আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিল হার্বিসেন : রঙিলা দুনিয়ায় তব শোনো রঙেরই শব্দ!

রিজওয়ানুল ইসলাম রুদ্র লাল, নিল, হলুদ প্রতিটি রঙেরও যদি থাকে শব্দ, বিভিন্ন কম্পাংকের সে শব্দ শ্রোতা চোখ বন্ধ করে শ্রবণ করে বুঝতে পারে এটা লাল, এটা হলুদ, এটা নিল, তাহলে ব্যাপারটা কেমন রোমাঞ্চকর হয়ে দাঁড়ায় বলুন দেখি? অনেকেই ভাবছেন, চোখ খোলা রেখেই তো এত সুন্দর সুন্দর সব রঙের বিচিত্র উপাচার উপলব্ধি করা যায় সহজে, রঙের দুনিয়ায়! তাহলে আবার এই জটিল খেলার কী দরকার? প্রিয় ব্লগার! যদি আপনি হয়ে থাকেন একজন বর্ণান্ধ, তখন চারপাশের পৃথিবী আপনার কাছে হয়ে উঠবে অনেকটা সাদা-কালো, রঙিন দুনিয়ার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবেন আপনি... তখন কী করে বুঝবেন লাল-হলুদ আর নিলের খেলা? এ অসম্ভব ব্যাপারটাকে সম্ভব করে তুলেছেন নিল হার্বিসেন (২৯) নামের একজন বর্ণান্ধ তরুণ। জন্ম ২৭ জুলাই ১৯৮২ খ্রি:। নর্দান আয়ারল্যান্ডে। পেশায় তিনি একাধারে একজন শিল্পী, মিউজিশিয়ান, পারফর্মার! নিল হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি নিজের আশ্চর্য উদ্ভাবনী ক্ষমতায় রঙের শব্দ শ্রবণ করে বুঝে নিতে পারেন কোনটা কোন রঙ। আর এ কাজের জন্য তিনি ব্যবহার করেন "আইবর্গ" নামের যন্ত্র যেটা মাথায় পরিধান করতে হয়।

আইবর্গ কাজ করে শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে রঙ চেনার ক্ষেত্রে। আর এটা ব্যবহার করা হয় জন্মান্ধ, বর্ণান্ধ বা অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া রোগিদের ক্ষেত্রে। ২০০৩ সালে প্রথম আইবর্গ আবিষ্কার করেন অ্যাডাম মনট্যানডন, নিলকে সাথে নিয়ে। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে স্লোভাক সফটওয়্যার প্রকৌশলী পিটার কেস আইবর্গের কালার হিউ ৩৬০ এ উন্নীত করেন এবং বিভিন্ন ঘনত্বের কালার স্যাটুরেশান যোগ করেন। নিলের পাসপোর্টে তাঁর আইবর্গসহ ছবি সংযুক্ত হওয়ায় তাকে "সাইবর্গ"ও বলা হয়ে থাকে।

২০১০ সালে নিল "সাইবর্গ ফাউন্ডেশন" প্রতিষ্ঠা করেন, যা অক্ষম মানুষদের সাইবর্গ হতে সাহায্য করে। শৈশবের নিল নিল জন্মগতভাবে অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়াতে আক্রান্ত, এ ধরণের রোগিরা শুধু সাদা এবং কালো রঙ দেখতে পায়। শৈশবে সে স্পেনের বিভিন্ন স্কুলে নাচ, গান এবং নাটকের ওপর পড়াশোনা করে। মাত্র ১১ বছর বয়সে সে পিয়ানো পিস বাজাতো। স্কুলে সবাই ভাবতো, নিল ভীষণ অলস কারণ আর্টক্লাসে কেউ তাকে লাল রঙের কলম ধরতে বললে, সে নিল রঙেরটা ধরতো, যদিও সেটা তার অসুখের কারণেই! সে সর্বদা সাদা-কালো পোশাক পরতো।

