আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পৌর শহর পরিকল্পনার ভবিষ্যত, বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

পৌর শহর পরিকল্পনার ভবিষ্যত, বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট ইদানিং একটা কথা আমার প্রায়ই শুনতে হয় দেশে এত পরিকল্পনাবিদ থাকতে ঢাকার এই অবস্থা কেন? আমি মাঝে মাঝে জবাব দেয়ার চেষ্টা করি, আবার মাঝে মাঝে জবাব দেই না। কারন আমাদের দেশে প্লানিং প্রাকটিস নেই। দেশে সড়ক ও জনপথ ভবনে গেলে পাজেরো ছাড়া অন্য কোন গাড়ী পাওয়া যাবে না। আমাদের মত একটা দরিদ্র (!) দেশে এত বিলাশবহুল গাড়ী কেন? এর উত্তর জানলেই বুঝতে পারবো আমাদের সমস্যা কি? কোথাও কোন নিয়ম নেই। সবজায়গায় দুর্নীতি আর অনিয়ম।

আর পৌরসভা গুলিতে দুর্নীতি দিন দিন যেন বেড়েই চলছে। সেদিন উত্তরাঞ্চলের একটি পৌরসভার কাউন্সিলর বললেন, আমি ৩ লাখ টাকা খরচ করে কাউন্সিলর হয়েছি আমার তো ৯ লাখ কমপক্ষে আয় করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো কিভাবে সে আয় করবে? সে শুধু কাউন্সিলর নয়, কন্ট্রাকটর। সে পৌরসভার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের থেকে এই টাকা আয় করবে। যেন পরবর্তী নির্বাচনে আরও ৬ লাখ টাকা খরচ করে নির্বাচিত হতে পারে।

দেশের একটি বড় পৌরসভার মেয়র এর কথা শুনেছিলাম, তিনি গত নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে শপথ নেয়ার পরের সপ্তাহে তার এলাকার সকল কন্ট্রাকটর কে তার অফিসে ডেকে একটা মিটিং করেন। সেখানে তিনি প্রকাশ্যে বলেন যে কোন টেন্ডার এর ১০% তাকে না দিতে রাজি থাকলে তার কাছে টেন্ডার বিক্রি হবে না। বর্তমানে দেশেরে শতকরা ৩০ জন শহরে বসবাস করে। ২০৫০ সালের মধ্যে অনুমান করা হচ্ছে শতকরা ৫০% লোক শহরে বসবাস করবে। সেজন্য শহর পরিকল্পনা বর্তমান সময়ে সময়ের দাবি।

দাতা সংস্থাগুলোও শহর মহাপরিকল্পনার জন্য বিশেষ বরাদ্দ দিচ্ছেন। মহাপরিকল্পনা ব্যতিত যে কোন ফিজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট করা আমাদের জন্য শপে বর হয়ে যেতে পারে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বর্তমান সময়ে শহর মহাপরিকল্পনার নামে পৌর শহর গুলিতে যা হচ্ছে সেটা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অশনি সংকেত। খুব অল্প বাজেটে যাচ্ছেতাই এক একটি মহা পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে। অধিকাংশ মহাপরিকল্পান প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।

যাদের অবকাঠামো উন্নয়ন সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান আছে, শহর পরিকল্পনা সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞান আছে? এবং কিন্তু সেটাকে আদৌ শহর পরিকল্পনা বলা যাবে কি না সন্দেহ আছে। তার পরেও বলবো যা হচ্ছে মহাপরিকল্পনার নামে তা একেবারেই ফেলে দেয়ার মত নয়। কিছু তো শুরু হয়েছে। শহর মহাপরিকল্পনার দ্বায়িত্ব আসলে কার? এটি বিতর্কিত বিষয় নয়। শহর পরিকল্পনার আইনানুগ দ্বায়িত্ব আরবান ডেভেলপমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইউডিডি) এর কিন্তু আমাদের অধিকাংশ শহরের মহাপরিকল্পনা করছেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।

এলজিইডি শুধুমাত্র অবকাঠামো উন্নয়ন করতে পারে তাদের মহাপরিকল্পনা করার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু আমাদের ইউডিডি’র কাঠামো দুর্বল হওয়ায় এবং এলজিইডি’র কাঠামো অপেক্ষাকৃত অনেক সবল ও দাতা সংস্থার সাথে সুসম্পর্ক থাকার কারনে তারাই পৌর শহর গুলোর মহাপরিকল্পনা করছে। এই মহাপরিকল্পনা গুলোর ভবিষ্যৎ কি হবে কে জানে? এসব মহাপরিকল্পনার স্ট্যান্ডার্ড যে সব মহাপরিকল্পনা হচ্ছে সেসব কোন স্ট্যার্ন্ডাড ধরে হচ্ছে কি হচ্ছে না, যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাজ করতে তারা তাদের নিজেদের সুবিধামত কিছু স্ট্যার্ন্ডাড ধরে কাজ করছেন। আমি যতদুর দেখেছি তাদের কোন স্ট্যান্ডর্ড মেনে ভূমি ব্যবহার / শহরের মহাপরিকল্পনা করতে দেখিনি। এসব পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বর্তমান ভূমির ব্যবহার মানচিত্র তৈরি করছে।

