আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নির্মলেন্দু গুণের প্রেমের কবিতা...

বালক ভুল করে পড়েছে ভুল বই , পড়েনি ব্যাকরণ পড়েনি মূল বই কবিতার পাঠক মাত্রই জানেন কবিতা কতখানি মন ছুঁয়ে দিতে পারে । আর তা যদি হয় আধুনিক কবিতার প্রাণ পুরুষ নির্মলেন্দু গুণের কবিতা তাহলে তো চোখ বন্ধ করে তুলে নিতে হয় অক্ষরের প্রজাপতি উড়ানো নির্মলেন্দু গুণের কবিতার বইগুলো । কয়েক দশক ধরেই নির্মলেন্দু গুণ বাংলা কবিতার জমিন চেষে ফলিয়ে যাচ্ছেন কবিতার সোনালী ফসল । কখোনো প্রেমের কখোনো বিরহের আবার কখোনাবো দেশাত্ববোধ উঠে এসেছে গুণের কবিতায় । নিরলস জেগে থাকা কবিতার এই কান্ডারী ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন প্রিয় থেকে প্রিয়তর ।

যদি কেউ বলে বসেন কেন নির্মলেন্দু গুণ ?? আমি বলবো যখন মনের ভিতর বেদনার উথালপাতাল ঢেউ খেলে যায় , কষ্ঠের দ্বীর্ঘশ্বাসে ক্রমশ ভারী হয় আকাশ ঠিক তখনো নির্মলেন্দু গুণ সমানভাবে সাহস জুগিয়ে যান আমার অসময়ে । তাই প্রিয় কবির তালিকায় যুক্ত হয় আরো একটি নাম , নির্মলেন্দু গুণ । নির্মলেন্দু গুণের অসংখ্য কবিতার ভিতর ৪০ টি কবিতা নিয়ে নির্মলেন্দু গুণের প্রেমের কবিতা নামে এই সংকলনটি সাজানোর চেষ্টা করেছি । নির্মলেন্দু গুণ এবং তাঁর কবিতা হয়ে উঠুক সবার কাছে সমানভাবে প্রিয় তোমার চোখ এতো লাল কেন ? আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক, শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরজা খুলে দেবার জন্য। বাইরে থেকে দরজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত।

আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই কেউ আমাকে খেতে দিক। আমি হাত পাখা নিয়ে কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না। আমি জানি এই ইলেকট্রিকের যুগ নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী-সেবার দায় থেকে। আমি চাই কেউ একজন জিজ্ঞেস করুকঃ আমার জল লাগবে কিনা, আমার নুন লাগবে কিনা, পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরোও একটা তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কিনা। এঁটো বাসন, গেঞ্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি।

আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই কেউ একজন ভেতর থেকে আমার ঘরের দরোজা খুলে দিক। কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক। কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে জিজ্ঞেস করুকঃ “তোমার চোখ এতো লাল কেন তুলনামূলক হাত তুমি যেখানেই স্পর্শ রাখো সেখানেই আমার শরীর৷ তোমার চুলের ধোয়া জল তুমি যেখানেই খোঁপা ভেঙ্গে বিলাও মাটিকে; আমি এসে পাতি হাত, জলভারে নতদেহ আর চোখের সামগ্রী নিয়ে ফিরি ঘরে, অথবা ফিরি না ঘরে, তোমার চতুর্দিকে শূন্যতাকে ভরে থেকে যাই৷ তুমি যেখানেই হাত রাখো, যেখানেই কান থেকে খুলে রাখো দুল, কন্ঠ থেকে খুলে রাখো হার, সেখানেই শরীর আমার হয়ে ওঠে রক্তজবা ফুল৷ তুমি যেখানেই ঠোঁট রাখো সেখানেই আমার চুম্বন তোমার শরীর থেকে প্রবল অযত্নে ঝরে যায়৷ আমি পোকা হয়ে পিচুটির মতো তোমার ঐ চোখের ছায়ায় প্রতিদিন খেলা করে যাই, ভালোবেসে নিজেকে কাঁদাই৷ তুমি শাড়ির আঁচল দিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিলে আমি রথ রেখে পথে এসে তোমারই দ্বৈরথে বসে থাকি তোমার আশায়৷ তুমি যেখানেই হাত রাখো আমার উদগ্রীব চিত্র থাকে সেখানেই৷ আমি যেখানেই হাত পাতি সেখানেই অসীম শূন্যতা, তুমি নেই৷ মানুষ আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম, হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়, মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় । আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি, গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি। সাপে কাটলে টের পাই না, সিনেমা দেখে গান গাই না, অনেকদিন বরফমাখা জল খাই না ।

কী করে তfও বেঁচে থাকছি, ছবি আঁকছি, সকালবেলা, দুপুরবেলা অবাক করে সারাটা দিন বেঁচেই আছি আমার মতে । অবাক লাগে । আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে জুতো থাকতো, বাড়ি থাকতো, ঘর থাকতো, রাত্রিবেলায় ঘরের মধ্যে নারী থাকতো, পেটের পটে আমার কালো শিশু আঁকতো । আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে আকাশ দেখে হাসবো কেন ? মানুষগুলো অন্যরকম, হাত থাকবে, নাক থাকবে, তোমার মতো চোখ থাকবে, নিকেলমাখা কী সুন্দর চোখ থাকবে ভালোবাসার কথা দিলেই কথা রাখবে । মানুষ হলে উরুর মধ্যে দাগ থাকতো , বাবা থাকতো, বোন থাকতো, ভালোবাসার লোক থাকতো, হঠাৎ করে মরে যাবার ভয় থাকতো ।

আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা আর হতো না, তোমাকে ছাড়া সারাটা রাত বেঁচে থাকাটা আর হতো না । মানুষগুলো সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ; অথচ আমি সাপ দেখলে এগিয়ে যাই, অবহেলায় মানুষ ভেবে জাপটে ধরি । যাত্রাভঙ্গ হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে মন বাড়িয়ে ছুঁই, দুইকে আমি এক করি না এক কে করি দুই। হেমের মাঝে শুই না যবে, প্রেমের মাঝে শুই তুই কেমন কর যাবি? পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া আমাকেই তুই পাবি। তবুও তুই বলিস যদি যাই, দেখবি তোর সমুখে পথ নাই।

তখন আমি একটু ছোঁব হাত বাড়িয়ে জড়াব তোর বিদায় দুটি পায়ে, তুই উঠবি আমার নায়ে, আমার বৈতরণী নায়ে। নায়ের মাঝে বসবো বটে, না-এর মাঝে শোবো, হাত দিয়েতো ছোঁব না মুখ দুঃখ দিয়ে ছোঁব। শুধু তোমার জন্য কতবার যে আমি তোমোকে স্পর্শ করতে গিয়ে গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন। তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও কতবার যে আমি সে কথা বলিনি সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন। তোমার হাতের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবেঃ ‘এই ওঠো, আমি, আ…মি…।

‘ আর অমি এ-কী শুনলাম এমত উল্লাসে নিজেকে নিক্ষেপ করবো তোমার উদ্দেশ্যে কতবার যে এরকম একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে কল্পনা করেছি, সে-কথা আমার ঈশ্বর জানেন। আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য, আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য, আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য। তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে, আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য। পূর্ণিমার মধ্যে মৃত্যু একদি চাঁদ উঠবে না, সকাল দুপুরগুলো মৃতচিহ্নে স্থির হয়ে রবে; একদিন অন্ধকার সারা বেলা প্রিয় বন্ধু হবে, একদিন সারাদিন সূর্য উঠবে না।

একদি চুল কাটতে যাব না সেলুনে একদিন নিদ্রাহীন চোখে পড়বে ধুলো। একদিন কালো চুলগুলো খ’সে যাবে, কিছুতেই গন্ধরাজ ফুল ফুটবে না। একদিন জনসংখ্যা কম হবে এ শহরে, ট্রেনের টিকিট কেটে একটি মানুষ কাশবনে গ্রামে ফিরবে না। একদিন পরাজিত হবো। একদিন কোথাও যাব না, শূন্যস্থানে তুমি কিম্বা অন্য কেউ বসে থেকে বাড়াবে বয়স।

একদিন তোমাকে শাসন করা অসম্ভব ভেবে পূর্ণিমার রাত্রে মরে যাব। মোনালিসা চোখ বন্ধ করলে আমি দেখতে পাই সদ্য-রজঃস্বলা এক কিশোরীরে− যে জানে না, কী কারণে হঠাৎ এমন তীব্র তুমুল আনন্দ-কাতরতা ছড়িয়ে পড়েছে তার নওল শরীরে। মনুর ভাষায় গৌরী, এইটুকুনু মেয়ে চমকে ওঠে নিজের পানে চেয়ে− দেখে তার অঙ্গজুড়ে ফুলের উৎসব। মনে হয় ছড়িয়ে পড়েছে মর্ত্যে নার্গিস আর বার্গিসের স্বর্গপুষ্পঘ্রাণ। মাকে ডেকে মেয়েটি শুধায়− ‘আমার শরীরে ফুলের সৌরভ কেন? মেয়েরা বুঝি ফুলের উদ্যান?’ মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে মা বলেন, ‘বোকা মেয়ে, কিচ্ছু বোঝে না,−আয়, আজ আমি কুসুমগরমজলে তোকে নিজ হাতে গোসল করাব।

’ মা’র বুকে মাথা পেতে মেয়েটি তখন নিজেই কখন যেন মা হয়ে যায়। এই লাভাস্রোত, এই সঙ্গকাতরতা তাকে শেষে কোথায় ভাসিয়ে নেবে জানে না সে; বোঝে না সে তার বৃক্ষপত্রে কার হাওয়া লাগে? অগ্নিকুন্ডে বায়ুর মতন ছুটে এসে কে তাকে জড়াবে আদরে, সোহাগে? জানে না সে, বোঝে না সে তার চোখে, ঠোঁটে, তলপেটে, ঘুমভাঙা স্তনে জেগেছে যে ঢেউ তার গন্তব্য কোথায়? আনন্দ পুরুষে? নাকি আনন্দ সন্তানে? এইসব দেহতত্ত্ব জানার আগেই, এইসব গূঢ় গোপন রহস্যভেদ হওয়ার আগেই আষাঢ়ের এক বৃষ্টিভেজা রাতে মোনালিসার বিয়ে হয়ে গেল− লিওনার্দো দা ভিঞ্চির সাথে। লিওনার্দো অতঃপর দীর্ঘ রাত্রি জেগে জীবনের শেষ রং দিয়ে তাঁর প্রিয়তমা তরুণী ভার্যা মোনালিসাকে ক্যানভাসে আঁকলেন। শিল্পের ঔরসে মোনালিসা গর্ভবতী হলে স্বর্গ থেকে মখলুকাতে পুষ্পবৃষ্টি হলো। সিন্ধুর বিজয়রথ পশিল নদীতে− শান্ত হলো ক্ষিপ্তোন্মত্ত সমুদ্রের জল।

