মলম, মরিচের গুঁড়া কিংবা গামছা তাদের অস্ত্র । । নির্জনে লুকিয়ে থাকা ঘাতকচক্র কেড়ে নিচ্ছে মানুষের প্রাণ
ঋত্বিক নয়ন ॥
মলম পার্টি কিংবা অজ্ঞান পার্টি, গামছা পার্টি বা মরিচের গুঁড়া পার্টি - যা-ই বলা হোক না কেন কাজ তাদের এক। সিএনজি অটোরিক্সা নিয়ে রাতের আঁধারে ঘুরতে বের হয় ৩/৪ জন। সুবিধামতো স্থানে টার্গেট করা ব্যক্তিকে জোরপূর্বক সিএনজি অটোরিক্সায় তুলে নেয়।
চোখে মরিচের গুঁড়া কিংবা মলম লাগিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নেয়। যদি তাতেও কাবু করতে না পারে তবে ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত জুস খাইয়ে অজ্ঞান করার চেষ্টা চলে। শেষ অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করা হয় গামছা বা অন্য কোন কাপড়। গলায় পেঁচিয়ে দুই পাশ থেকে কষে টান দেয়া হয়। মাঝে কিছুদিন এদের তৎপরতা থেমেছিল।
তখন এ চক্রগুলোর শীর্ষ নেতারা ধরা পড়ে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় সকলেই জামিনে বের হয়ে ফিরে গেছে পুরনো পেশায়। আমির গ্রুপ ও হাসেম গ্রুপের বিশ থেকে বাইশ জন সদস্য নগরী ও জেলায় এ কৌশলে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনে খুন করতেও দ্বিধা করছে না। গত এক সপ্তাহে এদের হাতে দুই ব্যবসায়ী খুন হয়েছে।
এছাড়া আহত হয়েছে অন্তত আরো ১৪ জন। এদের মধ্যে গত ৩০ অক্টোবর রাতে নগরীর সিআরবি এলাকায় মলম পার্টির সদস্যদের হাতে ব্যবসায়ী জহুর আহমেদ খুন হওয়ার ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ব্যাপারে সিএমপির উপ কমিশনার (উত্তর) আমেনা বেগম আজাদীকে বলেন, আমাদের দায়িত্ব অপরাধীদের ধরা। আমরা সেটা করছি। এখন বের হয়ে গেলেতো আমাদের কিছু করার নেই।
এক্ষেত্রে অন্যদের রেসপন্সিবিলিটির ব্যাপার আছে। তিনি জানান, নগরীর নির্জন এলাকাগুলোতে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করার জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে চিঠি পাঠানো হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, সিআরবি এলাকাটি যেমন খুব নির্জন। এখানে অপরাধটাও বেশি হচ্ছে। তাই এ এলাকায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করার জন্য সিএমপির পক্ষ থেকে সিটি কর্পোরেশন ও রেলওয়ের কাছে চিঠি পাঠানো হচ্ছে।
পাশাপাশি স্থায়ী চেকপোস্ট বসানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ চক্রের সদস্যরা নগরীতে ভাসমান। সপ্তাহ্ দুয়েকের জন্য আসে, উপর্যুপরি কাজ করে চলে যায়। ফিরে আসে কিছু দিন পরে। বছরের পর বছর এভাবেই চলছে।
মাঝে মধ্যে ধরা পড়ে, আবার অল্পদিনের মাথায় ছাড়াও পেয়ে যায়। কারাগার থেকে বেরিয়ে ফিরে যায় পুরনো পেশায়। নগর গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে চট্টগ্রামে বর্তমানে মলম পার্টির যে ক’টি গ্রুপ সক্রিয় আছে তার মধ্যে আমির গ্রুপ ও হাশেম গ্রুপ সবচেয়ে শক্তিশালী। সিআরবিতে ব্যবসায়ী জহুর হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারকৃত শাহাবুদ্দিন, এনাম প্রকাশ রাজিব ও রাশেদ আমির গ্রুপের সদস্য বলে জানা গেছে। এছাড়া গত ২ নভেম্বর বোয়ালখালীতে ব্যবসায়ী ইউছুফ খুনের ঘটনাটি হাশেম গ্রুপের কাজ বলে পুলিশ তথ্য পেয়েছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে নগরীতে এ ধরনের অপরাধ সংঘটনের মূল হোতা ছিল হাশেম। আমির ছিল তার সেকেন্ড ইন কমান্ড। পরবর্তীতে ছিনতাইকৃত টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্বে তাদের সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি হয়। আমির পৃথক গ্রুপ গঠন করে। এ দুটি গ্রুপের সদস্যরা শুধু চট্টগ্রামেই নয়, অন্যান্য জেলা, এমনকি ঢাকাতেও অপরাধ করে বেড়ায়।
