাম অনেক কিছু।
সে ঢাকাতেই থাকে। বেড়াতে এসেছে আমারই মতো। কালই চলে যাবে। শুনে আমার মুখ কালো হয়ে গেলো। কিন্তু যখন মেয়েটি একটি কাগজ ধরিয়ে দিল, আমার আনন্দ দেখে কে।
পরদিন আমিও ঢাকা চলে আসলাম। না এসে উপায় কি। ওর সাথে আবার দেখা করতে হবেনা?
আমার এখনও মনে আছে আমরা যেদিন প্রথম ঘুরতে গিয়েছিলাম। কিছু একটা দেখবার অজুহাতে প্রথম হাত ধরেছিলাম। সে বুঝতে পেরেছিল।
হেসেছিল। আমি বলেছিলাম হাসলে ওর গাল কমলার মতো লাল হয়ে যায়। কিন্তু কমলা কি আসলে লাল হয়?নাকি কমলা রঙের হয়? মাথা ঠিক ছিলনা আমার। মাথা ঠিক থাকবে কিভাবে? জীবনের প্রথম অমৃতসুধা পান করে কেউ কি মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পেরেছে???
সুখের দিন কারোই অনেকদিন টেকে না। আম্মাদেরও টিকলো না।
তার বাসা থেকে বিয়ের জন্য ক্রমাগ্রত চাপ, আর আমার বাসায় জেনে যাবার পর আপত্তি, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বিষিয়ে তুলল। অবশেষে সবকিছু নিয়ে আলোচনা করতে আমরা দেখা করলাম।
“আচ্ছা, তুমি কি আমার জন্য ৬ বছর অপেক্ষা করতে পারবে?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“তোমার কি মনে হয়?”
আমি আর কিছু বললাম না। চিন্তায় মাথা কাজ করছেনা।
“আচ্ছা, তুমি কি আমার সত্যিই বিয়ে করবে?” এবার তার প্রশ্ন।
“তোমার কি মনে হয়?” উত্তর দিলাম আমি। এবং দুজনেই একসাথে হেসে ফেললাম।
৮ বছর পর।
ব্যাক্তিগত চেম্বারে বসে রুগী দেখছি।
পরের রুগী আসার আগেই হঠাৎ করে বিনা অনুমতিতে একটি মেয়ে চেম্বারে ঢুকে গেলো। সেই মেয়েটি। প্রতিবারই সে এমন করে। মৃদু হেসে বলল, “ডাক্তার সাহেব কি বাবুটাকে একটু কোলে নিবেন? অনেকক্ষন ধরেই কাঁদছে”
আমিও হেসে বাবুটাকে কোলে নিলাম। ও হ্যাঁ, বাবুর বয়স মাত্র ৬ দিন।
এখনও নাম রাখিনি। কি নাম রাখা যায় বলেন তো??
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।