মোনালিসা, য়ুরোপের প্রথম রমণী− পুরুষের কান্ড দেখে হাসে। ফুলদানি যেকোনো বাগান থেকে যেটা ইচ্ছে সেই ফুল, যেকোনো সময় আমি তুলে নিয়ে যদি কভু তোমার খোঁপায়, আহা, অজগর তোমার খোঁপায় সাজাবার সুজোগ পেতাম–; তাহলে দেখতে লীলা, তোমার শরীর ছুঁয়ে লাবণ্যের লোভন ফুলেরা উদ্বেল হৃদয়ে নিত্য বিপর্যস্ত হতো, মত্ত মমতায় বলতো আশ্চর্য হয়ে, হতো বলতেইঃ ‘খোঁপার মতন কোনো ফুলদানি নেই৷’ টেলিফোনে প্রস্তাব আমি জানি, আমাদের কথার ভিতরে এমন কিছুই নেই, অনর্থ করলেও যার সাহায্যে পরস্পরের প্রতি আমাদের দুর্বলতা প্রমাণ করা সম্ভব। আমিও তো তোমার মতোই অসম্পর্কিত-জ্ঞানে এতদিন উপস্থাপন করেছি আমাকে। তুমি যখন টেলিফোন হয়ে প্রবেশ করেছো আমার কর্ণে- আমার অপেক্ষাকাতর হৃৎপিণ্ডের সামান্য কম্পনও আমি তোমাকে বুঝতে দিই নি। দুর্বলতা ধরা পড়ে যায় পাছে।

তুমিও নিষ্ঠুর কম নও, তুমি বুঝতে দাওনা কিছু। জানি, আমার কাছেই তুমি শিখেছিলে এই লুকোচুরি করা খেলা। কিন্তু এখন, যখন ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে আমাদের বেলা, তখন ভেতরের চঞ্চলতাকে আমরা আর কতটা লুকাবো? অস্ত যাবার আগে প্রবল সূর্যও চুম্বন করে পর্বত শিখর, আর আমরা তো দুর্বল মানুষ, মিলনে বিশ্বাসী নর-নারী। কার ভয়ে, কী প্রয়োজনে আমরা তাহলে শামুকের মতো স্পর্শমাত্র ভিতরে লুকাই আমাদের পল্লবিত বাসনার শূঁড়। তার চেয়ে চল এক কাজ করি, তুমি কান পেতে শোনো, তুমি শুধু শোনো, আর আমি শুধু বলি, বলি, ভালবাসি।

ওটা কিছু নয় এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ? একটু দাঁড়াও আমি তৈরী হয়ে নিই । এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ? তেমার জন্মান্ধ চোখে শুধু ভুল অন্ধকার । ওটা নয়, ওটা চুল । এই হলো আমার আঙ্গুল, এইবার স্পর্শ করো,–না, না, না, -ওটা নয়, ওটা কন্ঠনালী, গরলবিশ্বাসী এক শিল্পীর মাটির ভাস্কর্য, ওটা অগ্নি নয়, অই আমি–আমার যৌবন । সুখের সামান্য নিচে কেটে ফেলা যন্ত্রণার কবন্ধ–প্রেমিক, ওখানে কী খোঁজ তুমি ? ওটা কিছু নয়, ওটা দুঃখ ; রমণীর ভালোবাসা না-পাওয়ার চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা নদী, নীল হয়ে জমে আছে ঘাসে,–এর ঠিক ডানপাশে , অইখানে হাত দাও, হ্যাঁ, ওটা বুক, অইখানে হাতা রাখো, ওটাই হৃদয় ।

অইখানে থাকে প্রেম, থাকে স্মৃতি, থাকে সুখ, প্রেমের সিম্পনি ; অই বুকে প্রেম ছিল, স্মৃতি ছিল, সব ছিল তুমিই থাকো নি । এবারই প্রথম তুমি ভুলে যাও তুমি পূর্বেও ছিলে মনে করো এই বিশ্ব নিখিলে এবারই প্রথম তুমি। এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না ছিলে না আকাশে, নদী জলে ঘাসে ছিলে না পাথরে ঝর্ণার পাশে। এবারই প্রথম তুমি। এর আগে তুমি কিছুতে ছিলে না।

ফুলেও ছিলে না, ফলেও ছিলে না নাকে মুখে চোখে চুলেও ছিলে না। এবারই প্রথম তুমি। এর আগে তুমি এখানে ছিলে না এর আগে তুমি সেখানে ছিলে না এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না। এবারই প্রথম তুমি। রাতের পুণ্য লগনে ছিলে না নীল নবঘন গগনে ছিলে না।

এবারই প্রথম তুমি। এর আগে তুমি তুমিও ছিলে না। এবারই প্রথম তুমি। এপিটাফ করতল ভরা এই ম্লান রেখাগুলো তোমাদের জন্য রেখে গেলাম। হাড়গুলো থেকে সার হবে, সার থেকে জন্ম নেবে হাড়ের গোলাপ।

আমার যে ছেলেটির জম্ন হয় নি, তাকে দিও এই দুর্বিনিত শীসের কলম। যে শব্ দটি আমি উচ্চারণ করতে পারলুম না— তোমাদের প্রচণ্ড ঘৃণায়, সন্দেহে, তার আত্মা রক্তাপ্লুত হয়েছে বারবার। যে গান গাইতে পারি নি, তার সুর বেজেছে চৈতন্যে। যে কবিতা লেখা হল না সে-ও ছিল সংগঠিত সীসার ভিতরে। এই কবরগুলো সাক্ষ দেবে, ভালবেসেছিলাম।

