blog_id: 85969 [[
ডিস্ক্লে.
আমার সংস্কৃতির মূল কি???...
বাঙালী জাতির আদি লোকজ-সংস্কৃতিক উৎস জানার অদম্য প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আমরা দু’জনে ( ব্লগার “প্রভাষক আশিক”] ও “শর্বরী-শর্মী”) নিরন্তন কিছু গবেষণায়রত হই....
যেখানে আমরা এমন কিছু তথ্য-উপাত্ত পাই যার অনেকগুলো সম্পর্কে আমরা অনেকেই খুব সীমিত জ্ঞান রাখি...
আপনার-আমার তথা বাঙালীর আদি লোকজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে তাবৎ নবীন ও যুব-সমাজকে জানানোর ঐকান্তিক বাসনা ও দায়বদ্ধতা থেকেই এই ধারাবাহিকটির জন্ম...
আপনাদেরকে নিজেদের শেকড় সম্পর্কে এতোটুকুও যদি সচেতন করতে পারি তবেই গবেষক ও শিক্ষক হিসেবে আমাদের নেয়া এই প্রচেষ্টার সার্থকতা বলে মেনে নেবো...
পরিশেষে যে কথাটি না বললেই নয়...
যদি তথ্যগত কোনো ভুল-ভ্রান্তি বা লেখার তথ্য-সূত্র সম্পর্কে অথবা অপরাপর লেখকদের তথ্য ব্যবহার করার পরও উৎস হিসেবে তাদের নাম না দেয়া হয়ে থাকে তবে জানানোর জন্য এবং এই সম্পর্কিত নতুন কোনো তথ্যের সন্ধান আপনার জানা থাকে তাহলে তা আমাদের গোচরীভূত করার বিনীত অনুরোধ রইলো...
]
শুরুর কথাঃ
১৭৭৯ সালে মনিপুরী মহারাজ ভাগ্যচন্দ স্বপ্নাদিষ্ট হলেন যে, “নৃত্য-গীতের মাধ্যমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনার দ্বারা পূণ্যার্জন করো” এবং তিনি তখন প্রবর্তন করেছিলেন কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ বিভিন্ন লীলানুরূপ নৃত্য-গীতের; যা পরবর্তীতে রাস-নৃত্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে, প্রায় শতবর্ষ পরে, মহারাজ চন্দ্র কীর্তি এই নৃত্য-গীতের ধারায় কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন আনেন এবং মণিপুরী-সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয়-উৎসব হিসেবে এটি পালন করা শুরু করেন; যা পরবর্তী রাজাগনের দ্বারা বহাল থাকে।
নামকরণঃ
মণিপুরীদের মহা-রাস বলতে ভক্তিপূর্ণ-প্রেমরসকে বোঝানো হয়, যা মূলতঃ কৃষ্ণের প্রতি রাধা বা গোপী-বালিকাদের থেকে উৎসরিত হতো। বস্তুতঃ “রস” শব্দ থেকেই “রাস” শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে; এতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রদর্শিত ভক্তি-রস আস্বাদনের জন্য রাধা-কৃষ্ণের লীলানুকরণের দ্বারা নৃত্য ও গীতের মাধ্যমে উৎসব পালন করা হয়ে থাকে।
অনুষ্ঠানের সময় কালঃ
প্রতি বছর কার্তিক মাসের পূর্নিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় এই মহারাসলীলা।
শুরু হয় সকাল আনুমাণিক ১১-টার দিকে এবং শেষ হয় রাত ৩/৪-টার দিকে।
প্রস্তুতিঃ
আশ্বিণ মাসের প্রথম থেকেই শুরু হয় রাস উৎসবের যোগাড়-যন্ত্র; গঠিত হয় বিভিন্ন পরিচালনা পর্ষদ। বাড়িতে বাড়িতে কুমারী মেয়েরা রাসলীলায় অংশ নেওয়ার জন্য নৃত্য ও সংগীতের তালিম নেয়; শিশু-কিশোরেরা নেয় রাখাল নৃত্যের তালিম।
মঞ্চঃ
সাধারণতঃ পুজার-মন্ডপের মতো কিছুটা উঁচু করে প্রস্তুত করা হয় রাসলীলার-মন্ডপটি কলাগাছ, বাশ প্রভৃতির দ্বারা। এই মন্ডপগুলো সাদা কাগজের নকশায় সজ্জিত করা হয়; যেগুলো সাধারণতঃ স্থানীয় শিল্পীরা খালি হাতেই তৈরী করেন।
মন্ডপে বাড়তি সজ্জ্বা হিসেবে দেয়া হয় ফুলের আচ্ছাদন; যা পূণ্যার্থীরা নিজেরাই জোগাড় করে আনেন।
