বাধা পেলেই সৃষ্টি হয় গণজোয়ার। 'বাড়িত থাইক্যা ছেলে ফোনে কয়-বাবা, তুমি কেমন আছো? আমি বলি, খুব ভালা বাবা, কত সুন্দর দেশ, সাগরের মধ্যে! এরপর সে কয়, আমিও আইসা তোমার সাথে কাজ করমু। আমি উত্তর দেই, জীবনেও আমি তোরে বিদেশে আইতে দিমু না। ছেলে বলে, ভালাই যখন, কেন আইতে দিবা না? আমি কোনো জবান খুঁইজ্যা পাই না। ' গতকাল শনিবার সকালে আদ্দুর ইকুয়েটরিয়াল ভিলেজ হোটেলে কালের কণ্ঠকে কথাগুলো বলছিলেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার শিবেন চন্দ্র সরকার।
বয়স ৫০ পেরোয়নি। কিন্তু প্রবাসে হাড়ভাঙা খাটুনির কারণে শিবেনকে আরো বেশি বয়সী মনে হয়। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) সংবাদ সংগ্রহ করতে বাংলাদেশি সাংবাদিকদের আসার খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন তিনি। জীবনযাপনের জন্য খুবই ব্যয়বহুল এ দ্বীপে স্বদেশি কাউকে সমস্যার কথা খুলে বলার সুযোগ পেয়ে শিবেন এ প্রতিবেদকের হাত পুরোটা সময় ধরে রাখেন। যেন কত আপন, কত চেনা কেউ!
ইকুয়েটরিয়াল ভিলেজ হোটেলেই আরো ১৫ জন বাংলাদেশি কর্মী আছেন।
তাঁদের বেশির ভাগই হোটেলটিতে পাঁচ থেকে সাত বছর ধরে কাজ করছেন। কিন্তু তাঁদের তেমন কোনো সঞ্চয় নেই, নেই তেমন কোনো অধিকারও।
হাজারো দ্বীপের দেশ মালদ্বীপে ভালো নেই বাংলাদেশিরা। বেসরকারি হিসাবে, এ দেশে ৭০ থেকে ৮০ হাজার বাংলাদেশি আছেন এবং তাঁদের বেশির ভাগেরই কাজের জন্য বৈধ নিবন্ধন নেই। ফলে হাড়ভাঙা
খাটুনির পরও তাঁরা প্রাপ্য বেতন ও বিশ্রামের অধিকার থেকে বঞ্চিত।
তাঁদের অনেকেরই আশা ছিল, সার্ক শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মালদ্বীপ সফরের সময় বাংলাদেশিদের সুখ-দুঃখের কথা শুনবেন, মালদ্বীপ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেবেন। কিন্তু এ সফরের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোনো মতবিনিময় কর্মসূচি না থাকায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাঁদের সমস্যার কথা জানানোর সুযোগ পাননি। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় কোনো বৈঠকও হয়নি এবারের সম্মেলনের ফাঁকে।
মালদ্বীপের এক সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, মালদ্বীপের জনসংখ্যা তিন লাখ ১৪ হাজার। এর বাইরে অনেক বিদেশি আছে।
তবে বিদেশি হিসেবে শুধু বাংলাদেশেরই ৮০ হাজার কর্মী থাকায় কর্তৃপক্ষ উদ্বিগ্ন।
গত মঙ্গলবার রাতে মালদ্বীপের ইব্রাহিম নাসির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে কথা হয় কুমিল্লার নাজির আহমদের (২৮) সঙ্গে। তিনি জানান, বাংলাদেশিদের অনেকেই মালদ্বীপে নানা ধরনের সমস্যার মধ্যে আছে। বিশেষ করে চাকরির বৈধ কাগজপত্র না থাকায় তাঁরা নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না। আবার বেতন না পাওয়ায় কোনো প্রতিকারও পাচ্ছেন না।
নাজির প্রায় আট মাস মালদ্বীপে আছেন। পরিচিত এক বাংলাদেশির মাধ্যমে তিনি মালদ্বীপে এসে দালালকে প্রায় দুই লাখ টাকা দিয়ে সাময়িক কাজের অনুমতি পেয়েছেন। এই মেয়াদও শেষ হতে চলেছে।
