লেখক জে.এস.সি-পি.এস.সি পরীক্ষা - শিক্ষার হার এবং শিক্ষার মান
ফারুক আহমেদ
বাংলাদেশে সবকিছুই যেন পরীক্ষামূলক। পরীক্ষা কোন খারাপ জিনিস নয় । তবে তা যদি হয় শিক্ষার মত একটি বিষয় এবং এর সাথে যুক্ত থাকে লক্ষ ,লক্ষ শিক্ষার্থী এবং কোটি ,কোটি মানুষ তাহলে পরীক্ষা চালিয়ে দেবার পূর্বে তার ওপর আলোচনা , সমালোচনা , সংশ্লিষ্ট মানুষের মতামত এবং গবেষণা জরুরী । যেন বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে গিনিপিগ বানানো না হয় । কিন্তু বাংলাদেশে একটি বিষয় দেখা যায় তা হলো, শিক্ষার মত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সব সময়ই কোন প্রকার আলোচনা , সমালোচনা,গবেষণা ,মতামত ছাড়াই সরাসরি পরীক্ষার মধ্যে চলে যাওয়া হয় ।
বিশেষ করে পরীক্ষা পদ্ধতি এবং পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে এটা খুব বেশি করে ঘটে থাকে । বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার্থীদের যে সব পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল তার সাথে সাম্প্রতিক কালে প্রাথমিক এবং নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে জাতীয় পর্যায়ে আরো দুটি পরীক্ষা গ্রহনের নিয়ম করা হয়েছে । একটি পঞ্চম শ্রণী শেষে প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট (পি.এস.সি ) পরীক্ষা এবং অপরটি জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জে. এস. সি ) পরীক্ষা ।
গত ১ নভেম্বর থেকে ২০১১ সালের জে. এস. সি পরীক্ষা শুরু হয়েছে । এদিন পরীক্ষাকেন্দ্রে সাংবাদিক এবং সংশ্লিষ্ঠ ব্যাক্তিদের সামনে এ পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে দেওয়া বক্তব্য লক্ষ্য করবার মত ।
সেখানে তিনি বলেছিলেন যে, এসব পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া কমিয়ে শিক্ষার হার যেমন বাড়িয়ে দিচ্ছে তেমনই শিক্ষার মানও বৃদ্ধি করছে । এখানে একটি কথা বলার ইচ্ছা সংবরন করতে পারছিনা তা হলো , বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর শিক্ষাক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়া একসময় ছাত্র আন্দোলনের খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও ‘ঝরে পড়া’ শব্দটি সরকারী লোকজনের মুখে সহজে শোনা গিয়েছে বলে হয় না । এ ক্ষেত্রে খুব সহজে শব্দটি উচ্চারণ করার জন্য শিক্ষামন্ত্রী অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারেন । হবে হয়তো একসময় ওপক্ষের সরকারের মুখোমুখি জনগণের এ পক্ষে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন বলেই তাঁর এই সহজ উচ্চারণ । এটাও একসময়ে জনগণের পক্ষের লোকদের তাঁদেরই ভাষায় ‘জনগণের বিপরীত’ পক্ষে চলে যাওয়ার পর জনগণকে দেওয়া কম বড় উপহার নয় ।
এখন শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে বলা যায় তাঁর এ বক্তব্যই এ ধরনের পরীক্ষার যেৌক্তিকতার প্রশ্ন টেনে নিয়ে আসে । তাঁকে এ ধরনের পরীক্ষার যেৌক্তিকতা নিয়ে কোন প্রশ্ন না করতেই পরীক্ষা অনুষ্ঠানের দিন তাঁর এ বক্তব্যই প্রমাণ করে জনমনে এসব পরীক্ষার যেৌক্তিকতার মীমাংসা এনও হয়নি । এস. এস. সি , এইচ. এস. সি বা অন্যান্য পরীক্ষার ক্ষেত্রেতো ‘পরীক্ষার’ সুফল নিয়ে কথা বলতে হয় না?
