চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি [ গৌতম রায় আজকের আনন্দবাজারে এই লেখাটি লিখেছেন। আরব দুনিয়ার পরিবর্তন, শরিয়ত, গণতন্ত্র প্রসঙ্গে অনেক চিন্তা বিনিময়ের , বিতর্কের উপকরণ আছে লেখাটিতে। ]
ইসলামের ভুবনে আরব বসন্তের দখিনা বাতাস কি মৌলবাদী শৈত্যপ্রবাহে উত্তরবাহিনী? স্বৈরাচারী শাসক জিনে আল আবেদিন বেন আলিকে ক্ষমতাচ্যুত ও দেশছাড়া করার পর টিউনিসিয়ায় গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনা ও শাসনপ্রণালী চালু করার জন্য সদ্য যে গণ-পরিষদ নির্বাচিত হয়েছে, তাতে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছে ইসলামপন্থী দল আল-নাহ্দা বা এন্নাহ্দা, যারা গত দু’দশক বেন আলির জমানায় নিষিদ্ধ ছিল। ক্ষমতার স্বাদ পেয়েই ইসলামপন্থীরা শরিয়তের প্রতি অতিরিক্ত আনুগত্য না দেখানোর আভাস দিয়েছে। এমনকী পশ্চিমী পর্যটকদের আশ্বস্ত করেছে, আগের মতোই সুরার মাদকতা ও বিকিনির স্বল্পবাস স্বচ্ছতা এই ভূমধ্যসাগরীয় সৈকতরাষ্ট্রে অব্যাহত থাকবে, যেমন থাকবে বিবাহ, বিচ্ছেদ ও উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে মুসলিম নারীর সমানাধিকার।
কিন্তু এ সবই আপাতত নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতাবর্জিত ইসলামপন্থীদের কোয়ালিশন সরকার গড়ার বাধ্যতাপ্রসূত ক্ষণস্থায়ী আপস বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। ক্ষমতা পেলেই তারা স্বমূর্তি ধারণ করবে, এমন উদ্বেগ টিউনিসিয়ার মহিলাদেরও। অন্য দিকে গদ্দাফি-উত্তর লিবিয়ায় ক্ষমতাসীন জাতীয় অন্তর্বর্তী পরিষদ ঘোষণা করেই দিয়েছে-- শরিয়তের সঙ্গে খাপ খায় না, এমন কোনও আইন নতুন লিবিয়ায় গ্রাহ্য হবে না। মিশরে ক্ষমতার সিংহাসনের দিকে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে ইসলামপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুডের শাখা সংগঠন ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি। সুতরাং আরব বসন্তের সুপবন স্বৈরাচার থেকে গণতন্ত্রের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে, হিসেবটা বোধহয় অত সরল নয়।
টিউনিসিয়া ও মিশরের জমানা-বদলের আনুপূর্বিক ঘটনাক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমের মুক্ত দুনিয়া অনেকটা নিরপেক্ষ ছিল। কেননা প্রথম থেকেই তাদের আশঙ্কা ছিল, জমানা-বদল ইসলামপন্থীদের ক্ষমতারোহণের পথ সুগম করতে পারে। জমানা-বদলে অনুঘটক, এমনকী সক্রিয় সহায়কের ভূমিকা পালনে পশ্চিমের এই দ্বিধা তাদের সমালোচনার মুখেও ফেলে। গদিচ্যুত একনায়কদের সঙ্গে দীর্ঘ, নিবিড় ও সময়-পরীক্ষিত আর্থ-রাজনৈতিক যোগসাজশের কারণেই তারা গণ-বিদ্রোহের নতুন প্রভাতকে স্বাগত জানাতে পারছে না, এমন অভিযোগে বারংবার বিদ্ধ হয়েছে মুক্ত দুনিয়ার অবাধ গণতন্ত্র। অভিযোগটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনও ছিল না।
ভবিষ্যৎ? টিউনিস, টিউনিসিয়া, ২৮ অক্টোবর ২০১১। ছবি: এ এফ পি
