আমি যদি আমার মনকে নিয়ন্ত্রন করতে পারতাম তাহলে হয়তো জীবনে আমি এত দুঃখ পেতাম না... দেখতে দেখতে আমার জীবনের ২১টা বছর পার করে ফেলেছি, সেই ১৯৮৯ থেকে ২০১১ সাল। এত্ত গুলো বছরে অনেক অনেক ঘটনা ঘটেছে। এর মাঝে ২০০৫ বছরটা আমার সব থেকে বেশি মনে পড়ে। এই বছর অনেক ঘটনাই ঘটেছে যা মনে রাখার মত ।
একে একে কিছু ঘটনা বলে যাই...
১. ২০০৫ এই আমি প্রথম ঘর থেকে বের হওয়ার স্বাধীনতা পাই।
ক্লাস এইট পর্যন্ত আমি ঘর থেকে বের হতে পারতাম না। ৭ম শ্রেনী পর্যন্ত আম্মা আমাকে স্কুলে দিয়ে আসত আবার নিয়ে আসত। আমার স্কুল যে খুব একটা দূরে তাও না, বাসা থেকে আধ কিলোও হবে না।
অনেকের অনেক কিছু বলাবলির পর ৮ম শ্রেনী থেকে আম্মা আমাকে দিতে / আনতে যাওয়া বন্ধ করে, বন্ধুদের সাথে স্কুলে আসতাম যেতাম ।
নবম শ্রেণীতে উঠার পর আমি ঘর হতে একা বের হওয়ার স্বাধীনতা পাই ।
তবে যেকোন সময় বের হওয়ার জন্যে নয়, শুধুমাত্র প্রাইভেট পড়তে আর স্কুলে যাওয়ার জন্য ।
২. ২০০৫ এই আমি প্রথমবারের মতো ব্যাচে প্রাইভেট পরতে যাই।
সাধারণত স্যার বাসায় এসে আমাকে পড়াতো। কিন্তু ৯ম শ্রেণীতে উঠার পর কয়েকজন স্যারের কাছে পড়তে হতো বলে সব স্যারকে বাসায় এনে পড়ানো অনেক ব্যয়বহুল। তাই ইংরেজি পড়ার জন্য সাইফুল স্যারের বাসায় যেতাম সপ্তাহে ৪ দিন সকাল বেলা ।
এপ্রিল মাস থেকে স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে যেতাম।
১ম দিন পড়তে যাওয়ার ঘটনা... আমি কিভাবে যে ঘুমিছিলাম কে জানে !!! হাত বালিশের নিচে চাপা পড়েচিলো, তাই ঠিকমত রক্ত চলাচল করতে না পারায় হাত অবশ হয়ে যায়। আম্মা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে দেয় পড়তে যাবার জন্য। আমি জীবনে প্রথম প্রাইভেট পড়তে যাবো ! মনের ভেতর কেমন জানি এক অজানা ভয়। তার উপর আবার হাত অবশ !!! আমি তো ভয়ে দিশেহারা, হাত নড়াতে পারছিনা ।
আমি ভয়ে চিৎকার করা শুরু করে দিলাম। পরে আবশ্য কিছুক্ষণের ভেতরই হাত আবার নাড়াচাড়া করতে পারলাম ঠিক মতো। ভয়টা কিছুটা কমেছিলো ।
যে ব্যাচে পড়তে যেতে এত ভয় পাচ্ছিলাম, কিছুদিনের ভেতরই আমি হয়ে গেলাম ব্যাচের সুপারস্টার !!! সাইফুল স্যারের সাথেও আমাদের সম্পর্ক দারুণ হয়ে গিয়েছিলো । এই সাইফুল স্যারের জন্যই আমি আবার পরে ডাউন হয়ে যাই !!! এ ব্যপারে একটু পরে বলবো...
