বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে যে ভূখণ্ড পূর্ব পাকিস্তান ছিল সেটাই হবে বাংলাদেশের ভূখণ্ড। সুতরাং কোনো বাংলাদেশীর পক্ষেই এই ইতিহাসকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি এবং শেখ মুজিবুর রহমান—এরা প্রত্যেকেই পাকিস্তান আন্দোলনের অগ্রসৈনিক ছিলেন। বর্তমানে অবশিষ্ট পাকিস্তানের খুব কম নেতাই পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য এদের মতো গৌরব দাবি করতে পারেন। অথচ পাকিস্তান সৃষ্টির পর এরা হলেন অবহেলার পাত্র।
পাকিস্তানের শাসনে এদের এবং এই অঞ্চলের মানুষের অংশীদারিত্বের দাবি অস্বীকৃত হওয়ার ফলেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় অনিবার্য হয়ে ওঠে।
আলোচ্য প্রতিবেদনের তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে— 'Unless incremented within the political cycle of the present Governments in the two countries, there is a serious downside risk of a fall through, especially in the context of the Bangladeshi political environment. Speedy implementation is of essence to take full advantage of this rare window of opportunity.' বিরল সুযোগ তো বটেই, বাংলাদেশে এখন ভারতের প্রতি সব দিক থেকে উদারমনা একটি সরকার ক্ষমতাসীন। যা কিছু করতে হবে, এ সরকারের আমলেই করে ফেলতে হবে। এতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটা সংরক্ষিত হলো বা না হলো সেই বিবেচনা গৌণ। একবার যদি যা কিছু করার দরকার সেসব করে ফেলা সম্ভব হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে ভিন্নপন্থী কোনো সরকার বাংলাদেশের ক্ষমতায় এলেও সেগুলো রদ করা সম্ভব হবে না।
কারণ আন্তর্জাতিক চুক্তি অলঙ্ঘনীয় হয়ে পড়ে। এই ধরনের জাতিঘাতী চুক্তি রদ করার জন্য প্রয়োজন হয় একটি বিপ্লবী সরকারের। বাংলাদেশে এখনও কোনো দল বিপ্লবের জন্য কাজ করছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। তদুপরি বর্তমান বৈরী বিশ্ব পরিস্থিতিতে এ ধরনের সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা দুরূহ।
প্রতিবেদনে কলকাতা ও আগরতলার দূরত্ব ১৬০০ কিলোমিটার উল্লেখ করা হয়েছে।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আগরতলার দূরত্ব মাত্র ১০০ কিলোমিটার। কাজেই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ভারতকে করিডোর সুবিধা দিলে ভারতের জন্য বিশাল ব্যয় সাশ্রয় হবে। ব্যয় সাশ্রয়ের পরিমাণ উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের অবস্থান ভেদে বিভিন্ন রকমের হবে। আসলে কলকাতা থেকে আগরতলার দূরত্ব ১৬০০ কিলোমিটারের চেয়েও অনেক বেশি। জ্যামিতিক সূত্র অনুযায়ী চড়াই-উত্রাই পথের দূরত্ব সরল রৈখিক পথের তুলনায় অনেক বেশি।
এভাবে দেখলে ভারতের ব্যয় সাশ্রয়ের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে। পাঠ্যপুস্তকের অর্থনীতি শাস্ত্রের সূত্র অনুযায়ী ভারত যদি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে করিডোর ব্যবহার করে ১ সেন্ট পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের দর কষাকষির সীমানা ভারতের বর্তমান যাতায়াত ব্যয় বিয়োগ ১ সেন্ট। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার কি সে ধরনের কোনো কড়া দরকষাকষি করছে? সাফ জবাব হলো, না। উল্টো কঠিন ও বন্ধনযুক্ত ৭ হাজার কোটি টাকা ভারতীয় ঋণ নিয়ে ভারতকে করিডোর সুবিধা দেয়ার জন্য বাংলাদেশকে অবকাঠামো গড়ে তুলতে হচ্ছে। কার্যত বাংলাদেশের সম্পদ দিয়েই ভারতকে যত সব সুবিধা দেয়া হচ্ছে।
এই ঋণচুক্তিটি নিয়ে দেশের ভেতরে অনেক প্রতিবাদ হলেও সরকার কর্ণপাত করেনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০-এর জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে একটি বিশাল রাজনৈতিক উন্মুক্ততা সৃষ্টি হয়েছে। ১২ জানুয়ারি, ২০১০ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং শেখ হাসিনা যে যৌথ ইশতেহার ঘোষণা করেন তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হলো বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের জন্য বহুমুখী যানভিত্তিক ট্রানজিট সুবিধা সৃষ্টি করা। এর মধ্যে আছে ‘নদী ট্রানজিট’, ‘বন্দর সড়ক ও রেল ট্রানজিট’, রেল অবকাঠামো নির্মাণ এবং অভ্যন্তরীণ সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ।
বাংলাদেশ ভারতকে যে করিডোর সুবিধা দিচ্ছে সেটি অর্থনীতি শাস্ত্রের ইরষধঃবত্ধষ গড়হড়ঢ়ড়ষু (দ্বিপাক্ষিক একচেটিয়া বাজার) কাঠামোর ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা যায়।
