আমি সত্যের এবং সুন্দরের পুজারী। কজন মানুষের সাথে হাসিমুখে মিষ্টি ভাষায় যারা কথা বলে তাদের প্রতি আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা । আর যারা নিজেদের অনেক বড় ভাবে, তাদের প্রতি আমার রয়েছে করুণা । যেটা আমার কাছে ভুল মনে হয় , তার তাত্ক্ষণিক যুক্তিসম্মত প্রতিবাদ করতে আমার ব দ্বিতীয় পর্ব: “আমরার কি লাভ হইল?”
নেতা বক্তব্য শুরু করিয়াছেন তাহার গত আমলের সাফল্যের কথা দিয়া। তাহার সাফল্যের কথা শুনিয়া “দ্বিতীয় নেবুলা” আহ্লাদিত হইল।
আহা, এই নেতার কত কথাই না অজানা ছিল। কত বড় সুযোগ আসিয়াছে আজ তাহাদের সামনে, তাহাদের কথা কি আজ এই নেতাকে বলিতে পারিবে! নেতাকে বলিলে নেতা না শুনিয়া পারিবে না। উনি যে জনগণের নেতা!
ভাষণ দিতে দিতে নেতা ইমোশোনাল হইয়া পড়িলেন। এই একবার হাসিয়া উঠেন, তো পরমুহূর্তে কাঁদিয়া উঠেন। যাহাই হউক, কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হইলে হাসপাতাল প্রসংগ আসিয়া পড়িল, আশে পাশের জনতা নড়িয়া চড়িয়া বসিল।
পরিস্থিতির গুরুত্ব “দ্বিতীয়” বেশ অনুধাবন করিতে পারিল। তাহার মনে হইল এই বেলা বেশ বড় কোন ঘোষণা আসিতেছে! চিকিতসার জন্য অনেক বড় কোন যন্ত্রপাতি আসিতেছে কি! নাকি তাহার মত গরীবদের চিকিতসা আর পরীক্ষার সমস্ত কিছু ফ্রী হইয়া যাইবে! নাকি হাসপাতালে আরো ভবন বানানো হইবে! এইরূপ চিন্তা করিয়া সে ফিসফিসাইয়া নেবুলাকেও তাহার চিন্তার কথা কহিল। তাহার কথা শুনিয়া নেবুলাও আশান্বিত হইয়া উঠিল। সেও ফিসফিসাইয়া সম্মতি জানাইল,
নেতা জলদগম্ভীর স্বরে ঘোষণা করিলেন,
“আগামী সপ্তাহ থেকে এ হাসপাতালের নাম পরিবর্তন হয়ে যাবে”।
নাম পরিবর্তন হইয়া যাইবে? দ্বিতীয় নেবুলা একে অপরের দিকে বোকা হইয়া চাহিয়া রহিল।
সেই ছোট্টবেলা হইতে শুনিয়া আসা নাম কেন পরিবর্তন হইবে ? ইহাতে নিশ্চয় ই কোন লাভ হইবে ব্যাপক ! তাহাদের কতটুকুন ই বা বুদ্ধি। বেশি বুদ্ধি থাকিলে তো তাহারাই নেতা হইত। চারিদিকে জনতা আবারো স্লোগান দিয়া ভবন ভরাইয়া ফেলিল। নেতার মুখে মৃদু হাসি আর জনতার আহ্লাদি ভাব দেখিয়া দ্বিতীয় নেবুলা ও তাহাদের ইতস্তত ভাব ঝারিয়া ফেলিল। তাহারাও স্লোগান দিল নেতার সম্মানে।
এবার নেতা দ্বিতীয় লাইনটা বলিলেন,
“এখন থেকে এই হাসপাতালের নামের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত হইবে। এই হাসপাতাল এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়”
চারিদিকে আবারো মুহুর্মুহু স্লোগান, এইবার দ্বিতীয় নেবুলা আর বোকা থাকিবে না, তাহারা জনতার সহিত তাল মিলাইয়া সজোরে স্লোগান দিতে থাকিল। নেতা প্রীত হইলেন। দ্বিতীয় নেবুলার হাত ধরিয়া ঈষত চাপ দিল।
অতঃপর নেতা আরো কিছু কথা কহিলেন।
নেবুলা “দ্বিতীয়” ‘র কানে কানে কহিল, নেতা কি গুরূত্বপূর্ণ কিছু বলিলেন, আমি তো বুঝিতে পারিলাম না। দ্বিতীয় ও ব্যাপারটা পুরা বুঝিতে পারে নাই। কিন্তু সে তো আর নেবুলাকে তাহা বলিতে পারে না! নেবুলার চোখে সে অনেক জ্ঞানী যে! কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বলে ডাকিতে হইলে তো আরো অনেক ভবন লাগিবে, আরো অনেক সুযোগ সুবিধা লাগিবে নিশ্চয় ই। পরীক্ষাগার লাগিবে। রোগীরাও নিশ্চয় ই সুবিধা পাইবে অনেক।
কিন্তু এই হাসপাতালে সে ছোটবেলায় আসিয়াছিল একবার। তখন যাহা সংখ্যক ভবন ছিল আজ ও তো তাই। কিন্তু আজ থেকেই কিভাবে নেতা ইহাকে বিশ্ববিদ্যালয় ডাকিতে হইবে বলিলেন, তাহা সে বুঝিতে পারিল না।
যাহাই হউক, নেতা ভাষণের শেষ পর্যায়ে চলিয়া আসিয়াছেন, আবেগ ঘন কন্ঠে নেতা বলিলেন আগামী বছর সবার ভোটে জিতিয়া তিনি ক্ষমতায় আসিলে এভাবেই সকল হাসপাতালকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এ রূপান্তরিত করিবেন। তখন বিশ্বের মানুষ অবাক হইয়া ভাবিবে এই ছোট্ট দেশে কত কত বিশ্ববিদ্যালয়।
বিদেশীদের ঈর্ষাভাব কল্পনা করিয়াই বুঝি জনতা আবারো স্লোগান দিতে লাগিল হাত উঁচাইয়া। নেতা স্নেহার্দ্র চোখে অসংখ্য হাতের দিকে তাকাইলেন। আহা তার নেতৃত্বে দেশবাসী কত আনন্দেই না আছে। আস্তে আস্তে সব হাত নামিয়ে গেল। একটা হাত নামিল না।
নেতা সেইদিকে ঈষত ভুরুকুঞ্চন করিয়া তাকাইলেন। মুখে হাসি ধরিয়া রাখিয়া কৌতুক করিলেন,
“কিহে, তুমি কি এতই খুশি যে হাত নামাইতেই ভুলে গিয়েছ ? হাত নামাতে পার এবার”।
কিন্তু হাত উপরেই রহিয়ে গেল। নেতা কিছুটা গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসিলেন, “তোমার নাম কি ? তুমি কিছু বলতে চাও?”