প্রচলিত অনুষ্ঠান-মালাঃ
মহারাসলীলা উৎসবে কিছু প্রচলিত অনুষ্ঠান-মালা অনুসরণ করে মণিপুরী সম্প্রদায় (বিষ্ণুপ্রিয়া এবং মৈ-তৈ, এই উভয় গোত্র-ই), যেখানে সময়ের কিছুটা হের-ফের হলে-ও মূল অনুষ্ঠান-সূচী প্রায় একই রকম থাকে; যেমনঃ
বেলা ১১ টা থেকে শুরু হয় খোলা মাঠে শ্রীকৃষ্ণের বালকবেলার রাখাল হয়ে গবাদি-পশু চড়ানো অনুসরণে শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণে “গোষ্ঠ-লীলা”, এটি চলে সন্ধ্যা ৬ টা (গোধুলী লগ্ন) পর্যন্ত;
সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুরু হয় বিভিন্ন প্রকার আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এটি চলে সন্ধ্যা ৯ টা পর্যন্ত;
রাত ৯টা থেকে শুরু হয় বিভিন্ন ধরণের পালাকীর্তন, এটি চলে মধ্য-রাত (সাধারণতঃ রাত ১১ টা) পর্যন্ত;
এবং সর্বশেষে-
মধ্য-রাত (সাধারণতঃ রাত ১১টা) থেকে শুরু হয় মূল পর্ব যা শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলা অনুসরণে সজ্জ্বিত এবং এটি চলে রাত পোহানোর পূর্ব পর্যন্ত।
গোষ্ঠ-লীলাঃ
ছোট ছোট মণিপুরী শিশুশিল্পীরা সাদা ধুতি, মাথায় ময়ূর পালকের মুকুট, কপালে চন্দ্রের তিলক, গলায় সোনার মালা, হাতে বাঁশি ও পায়ে ঘুঙুর বেঁধে রাখাল সাজে সজ্জিত হয়ে একটি মাঠে সমবেত হয়ে নৃত্য করে; এটিই গোষ্ঠ-লীলা; এটি বেলা ১১ টায় শুরু হয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলে পালা ক্রমে।
মূল লীলাঃ
মধ্য-রাতে মূল অনুষ্ঠানের শুরুতেই মঞ্চে প্রবেশ করে গোপীনিরা; পরিবেশিত হয় রাসধারী-গোপীনিদের মৃদঙ্গ-নৃত্য। মৃদঙ্গ-নৃত্য শেষে প্রদীপ হাতে নৃত্যের তালে তালে মঞ্চে প্রবেশ করেন শ্রীরাধিকা দেবীর সাজে সজ্জিত এক যুবতী, যাকে পার্শ্বে উপবিষ্ট যুবতীরা উলুধ্বনিতে অভ্যর্থনা জানায়।
এই যুবতীর নৃত্য পরিবেশনের সময় বাদ্যের তালে তালে পরিবেশিত হয় মণিপুরীদের বন্দনা-সঙ্গীত এবং এক-পর্যায়ে রাধা-রূপী যুবতী মঞ্চ ত্যাগ করলে মঞ্চে আসে বাঁশী হাতে মাথায় কারুকার্য খচিত ময়ুর-পুচ্ছ মুকুট-ধারী এক কিশোর নৃত্যশিল্পী, সে শ্রীকৃষ্ণ রূপধারী। মঞ্চে এসে সে বাশির মোহনীয় সুরে নৃত্য করতে থাকে আর তার বাঁশির সুর শুনে গোপীনিদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে শ্রীরাধা-রূপী এক কিশোরীও মঞ্চে উঠে এবং চলতে থাকে রাস-নৃত্য। এরপর মঞ্চে আসে মণিপুরী কিশোরীরা, প্রদর্শন করে তাদের নৃত্য; অপর-দিকে, মঞ্চে বসে কীর্তন গায় একদল গায়ক। গীত-নৃত্য আর কীর্তনের মূল-ভাব একই; রাধা-কৃষ্ণের প্রেম-কাহিনী আর লীলা-খেলার কথা দ্বারা তা সজ্জ্বিত। এতে থাকে বৃন্দাবন-বিহার, যমুনা-পর্ব, কৃষ্ণের-অন্তর্ধান, কৃষ্ণ-বিরহের রোদন, সতী-বন্দনা প্রভৃতির পরিবেশনা।
রাতভর এই নৃত্য শেষে ভোরবেলায় কৃষ্ণ-রাধার বিদায় পর্বের মাধ্যমে শেষ হয় এই রাস-নৃত্যের।
লোকজ মেলাঃ
রাস উৎসবকে ঘিরে পার্শবর্তী এলাকাতে লোকজ মেলার আয়োজন করার হয়। এখানে মণিপুরীদের তৈরী ঐতিহ্যবাহী তাঁতের চাদর, শাড়ি ও অন্যান্য পোষাক-কাপড়; কৃষিকাজের সরঞ্জাম; শিশুতোষ খেলনা; গ্রামীন কুটির শিল্প; বিভিন্ন প্রকার গ্রামীন খাবার ও মন্ডা-মিঠাই; মাটির তৈরি সামগ্রী; ঘর সাজানোর সামগ্রী প্রভৃতি লোকজ-জীবনের সঙ্গে যুক্ত নানা দ্রব্য বিক্রি হয়।
শিল্পকলায়ঃ
