বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী ভারতীয় লেখিকা অরুন্ধতী রায়। একদিকে সাহিত্যে যেমন তার দৃপ্ত পদচারণা অন্যদিকে রাজনৈতিক সচেতনতা জাগরণেও তার অনবদ্য অবদান। 'দ্য গড অব স্মল থিংস' বইয়ের জন্য তিনি ১৯৯৭ সালে বুকার পুরস্কার পান।
কিন্তু এই পুরস্কার প্রাপ্তির পরবর্তী সময়ে অরুন্ধতী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষ করে উন্নত দেশ এবং নিজ দেশ ভারতের বিরুদ্ধে খুবই সমালোচনামুখর হয়ে উঠেন। ভারত সরকারের মাওবাদী দমনের 'অপারেশন গ্রিন হান্ট' থেকে শুরু করে সব সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার।
এবার করপোরেট আর ধনিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সমালোচনার তীর ছুড়েছেন তিনি। কথা বলেছেন, চলমান ওয়ালস্ট্রিট দখল কর আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন এই সাহিত্যিক-সমালোচক। ডেমোক্রেসি ওয়াচ'কে একটি সাক্ষাৎকারে এই বিষয়টিসহ অপরাপর নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন অ্যামি গুডমান।
গুডমান : ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় কর্মী অরুন্ধতী রায়ের সঙ্গে এখন কথা বলব।
একজন সক্রিয় কর্মীর বাইরে তিনি একজন লেখিকাও। লিখেছেন, 'দ্য গড অব স্মল থিংস' 'ফিল্ড নোটস অন ডেমোক্রেসি : লিসেনিং টু দ্য গ্রাসহোপার্স' 'অ্যান অর্ডিনারি পারসনস গাইড টু এম্পায়ার' মতো উপন্যাস। তার সর্বশেষ কাজ হলো- 'ওয়াকিং উইথ দ্য কমরেডস'। ভারতের মাওবাদী গেরিলাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম এবং গেরিলাদের সঙ্গে অরুন্ধতীর জঙ্গলে সময় কাটানো নিয়েই বইটি লেখা। গেল সপ্তাহেই নিউইয়র্কে আসেন তিনি।
আর এসেই প্রথম যে কাজটি করলেন তা হলো, ওয়ালস্ট্রিটে গেলেন আন্দোলন দেখতে। এরপর অনেক বিষয়েই তার সঙ্গে কথা হলো আমার। অনেক বিষয়ের মধ্যে ওয়ালস্ট্রিট দখল আন্দোলন নিয়ে যে কথা হলো..
অরুন্ধতী রায় : আপনি জানেন, ওয়ালস্ট্রিট কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। কারণ, এটা হলো সাম্রাজ্যবাদের প্রাণভোমরা। একে আমরা সাম্রাজ্য হিসেবেই দেখছি।
এখান থেকেই পুরো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এই বিরোধিতা গোটা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। এর কারণে সবাই এর গুরুত্ব এবং গভীরতা অনুধাবন করতে পেরেছে। আমাকে অনেক আশাবাদী করেছে এই আন্দোলন। দেখুন, অনেক দিন পর কিছু রাজনীতিক তৈরি হচ্ছে এবং পুরনো রাজনীতিক এই আচরণে ক্ষুব্ধ। অনেক কিছুই বলার আছে।
কিন্তু সবার আগে জনগণকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগুতে হবে। এভাবেই রাজনীতিক এবং করপোরেটদের ক্ষমতা এবং সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার ব্যবস্থা ভেঙে দিতে হবে। আর এটাই হওয়া উচিত আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য। যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে মডেল মনে করে তাদের বিশ্বাস ভেঙে দিতে হবে। আমি আপনাকে বলতে পারি, ভারতে এখনো অনেক শক্তি আছে যারা ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনের মতো রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম।
আমি মনে করি, ওয়ালস্ট্রিটের আন্দোলনকারী এবং ভারতের সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া ফরেস্ট আদতে একটা বড় পাইপলাইনের মাধ্যমে সংযুক্ত। আর আমি নিজেও সেই পাইপলাইনের একজন।
গুডমান : ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন নিয়ে আপনার কাছে কিছু জানতে চাই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন আপনি?
অরুন্ধতী রায় : বারাক ওবামার বিজয়ের পর যারা টুপি খুলে আনন্দ প্রকাশ করেছেন আমি তাদের দলে নই। খুব মনে পড়ছে, যখন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষগুলো হোয়াইট হাউজে কৃষ্ণাঙ্গ লোক দেখতে পেয়ে খুশি হয়েছিলেন।
তিনি (ওবামা) কী করেছেন তা আপনিও দেখেছেন। এর মাধ্যমে আমি তাকে তিরস্কারই করতে চেয়েছি। তিনি আসলে কী করেছেন? আফগানিস্তানে যুদ্ধের সময়সীমা বাড়িয়ে এখন ঠেলে দিচ্ছেন পাকিস্তানের দিকে। ড্রোন হামলা চালিয়ে প্রতিদিনই মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। আমার মনে হয় তিনি নিজেও জানেন না যে তিনি আসলে এই উপমহাদেশে কী করতে চান।
তবে ধীরে ধীরে এটা একটা ভয়ঙ্কর অবস্থার দিকে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে যা ঘটছে তা দেখে আমি বিপর্যস্ত। যদি বলি, জর্জ বুশ যা করেছেন তা তিনিও করছেন, তাহলে সবাই তাকে ফ্যাসিস্ট বলবে। একজন মানুষ দিনের আলোতে যে কাজ করছেন অন্যদের তা করতে রাতের অন্ধকার লাগে। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকানের বাইরে কোন বিকল্প নেই।
এই অবস্থা ভারতেও, সেখানে কংগ্রেস আর বিজেপি। মানুষ আসলে জিম্মি হয়ে পড়েছে। নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনীতিতে আমাদের ভাবনাগুলো আটকে গেছে। আর তাই এর পক্ষে সুন্দর সুন্দর কথা না চাইলেও আমাদের বলতে হবে। কিন্তু আমি অন্তত বলতে চাই না।
গুডমান : এবার কথা বলা যাক আপনার 'ওয়াকিং উইথ দ্য কমরেডস' বই নিয়ে। আপনি ওই বইয়ে যাদের কমরেডস বলছেন তাদের সঙ্গে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন? আসলে তারা কারা?