উপস্থিত জনতা অবাক হইয়া পেছনের সারিতে আলো আঁধারের মাঝে দাঁড়ানো ঝাকরা চুলের এক তরূণের দিকে তাকাইল। নেতার কথার মাঝখানে কথা বলাটা বুঝি ঠিক হয় নাই।
সে তো আর তাহা জানে না। মনের প্রশ্ন লুকাইতে সে জানে না। সে বলিয়া উঠিল,
“আমরার কি লাভ হইল?”
নেতা তাহার কথার অর্থ করিতে না পারিয়া কহিলেন, “ওহে যুবক, তুমি কি জানতে চাও? স্পষ্ট করিয়া বল”।
এইবেলা সাহস পাইয়া যুবক বলিল, “আমার নাম হইল দ্বিতীয়, নাম পরিবর্তন কইরলেই বিশ্ববিদ্যালয় হইয়া গেলে কত্ত ভালা হইল। আমগোর গ্রামে একটা স্কুল আছে, ঐটার নাম পরিবর্তন কইরা বিশ্ববিদ্যালয় কইরা দিলে আমগোর গ্রামেও একটা বিশ্ববিদ্যালয় হইত।
বিদেশি পোলাপাইন স্কুলে যায় আর আমাগো পোলাপাইন পত্থম থাইক্কাই বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া শুরু করত!” সে আশান্বিত হইয়া নেতার দিকে তাকাইল। আর খুবি একটা ভাল কথা বলিয়া ফেলিয়াছে এমন মনে করিয়া নেবুলা’র দিকে চাহিয়া একবার হাসিয়া দিল।
নেতা চক্ষু মুদিলেন। হঠাত কয়েকজন শক্তসমর্থ লোক আসিয়া দ্বিতীয়’র ঘাড় ধরিয়া বাইরে বের করিয়া আনিল। কোন কথা না বলিয়া তাহার পশ্চাদদেশে সজোরে একটা লাত্থি মারিয়া বাহির করিয়া দিল।
স্বামীর দুরাবস্থা দেখিয়া নেবুলাও আর ভেতরে থাকিল না। বাহিরে আসিয়ে দেখে স্বামী একটু দূরে বসিয়া আছে। প্রকৃতপক্ষে সে স্বামীর ঘাড় ধরাটা দেখিতে পারে নাই আর স্বামীর লাথি খাওয়াটাও দেখে নাই। সে কহিল, “তোমাকে নেতার লোকগুলা আসিয়া কি কহিল, তুমি বাহিরে চলিয়া আসিলে, তোমার কথাখান কিন্তু খাঁটি, নেতার নিশ্চয় ই তোমাকে মনে ধরিয়াছে”, আমরা কি এখানে অপেক্ষা করিব!দ্বিতীয় তেমন কিছু বলিল না, সে আসলে ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা বিমূঢ় হইয়াছে। খানিক পর সে কহিল, “চল সামনে যাই, ইহার চাইতেও আরো ভাল নেতা আছে।
সে নিশ্চয় ই আমাদের কথা শুনিবে”।
এইদিকে নেতা কিছুক্ষণ পর মুদিত চক্ষু খুলিলেন, ঝাকড়া চুলের তরূণটিকে না দেখিয়া মনে মনে হাঁপ ছাড়িলেন। তাহার মুখে আবার সেই মৃদু শান্ত হাসি ফিরিয়া আসিল। তিনি জনতাকে বলিলেন,
“কই সে পাগল ছেলেটা! প্রশ্ন করে উত্তর না জেনেই চলে গেল! পাগল ছেলে আমার”!
সম্পূর্ণ অচেনা একটা ছেলেকে এভাবে নিজের ছেলের মত মনে করায় জনতার মন আবেগে দ্রবীভূত হইল। তাহার আবারো নেতার নামে মুহুর্মুহু স্লোগান দিতে থাকিল।
জনতা বাহির হইবার সময় দেখিল হাসপাতালের নাম পরিবর্তন হইয়া গিয়াছে। হাসপাতাল টির দেয়ালে খোদাই করা নাম উঠাইয়া সেখানে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় এর নাম শোভা পাইতেছে। নেতার কথা শেষ হইবার আগেই কাজ হইয়া যাওয়ায় নেতার প্রতি শ্রদ্ধায় জনতার মাথা আপনা থেকেই নত হইয়া আসিল। নেতা প্রসন্ন চিত্তে বিদায় লহিলেন।
চলিবে,
প্রথম পর্ব : Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।