আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

১৯৭১-এর চেতনায় আসুন ইতিহাসের দায়শোধ করি

'১৯৭১। বাঙালি জাতির জীবনে তরঙ্গায়িত হয়েছিল এক 'মহাসিন্ধুর কল্লোল'। মিথ্যা দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত ভারতে আমরা পেয়েছিলাম এক উদ্ভট রাষ্ট্র পাকিস্তান। মিথ্যা এই কারণে যে, ধর্ম কখনো জাতিসত্ত্বা নির্ধারণ করতে পারেনা। মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ ভেবেছিলো- আলাদা দুটো রাষ্ট্র হলে বুঝি তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে।

আর এভাবেই মানুষকে উজ্জীবিত করেছিলো ভারতবর্ষের তথাকথিত জনপ্রিয় নেতৃত্ব। 'মুসলমানস্থান' পাকিস্থান আর 'হিন্দুস্থান' হিসাবে ভারত বিভক্ত হয় ১৯৪৭ সালে। প্রকৃত অর্থে এই বিভক্তির মাধ্যমে ভারতবর্ষের সকল ছোট-বড় জাতিসত্ত্বার বিকাশ হয় রুদ্ধ। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য উভয় রাষ্ট্রেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়। নির্মম সত্য হলো, এই কাঙ্খিত বিভক্তি ভারত বা পাকিস্তান কোথাও মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনা।

প্রশমন হয়না সাম্প্রদায়িক হানাহানির। সেই সময় কমিউনিস্টরা যথার্থই শ্লোগান তুলেছিল ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়। কমিউনিস্ট পার্টি অনেক ইতিবাচক কাজ করলেও তারাও ব্যর্থ হয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের খপ্পর থেকে লাখো ইনসানের 'ভুখ' নিবারণ করার জন্য সঠিক রাজনীতি নিয়ে মাঠে নামতে। ইতিহাসের সেই দায় তখন বামপন্থীরা শোধ করতে পারেনি বলে নতুন ইতিহাস আর সৃষ্টি হলো না। ইতিহাসের আয়না অস্বচ্ছই থেকে গেল।

উদ্ভট ও সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান পূর্ব বাঙলার মানুষের উপর উপনিবেশিক শোষণ শুরু করে দেয় জন্মলগ্ন থেকেই। ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৬৬'র ছয় ছফা, ৬৯'র গণঅভ্যূত্থান, ৭০'র নির্বাচনে ধাপে ধাপে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরী করে। এরমধ্যে আরো অনেক ঘনটাবালী ও ইতিহাসের চড়াই-উতরাই রয়েছে যা এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করার অবকাশ নেই। এখানে বলা প্রয়োজন, পাকিস্তান পর্বেও বিপুল সম্ভাবনা ও সাংগঠনিক অবস্থান সত্ত্বেও কমিউনিস্টরা ইতিহাসের দায়শোধ করতে ব্যর্থ হন। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের মতো সশস্ত্র সংগ্রামকেও গণযুদ্ধে পরিণত করে সমাজ কাঠামো আমূল পরিবর্তন করার কাজটাও কমিউনিস্টদের পক্ষে করা সম্ভব হলো না- দলাদলি ও ভুল লাইন নিয়ে বহুধা বিভক্তির করণে।

অথচ ষাটের দশকে পূর্ব বাঙলায় সবচাইতে শক্তিশালী ছিল বামপন্থীদের নেতৃত্বাধীন শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন ও ছাত্র আন্দোলন। এমন অভূতপূর্ব বিপ্লবের সম্ভাবনা আর কবে আসবে আমরা জানিনা। রাজনীতির হাজারো জটিল কুটচালেও কেউ ইতিহাসকে সাময়িকভাবে আড়াল করে রাখলেও তা' বেশিদিন আড়াল রাখা সম্ভব নয়। অস্বীকার করা যায়না ইতিহাসের সত্য ঘটনাবলী। যেমন, কোনোভাবেই ইতিহাসের নানা চড়াই উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে, কমিউনিস্টদের ব্যর্থতার পাশাপাশি বিপুল জনপ্রিয় হয়ে উঠা আ.লীগ এবং তার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে অস্বীকার করা যায় না।