এক্ষেত্রে একটি পক্ষ ক্রেতা, অন্য পক্ষ বিক্রেতা। অর্থাত্ এটি এমন এক ধরনের বাজার যেখানে ক্রেতা মাত্র একজন এবং বিক্রেতাও মাত্র একজন। বাজার কাঠামো যখন এমন ধরনের হয় তখন সর্বোচ্চ মুনাফাভিত্তিক পণ্যের পরিমাণ ও দামে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় না। এই ধরনের বাজার কাঠামোতে দাম ও পরিমাণ নির্ধারণে অর্থনৈতিক সূত্র নয়, বরং স্ট্র্যাটেজিক ছলচাতুরি কাজ করে। অর্থনীতিবিদ Koutsoyiannis e‡jb, 'Since the price goals of the two monopolies can not be realized, the price and quantity in the bilateral market are indeterminate. That is Economic analysis can not provide a determinate solution to a bilateral monopoly market. The only result is the determination of upper and lower limits to the price. The level at which the price will be settled depends on the bargaining skills and power of the participants. The power of each participant is determined by his ability to inflict losses to the opposite party and his ability of withstand losses inflicted by the opponent.' বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গত ৪০ বছরে আমরা যে সম্পর্ক লক্ষ্য করেছি সেই সম্পর্ক হলো নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করা, ভারতের বাজারে বাংলাদেশী পণ্য প্রবেশে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা সৃষ্টি করা, বাংলাদেশের কাছে তিন বিঘা করিডোর হস্তান্তর না করা, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা, সীমান্তে বাংলাদেশী নিরীহ নাগরিকদের গুলি করে হত্যা করা, বাংলাদেশের দ্বীপ তালপট্টি দখল করা, বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানার ওপর মালিকানা দাবি করা, বাংলাদেশী সন্ত্রাসীদের ভারতে আশ্রয় দেয়া এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদ উসকে দেয়ার ইতিহাস।
উভয় দেশের সম্পর্কে আস্থার প্রচণ্ড সঙ্কট। আস্থার মনোভাব ফিরিয়ে আনার জন্য ভারত আজ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি বাংলাদেশী ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রচার ভারতে করতে দেয়া হয় না এবং বাংলাদেশী নাগরিকদের প্রতি ভারতীয় দূতরা অশালীন মন্তব্য করে। এভাবে হেনস্থা হওয়ার পরও বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের একজন উপদেষ্টা ‘ট্রানজিটের’ জন্য ফি দাবি করা অসভ্যতা বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এই সরকারের ‘সব কিছু দেব, কিন্তু কিছুই নেব না’ নীতিকে গ্রহণ করতে রাজি নয়।
প্রতিবেদনে শুল্ক কর্তপক্ষ কর্তৃক মালামাল পরিদর্শনে না করারও সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে কিছু আন্তর্জাতিক কনভেনশনের উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব কনভেনশনের নজির দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো Convention And Statute on Freedom of Transit, Barcelona, 1921; Convention on the High Seas, Geneva, 1958; United Nation, Convention on the law of the Sea, Montego Bay, 1982; United Nations Convention on Transit Trade of Land-Locked States, New York, 1965 Ges World Trade Organization Ñ The General Agreement on Tariffs and Trade (GATT) 1994. উল্লেখ্য, এসব কনভেশন ভূবদ্ধ বা Land-locked country সংক্রান্ত। কিন্তু উত্তর-পূর্ব ভারত ভূবদ্ধতার অজুহাতে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা দাবি করতে পারে না। ভারত কার্যত করিডোর দাবি করছে।
করিডোরের জন্য কোনো কনভেশন বা ট্রিটির উল্লেখ প্রতিবেদনে নেই। প্রতিবেদনে User church'i উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'The generally accepted principles, is to price and infrastructure service based on long run social marginal cost' অর্থাত্ দীর্ঘমেয়াদি প্রান্তিক সামাজিক খরচের ভিত্তিতে অবকাঠামো সেবার জন্য টংবত্ ভবব নির্ধারণ করতে হয়। সামাজিক খরচের মধ্যে রয়েছে private cost I public cost. সড়কের জন্য User cost’র উপাদান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যথাক্রমে Road damage costs; accident externalities; congestion cost Ges environmental costs. যদি এসব খরচ আদায় করা যায় তাহলে মন্দের ভালো। কিন্তু এরই মধ্যে দ্বিপাক্ষিক একচেটিয়া বাজারের যে বৈশিষ্ট্যের কথা আলোচনা করা হয়েছে, সে কারণেই শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে বাংলাদেশ ভারতের হুমকি ও চাপ প্রয়োগের শিকার হবে।