উল্টোরথ শুধু চোখে নয়, হাত দিয়ে হাত, মুখ দিয়ে মুখ, বুক দিয়ে বুক ; ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট খোলো, এইভাবে খুলে খুলে তোমাকে দেখাও । শুধু চোখে নয়, নখ দিয়ে নখ, চুল দিয়ে চুল, আঙুলে আঙুল; হাঁটু দিয়ে হাঁটু, উরু দিয়ে উরু, আর এটা দিয়ে ওটাকে ঠেকাও । শুধু চোখে নয়, চোখে চোখে চোখ, বাহু দিয়ে বাহু, নাভি দিয়ে নাভি; চাবি দিয়ে তালা খোলা দেখিয়াছি, তালা দিয়ে খোলো দেখি চাবি ? উপেক্ষা অনন্ত বিরহ চাই, ভালোবেসে কার্পণ্য শিখিনি৷ তোমার উপেক্ষা পেলে অনায়াসে ভুলে যেতে পারি সমস্ত বোধের উত্স গ্রাস করা প্রেম; যদি চাও ভুলে যাবো, তুমি শুধু কাছে এসে উপেক্ষা দেখাও৷ আমি কি ডরাই সখি, ভালোবাসা ভিখারি বিরহে? আসমানী প্রেম নেই তবু যা আছের মতো দেখায় আমরা তাকে আকাশ বলে ডাকি, সেই আকাশে যাহারা নাম লেখায় তাদের ভাগ্যে অনিবার্য ফাঁকি ! জেনেও ভালোবেসেছিলাম তারে , ধৈর্য ধরে বিরহ ভার স’বো ; দিনের আলোয় দেখাবো নিষ্প্রভ জ্বলবো বলে রাতের অন্ধকারে । আমায় তুমি যতোই ঠেলো দূরে মহাকাশের নিয়ম কোথায় যাবে ? আমি ফিরে আসবো ঘুরে ঘুরে গ্রহ হলে উপগ্রহে পাবে ! মাটি হলে পাবে শস্য- বীজে বাতাস হলে পাবে আমায় ঝড়ে ! মৃত্যু হলে বুঝবে আমি কি যে , ছিলেম তোমার সারাজীবন ধরে ! আমি চলে যাচ্ছি জয় করবার মতো একটি মনও যখন আর অবশিষ্ট নেই, তখন আমার আর বসে থেকে কী প্রয়োজন? আমি যাই। তোমরা পানপাত্র হাতে হোয়াং হো রেস্তোঁরার নির্জনতায় মৃদু আলোর নিচে বসে মৃদুলের গান শোনো, আমি যাই।

মহাদেব-নীলা-অসীম-অঞ্জনা-কবীর-বদরুন আমি যাই, ইয়াহিয়া, আমি চললাম। এই-যে নাসরিন, আমি আসি। যদি কোনোদিন এই রাত্রি ভোর হয়, যদি কখনো আবার সূর্য ওঠে রূপসী বাংলায়, আবার কখনো যদি ফিরে পাই আমার যৌবন, যদি পাই অনন্ত স্বপ্নের মতো নারী, কবি না হয়ে, অন্য যা-কিছু হয়ে আমি ফিরে আসতেও পারি। অভিভূত কবির মতন নারীকে আমি ভালোবেসেছিলাম। সুচিত্রা সেনের মতো অপরূপা, বিদুষী-সুন্দরী ছিল তারা, তাদের দেহে স্বর্গের লাবণ্য ছিল কিন্তু হৃদয় ছিল ঘাস।

আমার প্রেম নিয়ে তারা কত রকমের যে রহস্য করেছে- গাধা ভেবে কেউবা নাকের ডগায় ঝুলিয়ে দিয়েছে মুলো; কেউবা উরাত দেখিয়ে-দেখিয়ে কাটিয়েছে কাল। তারপর একদিন সর্পচর্মবৎ আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেছে দূরে। আমি নিঃস্ব গৃহকোণে, তারা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বে। অথচ তাদের কথা ভেবে আমি কেঁদেছি নিদ্রায়-জাগরণে। এখন আমারও হৃদয়ে আর প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই, বাসনার আলোড়ন নেই, আজ আমারও হৃদয়ে শুধু ঘাস, শুধু স্মৃতি, শুধু স্মৃতি, শুধু স্মৃতি আর স্মৃতির দীর্ঘশ্বাস।

জয় করবার মতো একটি মনও যখন আর অবশিষ্ট নেই, তখন আর আমার বসে থেকে কী প্রয়োজন? আমি আর কতো ভালোবাসবো? আর কার জন্যে অপেক্ষা আমার? তার চেয়ে এই কি যথার্থ নয়? আমি খুব দূরে চলে যাই। যদি কোনোদিন এই রাত্রি ভোর হয়, আবার কখনো যদি সূর্য ওঠে নিষ্ঠুর বাংলায়, আবার কখনও যদি ফিরে পাই আমার যৌবন, যদি পাই আমার স্বপ্নের সেই নারী, কবি না হয়ে, অন্য যা-কিছু হয়ে আমি ফিরে আসতেও পারি। তোমরা পানপাত্র হাতে হোয়াং হো রেস্তোঁরার নির্জনতায় মৃদু আলোর নিচে বসে মৃদুলের গান শোনো, আমি চলি। মহাদেব-নীলা-অসীম-অঞ্জনা-কবীর-বদরুন, আমি যাই, ইয়াহিয়া, আমি চললাম। এই-যে নাসরিন, আমি আসি।

আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও তোমার পায়ের নিচে আমিও অমর হব, আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও। এই নাও আমার যৌতুক, এক-বুক রক্তের প্রতিজ্ঞা। ধুয়েছি অস্থির আত্মা শ্রাবণের জলে, আমিও প্লাবন হব, শুধু চন্দনচর্চিত হাত একবার বোলাও কপালে। আমি জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে উড়াব গাণ্ডীব, তোমার পায়ের কাছে নামাব পাহাড়। আমিও অমর হব, আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।

পায়ের আঙুল হয়ে সারাক্ষণ লেগে আছি পায়ে, চন্দনের ঘ্রাণ হয়ে বেঁচে আছি কাঠের ভিতরে। আমার কিসের ভয় ? কবরের পাশে থেকে হয়ে গেছি নিজেই কবর, শহীদের পাশে থেকে হয়ে গেছি নিজেই শহীদ, আমার আঙুল যেন শহীদের অজস্র মিনার হয়ে জনতার হাতে হাতে গিয়েছে ছড়িয়ে। আমার কিসের ভয় ? তোমার পায়ের নিচে আমিও অমর হব, আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও এই দেখো অন্তরাত্মা মৃত্যুর গর্বে ভরপুর, ভোরের শেফালি হয়ে পড়ে আছে ঘাসে। আকন্দ-ধুন্দুল নয়, রফিক-সালাম-বরকত-আমি; আমারই আত্মার প্রতিভাসে এই দেখ আগ্নেয়াস্ত্র, কোমরে কার্তুজ, অস্থি ও মজ্জার মধ্যে আমার বিদ্রোহ, উদ্ধত কপাল জুড়ে যুদ্ধের এ-রক্তজয়টিকা। আমার কিসের ভয় ? তোমার পায়ের নিচে আমিও কবর হব, আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।