ইব্রাহিম নাসির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রাজধানী মালেতে যাওয়ার ফেরিঘাটে আরো কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে দেখা হলে তাঁরাও তাঁদের বিভিন্ন সমস্যার কথা জানান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন। পরে তাঁদের অনুরোধে ফেরি পাড়ি দিয়ে রাজধানী মালেতে যাওয়ার পর আরো বেশ কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা হয়।
তাঁদের বেশির ভাগই কয়েক লাখ টাকা খরচ করে মালদ্বীপে এসে বৈধতা পাচ্ছেন না। ফলে তিন মাস চাকরি করলে তাঁদের এক মাসের বেতন জোটে। এর কোনো প্রতিকারও পাওয়া যায় না।
মালেতে একটি খাবারের দোকানে কর্মরত নোয়খালীর ওয়াসিম জানান, বাংলাদেশি দালালরাই তাঁদের ঠকিয়েছে। মালে থেকে ফেরিযোগে ইব্রাহিম নাসির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় আরেক বাংলাদেশি কুমিল্লার দাউদকান্দির সুমনের সঙ্গে কথা হয়।
সুমন বলেন, মালের কবুতর পার্কে প্রতি শুক্রবার অনেক বাংলাদেশি আসে। তাঁদের দুঃখের শেষ নেই। মাসের পর মাস কাজ করেও বেতন মেলে না। অথচ এ দেশে অন্য কোনো দেশের নাগরিকদের এমন অবস্থা নেই।
গত মঙ্গলবার রাতে ইব্রাহিম নাসির বিমানবন্দর থেকে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে আদ্দুর গ্যান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় এগিয়ে আসেন কুমিল্লার নাজির।
বলেন, ওই দিন বিকেলে তিনি মালে গিয়েছিলেন সাবেক মালিকের কাছে পাওনা ৮০০ টাকা আনতে। কিন্তু তিনি পাননি। কারণ, ওই মালিকের অধীনে কাজ করার সময় তাঁর বৈধ কাগজপত্র ছিল না। এখানে বাংলাদেশিদের কেউ কেউ দেশে ফিরতে চাইলেও পারছেন না। ফেরার বিমান টিকিট জোগাড়ের সামর্থ্যও অনেকের নেই।
নাজির বলেন, মালদ্বীপে বাংলাদেশিদের বেশির ভাগই আতিথেয়তা ও পর্যটন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাঁদের বেতনও খুব বেশি নয়। তবু একদিন সুদিন ফেরার প্রত্যাশায় তাঁরা প্রতিকূলতার মধ্যেও মালদ্বীপে আছেন।
সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের সংবাদ সংগ্রহ করতে আসা সংবাদকর্মীরা মঙ্গলবার রাত ৩টার দিকে আদ্দু নগরীর ইকুয়েটর ভিলেজ হোটেলে পেঁৗছালে তাঁদের জন্য বরাদ্দ কক্ষগুলো খুলে দেন বাংলাদেশি কর্মীরা। তাঁদের একজন পরদিন বুধবার সকালে কালের কণ্ঠকে জানান, এ হোটেলে ১৬ জন বাংলাদেশি কর্মী আছেন।
তাঁদের কেউ ঝাড়ুদার, কেউ পাচক, ওয়েটার কেউ বা আবার অ্যাটেনডেন্ট। মালদ্বীপ ও অন্য দেশের নাগরিকদের কাজের সময় এখানে দৈনিক আট ঘণ্টা। ব্যতিক্রম কেবল বাংলাদেশিরাই। তাঁদের কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। একজন বাংলাদেশি কর্মী জানান, সারা দিন কাজ করার পরও রাত ৩টায় তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়েছে হোটেলে রুমগুলোর দরজা খুলে দেওয়ার জন্য।
বাংলাদেশি বলেই তাঁরা এত অবহেলিত, তাঁদের এত কষ্ট।
বুধবার রাতে ইকুয়েটর ভিলেজে মালদ্বীপের শিল্প ও পর্যটনমন্ত্রী ড. মরিয়ম জুলফা আয়োজিত পার্টিতেও খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশি কর্মীরা। তাঁরা জানান, রাত ৯টায় এখানে রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যায়। এ অনুষ্ঠান তারও পরে হচ্ছে দেখে দায়িত্ব পড়েছে বাংলাদেশিদের ওপর।