বাংলাদেশকে ভারতীয় হুমকির মুখে সর্বোচ্চ দাম নয় বরং সর্বনিম্ন দামের স্তরটি বেছে নিতে বাধ্য হওয়াটাই বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আশঙ্কা করা অমূলক হবে না। কারণ বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনের অভ্যন্তরে ভারত-অন্তপ্রাণ এমনভাবে তত্পর যে তারা ‘ট্রানজিট’ ফি দাবি করা অসভ্যতা মনে করে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে নিজ ব্যবহারের জন্য যে অবকাঠামো উন্নয়ন করেছে এবং ভারতকে করিডোর দেয়ার জন্য অবকাঠামোর অধিকতর উন্নয়নে যে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে, এখন তার সেবা যৌথভাবে উপভোগ করবে ভারত ও বাংলাদেশ। একটি সেবা বা পণ্যের উত্পাদনকারী যদি একজন হয় এবং এর ভোগ যদি দুজন যুগপত্ভাবে করে তখন পণ্য বা সেবার দামটি নির্ধারণ আরও জটিল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশকে তার বিনিয়োগের সুযোগ ব্যয় বা Opportunity Cost'র কথাও বিবেচনায় নিতে হবে।
এছাড়া Accident externalities, Congestion cost Ges environmental costs প্রভৃতি নির্ধারণেও কতটা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ এবং সত্যিকারের ব্যয় তুলে আনা হবে, তা নিয়ে জনমনে গভীর সন্দেহ রয়েছে। এছাড়াও যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সেটি নিছক দ্বিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক নয়। যেমনটি বিরাজ করছে ইউরোপের ক্ষেত্রে। সুতরাং ইউরোপের দৃষ্টান্ত এক্ষেত্রে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। প্রতিবেদনে রিহরিহ situation'র কথা বলা হয়েছে।
সেটি সুদূরপরাহত মনে হয়। এর জন্য খুব বেশি দূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার যে পানিচুক্তি করেছিল সেই চুক্তি অনুযায়ী ফারাক্কা পয়েন্টে গত ৩ মাসে বাংলাদেশ ৬৬ হাজার ২২৪ কিউসেক পানি কম পেয়েছে। চুক্তির ইন্ডিকেটিভ শিডিউল অনুযায়ী মোট ১০টি কিস্তিতে ভারত এই পরিমাণ পানি কম দিয়েছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ ওই ৩ মাস ১০ দিনে প্রতি কিস্তিতে গড়ে ৬ হাজার কিউসেক পানি কম পেয়েছে।
যে দেশটির এ ধরনের ট্র্যাক রেকর্ড, সেই দেশকে করিডোর সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশের সিঙ্গাপুর হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
34. নেপাল-ভুটানের মোড়কে ভারতকে ট্রানজিট:
ভারতকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পণ্য পরিবহনের সুযোগ করে দেয়ার পাশাপাশি নেপাল এবং ভুটানকে ট্রানজিট দেয়ার মাধ্যমে বড় অঙ্কের মাশুল আদায়ের ব্যবস্থা হবে বলে সরকার যে দাবি করছে, তা আসলে কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে অভিজ্ঞ মহলে প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হয়েছে, না আসলে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে করিডোর দেয়া হয়েছে এ প্রশ্নটি নতুন করে দেখা দিয়েছে। পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, নেপাল ও ভুটানের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ খুবই কম। নেপাল ও ভুটানের এক বছরে বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ মাত্র ৭ বিলিয়ন ডলারের মতো।
এর মধ্যে ওই দুই দেশের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৬৭ শতাংশ হয়ে থাকে ভারতের সঙ্গে, যে বাণিজ্যের জন্য তাদের বাংলাদেশের ট্রানজিট ব্যবহার করতে হবে না। ফলে নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট দেয়ার কথা বলা হলেও তার ব্যবহার হবে খুবই সামান্য এবং তা থেকে ‘ফি’ বাবত বাংলাদেশের আয়ের পরিমাণ হবে নগণ্য। এই হিসাবের উদ্ধৃতি দিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন আসলে ট্রানজিট দেয়া হচ্ছে ভারতকে।
এদিকে ভারতের উত্তরাঞ্চলে জনগণের মাথাপিছু আয় মাত্র ৩০০ ডলারের মতো। ফলে সেখান থেকে বহিঃবাণিজ্যের পরিমাণ যে নগণ্য হবে অথবা বাংলাদেশে উত্পাদিত কোনো পণ্য অতি সামান্য পরিমাণে যে সেখানে রফতানি হবে তা সহজবোধ্য।