৩. ২০০৫ এই আমি সর্বপ্রথম সি প্রোগ্রামিং করি।
৩য় মেয়াদী পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আমি যখন ফ্রি তখন ভাইয়া আমাকে তার সি প্রোগ্রামিং এর বইটা দেয় এবং প্রোগ্রামিং শেখায়। আমার যেহেতু অনেক আগে থেকেই প্রোগ্রামার হওয়ার ইচ্ছা*1* ছিলো তাই আমিও অনেক উৎসাহ নিয়ে সি শেখা শুরু করি। তখন সি প্রোগ্রামিং শিখেছিলাম বলেই ভাসিটিতে ভর্তি হওয়ার পর আমার সি প্রোগ্রামিং এ কোন ঝামেলা বা কষ্ট হয় নাই। টারবো সি [নীল রঙের পর্দা যেটাতে] তে আমি প্রোগ্রামিং শুরু করি এবং সর্বপ্রথম যে প্রোগ্রামটা লিখি তা ছিলো এটা
#include "stdio.h"
#include "conio.h"
void main()
{
clrscr();
printf("1+1 = %d",(1+1));
getch();
}
আউটপুটঃ
1+1 = 2
কিছুদিন ব্লু স্ক্রীনের টারবো সি তে প্রোগ্রামিং করার পর টিসি উইন এ প্রোগ্রামিং প্র্যাক্টিস করা শুরু করলাম। প্রোগ্রমিং করতে তখন অসাধারন লাগতো !!! নিজেকে অনেক বড় মনে হতো, বন্ধুদের কাছে বড়াই করে বলতাম আমি প্রোগ্রামিং পারি।
যদিও ওরা এসব কিচ্ছু বুঝতো না। কয়েক মাস পরে লেখাপড়ার চাপ বেড়ে যাওয়ার কারনে প্রোগ্রামিং ছেড়ে দিতে হয়।
এটাই আমার জীবনের সব থেকে বড় আফছোস !!! ওই সময় যদি প্রোগ্রামিংটা ধরে রাখতে পারতাম তাহলে আজ হয়তো আমাকে এই অবস্থানে পরে থাকতে হত না, আরোও ভালো কোন অবস্থানে থাকতে পারতাম...
৪. ২০০৫ এর সব থেকে স্মরণীয় ঘটনা “আমার প্রেমে পড়া”
আমি যে মেয়েটির প্রেমে পড়ি তার নামটি উল্লেখ করছি না। ওকে আমি চিনি ১৯৯৭ থেকে। মাঝে কয়েক বছর দেখা হয় নাই।
আমরা একই স্কুলে পড়তাম, দু ক্লাসের ব্যবধান ছিলো আমাদের মাঝে। সেপ্টেম্বার মাসের ১ম সোমবার হল সেই মহিমান্বিত দিন যেদিন এই দুর্ঘটনাটি ঘটে। সেদিন ছিলো আমদের পদার্থ বিজ্ঞানের প্যাক্টিকেল ভাইবা। আমি সুন্দরমতো ভাইবা দিয়ে বের হয়ে আসছি, ঝামেলাটা বাঁধে আমার ২ বন্ধুকে নিয়ে। ওদের ১ জন পদার্থ প্যাক্টিকেল খাতা নিয়ে আসেনি।
একই খাতা ২জনে নিয়ে ভাইবা দিতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়, যার জন্য স্যার ওদের বকা তো দেয়ই সাথে নাম্বারও কাটে। এই নিয়ে ২ জনের মাঝে ঝগড়া, একপর্যায়ে মারামারি। ২জনেই ব্যাথা পেয়ে কাঁদতে থাকে। আমি ওদের থামাতে গিয়েও থামাতে পারি নাই, তাই রাগ করে ওদের ফেলেই একা একা স্কুল থেকে বাসায় ফিরতে থাকি। সেদিন যেন কি মনে করে অন্য রাস্তা দিয়ে বাসায় ফিরছিলাম! সাধারণত ঐ রাস্তা দিয়ে যাই না।
তো... যা লিখা ছিলো তাই হোল...
