(ক্লাস টেনের শেষের দিকে পড়ার চাপে যখন মাথা নষ্ট প্রায়, তখন মাথা ঠান্ডা করতে একটা হাবি জাবি গল্প লিখেছিলাম। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে অল্প অল্প করে লিখতে গিয়ে তিন মাস লেগেছিল গল্পটা শেষ করতে। অনেক ভুল-ভাল আছে জানি। তবু ব্লগে দেয়ার সাহসটা করেই ফেললাম। হাস্যকর বা বিরক্তিকর হলেও কিছু করার নেই।
)
সেপ্টেম্বর-নভেম্বর, ১৯৯৫।
-"ধ্যৎ! সব ভন্ডুল হয়ে গেল। "
--"কী ভন্ডুল হয়ে গেল রে গাধী?"
-"গাধী বলিস না, মেজাজ এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে। "
ঘরে ঢুকে কথাগুলো বলেই ধুপ করে খাটে বসে পড়ল তোকুম। ওর নাম অবশ্য তোকুম না, তবে আমি ডাকি।
ও মাঝে মাঝেই আনমনা হয়ে পড়ে আর মুখ দিয়ে 'তোকুম তোকুম' শব্দ করে। অবশ্য ও ঠিক কী বলে বুঝি না, আমার কানে 'তোকুম তোকুম' শব্দটাই আসে। গালে হাত দিয়ে কি যেন চিন্তা করছে তোকুম। সামনের কাটা চুলগুলো কপালে এসে পড়েছে বলে কপাল দেখা যাচ্ছে না, তবে কপাল কুঁচকে আছে বুঝতে পারছি। গায়ে ধাক্কা দিয়ে বললাম-
--"কী রে, কী হল?"
-"বললাম তো সব ভন্ডুল হয়ে গেল।
"
--"যা বান্দরী!"
ওকে আমি প্রায় সারাক্ষণই বান্দরী, গাধী বলে গালি দিই। খুব রেগে যায় ও এসব শুনলে। রেগে যায় বলেই আরও বেশি করে দিই। কিন্তু এখন কিছু বলল না, রাগলোও না। মনে হচ্ছে ওর নিজের তৈরী রেসিপি অনুযায়ী ভাত দিয়ে চটপটি বানাবার প্ল্যান ভেস্তে গেছে।
আবার বাড়ির পাশের ড্রেনের মধ্যে পদ্মফুল ফোটানোর প্ল্যানও ভেস্তে যেতে পারে। কি যে আবোল তাবোল প্ল্যান করতে পারে মেয়েটা। একটু নরম সুরে জিজ্ঞেস করলাম,
--"কী হয়েছে রে তোকুম?"
-"আর বলিস না, ছাদের বাগানের প্ল্যানটা গেছে। "
--"কোনটা? ঐ যে মরিচ গাছে পটল ধরানোর প্ল্যানটা?"
-"হুঁ। "
--"বলিস কী রে? এমন দুর্দান্ত একটা প্ল্যান।
কিভাবে ভন্ডুল হল?"
-"আরে ঐ দাদীজানের কান্ড। পটলের যে লতাগুলি জোগাড় করেছিলাম সব ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে। বলেছে আমি যদি আবার ঐ রকম প্ল্যান করি তো আমার পা দুটো মাটিতে পুঁতে দিয়ে আমার গায়ে বিছুটি পাতা জন্মানোর প্ল্যান করবে। "
--"কী ভয়াবহ! কী মর্মান্তিক! তা তুই ডাস্টবিন থেকে লতাগুলো তুলতে পারলি না?"
-"চেয়েছিলাম তো। কিন্তু তার আগেই মরিয়মের মা ময়লা ফেলে দিয়েছে।
আমি অবশ্য পরে গিয়ে ময়লা ঘেটেছি, কিন্তু পেলাম না। বোধ হয় বস্তির ছেলেপেলে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। "
আমার পেটের ভেতরটা গুলিয়ে উঠল। অনেক কষ্টে বমির ভাবটা চেপে বললাম,
--"তা দাদী জানলো কী করে?"