এবার শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যকে বিশ্লেষণ করা যাক । তিনি বলেছেন এ ধরনের পরীক্ষা ‘ঝরে পড়া’ কমাবে । প্রশ্ন আসতেই পারে , কেন ? শিক্ষাক্ষেত্র থেকে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার কারণ কি? এর কারণ কি এই যে , এসব শিক্ষার্থীর অভিভাবকেরা অসচেতন ? এসব শিক্ষার্থীরা অবাধ্য , তারা লেখাপড়া করতে চায় না ? এক সময় শিক্ষামন্ত্রীর এসব প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল ।
আজ নতুন অবস্থানে গিয়ে তিনি হয়তো ভাবছেন তাঁর আগের অবস্থান থেকে পাওয়া এসব প্রশ্নের উত্তর নিতান্তই পুরোনো । পরীক্ষায় শিক্ষার হার বাড়ার এই অদ্ভুৎ হিসাবটি মিলিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ঠ লোকেরা যুক্তি দেখাচ্ছেন , জে. এস.সি পরীক্ষায় যে সার্টিফিকেট দেওয়া হবে তার আশায় শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়বে না । ফলে শিক্ষার হার বাড়বে এবং বেড়ে যাচ্ছে । এই যদি হয় শিক্ষার হার বাড়ানোর কেৌশল তাহলে প্রথম শ্রেণী থকে শুরু করে প্রতিটি শ্রণীতেই জাতীয় পর্যায়ে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করলেইতো শিক্ষার হার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে ! একটি দেশের শিক্ষার হার বাড়ানোর কত সহজ পথ !!এ এক ‘জাতীয় আত্নপ্রতারণা’ ।
এ ধরনের যুক্তি দেওয়া গরীব মানুষের দারিদ্র্য , অনেক বঞ্চনার ফলে সৃষ্ট তাঁদের অক্ষমতাকে ঠাট্টা- তামাশা করা ,তাঁদেরকে অসন্মান করা ।
ভাবখানা এমন যে, এসব গরীব মানুষের লোভ অনেক এবং তাঁদের সামনে সার্টিফিকেটের মত একটি আকর্ষণীয় বস্তুর মুলো ঝুলিয়ে দিলেই সেই লোভে তাঁরা তাঁদের সন্তানদের শিক্ষাক্ষেত্র থেকে তুলে নেবে না । কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী এখানে একটি ভুল করে বসেছেন । পূর্বের অবস্থানগত কারণে তিনি অত্যন্ত সত্য কথাটি বলে ফেলেছেন । ‘ঝরে পড়া’ শব্দটি তিনি উচ্চারণ করেছেন । বৃক্ষের শরীর থেকে যখন সব জল শুকিয়ে যায় , মাটিতেও আর কোন জল থাকে না তখন তার সকল ফুল-ফল বৃন্তচ্যুৎ হয় , ঝরে যায় ।
এ অবস্থায় আকাশে যত ঘন মেঘই থাকুক না কেন সেই জলের আশায় বৃক্ষ তার ফুল-ফল ধরে রাখতে পারে না । ঠিক তেমনিভাবে একটি পরিবারের সকল উপায় শুকিয়ে মরলেই কেবল তার শিক্ষাবৃন্ত থেকে তার সন্তানের চ্যুতি ঘটে । গরীব মানুষকে অসন্মান করা এবং তাঁদের ওপর দোষ চাপানো ছাড়া পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার হার বাড়ানোর যুক্তি আর কিছুই নয় ।
এবার আসা যাক শিক্ষার মান বৃদ্ধির প্রসঙ্গে । এসব পরীক্ষাতো বটেই এমনকি অনেক আগে থেকেও যেসব পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে তার কোনটিতেই শিক্ষার মান বৃদ্ধি পেতে পারে না ।
