আিম ভবঘুের
গত ২৬ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় ‘শেয়ারবাজার বাঁচাতে ব্যাংকের তহবিল, উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি পুঁজিবাজার ও সংশ্লিষ্ট মহলে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর শেয়ারবাজারে বড় ধরনের দরপতন হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সভাপতি শাকিল রিজভী। একই সঙ্গে পুঁজিবাজারে বিভিন্ন শ্রেণীর বিনিয়োগকারী, স্টেকহোল্ডাররাও তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এ নিয়ে। চট্টগ্রামে পোড়ানো হয়েছে পত্রিকাটির কপি।
শুধু পুঁজিবাজারই নয়, ইন্টারনেটে ফেসবুক এবং ব্লগেও এ বিষয়ে বিতর্ক জমে ওঠে।
পত্রিকাটির প্রতিবেদন এবং তা ঘিরে বিতর্ক ও বিভিন্ন মহলের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় দৈনিক স্টক বাংলাদেশের পক্ষ থেকে খোঁজ নিতে গিয়ে বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে। প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনের দায় সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ। আন্তর্জাতিক এ সংস্থা দুটি জানিয়েছে, প্রতিবেদনে সূত্র হিসেবে উল্লিখিত যেসব তথ্য তাদের বলে লেখা হয়েছে, তা মোটেও সত্যি নয়। এরকম কোনো প্রতিবেদন বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ তৈরি করেনি, প্রকাশও করেনি। মোটের ওপর পত্রিকার এই মনগড়া প্রতিবেদনের কোনো দায়ই তারা নিতে রাজি হয়নি।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আইএমএফের অফিস ম্যানেজার গ্লোরিয়া হালদার দৈনিক স্টক বাংলাদেশকে বলেন, এটা আইএমএফের রিপোর্ট নয়। পত্রিকাটি যা করেছে, তা তাদের একান্তই নিজস্ব। তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, আইএমএফ কোনো বিষয়ে মতামত জানানোর প্রয়োজন মনে করলে তা প্রেস বিজ্ঞপ্তি বা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তবেই প্রকাশ করে থাকে। বিশেষ কোনো পত্রিকার মাধ্যমে কোনো কিছু প্রকাশ করার কোনো চর্চা আইএমএফের নেই। এর দায় কোনোভাবেই আইএমএফ নিতে পারে না।
গ্লোরিয়া জানান, প্রতিবেদনটি ছাপা হওয়ার পর থেকে তারা টেলিফোনে বেশ কিছু ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের অবস্থান জানতে চাইলে সংস্থার কমিউনিকেশন অফিসার মেহেরিন আহমেদ মাহবুব বলেছেন, গত অক্টোবরে বিশ্বব্যাংক সর্বশেষ অর্থনৈতিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেটি সেপ্টেম্বর মাসের হালনাগাদ। এর পর আর কোনো রিপোর্ট প্রকাশ বা প্রচার করেনি। বিশ্বব্যাংকের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকলে তা একান্তই তাদের নিজস্ব ব্যাপার।
এ ব্যাপারে কোনো দায় বিশ্বব্যাংক নেবে না। ’ তার দাবি সত্যি হলে অক্টোবরে ঘোষিত পুঁজিবাজার স্থিতিশীলকরণ তহবিল নিয়ে কোনো মন্তব্য ওই প্রতিবেদনে থাকা অবান্তর।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ব্যাংকগুলোর উদ্যোগে ‘বিশেষ তহবিল গঠন’ প্রক্রিয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে বাজার বাড়ানোর চেষ্টা এবং বিশেষ তহবিল গঠন দায় আরও বাড়াবে। এতে ব্যক্তি খাতের ঋণের পরিমাণও কমবে।
আইএমএফের মতে, এই তহবিল ব্যর্থতাকে পুরস্কৃত করবে। এটি শুধু ভুল নয়, উদ্যোগের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ (বিএপিএলসি) ‘বাজার স্থিতিশীলকরণ তহবিল (এমএসএফ)’ নামে যে তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে, তা নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছে আইএমএফ। তারা বলছে, তহবিলটির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এটি বাজারে লেনদেন হবে। কিন্তু মেয়াদি তহবিল সচরাচর বাজারে লেনদেন হতে দেখা যায় না।
পত্রিকাটির ভাষ্যে আইএমএফ বলছে, শেয়ারবাজার এখনো অস্থিতিশীল। শেয়ারের বড় ধরনের দরপতনের আশঙ্কা এখনো রয়ে গেছে। এ অবস্থায় নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই ‘প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী’ হিসেবে ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারের উদ্ধারক বলে মত দিচ্ছেন। কিন্তু এটি তাদের সঠিক ভূমিকা নয়। ব্যাংকগুলো এরই মধ্যে শেয়ারবাজারে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করেছে।
এ অবস্থায় তারা যদি বিনিয়োগ আরও বাড়ায়, তাহলে তা ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি আরও বাড়াবে। ’