আগ্নেয়াস্ত্র পুলিশ স্টেশনে ভিড়,আগ্নেয়াস্ত্র জমা নিচ্ছে শহরের সন্দিগ্ধ সৈনিক। সামরিক নির্দেশে ভীত মানুষের শটগান,রাইফেল,পিস্তল এবং কার্তুজ,যেন দরগার স্বীকৃত মানত,টেবিলে ফুলের মতো মস্তানের হাত। আমি শুধু সামরিক আদেশ অমান্য করে হয়ে গেছি কোমল বিদ্রোহী,প্রকাশ্যে ফিরছি ঘরে অথচ আমার সঙ্গে হৃদয়ের মতো মারাত্তক একটি আগ্নেয়াস্ত্র,আমি জমা দেইনি। আকাশ ও মানুষ কবে থেকে আকাশ দাঁড়িয়ে আছে একা, তার বুক থেকে খসে পড়েছে কত তারা। বেঁচে থাকলে আরো কত তারাই খসবে, তা নিয়ে আকাশ কি দুঃখ করতে বসবে? না, বসবে না, আমি বলছি, লিখে নাও, আকাশকে তো মহান মানি এ-কারণেই।

মনুষ্যবৎ হলে কি মানুষ তাকে মানতো? প্রিয়জন চলে গেলে মানুষই ব্যথিত হয়, আকাশ নির্বিকার, আকাশ কখনও নয়। তোমরা মানুষ, তাই সহজেই দুঃখ পাও, হে ঈশ্বর, আমাকে আকাশ করে দাও। পতিগৃহে পুরোনো প্রেমিক পাঁজরে প্রবিষ্ট প্রেম জেগে ওঠে পরাজিত মুখে, পতিগৃহে যেরকম পুরোনো প্রেমিক স্বামী ও সংসারে মুখোমুখি । প্রত্যাখ্যানে কষ্ট পাই,–ভাবি, মিথ্যে হোক সত্যে নাই পাওয়া । বুকের কার্নিশে এসে মাঝে-মধ্যে বসো প্রিয়তমা, এখানে আনন্দ পাবে, পাবে খোলা হাওয়া ।

সেই কবে তোমাকে বুনেছি শুক্রে, শুভ্র বীজে, যখন নদীর পাড় ঢাকা ছিল গভীর সবুজে । সময় খেয়েছে মূলে, বীজের অঙ্কুরে অমাক্রোধ, দাবাগ্নিতে পুড়ে গেছে ভালোবাসা জনিত প্রবোধ । অহল্যাও পেয়েছিল প্রাণ জীবকোষে, পাথর-প্রপাতে একদিন । তোমার অতনু জুড়ে কোনোদিন হবে নাকি সেরকম প্রাণের সঞ্চার ? কোনদিন জাগিবে না আর? পুরোনো প্রেমিক আমি কতো পুরাতনে যাবো? ক্ষমা করো ভালোবাসা, প্রিয় অপরাধ । যদি কভু মধ্যরাতে পরবাসে ঘুম ভেঙে যায়, যদি আচ্ছন্ন স্বপ্নের ঘোরে উচ্চারণ করো এই মুখ, যদি ডাকো যৌবনের প্রিয় নাম ধরে–; রুদ্ধশ্বাসে ছুটে যাবো পতিগৃহে পুরোনো প্রেমিক ।

মুখোমুখি দাঁড়াবো তোমার, যদি ক্ষমা পাই । গতকাল একদিন গতকাল বড়ো ছেলেবেলা ছিল আমাদের চারিধারে, দেয়ালের মতো অনুভূতিমাখা মোম জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে আমারা দেখেছি শিখার ভিতরে মুখ । গতকাল ছিল জীবনের কিছু মরণের মতো সুখ । গতকাল বড়ো যৌবন ছিল শরীরে শরীর ঢালা, ফুলের বাগান ঢেকে রেখেছিল উদাসীন গাছপালা । আমরা দু’জনে মাটি খুঁড়ে-খুঁড়ে লুকিয়েছিলাম প্রেম, গতকাল বড় ছেলেবেলা ছিল বুঝিনি কী হারালাম ! গতকাল বড়ো এলোমেলো চুলে বাতাস তুলেছে গ্রিবা, চুমু খেয়ে গেছে কৃষ্ণচূড়ার উজ্জ্বল মধুরিমা ।

গতকাল বড়ো মুখোমুখি ছিল সারাজীবনের চাওয়া, চোখের নিমিষে চোখের ভিতরে চোখের বাহিরে যাওয়া । এক ধরনের এপিটাফ বায়ুর ভিতর থেকে গ্রহণ করেছি আয়ু; জানি, একদিন বায়ুতেই যাবো মিশে । আমাকে তখন যদি দরকার হয় কারও, আজকের মতো সহজে পাবে না খুঁজে । চৈত্রের ঝড় হয়ে লুটিয়ে পড়বো আমি বৃক্ষপত্রে, ধু-ধু মাঠে, –মঠের গম্বুজে । বায়ুর ভিতর থেকে গ্রহণ করেছি আয়ু; জানি, একদিন বায়ুতেই যাবো মিশে ।