আর কিছু রিপোর্ট করছে। সবচেয়ে আশ্চার্যের বিষয় হচ্ছে, যে শহরের মহাপরিকল্পনা হচ্ছে সে শহরের পৌরসভা কে শুধুমাত্র কাগজে কলমে সম্পৃক্ত রাখা হচ্ছে। কোন পৌরসভার এই মহাপরিকল্পনা সম্পর্কে ধারনা আছে এমন কোন লোক নেই। সুতরাং তাদের কাজের মান যাচাই করার কোন সুযোগ নেই। গত ২০১০ সালে ২৭ জন এবং ২০১১ সালে ৪৩ জন শহর পরিকল্পনাবিদ নিয়োগ দেয়া হয়েছে বিভিন্ন পৌরসভাগুলিতে এসব কাজ দেখার জন্য কিন্তু তারা সেখানে আসলে কতটুকু কি করতে পারছে? ২০১০ সালের ২৭ জনের মধ্যে ২৫ জন কর্মরত আছে।

তাদের দেয়া তথ্য মতে, এসব মহাপরিকল্পনা দেখে মান যাচাইয়ের কোন সুযোগ নেই। এখানে মেয়র যা বলেন সেটাই আইন সেটাই করতে হয়। মেয়র যদি বলেন এই কাগজে স্বাক্ষর করতে, তাদেরকে তাই করতে হয়। কারন, প্রথমত, পৌরসভার বেতন ভাতা পৌরসভার আয় থেকে দেয়া হয়, মেয়র ইচ্ছে করলেই যে কারও বেতন অনেকদিন নাও দিতে পারেন। দ্বিতীয়ত, প্রায় সকল পৌরসভায় ৯০% কর্মচারী কর্মকর্তা দুর্নীতি পরায়ন।

এগুলো পৌরসভায় খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। যে কোন টেন্ডার হলেই মেয়র কে কমপক্ষে ১০% আর প্রকৌশলীদের কমপক্ষে ২% বাধ্যতামুলক ভাবে দিতে হয়, নয়তো কন্ট্রাকটারদের কাছে শিডিউল বিক্রি করা হয় না। পৌরসভার কর্মকর্তা কর্মচারীরা মনে করে এটা তাদের অধিকার। ট্যাক্স আদায় হচ্ছে না কেন? আবার ট্যাক্স সংগ্রহের ক্ষেত্রে কিছু কিছু পৌরসভায় ৮০% পর্যন্ত মওকুফ কারর রেকর্ড আছে। মেয়র রাজনৈতিক ব্যক্তি হওয়ায় জনপ্রিয়তা নষ্ট হওয়ার ভয়ে ট্যাক্স সংগ্রহের ক্ষেত্রে কঠিন হতে পারেন না।

সুতরাং অধিকাংশ পৌরসভার রাজস্ব আয় অনেক কম। সেজন্য অধিকাংশ পৌরসভায় বেতন অনিয়মিত, কোথাও কোথাও ৫/৬ মাসের বেতন দেয়া হয় না। এর ফলাফল প্রতিটি কর্মচারী নিজের সংসার চালানোর জন্য সবকিছুতেই নিয়ম বর্হিভুত ভাবে বাড়তি টাকা আদায় করে সাধারণ পৌরবাসীর কাছে। একটা নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট নিতে গেলেও নিয়ম বর্হিভুত টাকা দিতে হয়। সাধারন মানুষের কাছে পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই ঘুষখোর।

একটা চক্র দাড়িয়ে গেছে। একজন নাগরিক নিয়মিত হোল্ডিং ট্যাক্স দেয় না কিন্তু সে ভবন এর নকশা অনুমোদনের সময় ঘুষ দেয় ফির এর দ্বিগুন টাকা। ভবন অনুমোদনের অনিয়ম টাই এখানে নিয়ম ভবন অনুমোদনের নিয়ম শুধু মাত্র কাগজ কলমেই আছে বাস্তবে নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভাগীয় শহর ব্যতীত অন্যান্য পৌর শহরগুলিতে কেউ ভবন অনুমোদনের জন্য সহজে আসে না। যারা আসে তারা অধিকাংশই ব্যাংক লোন এর জন্য ভবন এর অনুমোদন নিতে আসে।