৩ রাস্তার ১টা মোড়, হঠাৎ করে আমারা সামনা-সামনি হয়ে গেলাম... ও ওর ২জন বান্ধবীর সাথে প্রাইভেট পড়তে যাচ্ছিলো*2*। ও ওর বান্ধবীদের সাথে কিছু নিয়ে হাসাহাসি করছিলো। আমাকে দেখে হাসি থেমে যায়। আমিও বোকার মতো হা করে দাড়িয়ে যাই! কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমাদের চোখাচোখি স্থায়ী হয়। ও পাশ কেটে চলে যাওয়ার পর থেকে আমার মাথা চক্কর খেতে থাকে, হৃদপিন্ডও প্রচন্ড জোরে লাফাতে থাকে ! আমি বুঝতে পারি না কি হয়ে গেল এটা !!!
সেই রাতে আর ঘুমাতে পারি নাই।
সারা রাত শুধু ঐ কয়েকটা মুহূর্ত চোখের সামনে ভাসছে, ওর চেহারাটাই চোখে ভাসছে আর শুধু মনে হচ্ছিলো, “ও দেখতে আগের থেকে অনেক সুন্দর হয়েছে” । পরের দিন আমি আমার ঘনিস্ট ২জন বন্ধুকে ঘটনাটা বলারপর ওরা আমাকে বলল, ”দোস্ত তোর তো হয়ে গেছে !!! প্রেম হয়ে গেছে !!!”। আমিও বুঝতে পারলাম আসলেও তাই...
৫. ২০০৫ সালে ভাইয়া বিয়ে করে
আমার প্রেমে পড়ার মাত্র ১৯দিন পরেই ভাইয়া বিয়ে করে !!! সব কিছুই স্বাভাবিক ভাবে চলছিলো কিন্তু হঠাৎ করে বাসার পরিস্থিতি কেমন জানি বদলাতে থাকে। আমি ব্যপারটা ঠিকমত বুঝে উঠার আগেই শুনি ভাইয়া বিয়ে করবে !!! ভাইয়ার বিয়ের আগের দিন জানতে পারি এসব।
পরের দিন সকালবেলা আম্মা আর ভাইয়া ২জন এয়ারপোর্টে যায় আমার ‘সিস্টার ইন ল’*3* কে রিসিভ করতে।
বিয়ের পর ভাইয়া ১মাস আমাদের সাথে ছিলো, তারপর ভাইয়া আলাদা বাসায় উঠে।
৬. ২০০৫ এ আমি বাসায় একা হয়ে যাই।
আপু ২০০৫ এ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর হলে চলে যায়। তখন মে/জুন মাস হবে। এরপর ভাইয়া বিয়ে করে নভেম্বর মাসে আলাদা বাসায় চলে যায়।
তখন থেকে বাসায় কম্পিউটার ছাড়া আমি একদম একা হয়ে যাই।
এর ভালোমন্দ ২টো প্রভাবই আমার উপর পরে। প্রথমত, আমি তখন প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম, লেখা পড়া ঠিক মতো করতে পারছিলাম না। বাসা খালি হওয়ায় আমার জন্য বেশ সুবিধা হয়েছিলো। আমার পড়ালেখার উপর নজরদারি করার কেউ ছিলো না।
পুরো ১টা রুমই তখন আমার, ১৫ বছর বয়সের কোন ছেলের নিজের একার ১টা বিশাল রুম। রাতে একা যখন ঘুমাতাম প্রায়ই ভয় করতো। আমার রুমের সাথেই বারান্দা ছিলো, দিনের অধিকাংশ সময়ই বারান্দাতে কাটাতাম, আমার উনার উপর নজরদারি করার জন্য*4* ।
তবে এতবছর ভাইবোনের সাথে থেকে অভ্যাস, ঐ সময় মাঝে মাঝেই নিজেকে খুব একা একা লাগতো, কথা বলার কেউ নেই...