তখন আমাকে যদি খোঁজ, যদি খোঁজ, শুভ্র অভ্রবিন্দুবৎ তখন আমাকে পাবে কম্পমান পদ্মের পাতায়, ঘাস-শীষে । মধুর ভিতর থেকে গ্রহণ করেছি আয়ু; মৃত্যু হয়ে একদিন মিশে যাবো বিষে । এবারই প্রথম তুমি ভুলে যাও তুমি পূর্বেও ছিলে মনে করো এই বিশ্ব নিখিলে এবারই প্রথম তুমি। এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না ছিলে না আকাশে, নদী জলে ঘাসে ছিলে না পাথরে ঝর্ণার পাশে। এবারই প্রথম তুমি।

এর আগে তুমি কিছুতে ছিলে না। ফুলেও ছিলে না, ফলেও ছিলে না নাকে মুখে চোখে চুলেও ছিলে না। এবারই প্রথম তুমি। এর আগে তুমি এখানে ছিলে না এর আগে তুমি সেখানে ছিলে না এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না। এবারই প্রথম তুমি।

রাতের পুণ্য লগনে ছিলে না নীল নবঘন গগনে ছিলে না। এবারই প্রথম তুমি। এর আগে তুমি তুমিও ছিলে না। এবারই প্রথম তুমি। সেই প্রজাপতি ফুলের মতো দেয়ালটাতে একটি প্রজাপতি, দঃসাহসে বসলো এসে আলোর মুখোমুখি; চিত্রিত নয় কালো রঙের পাখনা দু’টি মেলে ।

এবার বুঝি এলে ? দেয়াল জুড়ে লাগল তার ঘরে ফেরার কাঁপন, প্রাণের মাছে ফিরল বুঝি চিরকালের আপন । ভালোবাসার অর্ঘ্য দিয়ে মৃত্যুখানি কেনা, শেষ করেছি প্রথম দিনে হয়নি শুধু চেনা! চোখের পাশে দেয়ালটিতে বসলে তুমি যেই, হঠাৎ-চেনা পাখার রেণু আঙ্গুল ভরে নেই । এমন করে পরের ঘরে দেয়ালে কেউ বসে? হঠাৎ যদি ভালোবাসার পলেস্তার খসে? আলিঙ্গনে বন্দী করে প্রতীক বাহুপাশে, হঠাৎ যদি এই আমাকে অন্যে ভালোবাসে? রুপান্তরে পুড়িবে তোর ক্লান্ত দু’টি ডানা, চিত্রিত নয় কালো রঙের পৃথিবী একটানা । আমি কেবল আমি কেবল আমি কেবল দেখি, ভালোবাসার দেয়াল জুড়ে একটি প্রজাপতি । আমার বসন্ত এ না হলে বসন্ত কিসের? দোলা চাই অভ্যন্তরে, মনের ভিতর জুড়ে আরো এক মনের মর্মর, পাতা ঝরা, স্বচক্ষে স্বকর্ণে দেখা চাঁদ, জ্যোৎস্নাময় রাতের উল্লাসে কালো বিষ ।

এ না হলে বসন্ত কিসের ? গাছের জরায়ু ছিঁড়ে বেরিয়েছে অপিচ্ছিল বোধ, ওর মুখে কুমারীর খুন, প্রসূতির প্রসন্ন প্রসূন । কন্ঠ ভরে করি পান পরিপূর্ণ সে-পাত্র বিষের, চাই পূর্ণ শিশিরে নির্ঘুম । এ না হলে বসন্ত কিসের? আকাশ সিরিজ শুধু তোমাকে একবার ছোঁব, ঐ আনন্দে কেটে যাবে সহস্র জীবন। শুধু তোমাকে একবার ছোঁব, অহংকারে মুছে যাবে সকল দীনতা। শুধু তোমাকে একবার ছোঁব, স্পর্শসুখে লিখা হবে অজস্র কবিতা।

শুধু তোমাকে একবার ছোঁব, শুধু একবার পেতে চাই অমৃত আস্বাদ। শুধু তোমাকে একবার ছোঁব, অমরত্ব বন্দী হবে হাতের মুঠোয়। শুধু তোমাকে একবার ছোঁব, তারপর হব ইতিহাস। স্ববিরোধী আমি জন্মেছিলাম এক বিষণ্ন বর্ষায়, কিন্তু আমার প্রিয় ঋতু বসন্ত । আমি জন্মেছিলাম এক আষাঢ় সকালে, কিন্তু ভালোবাসি চৈত্রের বিকেল ।

আমি জন্মেছিলাম দিনের শুরুতে, কিন্তু ভালোবাসি নিঃশব্দ নির্জন নিশি । আমি জন্মেছিলাম ছায়াসুনিবিড় গ্রামে, ভালোবাসি বৃক্ষহীন রৌদ্রদগ্ধ ঢাকা । জন্মের সময় আমি খুব কেঁদেছিলাম, এখন আমার সবকিছুতেই হাসি পায় । আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম, এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি । স্ত্রী রান্নাঘর থেকে টেনে এনে স্তনগুচ্ছে চুমু খাও তাকে, বাথরুমে ভেজানো দরোজা ঠেলে অনায়সে ঢুকে যাও- সে যেখানে নগ্ন দেহে স্নানার্থেই তৈরি হয়ে আছে আলোকিত দুপুরের কাছে, মনে রেখো, তোমার রাত্রি নেই অন্ধকার বলে কিছু; বিবাহিত মানুষের কিছু নেই একমাত্র যত্রতত্র স্ত্রী-শয্যা ছাড়া।