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, দৈনিক প্রথম আলো এমন সময়ে প্রতিবেদন ছেপেছে, যখন বাজারে একটা ইতিবাচক ধারা ফিরে আসতে শুরু করেছিল। তিনি বলেন, প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রভাবে বাজারে ব্যাপক দরপতন ঘটেছে। এর ফলে সরকারের ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি। কারণ, এই একটি রিপোর্ট পুঁজিবাজারের জন্য সরকারের অনেক উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বিনিযোগকারীদের আস্থা নষ্ট করে দিয়েছে এবং তাদের মাঝে হতাশা বাড়িয়ে দিয়েছে। ’
শাকিল রিজভী আরও বলেন, আইএমএফকে উদ্ধৃত করে এ রকম মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করা যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে। আইএমএফই কীভাবে এ রকম মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করেছে, সেটাও ভেবে দেখা দরকার। ’
ডিএসইর সভাপতি বলেন, প্রতিবেদনে আইএমএফের পর্যবেক্ষণের কথা বলা হয়েছে, এটা কোনো সুপারিশ বা পরামর্শ নয়। সরকার ইচ্ছা করলে তা মানতে পারে আবার নাও পারে।
এর আগেও আইএমএফের অনেক সুপারিশই সরকার মানেনি। আবার তাদের সুপারিশ মানতে গিয়ে অনেক সময় সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। ’
প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেক বিনিয়োগকারী। ফেরদৌস হাসান নামে এক বিনিয়োগকারী অভিযোগ করেন, শেয়ারবাজার নিয়ে প্রথম আলোর কোনো এজেন্ডা রয়েছে। ’ তিনি বলেন, আগেও দেখা গেছে, যখন বাজার একটু স্থিতিশীল হওয়া শুরু করেছে, তখনই প্রথম আলো শেয়ারবাজারবিরোধী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
এতে আবার বাজার অস্থির হয়ে গেছে। দরপতন ঘটিয়ে প্রথম আলোর পক্ষের বড় খেলোয়াড়দের শেয়ার কিনে নিতে সুযোগ করে দিতে এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। ’
প্রতিবেদনটির বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক দৈনিক স্টক বাংলাদেশকে বলেন, রিপোর্ট প্রকাশের ফলে আর যাই হোক, পুঁজিবাজারের জন্য কোনো লাভ হয়নি। এটি অনেক বিনিয়োগকারীকে হতাশ করবে। পাশাপাশি যেসব প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বাজারে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তারা একটু হোঁচট খাবে।
কারণ, যারা বাজারে আসতে চাচ্ছেন, তাদের মধ্যে ব্যাংকিং খাত অন্যতম। এ খাতটিকে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএমএফ নানাভাবে চাপের মুখে রাখার চেষ্টা করে। তারা ব্যাংকিং সংস্কার ও আমানতকারীদের আমানত নিরাপত্তা রক্ষার নামে বিভিন্ন নিয়ম বেঁধে দেয়। এখন পুঁজিবাজারের স্বার্থে যখন ব্যাংকিং খাতের বিনিয়োগ আসার পথে, তখন তারা রিপোর্ট প্রকাশ করে এক ধরনের ভয় ছড়িয়ে দিল। ওই শিক্ষক বলেন, আমাদের অনেক দুর্ভাগ্যের মধ্যে এটি আর একটি দুর্ভাগ্য যে অর্থনীতির জন্য আমরা এখনো নিজস্ব কোনো সুনির্দিষ্ট পলিসি গ্রহণ করতে পারিনি।
তিনি বলেন, সরকারের উচিত এ রিপোর্টকে বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট পত্রিকা এবং সংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি এ কে মিজানুর রশিদ বলেন, ‘প্রথম আলোর বিরুদ্ধে অনেকেই অনেক কথা বলছেন; যাদের সূত্র করে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, সেই আইএমএফ এখন বিষয়টি অস্বীকার করছে। এটা তারা বলতেই পারে। কারণ, আইএমএফকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তবে আমার মনে হচ্ছে, এখানে নতুন কোনো খেলা চলছে।
তবে ভেতরে কি খেলা চলছে তা বলা মুশকিল। তবে খেলা যে চলছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আমি মনে করি, সরকারের একটি অংশ আইএমএফের মাধ্যমে এমন রিপোর্ট করাতে পারে। পত্রিকা হিসেবে প্রথম আলোকে চাপে ফেলার এটা একটা নতুন কৌশল। সেই সাথে পুঁজিবাজারের মূল সমস্যার জায়গাটি অনত্র সরিয়ে নেয়ার বিষয়টিও এখানে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
’
প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয়ে পত্রিকাটির বক্তব্য জানতে চাইলে প্রথম আলোর যুগ্ম বার্তা ও অর্থনীতিবিষয়ক সম্পাদক শওকত হোসেন মাসুম বলেন, আমরা যে রিপোর্ট করেছি তা ঠিক আছে। এ বিষয়ে আমাদের কাছে তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। ’ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।