অথচ ট্রানজিট বা করিডোর দেয়ার জন্য বাংলাদেশকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে অবকাঠামো খাতে। ট্রানজিটের জন্য বাংলাদেশ যে বিনিয়োগ করবে, তা শুল্ক আদায়ের মাধ্যমে উঠে আসবে কিনা সেটি নিয়েই সংশয় প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ব সংস্থা ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউটিও) নিয়ম প্রয়োগ করে ‘ফি’ আদায়ের হিসাব করা যায় কিনা। সম্প্রতি একজন বহির্বাণিজ্য বিশ্লেষক বলেছেন, ডব্লিউটিও’র সংজ্ঞা মতে ট্রানজিট হচ্ছে একটি দেশ থেকে দ্বিতীয় একটি দেশের মধ্য দিয়ে তৃতীয় দেশে পণ্য ও মানুষ চলার ব্যবস্থা। কিন্তু যেহেতু ভারতের ক্ষেত্রে সে দেশের পণ্য সে দেশ থেকেই বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের অন্য একটি অংশে পরিবহন করা হচ্ছে তাই এই সুবিধার বিপরীতে মাশুল আদায় করার হিসাব ডব্লিউটিও’র ফর্মুলা বা শর্ত দিয়ে করা যায় না।
এই হিসাব হতে হবে অন্যভাবে এবং বাংলাদেশের পাওনা হতে হবে উচ্চহারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন শিক্ষা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মাহবুব উল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, সামরিক প্রয়োজন ছাড়া অর্থনৈতিক প্রয়োজনে ট্রানজিট দেয়ার কথা বলা হলেও এর ভিত্তি দেখে তা মনে হচ্ছে না। কারণ একদিকে নেপাল ও ভুটানের অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতেই খারাপ; অন্যদিকে ট্রানজিটের মাধ্যমে ভারতের যেসব অঞ্চলে পণ্য আনা-নেয়া করা হবে সেসব অঞ্চলের মধ্যে সেভেন সিস্টারসহ অন্যান্য অঞ্চলে বার্ষিক মাথাপিছু আয় মাত্র ৩০০ ডলারের মতো। উপরন্তু বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণও খুব কম। তাদের ট্রানজিট দেয়ার কি ভিত্তি থাকতে পারে সেটিই প্রশ্নের বিষয়।
ভুটানের অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৮ সালে ভুটানের মোট রফতানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৫১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার মধ্যে ভারতেই রফতানি করা হয় ৮৬ শতাংশ। একই সময়ে দেশটির আমদানির পরিমাণও অনেক কম। ২০০৮ সালে মাত্র ৫৩৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে দেশটি। যার মধ্যে ৬৩ শতাংশই আমদানি করে ভারত থেকে।
অর্থাত্ আমদানি রফতানি মিলিয়ে দেশটির মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলারের মতো। এর মধ্যে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের ভাগ ৭৫ শতাংশ। যেহেতু ভুটানের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের সিংহভাগই করে থাকে ভারতের সঙ্গে। সুতরাং ট্রানজিটের মাধ্যমে মাত্র ২০০ থেকে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য পরিবহন হতে পারে।
নেপালকেও ট্রানজিট দেয়ার কথা বলা হচ্ছে।
অথচ ২০০৯ সালের হিসাব অনুযায়ী নেপালের মোট রফতানির পরিমাণ ৮৪৯ মিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে
ভারতেই রফতানি হয়েছে ৬৫ শতাংশ। একই সঙ্গে ২০০৯ সালে দেশটির আমদানির পরিমাণ ছিল ৫ বিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে ৫৭ শতাংশই এসেছিল ভারত থেকে। যেখানে দেশটির মোট আমদানি ও রফতানি মূল্য দাঁড়ায় ৬ বিলিয়নেরও কম।
এর মধ্যে ভারতেই বাণিজ্য হয়ে থাকে ৬১ শতাংশ। সুতরাং এক্ষেত্রেও বাংলাদেশের ‘ফি’ আদায়ের পরিমাণ অনেক কম।
এদিকে ট্রানজিট দেয়ার জন্য বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়নে উচ্চহারের সুদে ভারতের কাছ থেকে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেবে বলে চুক্তি করেছে। অথচ এই অবকাঠামো তৈরি করতে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা লেগে যেতে পারে। সুতরাং এত টাকা এই খাতে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ আসলে কতটা লাভবান হবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
কারণ নেপাল এবং ভুটান মিলে মাত্র ৩ বিলিয়ন মূল্যমানের পণ্য পরিবহনের জন্য তারা ট্রানজিট ব্যবহার করবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেন, ট্রানজিট দেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই বাংলাদেশের লাভক্ষতি হিসাব করা দরকার। বাংলাদেশ ট্রানজিট দিয়ে কি পাবে তা হিসাব না করে ট্রানজিট দেয়া বাংলাদেশের জন্য কোনোভাবেই ভালো হবে না। তাছাড়া ট্রানজিট দেয়ার জন্য বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে। অথচ সরকার লাভ-ক্ষতি বিবেচনা না করেই তাদের ট্রানজিট দেয়ার জন্য রাজি হয়ে গেছে।
অবকাঠামো তৈরির জন্য ভারতের কাছ থেকে কঠিন শর্তে ঋণ নেয়ার চুক্তিও করে ফেলেছে। এ কাজটি কোনোভাবেই দায়িত্বশীলতার পরিচায়ক হয়নি।
ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ট্রানজিটের জন্য বাংলাদেশে যে অবকাঠামোগত উন্নয়নের দরকার হবে তার খরচ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো। সুতরাং এত টাকা বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ এ খাত থেকে কত টাকা মাশুল পাবে এটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অথচ এই পরিমাণ অর্থ অন্য কোনো খাতে ব্যবহার করে বাংলাদেশ হয়তো আরও বেশি লাভবান হতে পারে।
অথচ তা বিবেচনা করছে না সরকার। নেপাল বা ভুটানকে ভারত আদৌ তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেবে কিনা সে ব্যাপারেও যথেষ্ট সন্দেহ এখনও রয়ে গেছে।
35. ট্রানজিট দিলেই আমেরিকা-সিঙ্গাপুর হওয়ার প্রসঙ্গ:
বিশাল দেশ আমেরিকা, আয়তনে বাংলাদেশের ৬৭ গুন আর লোকসংখ্যা ২ গুন, মাত্র ৩০ কোটি। বিশাল তার অর্থনীতি, বিশ্বের বৃহত্তম। আমেরিকার উত্তরে আরেক বিশাল দেশ কানাডা, বাংলাদেশের ৬৯ গুন, লোকসংখ্যা বাংলাদেশের পাঁচ ভাগের এক ভাগ; মাত্র ৩ কোটি।
আমেরিকার দক্ষিনে আরেক বড় দেশ মেক্সিকো, বাংলাদেশের ১৩ গুন, লোকসংখ্যা বাংলাদেশের অর্ধেক; মাত্র ৮ কোটি। উত্তরে কানাডা, দক্ষিনে মেক্সিকো আর চারিদিকের মহাসমূদ্র ছাড়া আমেরিকার আশেপার্শ্বে আর কোনো দেশ নাই। এই তিন দেশ মিলে মোট জনসংখ্যা মাত্র ৪২ কোটি। বড় দেশ ভারত। বাংলাদেশের ২২ গুন, বিপুল জনগোষ্ঠি, ১১৪কোটি অর্থাৎ বাংলাদেশের ৮ গুন।
ভারতের উত্তরে বিশাল দেশ চীন, বাংলাদেশের ৬৬ গুন, লোকসংখ্যা-১৩৩ কোটি, বাংলাদেশের ৯ গুন। আমাদের ছোট্ট দেশের আয়তন মাত্র ৫৫৫৯৮ বর্গ মাইল, অথচ লোকসংখ্যা-১৫ কোটি। মিয়ানমারের সাথে কয়েক মাইল বর্ডার আর দক্ষিনের বঙ্গপোসাগর বাদ দিলে পুরো বাংলাদেশ ভারত দ্বারা পরিবেস্টিত।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ শিল্প ও অর্থনীতির দেশ আমেরিকার লোকসংখ্যা মাত্র ৩০ কোটি হওয়ায় শ্রমিকের ঘাটতি থাকায় অন্যান্য দেশের উপর নির্ভর করতে হয়। আমেরিকার বিশাল অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখতে তাদের অনেক শিল্প অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের শ্রমিকের দেশ পার্শ্ববর্তী কানাডায় স্থাপন করে এবং কানাডার অনেক লোক আমেরিকায় এসে কাজের সুযোগ পায়।
কিন্ত কানাডার লোকসংখ্যা মাত্র ৩ কোটি হওয়ায়, আরো শ্রমিক স্বল্পতা থাকায় এবং আরো সস্তায় কাজ করানোর জন্য তারা অনেক কাজ মেক্সিকোতে পাঠায়। এর পরেও থাকে শ্রমিক স্বল্পতা-কারণ আমেরিকা, কানাডা আর মেক্সিকো মিলে মোট লোকসংখ্যা মাত্র ৪২ কোটি। লক্ষ লক্ষ অবৈধ শ্রমিক মেক্সিকো এবং অন্যান্য দেশ থেকে আমেরিকায় আসতে থাকে। আর আমেরিকায় এইসব অবৈধ শ্রমিককে দিয়ে খুব সস্তায় কাজ করানো যায় বলে প্রশাসন এদের দেখেও না দেখার ভান করে। তারপরেও শ্রমিক স্বল্পতা থাকায় অতিরিক্ত কাজ ভারত, চীন সহ অন্যান্য দেশে পাঠিয়ে দেয়।
তার মানে এই নয় যে কোন দেশ উন্নত হলেই তার যথেস্ট কাজ পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠিয়ে দেবে। ভারত অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা উন্নত হলেও তার উন্নতির ছোয়া শুধুমাত্র গুটিকয়েক শহরভিত্তিক (যেমন চেন্নাই, বোম্বে, বেঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ ইত্যাদি)। এর বাইরে গেলেই দেখা যাবে জরাজীর্ন অবস্থা। বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী ইন্ডিয়ার যে কোনো প্রদেশের (যেমন পশ্চিম বঙ্গ, আসাম, মিজরাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, বিহার, মনিপূর, নাগাল্যান্ড, উড়িষ্যা ইত্যাদি) মানুষের জীবনযাত্রার মান আমাদের থেকে অনেক নীচে। ইন্ডিয়ার গড় শ্রমিকের দৈনিক বেতন বাংলাদেশী মূদ্রায় মাত্র ৬৫ টাকা যা কিনা বাংলাদেশের গড় শ্রমিক মজুরীর সাথে খুব বেশী পার্থক্য নাই।
(সূত্রঃ ইন্ডিয়ান লেবার ব্যুরো)। আর এই বিশাল জনগোষ্ঠীর পুরোটাই স্বচ্ছলতা না আসা পর্যন্ত ভারতের কোনো কাজ বাংলাদেশ বা অন্যান্য দেশে পাঠানোর কোনো সম্ভাবনাই নাই। যদি থেকেই থাকে তবে তা হবে সম্পূর্নরূপে ভারতের ব্যবসায়িক স্বার্থে।
কারণ অর্থনীতিবিদদের মতে, কোটি কোটি বেকারের দেশ ভারতের নিজের শ্রমিকদেরই চাকুরী সৃষ্টি করা আরো ১০০ বছরেও সম্ভব নয়। আর তাই যেসব অর্থনীতিবিদগন ভারতকে ট্রানজিট দেবার জন্য কথায় কথায় আমেরিকা-কানাডা-মেক্সিকোর উদাহরণ দিয়ে থাকেন বা ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশও ভারতের কাছ থেকে অনেক কাজ পাবে বা তাদের অনেক শিল্প বাংলাদেশে স্থাপিত হবে ইত্যাদি ধরনের যুক্তি দিয়ে থাকেন তা একেবারে আষাঢ়ে গল্প।