তাতেই শয়ন কর বাথরুমে, পুজোঘরে, পার্কে, হোটেলে, সন্তানের পাশ থেকে টেনে এনে ঠোটগুচ্ছে চুমু খাও তাকে। তার প্রতিটি উৎফুল্ল লগ্নে এক-একটি চুম্বন, প্রতিটি রক্তিম মুখে এক-একটি নিঃশ্বাস দিতে হবে। সভ্যতা ধংস হোক, গুরুজন দাড়াক দুয়ারে, শিশুরা কাদতে থাক, যমদূত ফিরে যাবে এবং অভাব দেখো লজ্জা পেয় ম্লান হবে কিশোরীর মতো। যেমন প্রত্যহ মানুষ ঘরের দরোজা খুলেই দেখ নেয় সবকিছু ঠিক আছে কিনা, তেমনি প্রত্যহ শাড়ির দরোজা খুলে স্ত্রীকেও উলঙ্গ করে দেখে নিতে হয়, ভালো করে দেখে নিতে হয়: -জঙ্ঘায়, নিতম্বে কিংবা সংরক্ষিত যোনির ভিতরে অপরের কামনার কোন কিছু চিহ্ন আছে কি না। আক্রোশ আকাশের তারা ছিঁড়ে ফেলি আক্রোশে, বিরহের মুখে স্বপ্নকে করি জয়ী; পরশমথিত ফেলে আসা দিনগুলি ভুলে গেলে এতো দ্রুতো,হে ছলনাময়ী? পোড়াতে পোড়াতে চৌচির চিতা নদী চন্দনবনে আগ্নির মতো জ্বলে, ভূকম্পনের শিখরে তোমার মুখ হঠাৎ স্মৃতির পরশনে গেছে গলে ।

ফিরে গেলে তবু প্রেমাহত পাখি একা, ঝড় কি ছিলো না সেই বিদায়ের রাতে > ভুলে গেলে এতো দ্রুত, হে ছলনাময়ী, পেয়েছিলে তাকে অনেক রাত্রিপাতে । শব্দের চোখে করাঘাত করি ক্রোধে, জাগাই দিনের ধূসর প্রতিচ্ছবি । না-পাওয়া মুখের মুখর সুষমা দিয়ে, তবুও তোমার ছলনা-আহত কবি তোমাকেই লেখে, তোমাকেই রচে প্রিয় ! মাছি একটি মাছি বুকের ‘পরে একটি মাছি নাকে, একটি মাছি আমাকে চেনে একটি চেনে তাকে। আমাকে চেনে,তাকেও চেনে সেই মাছিটি কই? নাকেও নেই, বুকেও নেই চোখের জলে ঐ। অগ্নিতে যার আপত্তি নেই থামাও কেন? গড়াতে দাও, গড়াক; জড়াতে চায়? জড়াতে দাও, জড়াক ।

যদি পাকিয়ে ওঠে জট, তৈরি হবে নতুন সংকট সুখ না হলে দুঃখ দিয়ে পূর্ণ হবে ঘট । ডরাও কেন? এগোতে দাও জাগুক; সরাও কেন? আগুনে হাত লাগুক । জীবন শেষে মরণ হয়, মরণ শেষে হয় কী? আগ্নিতে যার আপত্তি নেই মাটিতে তার ভয় কী? আকাশ আমার সমস্ত ভাবনা যখন তোমাকে ছোঁয়, আমার সমস্ত উপলব্ধি যখন তোমার আত্মাকে স্পর্শ করে, আমার সমস্ত বোধ যখন তোমার বোধিতে নিমজ্জিত হয়, তখন আমার প্রাণের গভীর থেকে স্বতঃস্ফূর্ত মোহন মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয় একটি অত্যন্ত সহজ শব্দ…”আকাশ” । আমি শব্দটিকে ক্রমাগত উচ্চারণ করি । জানি না কেন এ শব্দটিই শুধু এত বারবার ঘুরে ঘুরে আসে ।

জানি না কী পেয়েছে সে আমার ভিতরে? আমি লক্ষ্য করেছি, ‘আকাশ’ শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার পরে আমার ভিতরে আর কোন কষ্টই অবশিষ্ট থাকে না । যেন যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বুলেটের মতো আমার বুকের ভিতরে গেঁথে ছিল এই যন্ত্রণাক্ত আমাশ শব্দটি । তোমার আমার মাঝে আছে এরকম বক্ষফাটা অনেক আকাশ । – আমি ব্যর্থ প্রেমিকের মতো মুগ্ধমূর্খচোখে কেবল তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে । কন্টক বাসর না হয় রক্ত হবে মাধবীর সিঁথির সিঁদুর তবুও সত্যের মত রোগী হয়ে সচকিত স্বপ্নের রুটি শুকরের মত ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাব না হয় দুর্গম হলো কন্টকীত ভোরের নীলিমা তবুও মদাক্রান্ত পশুর মত দুর্গম বালির ঝড় মরুভূর উট হয়ে হেঁটে হেঁটে যাব।

এবং যাবই আমি রক্তের খর নদী বেয়ে আকাঙ্কিত মাধবীর প্রশুদ্ধ বাসরে যখন ভ্রষ্টা নারী মতান্তরে কাম্য হয় সূর্ষরঙ কোন এক ভোরের আসরে। আমার সংসার সংসার মানে সোনার কাঁকনে জীবনের রঙ লাগা, সংসার মানে রক্তে-মাংসে সারারাত্তির জাগা। সংসার মানে অপেক্ষমাণ একজোড়া চোখে দাবি, সংসার মানে সাজানো ভুবন, আঁচলের খোঁটে চাবি। সংসার মানে অনাগত শিশু, পুতুলে সাজানো ঘর, সংসার মানে মনোহর নেশা, ঈশানে-বিষাণে ঝড়। সংসার মানে ব্যর্থ বাসনা, বেদনার জলাভূমি, সংসার মানে সংসার ভাঙা, সংসার মানে তুমি।