অরুন্ধতী রায় : ওরা (কমরেডস) মাওবাদী গেরিলা। ভারত সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে তারা ভারতের সেন্ট্রাল ফরেস্টে অবস্থান করছেন। ভারত সরকার বাইরেও খনিজ উত্তোলনকারী করপোরেশনের বিরুদ্ধেও তারা লড়ে যাচ্ছে। কারণ এই করপোরেশনগুলো আদিবাসী উচ্ছেদ এবং বনভূমি উজার করছে।
'আসলে কমরেড কারা?' আমার ধারণা প্রশ্নটি নিয়ে আপনি যতটা ভেবেছেন ব্যাপারটা তার চেয়েও জটিল। আমি সেখানে গিয়ে তাদের দেখেছি। তাদের সম্পর্কে আমার কিছুই জানা ছিল না। মাওধারার কমিউনিস্ট পার্টি ?অব ইন্ডিয়া সেই অবতার কেন্দ্রিক হয়েই নিজেদের অবস্থান বজায় রেখেছে। যাদের আমি মাওবাদী বলছি তারা ৯৯ শতাংশই আদিবাসী।
আদিবাসীরা কীভাবে এবং কিসের জন্যইবা মাওবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছে তা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু বিষয়টা এখনো অমীমাংসিত বলেই জানি।
গুডমান : 'আদিবাসী' শব্দটা কি একটু পরিষ্কার করবেন?
অরুন্ধতী রায় : আদিবাসী বলতে আসলে ভারতের আদি বাসিন্দাদের বোঝানো হয়েছে। মূলত তারা যারা এই মাটিরই সন্তান। এই মাটির সন্তানদের তাহলে আমরা কি বলতে পারি, উপজাতীয় মানুষ।
ভারতে তাদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য নয়। বিভিন্ন উপজাতিতে বিভক্ত প্রায় ১৫ কোটি মানুষের বসবাস এখানে। গুডমান : আদিবাসীদের বিশাল এই জনসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক।
অরুন্ধতী রায় : হ্যাঁ, কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই তারা প্রায় ধ্বংসের কিনারায় দাঁড়িয়ে। আর ভারতের গণতন্ত্রের সব উপাদানই কমবেশি গোপন ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছে।
কেন্দ্রীয় বনভূমির ওই জঙ্গল থেকে আসলে খুব কম খবরই বের হয়। গেল বছর তো ভারত সরকার তাদের বিরুদ্ধে 'অপারেশন গ্রিন হান্ট' নামে যুদ্ধই ঘোষণা করে দিয়েছে। যারা খনিজ উত্তোলনকারীদের কাছ থেকে তাদের জমি বাঁচাতে চেয়েছিল তারাই আজ হয়ে গেছে মাওবাদী। সবাইকেই সরকার এখন মাওবাদী বানিয়ে দিয়েছে। এরমধ্যে জঙ্গি, গান্ধীবাদী, স্বাধীনতা আন্দোলনকারী সবাই অন্তর্ভুক্ত।
জঙ্গলে অনেকগুলো আইন জারি আছে। 'অনৈতিক কর্ম প্রতিরোধ আইন' এবং 'ছত্তিশগড় জননিরাপত্তা আইন' এর আওতায় নিরাপত্তা বাহিনী যে কাউকে আটক করতে পারবে কোন প্রকার জবাবদিহিতা ছাড়াই। আর এজন্য কয়েক হাজার মানুষ এখন কারারুদ্ধ। জঙ্গলে ২০ হাজার সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। ছত্তিশগড়ের কথাই যদি বলতে হয়, আমি সেখানে যে পথ দিয়েই গিয়েছি, সেখানেই সরকারের সহযোগিতায় গড়ে তোলা হয়েছে পাহাড়াদার পরিষদ।
আর এরাই আসলে ধর্ষণ-লুটপাটের সঙ্গে জড়িত। সেখানকার মানুষদের ওপরে আসলে তারা জোর খাটাচ্ছে। এতে করে হয় তারা জঙ্গলেই আশ্রয় নিচ্ছে, নয়ত অন্য কোন রাজ্যে চলে যাচ্ছে। যারা পালিয়ে যাচ্ছে তাদের অনেকেই যোগ দিচ্ছে মাওবাদীদের সঙ্গে। তবে সরকারের মূল উদ্দেশ্য হলো জঙ্গল খালি করা।
কারণ ২০০৫ সালে বিভিন্ন খনিজ উত্তোলনকারী কোম্পানির সঙ্গে একশ'রও বেশি চুক্তি সই করেছে ভারত সরকার। এরপর থেকেই শুরু হয়েছে যুদ্ধ।
গুডমান : আমরা কথা বলছি বিখ্যাত ভারতীয় লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের সঙ্গে। সমপ্রতি 'ওয়াকিং উইথ দ্য কমরেডস' নামে তার আরও একটি বই বের হয়েছে। তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের বাকি অংশ পরবর্তীতে দেয়া হবে।
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম।
মূল পোস্ট: Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।