১৬ বছর বয়সে তিনি ইনস্টিটিউট অ্যালেকজানদ্রো স্যাটোরাস এ ফাইন আর্টস এ পড়ার সুযোগ পান এবং শুধুমাত্র কালো, সাদা এবং ধূসর রঙের ব্যবহারের অনুমতি পান। অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া সম্পর্কে জানতে : Click This Link ২০০১ সালে স্পেনের ম্যাতারোতে একটি গাছে আরোহণ করে তিনি তিনটি গাছ কাটা থেকে সবাইকে বিরত করেন এবং মিডিয়ায় প্রশংসিত হন। সেপ্টেম্বরে তিনি আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে যান এবং সেখানে ওয়ালটনস্ নিউ স্কুল অব মিউজিকে তাঁর পিয়ানো বিষয়ক পড়াশোনা শেষ করেন। ২০০২ তে তিনি ইংল্যান্ডের ডার্টিংটন কলেজ অব আর্টস এ মিউজিক কম্পোজিশন বিষয়ে পড়তে যান। আইবর্গ প্রজেক্ট ২০০৩ এর অক্টোবরে ডার্টিংটন কলেজে পড়া অবস্থায় নিল প্লাইমাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র অ্যাডাম মনট্যানডন এর সাইবারনেটিকস বিষয়ে একটি লেকচার ক্লাসে যোগদান করেন।

নিল এই বিষয়ে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং তারপর অ্যাডাম এবং নিল মিলে আইবর্গ প্রজেক্টে কাজ করা শুরু করেন পুরোদমে। আইবর্গ আইবর্গ মাথায় লাগানো একটি ক্যামেরার মাধ্যমে কাজ করে এবং ব্যক্তির সামনে থেকে যেকোন রঙ ধারণ করতে পারে, পরে সেগুলো বাস্তব শব্দতরঙ্গে রূপায়িত করে। নিল প্রতিটি রঙের কম্পাংক মনে রাখতে পারেন, উচ্চ কম্পাংকের হিউ উচ্চ পিচের এবং নিম্ন কম্পাংকের হিউ নিম্ন পিচের। পরবর্তীতে ভিয়েনায় ২০০৪ সালে তাঁদের এই আইবর্গ প্রজেক্ট ২৯টি দেশের ৪০০টি প্রজেক্ট এর মধ্য থেকে পুরষ্কৃত হয় ইউরোপ্রিক্স অ্যাওয়ার্ড-এ। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে স্লোভাক সফটওয়্যার প্রকৌশলী পিটার কেস আইবর্গের কালার হিউ ৩৬০ এ উন্নীত করেন এবং বিভিন্ন ঘনত্বের কালার স্যাটুরেশান যোগ করেন।

সম্প্রতি মাতিয়াস লিজানা, একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আ্ইবর্গকে একটি ছোট চিপে উন্নীতকরণে কাজ করছেন। সাইবর্গ হিসেবে নিল সাইবর্গ মূলত দেহজ ও কৃত্রিম উপাদান (যেমন মেকানিক্যাল, ইলেকট্রনিক বা রোবোটিক অংশ) এর সমন্বয়। সাইবর্গ হলো মানুষ ও যন্ত্রের মিশ্রণে অতীব ক্ষমতাধর কিছু। ২০০৪ সালে নিলকে তাঁর ব্রিটিশ পাসপোর্ট নবায়ন করতে অনুমতি প্রদান করা হয় না কারণ তাঁর পাসপোর্টে আইবর্গসহ মুখমন্ডলের ছবি ছিলো। পরবর্তীতে নিল "আইবর্গকে কেন তাঁর শরীরের অংশ হিসেবে ধরা হবে না" এ বিষয়ে পাসপোর্ট অফিসে চিঠি লিখেন এবং তিনি একজন "সাইবর্গ" এটাও উল্লেখ করেন।

তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, বন্ধুরা এবং তাঁর কলেজ থেকেও সেখানে চিঠি পাঠানো হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে তারা ইতিবাচক সাড়া দেন এবং আইবর্গসহ তাঁর ছবি মঞ্জুর করেন। নিলের ভাষায়, "It's not the union between the eyeborg and my head what converts me into a cyborg but the union between the software and my brain". অর্থাৎ এটা শুধু আইবর্গ ও আমার মাথা, যা আমাকে সাইবর্গে রূপান্তর করেছে, এ দুটোর সমন্বয়ই নয় বরং এটা সফট্ওয়্যার এবং আমার মস্তিষ্কের সমন্বয়"। সাইবর্গ নিল হার্বিসেন নিলের সনোক্রম্যাটিক স্কেল নিলের সনোক্রম্যাটিক মিউজিক স্কেল হচ্ছে (২০০৩) ক্ষুদ্রসুরের এবং লগারিদমিক স্কেল যা একটি অষ্টকের সাথে ৩৬০টি নোটের মাধ্যমে সংযুক্ত। প্রতিটি নোট কালার হুইলের (বর্ণচক্র) একটি নির্দিষ্ট মাত্রাকে নির্দেশ করে।