উল্লেখ্য যে আমেরিকার অর্থনীতি বর্তমানে খারাপ হওয়ায় সেখান থেকে প্রতিমাসে লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে বিতাড়িত করা হচ্ছে। স্বাধীন হবার পর ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ইতিহাস সম্বন্ধে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের একটু বিস্তারিত জানা দরকার। প্রথমেই বলি তিন বিঘা চুক্তির কথা। তিন বিঘা চুক্তি মূলতঃ দক্ষিণ বেরুবাড়ী, অঙ্গরপোতা আর দহগ্রামকে ঘিরে। দক্ষিণ বেরুবাড়ী আর এর আশপার্শ্বের ৪টি ছিটমহল(Enclave) মিলে মোট আয়তন ১৮.১৩ বর্গ কিঃমিঃ যা ছিল বাংলাদেশের অংশ এবং এর লোকসংখ্যার ৯০% ছিল হিন্দু (১৯৬৭ সালের তথ্য অনূযায়ী)।
অন্যদিকে বাংলাদেশের দুটি ছিটমহল(Enclave) অঙ্গরপোতা আর দহগ্রাম যার আয়তন ১৮.৬৮ বর্গ কিঃমিঃ ছিল ভারতের মধ্যে এবং এখানে মোট লোকসংখ্যার ৮০% ছিল মুসলিম। স্বাভাবিকভাবেই বেরুবাড়ী সংলগ্ন ৪টি ছিটমহলের জনগনকে ভারতে যাতায়াত করার জন্য বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করতে হতো আর অঙ্গরপোতার-দহগ্রামের বাংলাদেশী জনগনকে বাংলাদেশের মূল ভুখন্ডে যাতায়াত করার জন্য ভারতীয় রাস্তা ব্যবহার করতে হতো। ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেয় যে চারটি ছিটমহল সহ দক্ষিণ বেরুবাড়ী ভারতকে দিয়ে দেওয়া হোক আর তার বদৌলতে ভারত অঙ্গরপোতা-দহগ্রামের বাংলাদেশী লোকজনের যাতায়াতের জন্য কিছু জমি স্থায়ীভাবে লীজ দেবে। এই জমির পরিমান ছিল ১৭৮মিঃ X ৮৫মিঃ (প্রায় ৩ বিঘা) যা কিনা রাস্তারূপে অঙ্গরপোতা-দহগ্রামের সাথে বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডে যোগ হবে।
প্রস্তাবে রাজি হয়ে ১৯৭৪ সালে ইন্ডিয়ার তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং বাংলাদেশের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান নিম্নলিখিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনঃ “India will retain the southern half of South Berubari Union No. 12 and the adjacent enclaves, measuring an area of 2.64 square miles approximately, and in exchange Bangladesh will retain Dahagram and Angorpota enclaves. India will lease in perpetuity to Bangladesh an area of 178 meters X 85 meters near “Tin Bigha” to connect Dahagram with Panbari Mouza(P.S. Patgram) of Bangladesh.” উক্ত চুক্তি অনূযায়ী বাংলাদেশ সুবোধ বালকের মতো দক্ষিণ বেরুবাড়ীসহ চারটি ছিটমহল ভারতকে দিয়ে দিলেও সেই তিন বিঘা আজ পর্যন্ত বাংলাদেশকে না দিয়ে উপরন্ত তাদের স্বভাব অনুযায়ী নানারকম ছলচাতুরী শুরু করে।
অবশেষে ১৯৮২ সালের ৭ই অক্টোবার ইন্ডিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ আর শামসুজ-উদ-দোহার সাথে অনেক শর্ত সাপেক্ষে চিঠি বিনিময়ের মাধ্যমে লীজ নিশ্চিত করা হয়। শুরু হলো ভারতীয়দের আন্দোলন - তিন বিঘা লীজ বাংলাদেশকে দেয়া যাবেনা। তাদের যুক্তি এতে তাদের সার্বভৌমত্ব থাকবেনা, এইখান দিয়ে বাংলাদেশীরা ভারতে ঢুকে পড়বে, এই করিডোর দিয়ে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী অস্ত্র-সজ্জা নিয়ে ঢুকে ভারতের অভ্যন্তরে হামলা চালাবে, ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। এইসব যুক্তি দেখিয়ে তারা বড় বড় আন্দোলন, নিম্ন কোর্ট-উচ্চ কোর্ট করতে থাকে। ফলতঃ ছিটমহলবাসী নিদারুণ কষ্টের মধ্যে মানবেতর জীবন কাটায়।
অবশেষে ভারত সরকার ১৯৯২ সালের ২৬শে মার্চ লীজ চুক্তিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনে যাতে তিন বিঘার পুরো কর্তৃত্ব ভারতের হাতে থাকে আর শুধুমাত্র দিনের বেলায় এক ঘন্টা পর পর এটা খোলা হয় যাতে ছিটমহলবাসী বাংলাদেশের মূল ভুখন্ডে যাতায়াত করতে পারে। সূর্য ডুবে গেলে ছিটমহলবাসীর ওইখান দিয়ে যাতায়াত করতে পারেনা এমনকি অসুস্থ হয়ে মারা গেলেও চিকিৎসার জন্যও না। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এমনকি দিনের বেলায়ও যখন তখন বিভিন্ন অজুহাতে করিডোর বন্ধ করে ভারত নানাভাবে অপদস্ত করে খেটে খাওয়া বাংলাদেশী ছিটমহলবাসীদের। (তিন বিঘা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত ইন্ডিয়ান ওয়েবসাইট http://www.hcidhaka.org এ দেখুন)। মাত্র ১৭৮ মিটার রাস্তা লীজ দিলে যেখানে ভারতের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হয়ে যায়, নিরাপত্তার সমস্যা দেখা দেয়, বাংলাদেশ থেকে নেপালে যেতে মাত্র ২০ মাইল ট্রানজিট ভারত বছরের পর বছর বাংলাদেশের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে বলে, এমনকি নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আনার জন্য ভারতের ভিতর দিয়ে ২০ মাইল দীর্ঘ বৈদ্যুতিক লাইন বানানোর অনুমতি দেয়না, সেখানে কি করে বাংলাদেশের পেটের মধ্যে দিয়ে ৪০০ মাইল পথ পাড়ি দেবার করিডোর দিলে এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন থাকে? ফারাক্কা নিয়ে বাংলাদেশের প্রতি ইন্ডিয়ার আচরণ আরো জঘন্য, যার পুরো ইতিহাস পরে লেখার ইচ্ছা রইল।