রাজধানী মালে, আদ্দু, ফেদুসহ সর্বত্র বাংলাদেশি কর্মীদের উপস্থিতি।
তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে মালদ্বীপ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছে, আদ্দু নগরীতে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের জন্য কনভেনশন সেন্টার ও রাস্তা নির্মাণ এবং সৌন্দর্যবর্ধনসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোতে বাংলাদেশিরা অংশ নিয়েছেন।
মুক্তাগাছার শিবেন চন্দ্র বলেন, 'এই বয়সে বিদেশে থাকতে মন চায় না। বউ-ছেলে-মেয়েরে দেখতে ইচ্ছা করে। কিন্তু এত ঋণ কইরা দেশ থাইক্যা মালদ্বীপ আইছি, ওইগুলো কে শোধ করব।
আমার জীবনটা তো শেষ। এর পরও যদি আমার পরিবার ভালো থাকে। '
প্রবাসী বাংলাদেশিদের ক্ষোভ মালেতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের বিরুদ্ধেও। তাঁদের অভিযোগ, হাইকমিশন থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায় না। ট্রাভেল পাসের জন্য দূতাবাসের কাছে ২০-২৫ দিন ধরনা দিতে হয়।
তারা কোনো কথা শুনতে চায় না।
সমীর নামের এক বাংলাদেশি জানান, দেশে টাকা পাঠাতে খুব সমস্যা হয়। ব্যাংকগুলো অনিবন্ধিত বাংলাদেশিদের কাছে ডলার বিক্রি করতে চায় না, স্থানীয় মুদ্রা রুপিয়াও দেশে পাঠানো যায় না। ফলে বাইরে থেকে কম দামে ডলার কিনে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
মালদ্বীপে বাংলাদেশ হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের সমস্যা সম্পর্কে বাংলাদেশ হাইকমিশন অবগত।
বারবার বাংলাদেশ সরকারকে বলা হয়েছে, তারা যেন এত সহজে আসতে না দেয়। বাংলাদেশিদের আসার হার কমলে তাদের কর্মী সংকট হবে এবং এর ফলে বাংলাদেশিদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে দরকষাকষির সুযোগ সৃষ্টি হবে। অন অ্যারাইভাল ভিসার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশিদের বেশির ভাগই পর্যটক হিসেবে মালদ্বীপে এসে থেকে গেছে বলে তিনি জানান।
দেশে ফিরতে আগ্রহীদের আউট পাস ইস্যু করতে দেরি হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে ওই কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় দেখা গেছে, বাংলাদেশিদের আউট পাস দেওয়ার পর তাঁর নিয়োগকারী হাইকমিশনে এসে পাওনা টাকা দাবি করেছেন। এ কারণে আউট পাস ইস্যু করার আগে খোঁজ নেওয়া হয় এবং জনবল সংকটের কারণে এতে কিছুটা সময় লাগে।
কর্মকর্তা আরো বলেন, মালদ্বীপে বাংলাদেশিদের কেউ কেউ লাখ টাকা পর্যন্ত বেতন পান। কিন্তু বেশির ভাগই কাজ করেন নিম্নপদে ও নিম্ন বেতনে। আর তাঁদের নিয়োগকারীরাও শিক্ষিত নন। ফলে তাঁদের কাছে প্রত্যাশিত আচরণ অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় না। এর পরও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশিদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে মালদ্বীপ সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।