তবে গত রমজানের ঈদের সময় থেকে এ দুটি গ্রুপ প্রয়োজনে পরস্পরকে লোক ভাড়া দিয়েও সাহায্য করে।
মলম পার্টির সদস্যরা একাধিকবার জেল খেটেছে। প্রতিবার বেরিয়ে পুরনো পেশায় ফিরে গেছে। গত ১১ জানুয়ারি নগরী ও জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল আমির গ্রুপের দলনেতা আমিরসহ সাত জনকে। গ্রেফতারকৃত অন্যান্যরা হলো কাশেম, মেহরাজ, শাহাবুদ্দিন, আবু ছিদ্দিক, বাকের প্রকাশ আজাদ ও মোশারফ।
কিন্তু কিছুদিন পরেই তারা জামিনে বের হয়ে যায়। আমির ইতোপূর্বে আরো দুইবার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেল খেটেছিল। শাহাবুদ্দিন গত বছর আগস্ট মাসে মুক্তি পেয়ে ফিরে যায় আগের পেশায়। ধরা পড়ে চলতি বছর জানুয়ারিতে। রোজার ঈদের কয়েকদিন আগে জামিনে বের হয়।
গত ২ নভেম্বর পুনরায় ধরা পড়ে। অন্য গ্রুপের দলনেতা হাশেমও কিছুদিন আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এ কাজে সক্রিয় আছে বলে শাহাবুদ্দিন পুলিশকে জানিয়েছে।
গত দুই বছর ধরে নগরীতে মলম পার্টির উৎপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। কখনো মলম, কখনো মরিচের গুঁড়া, কখনো অস্ত্র হিসেবে টাইগার বাম অথবা গামছা ব্যবহার করলেও মূলত তারা মলম পার্টির সদস্য হিসেবে পরিচিত। গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য অপেক্ষমাণ সিএনজি টেক্সিতে উঠলে কিছুদূর যাওয়ার পর চালক গতি কমিয়ে ফেলে।
আর তখনই পেছনে ছায়ার মতো অনুসরণ করতে থাকা অন্য একটি সিএনজি টেক্সি থেকে দ্রুত তিনজন নেমে প্রথম টেক্সিটির যাত্রীর সিটের দুই পাশে দুইজন এবং চালকের পাশে একজন বসে পড়ে। চলন্ত টেক্সিতেই যাত্রীর চোখে মলম লাগিয়ে দেয়া হয়। চোখ খুলতে পারে না যাত্রী। এ সুযোগে যাত্রীর সব কিছু কেড়ে নিয়ে নির্জন কোন স্থানে নামিয়ে দেয়া হয়। আবার টেক্সি দুটি যোগাড় না হলে একটি নিয়েই তারা অভিযানে নেমে পড়ে।
গ্রুপের অন্যরা নির্দিষ্ট স্থানে থাকে। টেক্সি চালক কোন না কোনভাবে অপেক্ষমাণদের সামনে দিয়ে এমনভাবে যায় যাতে যাত্রী টেক্সিতে নেয়। চলন্ত অবস্থায় কোন না কোনভাবে সহযোগীদের গতিপথ বলে দেয়। তারপর নির্দিষ্ট স্থানে এলে একই কায়দায় সবকিছু কেড়ে নেয়। উপর্যুপরি কয়েকদিন কাজ করে তারা কিছুদিনের জন্য হাতিয়া চলে যায়।
গ্রেপ্তারকৃতরা নগরীর কিছু নির্দিষ্ট স্থানের কথা বলেছে যেখানে তারা টেক্সি নিয়ে শিকারের অপেক্ষায় থাকে। এগুলো হলো গরীবুল্লাহ শাহ মাজার সংলগ্ন এসি বাস কাউন্টারের সামনে, জিইসির মোড়ে, একে খান গেইট থেকে কর্নেল হাটের মধ্যবর্তী বাস কাউন্টার, রেয়াজ উদ্দিন বাজার ও এর আশেপাশের এলাকা, বাদামতলীর মোড় ও মুরাদপুর। এছাড়া সিএনজি টেক্সি নষ্টের ভাব দেখিয়ে যেসব স্থানে চালক দাঁড়িয়ে পড়ে এমন কিছু এলাকা চিহ্নিত করেছে অভিযান টিমের সদস্যরা। এগুলো হলো, পাহাড়িকা সিএনজি স্টেশনের আশেপাশে, ফয়’স লেক চক্ষু হাসপাতালের সামনে, নাসিরাবাদ বয়েজ স্কুলের সামনে, রুবি গেইট থেকে বায়েজিদ বোস্তামি যাওয়ার পথে বাংলাবাজার এলাকায়, জমিয়াতুল ফালাহ্ ও আশেপাশের এলাকায় ও নেভাল একাডেমি এলাকা।
মলম পার্টির তৎপরতা ঠেকাতে নগরবাসীর সচেতনতার উপর জোর দিয়েছেন সিএমপির সহকারী কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী।
একজন আসামি ধরার পর সে ছাড়া পেয়ে গেলে পুনরায় তাকে ধরাটা কঠিন। কারণ সে ধরার কৌশলগুলো সম্বন্ধে সজাগ হয়ে যায়। তাই তাদের মামলাগুলো মনিটরিং সেলের মাধ্যমে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার কাজ সম্পন্ন হলে এ অপরাধ কমে যেত। ইতোপূর্বে সাইলেন্ট কিলারদের তৎপরতা কিন্তু এভাবেই বন্ধ হয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।