ভারত আন্তর্জাতিক নদী আইন সম্পুর্নরুপে উপেক্ষা করে একতরফাভাবে ফারাক্কা বাঁধ নির্মান করে পদ্মার প্রবাহমুখ বদলিয়ে পানি ভাগীরথি-হুগলি নদীতে নিয়ে যায় কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য।
যার ফলস্বরূপ পরিবেশ নষ্ট হয়, কৃষি-শিল্প-বানিজ্য-মৎস্য সম্পদ ধ্বংস হয়, নদীর নাব্যতা কমে যায়, পানির লবনাক্ততা বৃদ্ধি পায়, ভূগর্ভস্থ পানির স্বল্পতা দেখা দেয়-এক কথায় বাংলাদেশের ৩ কোটি মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফারাক্কা যুদ্ধে বাংলাদেশ হেরে যাওয়ার পর ভারত একে একে তিস্তা বাঁধ, টিপাইমুখ বাঁধ সহ অন্যান্য সব নদীতে একইভাবে বাঁধ দিতে থাকে এবং এখনো দিচ্ছে। এই বাঁধগুলো যে মানুষের কত ক্ষতি করছে তা শহরের সুশীল গোত্রীয় অর্থনীতিবিদদের বোঝার কথা নয়, হাড়ে হাড়ে টের পায় উক্ত এলাকার গরীব কৃষকরা । ভারতকে ট্রানজিট দিতে অনেকে ইউরোপের উদাহরণ দিয়ে থাকেন।
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ক্ষমতা ও সমান মর্যাদার ভিত্তিতে। বিখ্যাত রাষ্ট্র ও সমরবিজ্ঞানী অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান এর মতে, ইউরোপের দেশগুলো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্পায়নের এমন একটা উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যেখানে সামরিক ফ্যাক্টর হয়ে পড়েছে গৌণ। কিন্ত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। যদিও ট্রানজিটকে ভারত অর্থনৈতিক বিষয় হিসাবে দেখাচ্ছে, ভারতের মূল উদ্দেশ্য সামরিক কৌশলগত। পূর্ব-উত্তর ভারতের সাতটি রাজ্যের বিদ্রোহ দমন এবং ভবিষ্যতে চীনের সাথে কোনো যুদ্ধের সম্ভাবনার সময় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দ্রুত সামরিক সরঞ্জাম এবং সৈন্য পাঠানোর জন্য ট্রানজিট তথা করিডোর চাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লাভ হবে বলে কেউ কেউ হাজার হাজার কোটি টাকা লাভের যে আজগুবি পরিসংখ্যান দিচ্ছেন, তা আরব্য উপন্যাসের দৈত্যের কাহিনীকেও হার মানায়। ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে অনুন্নত ৩০টি দেশের অন্যতম। ভারত কতৃক বাংলাদেশকে এই টাকা দেয়া দৈত্যের টাকা নিয়ে আসার মতো। চীনের সাথে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি প্রদেশের বিচ্ছিন্নতা পরিপূর্ণতা লাভের দিকে গেলে ভারত বাংলাদেশের অনুমতি না নিয়েই ট্রানজিট নামের এই করিডোর ব্যবহার করবে। উদাহরণস্বরুপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে হিটলারের আক্রমনের ভয়ে ফ্রান্স তার জার্মানির সীমান্তে অপ্রতিরোধ্য দূর্গ তৈরী করে।
সমরবিদ হিটলার ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধে না জড়িয়ে সহজে বেলজিয়ামের মধ্য দিয়ে ফ্রান্স দখল করে। ওই দূর্গ কোনো কাজে আসেনি। এইক্ষেত্রে হিটলার বেলজিয়ামকে করিডোর হিসাবে ব্যবহার করে। ট্রানজিটের সাথে সাথে ভারতের দৃষ্টি এখন চট্টগ্রাম বন্দর কব্জা করা। সামরিক, অর্থনৈতিক, সর্বোপরি বাংলাদেশের তেলসহ অনাবিস্কৃত খনিজ সম্পদের উপর খবরদারি করার জন্যই মূলতঃ তাদের এই কুদৃষ্টি ।
কলকাতা বন্দরের ভবিষ্যৎ আর নাই। এর সম্ভাবনা ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে। ৪০ হাজার কিউসেক কেন, এর বেশী পরিমান পানি দিয়েও কলকাতা বন্দরকে আর সিংহদ্বার করা যাবেনা। ভারত সেটা বুঝতে পেরেই চট্টগ্রাম বন্দর পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অনেক সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে।
বলা হচ্ছে এটা হলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের মতো হয়ে যাবে। যারা এই স্বপ্ন দেখছেন বা জাতিকে এই স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তারা একটু সিঙ্গাপুর আর বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানটা জানার জন্য মানচিত্রে একটু চোখ বুলিয়ে নিন। আপনি নিজেই আপনার নির্বুদ্ধিতার জন্য লজ্জা পাবেন। সিঙ্গাপুর হলো গোটা বিশ্বের জাহাজ চলাচলের একটা হাব(HUB)। এর সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনা চলেনা।