রবীন্দ্রনাথ ১৯১৯ সালে সিলেটে এসে প্রথম মনিপুরী নৃত্য শিল্পীদের রাস নৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হন; পরবর্তীতে তিনি শান্তি নিকেতনে এই নৃত্য পরিবেশনার প্রচলন করেন এবং এর জন্য কমলগঞ্জ থেকে নৃত্য শিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে নিয়ে নিয়োগ করা হয়; ফলে কালক্রমে এই মণিপুরী নৃত্য গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের নৃত্যকলায় একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে।
উৎসব-স্থলঃ
মণিপুরি অধ্যুষিত মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর (বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সম্প্রদায়ের) গ্রামের শিববাজার জোড়া-মন্ডপে ও আদমপুর (মৈ-তৈ মণিপুরী সম্প্রদায়ের) গ্রামের সানাঠাকুর মন্ডপে প্রধাণতঃ এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
এছাড়া-ও হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার ছয়শ্রী গ্রামে এবং সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার রাসনগর গ্রামেও ক্ষুদ্র পরিসরে উৎসবটি উজ্জ্বাপন করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানসহ ভারত থেকেও মণিপুরী লোকজনসহ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অনেকেই ছুটে আসেন মহারাসলীলা অনুষ্ঠান উপভোগের জন্য।
আপনি কি-ভাবে যাবেনঃ
সড়ক কিংবা রেলপথে দেশের যেকোন স্থান থেকে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় চলে আসুন। এখান থেকে আসুন ভানুগাছ বাজার-এ; এবার এখান থেকে আপনি ৫ কিঃ মিঃ দূরে মাধবপুর বাজারের সন্নিকটস্থ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সম্প্রদায়ের জোড়-মন্ডপে যেতে পারেন অথবা ৯ কিঃ মিঃ দূরের আদমপুর বাজারের পার্শ্ববর্তী মৈ-তৈ মণিপুরী সম্প্রদায়ের মহারাসলীলা মন্ডপে যেতে পারেন।
শেষ কথাঃ
আমাদের দেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ; এদেশে আমরা সবাই মিলে একটি সুন্দর লোকজ সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে তুলছি যা আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহমান-ধারা।
এই ধারা সমুন্নত রাখার জন্যই আমাদের সকল ধর্ম-মতের প্রবর্তিত এসব লোকজ উৎসবগুলো সম্পর্কে সাম্যক একটি ধারণা রাখা জরুরী।
>>>...
লেখার সূত্রঃ
আহমদ, ওয়াকিল (২০০৪)। বাংলার লোক-সংস্কৃতি। ঢাকাঃ গতিধারা।
ঘোষ, শান্তিদেব (১৯৫৯)।
গ্রামীন নৃত্য ও নাট্য। কলিকাতাঃ ইন্ডিয়ান এসেশিয়েশন পাবলিকেশন্স কোং (প্রাঃ) লিঃ।
ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৪)। লোকসাহিত্য। কলিকাতাঃ বিশ্বভারতী।
রহমান, ফজলুর (১৯৯১)। সিলেটের মাটি সিলেটের মানুষ। সিলেট।
রায়, যোগেশ চন্দ্র (১৩৫৮)। পুজা পার্বণ।
কলিকাতাঃ বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়।
শেরাম, এ. কে. (১৯৯৬)। বাংলাদেশের মণিপুরী। ঢাকা।
সেন, ক্ষিতিমোহন (১৩৫৪)।
হিন্দু সংস্কৃতির স্বরূপ। কলিকাতাঃ বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়।
লোকসাহিত্য সংগ্রহ (অখন্ড)। ঢাকাঃ বাংলা একাডেমী।
বাংলাদেশ বিষয়ক সঙ্কলিত তথ্য-পঞ্জী “বাংলা-পিডিয়া”।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।