পরবর্তীতে ২০০৫ সালে নিল একটি খাঁটি সনোক্রম্যাটিক স্কেল তৈরী করেন যা নন-অ্যালগরিদমিক এবং আলোক কম্পাংককে শব্দ কম্পাংকে রূপান্তর করতে সক্ষম। বিস্তারিত জানতে : Click This Link চিত্রকলা এবং অসাধারণ সাউন্ড পোর্ট্রেট শুরুতে নিলের জগত ছিলো ধূসর। সাদা-কালোয় তিনি ছবি আঁকতেন। এখন আইবর্গ ব্যবহার করে রঙিন সব সুন্দর ছবি আঁকেন। একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে তাঁর দক্ষতা চমকে দেয়ার মতো।

নিলের আঁকা ছবি প্রদর্শিত হয়েছে লন্ডনের রয়েল কলেজ অব আর্ট গ্যালারি, ভিয়েনার মিউজিয়ামকোয়ার্টার, ব্রিস্টলের সাবমার্জ ফেস্টিভ্যাল এবং পোর্ট এলিয়ট ফেস্টিভ্যালে। আইবর্গ শুধু তাকে রঙ আহরণ এবং ছবি আঁকার কাজেই সহায়তা করে না বরং প্রতিটি রঙের যে একটি সুর রয়েছে রিং টোন বা সঙ্গীতের মতো, সেটাও তুলে ধরে। আইবর্গের এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নিল "সাউন্ড পোর্ট্রেট" বা "শাব্দিক অবয়ব" তৈরী করতে সক্ষম। যার পোর্ট্রেট করা হবে তাঁর সামনে নিল দাঁড়িয়ে থেকে আইবর্গের সাহায্যে মুখমণ্ডলের ভিন্ন রঙের সাউন্ড নোট সংগ্রহ করেন এবং কাগজে লিখে রাখেন। পরে সেগুলোকে একত্রে জুড়ে তৈরী করেন সাউন্ড পোর্ট্রেট।

২০০৫ সাল থেকে এ অবধি প্রিন্স চার্লস, লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও, পিটার ব্রুক, আলো গোরে এবং উডি অ্যালেন এর মতো স্বনামধন্য ব্যক্তিদের পোর্ট্রেট করেছেন তিনি এই অসাধারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে। পিটার ব্রুকের সাউন্ড পোর্ট্রেটে ব্যস্ত নিল জীবনানন্দের কবিতার ধূসর জগত থেকে নিল বর্ণিল, রঙিলা এই জগত অনুভব করেন আইবর্গের সাহায্যে। তাই তো তিনি মানব-যন্ত্রের সমন্বয় "সাইবর্গ"। এই যে শব্দ কম্পাংকের মাধ্যমে রঙ চেনার উপায়, তা মানুষের বিজ্ঞান-মনস্কতা এবং আবিষ্কারের নেশাকে আরো মহিমান্বিত করে তোলে, প্রশ্ন জাগে, সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষের পক্ষে তাহলে কোন কাজটা করা অসম্ভব? আমরা কী সবাই মিলে নিল বা মনট্যানডনের মতো পরিশ্রমী হয়ে আমাদের বাংলাদেশটাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি না, প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের মাধ্যমে? ছবি আঁকায় মগ্ন নিল নিল বলেছেন, We aren't white or black, we are orange... আমরা কেউই সাদা বা কালো নই, আমরা সবাই কমলা রঙের। নিলের এই প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে মেনে নিবে কি সাদা-কালোর বর্ণবৈষম্যে ডুবে থাকা আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া বা ইউরোপ? কিংবা রক্ষা করবে ইরাক-আফগানিস্তানের নিরীহ জনপদকে? নিলের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।

নির্ঘন্ট : কালার হিউ : Hue is one of the main properties of a color, defined technically (in the CIECAM02 model), as "the degree to which a stimulus can be described as similar to or different from stimuli that are described as red, green, blue, and yellow,"[1] (the unique hues). The other main correlatives of color appearance are colorfulness, chroma, saturation, lightness, and brightness. বিস্তারিত : http://en.wikipedia.org/wiki/Hue নিল সম্পর্কে আরো জানতে : ১. http://en.wikipedia.org/wiki/Neil_Harbisson ২. Click This Link ৩. Click This Link ডিসকভারি চ্যানেলের একটি ডকুমেন্টারি : http://www.youtube.com/watch?v=9keRKQWe8sA ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।