এই বন্দর বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে আর কারোর ব্যবহারের প্রয়োজন পড়েনা। এমনকি চীনও এই বন্দর ব্যবহার করার সূযোগ চাইনি, তাদের প্রয়োজনও নাই। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কিছু দূরেই মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দর। প্রয়োজন হলে চীন সেটাই ব্যবহার করতে পারবে। আসলে ট্রানজিট আর চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সূযোগ নিয়ে ভারত তার পূর্বাঞ্চলে সামরিকভাবে সমৃদ্ধ হতে চায়।
বাংলাদেশ ভারতের পূর্বাঞ্চলে যে ৭টি রাজ্যে রপ্তানী করে থাকে তা বন্ধ করে তাদের নিজস্ব প্রোডাক্ট পাঠিয়ে বাংলাদেশের বানিজ্য-ঘাটতি আরো বাড়াতে চায়। ভারতীয় ব্যবসায়ী আর শিল্পপতিরা তাদের সর্বগ্রাসী থাবা দিয়ে আমাদের উঠতি সব কলকারখানা আর শিল্প স্থাপনাগুলোকে বন্ধ করে দিতে চায়। আমাদের উন্নতমানের টেক্সটাইল, প্রসাধনী, ঔষধ, প্লাস্টিক, চামড়া, কৃষি, পেট্রলিয়াম, সার শিল্প যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে চায়। বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যমে ভারতের আধিপত্য বিস্তার করে বাংলাদেশের অর্থনীতি পঙ্গু করে ফেলতে চায়। ভারতের মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে আরো সহজে ভরে দিয়ে জাতিকে পঙ্গু করে ফেলতে চায়।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের বিভিন্ন এলাকার শত শত কারখানা থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার নেশাজাতীয় পানীয় বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। ভারত এইব্যাপারে কোনোরূপ ব্যবস্থা গ্রহন করেনা বরং উৎসাহিত করে। ভারত ও বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে প্রমানিত হয়, বাংলাদেশকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার নৈতিক দায়িত্বের কোন তোয়াক্কাই করেনা তারা(যেমন গঙ্গার পানি বন্টন, সীমান্ত চুক্তির রেটিফিকাশন, তিন বিঘা হস্তান্তর, কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন, অন্যান্য নদীর উপর বাঁধ ইত্যাদি)। প্রনব বাবুরা এখন বলে বেড়ান যে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বানিজ্য ঘাটতি কমানো সম্ভব নয়। বিশ্বের সবচেয়ে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ আমেরিকার যদি কানাডা আর মেক্সিকোর সাথে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বানিজ্য ঘাতটি থাকে তবে বাংলাদেশের বানিজ্য ঘাটতি ভারতের সাথে কিছুতা কমিয়ে আনতে অসুবিধাটা কোথায়? কেন তারা সাফটা চুক্তি করার পরেও বাংলাদেশী পন্য ভারতে রপ্তানীতে গড়িমসি করে? গত মাসেও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে সমাদৃত বাংলাদেশী সিমেন্ট রপ্তানীতে ১৮% ট্যাক্স বসিয়েছে।
এইগুলো কি ভালো প্রতিবেশীর লক্ষণ? আমরা ভারতকে ভালো প্রতিবেশী হিসাবে পেতে চাই। সেক্ষেত্রে তাদেরকে অবশ্যই ভালো প্রতিবেশীর প্রমাণ দিতে হবে, পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত সমস্ত চুক্তি রিভিউ করতে হবে, আন্তর্জাতিক নদী নিয়ম মানতে হবে, চুক্তি ঠিকমত বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সেটা খেয়াল রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক সীমানা আইন অনুযায়ী কাঁটাতারের বেড়া দিতে হবে এবং সীমান্তে মানব হত্যা বন্ধ করতে হবে। আমরা যখন দেখবো ভারত আসলেই ভালো বন্ধু তখন আমরা উভয়ের স্বার্থেই নতুন নতুন চুক্তি করবো। তারা বাংলাদেশের ভালো চাইলে আমরাও তাদের দিকে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেবো।
তাদের সাথে ট্রানজিট বা বন্দর সংক্রান্ত সহযোগীতা বা চুক্তি সেদিনই হতে পারে, যেদিন আমরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারবো। লেখকঃ আমেরিকায় হোন্ডা মোটর কোম্পানীর রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে কর্মরত একজন উর্ধতন প্রকৌশলী ও কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ এবং আমেরিকান সোসাইটি অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স ও সোসাইটি অব অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার্স এর সদস্য।
চলবে.................
পূর্বের পর্ব সমূহ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।