নয়তো নিজের জমি, নিজের টাকায় বাড়ি বাসাবে এখানে কার কি বলার আছে? এমন একটা বদ্ধমূল ধারনা সবার মধ্যে। পৌর এলাকায় যারা ভবনের নক্সা অনুমোদন করে তাদের মতে, প্রায় সবাই মেয়র অথবা কাউন্সিলর দের পরিচিত সুতরাং যে নক্সাই এনেছে সেটা অনুমোদন দিতেই হবে। আইন দেখে কোন কিছু বলার সুযোগ নেই। যারা একটু আইন এর কথা বললে তাদের নিশ্চিতভাবে হয় মেয়র, কাউন্সিলর বা কর্মচারীর হাতে লাঞ্ছিত হবেন, নয়তো বেতন বন্ধ হয়ে যাবে অথবা মেয়র বদলী করে দিবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভবনের নকশা প্রচলিত ইমারত নির্মান বিধিমিালা ১৯৯৬ এবং মহানগরী, বিভাগীয় শহর, ও জেলা শহর পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ অনুয়ায়ী হওয়ার কথা থাকলেও এসব বিধিমালা বা আইন দেখে ডিজাইন পরীক্ষা করার কোন সুযোগ নেই।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাজকে কলমে ভবনের ডিজাইন ঠিক থাকলেও বাস্তবে ঠিক থাকে না। মেয়র যদি এসবএর ব্যপারে একটু সচেতন ও সদিচ্ছা পোষন করতো তাহলে হয়তো এই সমস্যা অনেকাংশে কমিয়ে ফেলা যেত। এখানেও একই সমস্যা মেয়র তার ভোট বা জনপ্রিয়তা হারানোর আশংকায় কোন আইনি পদক্ষেপ নিতে চান না। আমার জানা মতে শহকরা ১০ ভাগ ভবনও বিধিমালা ও আইন অনুযায়ী হয় না। সদিচ্ছার অভাব শহর আমাদের দৈনন্দিন সকল চাহিদা পুরোন করছে।

বাজার ঘাট, কেনাকাটা থেকে শুরু করে অফিস আদালত সব এই শহরে তার পরেও আমরা সাধারণ মানুষ শহরকে পর পর ভাবছি। শহরকে নিজের করে ভাবতে চাই না। এটা একটা বড় সমস্যা। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মর কথা না ভেবে বর্তমান সময়কে চিন্তা করে শহরের সবকিছু করছি। শহরে জমির দাম বেশি সুতরাং বাড়ি বানানোর সময় কেন জায়গা রাখবো? এ ধরনের মানষিকতা আমাদের সবার।

সচেতণতা বৃদ্ধি করার মত পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। আর বিভিন্ন সম্পর্কের কারনে অনেকেই আইন বা নিয়োম ভঙ্গ করে বাড়ি তৈরি করছে। অন্যদেরকে এখন নতুন করে বিধিমালা বা আইন এর কথা বললে বলে আগে যারা বাড়ি তৈরি করেছে বা বর্তমানেও অনেকে করছে তারা তো কেউ জমি খালি না রেখেই বাড়ি তৈরি করছে, আমি কেন খালি রাখবো। তারা চিন্তাও করে না ভবিষ্যতে যখন এই সব শহরের লোক আরও বেড়ে যাবে তখন আরও রাস্তা, আরও খোলা স্থান, পার্ক আরও স্কুল কলেজ, খেলাম মাঠ দরকার পরবে। বর্তমানকে নিয়েই সবাই ব্যস্ত।

সমাধান প্রথমত, মেয়র যদি চান তবে অনেক কিছুই করা সম্ভব। মেয়রের সদিচ্ছা থাকতে হবে। কিন্তু পুরোপুরি পলিটিক্যাল একজন মানুষকে দিয়ে এই সদিচ্ছা বা চাওয়া কতটুকু সম্ভব সেটা ভাববার বিষয়। দ্বিতীয়ত, মেয়রদের কে নিয়মিত বিশেষ প্রশিক্ষণ, সচেতণতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম করা যেতে পারে। তৃতীয়ত, পৌর বাসীর সচেতণতা বৃদ্ধি করাও জরুরী।

চতুর্থত, পৌর কর নিয়মিত পরিশোধ কিংবা সংগ্রহ করার জন্য আরও বেশি প্রযক্তির ব্যবহার করা যেতে পারে, যাতে কাজের সচ্ছতা বৃদ্ধি পায়। পঞ্চমত, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে বদলীর বিষয়টিও ভাবতে হবে। কিছু লোক আছে যাদের কোন বদলী নেই। অধিকাংশ পৌরসভায় দেখা যায় স্থানীয় লোক থাকে সবচেয়ে বেশি। বাইরের জেলার লোক থাকে বড় জোর ৫/৭ জন।

ষষ্ঠত, কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন সরকারী রাজস্ব থেকে দেয়া যেতে পারে। পৌরসভার আয় থেকে পৌর সভার উন্নয়ন বা আয়বর্ধন মুলক কাজ করতে পারে। এতে অনেক দক্ষ ও শিক্ষিত লোক পৌরসভায় কাজ করতে আগ্রহী হবে। এটা একজন শহর পরিকল্পনাবিদের ব্যক্তিগত মতামত। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।