তবে পশ্চিমের দ্বিধা ও দোলাচলের সেটাই একমাত্র কারণ নয়। এবং এখন সেটা অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে। যা স্পষ্ট নয় তা হল, লিবিয়ার বেলায় আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্স জমানা-বদলে এত তৎপর হল কেন? মুয়ম্মর গদ্দাফি কিন্তু আগাম হুঁশিয়ার করেছিলেন (যেমন করেছিলেন মিশরের হোসনি মুবারকও) যে, বিদ্রোহীদের গণ-অভ্যুত্থানে আল-কায়দা সহ অন্য ইসলামপন্থীরা ঘাপটি মেরে রয়েছে। কিন্তু স্বৈরাচারের অবসান আর গণতন্ত্রের আবাহনের মায়াটান ন্যাটোর বোমারুদের মৌলবাদের উত্থানের সম্ভাবনার প্রতি অন্ধ করে রাখে।
সেই বোমারুরা ছাউনিতে ফিরে যাওয়ার পর গদ্দাফি-বিযুক্ত লিবিয়ায় সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিক হলেন ইসলামি কট্টরপন্থী আলি সাল্লাবি, আর সবচেয়ে ক্ষমতাবান সেনানায়ক আল-কায়দার সঙ্গে পুরনো সংস্রবে থাকা আবদেল হাকিম বেলহাজ।
মিশরের তাহ্রির স্কোয়ারের প্রতিবাদ-বিক্ষোভে হাজার-হাজার মহিলা সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। টিউনিসিয়ার যুবতীরাও সে দেশের জমানা-বদলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মিশরে শিক্ষিত মুসলিম মহিলারা ওকালতি, ব্যাংকিং, প্রযুক্তিবিদ্যা, বিপণন, খাদ্য-উৎপাদন সহ নানা পেশায় দক্ষতার সঙ্গে সক্রিয়। টিউনিসিয়াতেও তাই।
টিউনিসিয়ার ৪০ শতাংশ চিকিৎসকই মহিলা, বিচারকদের ৩০ শতাংশও তাই। কিন্তু সেখানে ইসলামি দল আল-নাহ্দা এবং মিশরে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি ক্ষমতায় এলে তাঁদের পরিণতি কী হবে, ভেবে মুসলিম মহিলারা উৎকণ্ঠিত। দুই দলেরই শীর্ষ নেতারা আশ্বাস দিয়েছেন, পুরুষের বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করার আইন অপরিবর্তিত থাকবে, মহিলাদের বোরখাবন্দি করা হবে না, সমান কাজের বিনিময়ে সমান পারিশ্রমিকও দেওয়া হবে। মহিলারা তবু শঙ্কায় আছেন।
জমানা-বদলের পর থেকেই টিউনিসিয়ায় কট্টরপন্থী সালাফি গোষ্ঠী এবং ইমামরা বেন আলির আমলের প্রান্তিকতার নির্বাসন থেকে প্রকাশ্যে এসেছে।
তাদের সংখ্যা এখনই খুব বেশি নয়, কিন্তু তারা খোলাখুলি মুসলিম নারীর স্বাধিকারপ্রমত্ততা খর্ব করার পক্ষে সওয়াল করছে। মিশরের ফ্রিডম পার্টির নেতৃত্বেও পুরুষতন্ত্রের রমরমা। আসন্ন নির্বাচনে দল সেখানে কিছু মহিলা প্রার্থীও দেবে, যাদের অধিকাংশই মুসলিম ব্রাদারহুডের সক্রিয় কর্মীদের স্ত্রী। ২০০৭ সালে ব্রাদারহুড নেতৃত্ব ঘোষণাই করেছিল, কোনও মহিলাকে তারা দেশের প্রেসিডেন্ট হতে দেবে না। টিউনিসিয়ার আল-নাহ্দা নেতা রশিদ ঘানুচ্চি ক্ষমতার নৈকট্যে পৌঁছে উদারনৈতিক নানা বাণী আওড়ালেও আদতে যে তিনি গোঁড়া ইসলামপন্থী, তার বহু নমুনা তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ছড়িয়ে আছে।
১৯৯১ সালে আলজিরিয়ার পার্লামেন্ট নির্বাচনে ইসলামপন্থীরা নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠ হলেও সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে ক্ষমতাসীন হতে পারেনি। শুরু হয় ১০ বছর ব্যাপী রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। এর পর ২০০৬ সালে প্যালেস্টাইনের নির্বাচনে আল-হামাস-এর জয় ইসলামপন্থীদের সাফল্যের দ্বিতীয় মাইলফলক। ওই সাফল্য প্যালেস্টাইনিদের দ্বিধাবিভক্ত করে দেয়, ওয়েস্ট ব্যাংক ও গাজায় আলাদা-আলাদা প্রশাসনিক কর্তৃত্ব গড়ে ওঠে। টিউনিসিয়ার আল-নাহ্দার জয় আরবভূমিতে ইসলামপন্থীদের তৃতীয় সাফল্য।