১৯৭১-এর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ শেখ মুজিবুর রহমানকে জনপ্রিয়তার এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে দেয় যে, সেখানে তিনি বাঙালী জাতির একটা 'প্রতীকে' পরিণত হন। রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সমাজের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ জড়ো হয়েছিলো, জড়ো হয়েছিলো শেখ মুজিবুর রহমানের কট্টর সমালোচকও। শেখ মুজিবুর রহমান মানুষকে মহসমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তরঙ্গায়িত করে মোহাবিষ্ট করেছিলেন- এটা সত্য। দিয়েছিলন অনেক নির্দেশনা এটাও সত্য কিন্তু এরপরের সময়কালে মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে মানুষের যে ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিলো তার জন্য সাংগঠনিকভাবে কোনো নির্দেশনা আ.লীগ থেকে আসেনি। অবশ্য তা' হওয়ার কথাও নয়।

কারণ শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ পর্যন্ত অপক্ষা করেছেলেন পাকিস্তান কাঠামোর মধ্য থেকে একটা সমাধানের। ফলে একেবারেই সামরিক প্রস্তুতিবিহীণ নিরীহ বাঙালিদরে ওপর ২৫ মার্চ রাতে এমন ভয়বাহ হত্যাযজ্ঞ চালাতে পেরেছিল পাকিস্তানী হায়েনারা। এরপরের নয় মাসের ইতিহাস পাক বাহিনী কর্তৃক কেবলই রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়ার ইতিহাস। লক্ষ লক্ষ আদম সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যার ইতিহাস। লক্ষ বাঙালী নারীকে অবর্ননীয় নির্যাতনের ইতিহাস।

পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়ংকর গণহত্যার ইতিহাস। কিছু সংখ্যক বাঙালী দালাল রাজাকার-আলবদরের বেঈমানীর ইতিহাস। কোটি মানুষের শরনার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার ইতিহাস। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ইতিহাস। আরো বহু বুহু অকথিত-অলিখিত নির্যাতন-নীপিড়নের ইতিহাস।

দেশ স্বাধীন হলো। ক্ষমতায় এলেন অবিসম্বাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দল আ.লীগ। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু উলট পালট হয়ে গেল। শেখ মুজিব ও আ.লীগ এক যেন একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগের দিকে যাত্রা করলেন। শত্রু হয়ে গেল প্রতিবাদী বামপন্থীরা।

বামপন্থারও তখন নানা সংকট আরো জটিল হওয়া শুরু করেছে বিভিন্ন দল ও উপদলগুলো। প্রতিক্রিয়াশীল মোস্তাকচক্র বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন হলো, আর মুক্তিযুদ্ধের মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বদানকারী তাজউদ্দীন হয়ে গেলেন পরিত্যাজ্য। সবমিলিয়ে এক ভয়াবহ সংকটের কাল। মহান নেতা সামাল দিতে পারলেন না। গড়ে তুললেন 'বাকশাল'।

এখানে আবার সিপিবি, ন্যাপ যোগ দেয়। সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলা হয়। অদ্ভূত ব্যাপার, ডিক্রী জারি করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা!!! ৭২-এর সংবিধানের মূলনীতিতেও সমাজতন্ত্র ছিলো। সেটাওবা কীভাবে কায়েম হতো কে জানে। তারপরও কিছুটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হতে পারতো হয়তো।

কিন্তু একদলীয় বাকশাল! একদিকে উদার গণতন্ত্র আবার এক লাফে একদলীয় সমাজতন্ত্র? সবকিছু জাতীয়করণ! সবকিছু এক তালগোল পাকানো অবস্থা। জানিনা কার মাথা থেকে এসব এসেছিলো! সেনাবাহিনীর এক বিক্ষুব্ধ অংশ ফারুক-রশিদ চক্রের হাতে বাকশাল গঠনের কয়েক মাসের মাথায় নির্মমভাবে নিহত হলেন শেখমুজিবুর রহমান। এই চক্রের কুশীলবরে ভূমিকায় মোস্তাক ছাড়াও আ.লীগের অনেক সুবিধাবাদী নেতাও যুক্ত হয়। আরো তিন মাসের মাথায় পচাত্তরের নভেম্বরে জাতীয় চার নেতাকেও জেলের ভেতর হত্যা করা হলো। মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালনকারী সেক্টর কমান্ডারগণ জড়িয়ে পড়লেন ত্রাতৃঘাতি যুদ্ধে।

দেশী-বিদেশী চক্রান্তের এক লীলাভূমিতে পরিণত হলো এক সমুদ্র রক্তে কেনা বাংলাদেশ। একদিকে চেইন অব কমান্ড ফেরাতে খালেদ মোশাররফ এর অভূত্থান, জিয়াকে বন্দী করা। অত:পর কর্নেল তাহের এর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের পথ ধরে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ এবং সাথে সাথে কর্নেল তাহেরের সাথে বেঈমানী করে উপযুক্ত 'কৃতজ্ঞতা' প্রকাশ করলেন জিয়াউর রহমান। কর্নেল তাহেরকে এক প্রহসনমূলক বিচারে ফাঁসিতে ঝোলালেন জিয়া। জিয়াউর রহমানের কালপর্বেও কেবল হত্যা, ক্যু আর নানা ষড়যন্ত্রের ইতিহাস।