৭. মেয়েদের প্রথম সাথে উঠাবসা এবং অধঃপতন
বছরের শেষের দিকের কথা, ডিসেম্বার মাস । সাইফুল স্যার হঠাৎ করে তার ছাত্র-ছাত্রীদের একত্রে ব্যাচ করলেন।
এতদিন স্যারের ছেলে মেয়েদের ব্যাচ আলাদা ছিলো । কিন্তু তিনি তার সব ভালো স্টুডেন্টদের একত্রে ১টা ব্যাচ করলেন। এটা সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য জানি না, আমিও ঐ ব্যাচের ১জন হয়ে গেলাম।
হঠাৎ করে মেয়েদের সংস্পর্শে এসে আমি বিপাকে পড়ে গেলাম। কারন এত দিন বাস করে আসছি এমন ১টা পরিবেশে যেখানে মা,খালা,বোন ছাড়া অন্য কোন মেয়ে মানুষ ছিলো না ।
তার উপর বাড়ন্ত বয়স, কিছুদিন আগেই প্রেমে পড়েছি । ব্যাচে কয়েকটা মেয়ে ছিলো বেশ পাকনা*5* । আমার মত নিরীহ কয়েকজন ছেলে পেয়ে ওরা বেশ আক্রমনাত্তক হয়ে গেল । কথায় কথায় আমাদের অপমান করার চেস্টা করত, আমাদের নিয়ে ফান করত । এইসব করে করেই উনাদের সাথে বেশ বন্ধুত হয়ে গেল আর আমার লেখা পড়া লাঠে উঠলো !!
সার-সংক্ষেপঃ
*1* ২০০০ সালে যখন কম্পিউটারে প্রথম "রোডর্যাশ” গেম খেলি তখন আমার এত্ত ভালো লেগেছিলো যে বলতে পারবো না।
ভাইয়া কম্পিউটার সাইন্সের ছাত্র ছিলো, সে আমাকে বলছিলো এসব গেম প্রোগ্রামিং করে বানাতে হয়, সব লিখে লিখে বানাতে হয়। আমার কাছে ব্যপারটা তখন আজব লাগে। তখন আমারো ইচ্ছা জাগে আমিও একদিন এইরকম গেম বানাবো, প্রোগ্রামার হবো।
*2* পরে জানতে পারি ওরা ৬দিন সাড়ে ৪টার দিকে প্রাইভেট পড়তে যায়। ওকে দেখার জন্য এর পরথেকে স্কুল ছুটি দেওয়ার সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়তাম।
দৌড়িয়ে ওর স্যারের বাসা পর্যন্ত যেতাম তারপর কচ্ছপের বেগে হেটে যেতাম রাস্তায় ওকে দেখার জন্য। ভাগ্য যেদিন ভালো থাকতো সেদিন দেখা পেতাম, বেশির ভাগ সময়ই দেখা মিলতো না।
*3* আমি আমার ভাইয়ার বউ কে কখনই ভাবি বলে ডাকি নাই। কখনো ‘সিস্টার ইন ল’ কখনো শুধু নাম ধরে ডেকেছি।
*4* আমাদের বাসা পাশাপাশি ছিলো।
আমারা তিন তালায় ছিলাম আর ওরা ১ তালায়। আমাদের বারান্দা থেকে আমি দেখতাম ও কখন স্কুলে যায়,স্কুল থেকে ফেরে, প্রাইভেটে যায়-ফেরে।
*5* হলিক্রস গার্লস স্কুলের কয়েকটা মেয়ে ছিলো। আমাদের বাসা থেকে অল্প দুরেই থাকতো । দুর্ভাগ্যক্রমে তিনিও এখন ইস্ট ওয়েস্ট উনিভারসিটিতেই পড়েন,কিন্তু দেখা হলে কথা বলেন না !!! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।