২৮ নভেম্বর মিশরে যে নির্বাচন হতে চলেছে, সেখানেও ইসলামপন্থী ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির জয়ের সম্ভাবনা সমূহ। আলজিরিয়া, প্যালেস্টাইন, টিউনিসিয়া, মিশর, সর্বত্র ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ গোষ্ঠী বা সংগঠনে উচ্চবর্গের ভিড়। তারা হাতে ধুলোময়লা লাগাতে চায় না, বিতর্কসভায় সময় কাটায়, সংবাদপত্রে কলাম লেখে, মানুষের সঙ্গে মেলামেশার ধার ধারে না। গরিব নিরক্ষর জনসাধারণের কাছে তাদের কোনও আবেদন বা আকর্ষণ নেই। তুলনায় ইসলামপন্থীরা অনেক ‘কাছের লোক’, গরিব মানুষের পাশে থাকে, তাদের সাহায্য করে, ভোটের আগে বাড়ি-বাড়ি ঘুরে ভোট চায়, জনসংযোগ করে।
তারা কেন আরব মুলুকে পশ্চিম-ঘেঁষা শাসকদের পতনের শূন্যস্থান দ্রুত পূরণ করতে এগিয়ে আসছে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। স্বৈরাচারী জমানায় মসজিদগুলোই হয়ে ওঠে পারস্পরিক সান্ত্বনা-সহানুভূতি জ্ঞাপনের, সংঘবদ্ধ হওয়ার, প্রতিবাদ গড়ে তোলার একমাত্র সহজলভ্য মঞ্চ আর ইমাম-উলেমা-মৌলবি-মুফ্তিরা হয়ে ওঠেন একমাত্র ভরসাস্থল। গরিব, অসহায়, অধিকারবঞ্চিত ও অত্যাচারিত মানুষের কাছে আঁকড়ে ধরার একমাত্র অবলম্বন তখন ইসলাম, যা এক ধরনের ‘লিবারেশন থিয়োলজি’ হয়ে ওঠে। স্বৈরাচারীরা বিক্ষোভ দমনের অত্যুৎসাহে ইসলামপন্থীদের নিষিদ্ধ করে, মোল্লা মৌলবিদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে। একনায়করা ক্ষমতা হারালে তাই ইসলামপন্থীরাই বৈধ দাবিদার হিসাবে সামনে চলে আসে, স্বৈরাচারী জমানায় শাঁসে-জলে থাকা উচ্চশিক্ষিত সম্ভ্রান্ত সেকুলারিস্টরা নয়।
এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে সমাজসেবায়, আর্তত্রাণে ইসলামপন্থীদের দীর্ঘ নিঃস্বার্থ ত্যাগের রেকর্ড। আল-হামাস সেবা ও ত্রাণের কাজ করেই প্যালেস্টাইনিদের ‘ঘরের লোক’ হয়ে উঠেছিল। মিশরের ব্রাদারহুড, টিউনিসিয়ার আল-নাহ্দাও একই ভাবে স্বৈরাচারীর দমননীতি উপেক্ষা করেও মার-খাওয়া মানুষের পাশে থেকেছে। সৌদি আরব সহ পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের ইসলামি দেশগুলির কাছ থেকে পাওয়া মোটা অঙ্কের তহবিল মাদ্রাসা নির্মাণ, মসজিদ প্রতিষ্ঠা, লঙ্গরখানা খোলা, ন্যূনতম চিকিৎসার বন্দোবস্ত করার মতো সমাজকর্ম সম্পাদনে সহায়ক হচ্ছে। টিউনিসিয়ার ইসলামপন্থীরা যদি সৌদি তহবিল পায়, লিবিয়ার বিদ্রোহীরা তবে দ্রোহকালের শুরু থেকেই ধনী উপসাগরীয় রাষ্ট্র কাতারের পেট্রোডলারে সমৃদ্ধ।
এই রাষ্ট্রগুলি নিজেরা রাজতন্ত্র বা সামন্ততান্ত্রিক আমিরতন্ত্র অনুশীলন করে। এরা কি কখনও গণতন্ত্রকে জায়মান হতে সাহায্য করতে পারে?
লিবিয়া, টিউনিসিয়া কিংবা মিশরে যে অদূর ভবিষ্যতে কোনও উদারনৈতিক গণতন্ত্রের অভিষেক ঘটছে না, তা অতএব নিশ্চিত। ‘শরিয়তি গণতন্ত্র’ বলে কিছু হয় না। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।