মৌলবাদী রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোকে বৈধকরণের ইতিহাস। রাজাকার-আলবদরদের মূল সংগঠন জামায়াতে ইসলামীকে প্রকাশ্য রাজনীতিতে প্রবেশাধিকারের ইতিহাস। শাহ আজিজের মতো চিহ্নিত রাজকারকে প্রধানমন্ত্রী করার ইতিহাস। পরিশেষে আরেকটি সামরিক ক্যু' এর শিকার হয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানেরও নির্মম মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জিয়া-পর্বেরও দু:খজনক পরিসমাপ্তি ঘটে। এর পর জেনারেল এরশাদ।

সম্ভবত বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে ধূর্ত খেলোয়াড় এই এরশাদ। যে এখনও খেলে যাচ্ছে তার নোংরা খেলা। এই জেনারেল এরশাদও তার হাত বহু মানুষের রক্তে রঞ্জিত করে এখনো রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে চরম বার্ধক্য নিয়েও নানা নাটক মঞ্চস্থ করে যাচ্ছে। এই সামরিক ভাঁড় অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে বাংলাদেশ রাষ্টকে সাম্প্রদায়িক চরিত্র দান করে ইতিহাসের এক নিকৃষ্টতম কাজ করেছে। জিয়া ও এরশাদ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কাজ করেছে এই মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাষ্ট্রের মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষকতা করে।

নব্বই- এ মূলত শহরকেন্দ্রিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে এরশাদের পতন ঘটলেও কাঙ্খিত গণতন্ত্র আসেনি। আসার কথাও নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের লেবাসে বর্তমানে যা' চলছে তা' স্বৈরতন্ত্রেরই আরেক রূপমাত্র। একবার বিএনপি, একবার আ.লীগের দু:শাসন এখন আমাদের বিধিলিপি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেইসাথে মৌলবাদী রাজনীতির ভয়ংকর চিত্র এখন স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেছে।

বিএনপি নগ্নভাবে ও ক্ষেত্র বিশেষে আ.লীগ তাদের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য ফ্যাসিস্ট জামায়াতে ইসলামীকে আজকের এই ভয়ংকর দানবীয় শরীরে হৃষ্টপুষ্ট হতে সাহায্য করেছে। এখনো বিএনপি তার আস্তিনের তলায় জামায়াতকে রেখে ক্ষমতায় যেতে চায়, অপরদিকে আ.লীগ এখনো 'জামায়াত' ট্রাম কার্ড-কে হাতে রেখে আরেকবার ক্ষমতার আসন পাকাপোক্ত করতে চায়। এই উভয় দলই জামায়াত-কে নিয়ে যে ভয়ংকর খেলায় মত্ত, এখানে জনগণের আশা-আকাঙ্খা আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা- শুধুই ফাঁকা আওয়াজ মাত্র। যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়'কে কেন্দ্র করে এই সময়ে শাহবাগের জাগরণ এক অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছে জাতির মধ্যে। কাঁপন ধরিয়েছে রাজাকার-আলবদরদের শিরোমনি ইসলামের বিকৃতকারী মওদুদীবাদী জামায়াত-শিবির গং-দের।

একইসাথে ভীতি সঞ্চার করেছে জামায়াত-শিবিরের পৃষ্ঠপোষকতাকারী বিএনপি'কেও। এমনকি আ.লীগ সরকারও নড়ে-চড়ে বসেছে এই ব্যাপক গণ-জাগরণ দেখে। তাই তারাও এর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে মরিয়া। অবশেষে 'নাস্তিক' বলে সারাদেশের সকল বয়সের, নানা পেশার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী বিভিন্ন সংগঠনের আন্দোলনকে সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হলেও মানুষ আবারো জেগে উঠবে। মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিরোধীতাকারীরা 'নাস্তিক' বলে এই আন্দোলনকে অন্যদিকে মোড় ঘোরানোর এটাও একটা চেষ্টামাত্র।

হাজার চেষ্টা করেও প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধরা আর পাবেনা- এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত রুখে দিয়ে ৭১'র চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে নবীন-প্রবীন সকলে মিলে একটি শোষণহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাবো-স্বাধীনতা দিবসে এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।