শিক্ষার মান নির্ভর করে শেখানোর বিষয়বস্তু ,শেখানোর পদ্ধতি ,শেখানো বা শেখার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ,শিক্ষার্থীর প্রতিদিনের চিন্তা ও কাজের আন্তরিক গভীর পর্যবেক্ষণ এবং অবকাঠামোর ওপর । সমাজ, রাষ্ট্র ও সময় প্রভৃতির বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে প্রচলিত ধরনের পরীক্ষা নিতে হয় । সমাজ , রাষ্ট্র এবং সর্বপরি মানব সমাজের মধ্যে সংহতি ও সমন্বয় যে মাত্রায় উত্তীর্ণ হবে প্রচলিত ধরনের পরীক্ষাও সেই মাত্রায় কমে যাবে । এ দিক দিয়ে প্রচলিত ধারার পরীক্ষা শিক্ষার মানের বিপরীত । যদি ধরেই নেওয়া হয় যে,জ্ঞানে ,প্রজ্ঞায় এবং মানে আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি তবে পরীক্ষার সংখ্যা না বেড়ে বরং কিছু কিছু ক্ষেত্র কমার কথা ।
আর যদি ধরা হয় ওপরের চাকচিক্য আর ভড়ং ছাড়া জ্ঞানে , প্রজ্ঞায় , মানে ,বিচারে ,বিশ্লষণে আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতায় আমাদের শিক্ষা পিছিয়ে যাচ্ছে তবে তাকে আরো অনেক কারণের মধ্যে নামে –বেনামে , প্রতিষ্ঠানের ভিতরে –বাইরের অসংখ্য পরীক্ষার সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে । আমাদের শিক্ষানীতি বলতে যা’ দেখা যায় সেখানে শিক্ষার চালিকাশিক্তরূপে প্রতিযোগিতা ,শিক্ষার্থীদের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি অংশকে পুরষ্কৃত করা এগুলোই গুরুত্বপূর্ণ । বাইরে অন্তঃসারশূন্য অনেক বাগড়ম্বরপূর্ণ কথা বলা হলেও শিক্ষার লক্ষ্য হিসাবে সমষ্টির চেয়ে ব্যাক্তির উন্নতি এবং উৎকর্ষতার বিষয়টিই গুরুত্ব পেয়ে থাকে । প্রচলিত ধরনের সকল পরীক্ষার মাধ্যমে তারই পরিমাপ খুবই প্রান্তিকভাবে করা গেলেও সামগ্রিকভাবে শিক্ষার সামষ্টিক মান নির্ধারণের জন্য এ পদ্ধতি অকেজো । কাজেই এ ধরনের পরীক্ষার সংখ্যা যত বাড়ে ততই ‘তোতা’ হিসাবে এক ধরণের দক্ষতা বৃদ্ধি পেলেও জ্ঞান , প্রজ্ঞা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা বাড়ে না বরং ‘তোতা’ হিসাবে বিকাশের সাথে সাথে এসব কমেই যায় ।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে অবশ্যই একটি সীলেবাস থাকতে হয় সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে । যত ভাল সীলেবাসই হোক না কেন তার সীমাবদ্ধতা থাকতে বাধ্য । কাজেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মান নির্ধারণের এবং পরিপূর্ণতার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা যার মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষার একটি সংস্কৃতি তৈরী করতে পারে । একটি দেশে শিক্ষার মান কতখানি বৃদ্ধি বা হ্রাস পেল তা নির্ভর করে সেখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে কি মাত্রায় শিক্ষার সংস্কৃতি বৃদ্ধি বা হ্রাস করল তার ওপর । সামগ্রিকভাবে শিক্ষার লক্ষ্য যদি গণমানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট না হয় তবে সেখানকার প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষার সংস্কৃতি সৃষ্টি করা সম্ভব নয় ।
প্রাথমিক এবং নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে জাতীয় পর্যায়ে যে দুটি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে তাতে নীতিনির্ধারকদের অন্য যে কোন উদ্দেশ্যের যাই হোক এর মাধ্যমে শিক্ষার হার ও মান কোনটিরই বৃদ্ধি হবে না । এসব পরীক্ষার ক্ষতিকারক দিকগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ এবং আলোচনা হওয়া প্রয়োজন ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।