ওটা কিছু নয় এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ? একটু দাঁড়াও আমি তৈরী হয়ে নিই । এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ? তেমার জন্মান্ধ চোখে শুধু ভুল অন্ধকার । ওটা নয়, ওটা চুল । এই হলো আমার আঙ্গুল, এইবার স্পর্শ করো,–না, না, না, -ওটা নয়, ওটা কন্ঠনালী, গরলবিশ্বাসী এক শিল্পীর মাটির ভাস্কর্য, ওটা অগ্নি নয়, অই আমি–আমার যৌবন । সুখের সামান্য নিচে কেটে ফেলা যন্ত্রণার কবন্ধ–প্রেমিক, ওখানে কী খোঁজ তুমি ? ওটা কিছু নয়, ওটা দুঃখ ; রমণীর ভালোবাসা না-পাওয়ার চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা নদী, নীল হয়ে জমে আছে ঘাসে,–এর ঠিক ডানপাশে , অইখানে হাত দাও, হ্যাঁ, ওটা বুক, অইখানে হাতা রাখো, ওটাই হৃদয় ।

অইখানে থাকে প্রেম, থাকে স্মৃতি, থাকে সুখ, প্রেমের সিম্পনি ; অই বুকে প্রেম ছিল, স্মৃতি ছিল, সব ছিল তুমিই থাকো নি । গতকাল একদিন গতকাল বড়ো ছেলেবেলা ছিল আমাদের চারিধারে, দেয়ালের মতো অনুভূতিমাখা মোম জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে আমারা দেখেছি শিখার ভিতরে মুখ । গতকাল ছিল জীবনের কিছু মরণের মতো সুখ । গতকাল বড়ো যৌবন ছিল শরীরে শরীর ঢালা, ফুলের বাগান ঢেকে রেখেছিল উদাসীন গাছপালা । আমরা দু’জনে মাটি খুঁড়ে-খুঁড়ে লুকিয়েছিলাম প্রেম, গতকাল বড় ছেলেবেলা ছিল বুঝিনি কী হারালাম ! গতকাল বড়ো এলোমেলো চুলে বাতাস তুলেছে গ্রিবা, চুমু খেয়ে গেছে কৃষ্ণচূড়ার উজ্জ্বল মধুরিমা ।

গতকাল বড়ো মুখোমুখি ছিল সারাজীবনের চাওয়া, চোখের নিমিষে চোখের ভিতরে চোখের বাহিরে যাওয়া । দু’জনের ভাত গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে খেতে মনে কি পড়ে না? পড়ে । ভালো কি বাসি না? বাসি । শ্লথ টেপ থেকে সারা দিন জল ঝরে, সেই বেনোজলে এঁটো মুখ ধুয়ে আসি । গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে খেতে প্রেম কি জাগে না? জাগে ।

কিছু কি বলি না? বলি । তিতাস শিখায় যতটুকু তাপ লাগে, অনুতাপে আমি তার চেয়ে বেশি গলি । গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে খেতে আমি কি কাঁদি না? কাঁদি । কাঁচা কাকরুল ভাজার কবিতা লেখি, বড়-ডেকচিতে দু’জনের ভাত রাঁধি । গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে-খেতে কিছু কি ভাবি না? ভাবি ।

ভেবে কি পাই না? পাই । তবু কি ফুরায় তুমি-তৃষ্ণার দাবী? ভাত বলে দেয়, তুমি নাই, তুমি নাই । আশাগুলি জ্যা-মুক্ত হয়নি চিত্ত অধীর মিলনে কোনোদিন । পরশে খুলেছে দ্বার, বারবার কেটেছে অস্থির ঘুমে শূন্য চিরশয্যা তুমি-হীন । অপক্ব মৈথুনে বিবসনা শ্লীলতা ভাঙেনি শব্দ, আমাদের অবিমৃষ্য যুগলযৌবন অথচ জেগেছে কামে সুপ্তোত্থিতে, প্রিয়তমে মুখর মৃণালে, প্রিয় নামে ।

তোমাকে বেসেছি ভালো তীব্রতম বেদনার লাগি । মৃত্যুর শিয়রে বসি সেই প্রিয় মুখে রাত্রি জাগি একদিন উচ্চরিত প্রার্থনার ভাষা; করেছিনু আশা, আজ পূর্ণ হবে । খেলাঘর শিশুরা খেলাঘর করে । তারা হাঁড়ি-পাতিল, বাসন-কোসন নিয়ে বড়দের মতো সংসার সংসার খেলে । তারপর একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ঘুমভাঙ্গার পর শুরু হয় তাদের অন্যখেলা ।

এক্কা-দোক্কা, গোল্লাছুট কিংবা কানামাছি ভোঁ ভোঁ ! বড়োরাও খেলাঘর করে । তাদের বাসন-কোসনগুলো আকৃতিতে বড়ো, তাদের কামনা বাসনার মতো । তারা তাদের খেলাঘরের নাম রাখে সংসার । শিশুদের মতো তারাও ক্লান্ত হয় , তারাও সংসার ভাঙ্গে, কিন্তু শিশুদের মতো তারা ঘুমুতে পারে না । বিষ্টি আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা বাতাস জুড়ে বিষ্টি, গাছের পাতা কাঁপছে আহা দেখতে কী যে মিষ্টি! কলাপাতায় বিষ্টি বাজে ঝুমুর নাচে নর্তকী, বিষ্টি ছাড়া গাছের পাতা এমন করে নড়তো কি? চিলেকোঠায় ভেজা শালিখ আপন মনে সাজ করে, চঞ্চু দিয়ে গায়ের ভেজা পালকগুলি ভাঁজ করে।

হাঁসেরা সব সদলবলে উদাস করা দিষ্টিতে উঠানটাকে পুকুর ভেবে সাঁতার কাটে বিষ্টিতে। আকাশ এতো কাঁদছে কেন কেউ কি তাকে গাল দিলো? ছিঁচকাঁদুনে মেঘের সাথে গাছগুলি কি তাল দিলো? সকাল গেল, দুপুর গেল- বিকেল হ’য়ে এলো কী? আচ্ছা মাগো তুমিই বলো মেঘেরা আজ পেলো কী?  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।