-"কি জানি, বোধ হয় মরিয়ম বলে দিয়েছে। ওকে পেলে আমি--"
বলেই এমন একটা ভঙ্গি করল যে তাকে মনে হল অমরেশ পুরীর চাচী আম্মা।
ভাগ্যিস মরিয়ম এখানে ছিল না। থাকলে এখনই চিৎকার শুরু করে দিত। ওর যা চিৎকার! দু'হাতে চুল টেনে ধরে ইঁ-ইঁ-ইঁ করে চিৎকার ছাড়ে। শুনলে কানে তালা লেগে যায়। একবার তোকুম একটা এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছিল।
জ্যান্ত শোল মাছ মানুষের কোলে দিলে মাছের কি রকম অবস্থা হয় তা নিয়ে একটা পরীক্ষা করছিল। সে নিজে বাজারে গিয়ে য়্যাব্বড় একটা শোল মাছ নিয়ে এল। আমাকে বলল মাছটাকে কোলে নিতে। আমি তো তিন লাফে সরে গেলাম। তোকুম নিজে মাছটাকে কোলে নিতে পারছে না, কারণ তাহলে নাকি ও সেটাকে ভালোমত পর্যবেক্ষণ করতে পারবে না।
তোকুম "যাই মরিয়মকে দিই" বলে তিনতলায় দৌড় দিল। আমিও পিছনে পিছনে গেলাম মজা দেখবার জন্য। মরিয়ম তখন শাকপাতা বাছছিল। তোকুম দৌড় দিয়ে ওর সামনে গিয়েই মাছটা ওর কোলে ফেলে দিল। মরিয়ম শাক ফেলে একটা লাফ দিল।
মাছটা মেঝেতে পড়ে লাফাতে থাকল। ততক্ষণে মরিয়ম ওর স্বভাবমত দু'হাতে চুল টেনে ধরে ইঁ-ইঁ-ইঁ করে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। আমি তো হো হো করে হেসেই আর কূল পাই না। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে চোখ খুলে দেখি মরিয়ম আগের মতই চিৎকার করে যাচ্ছে, তোকুম মাছটা তুলে নিয়ে আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর মরিয়মের মা মরিয়মের চিৎকার থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে এখন কানে হাত দিয়ে বসে আছে।
ও কী! ও কী! তোকুম যে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে।
অবস্থা মনে হচ্ছে বেগতিক। আমি তাড়াতাড়ি দোতলায় নেমে আমার ঘরের দরজা লাগিয়ে বসে পড়লাম। পরিস্থিতি শান্ত হয়েছিল কিভাবে জানি না, তবে অনেক সময় লেগেছিল। পরদিন তোকুম মুখ ভার করে আমার ঘরে এসে বলেছিল,
-"কি মুশকিল দ্যাখ তো, আমার এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল কী লিখব এখন?"
আমি বললাম,
--"কেন? এক্সপেরিমেন্টটা আর শেষ করিস নি?"
-"কিভাবে করব? আম্মা মাছটা কেটে ফেলল, তবেই তো মরিয়ম ঠান্ডা হল। দুপুরে সবাই মাছটা নিয়ে গুরুভোজন চালিয়েছে।
"
--"তাহলে এক কাজ কর। এক্সপেরিমেন্টের নাম পাল্টে দে। তাহলেই আর ফলাফলের ঝামেলা থাকে না। "
-"কী রকম?"
--"দ্যাখ, তোর এক্সপেরিমেন্টের নাম হল 'জ্যান্ত মাছ মানুষের কোলে দেয়ার পর মাছের অবস্থা', এখানে 'মাছের অবস্থা' কেটে দিয়ে 'মানুষের অবস্থা' লিখে দে। ব্যস তাহলেই তো হল।
"
-"তাই তো!" বলে দৌড় দিয়ে তোকুম চলে গেল।
আসলে তোকুম আমার যে কোন পরামর্শই মহামূল্য উপদেশ মনে করে মেনে চলে।
যাক গে, যা বলছিলাম। তোকুমের বর্তমান প্ল্যান ভেস্তে যাওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করে বললাম,
--"থাক, দুঃখ করিস না। তোর তো আরও প্ল্যান আছে, ওগুলোর কাজ এগিয়ে নিয়ে যা।
"
তোকুম একটু চিন্তা করে বলল, "হুঁ, ঠিক। " তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আহা বেচারী তোকুম, যদি জানত যে ওর প্ল্যান ভেস্তে দেয়ায় আমিই মূখ্য ভূমিকা পালনকারী। আমিই দাদীর কানে তুলে দিয়েছি ওর সাধের প্ল্যানের খবর। দেবই বা না কেন, নইলে আমার সাধের বাগান আর মরিচ গাছগুলোর বারোটা বাজত।
এখন ও নিশ্চয়ই পাশের ড্রেনটা ঘাঁটা ঘাঁটি করছে। মেয়েটার বুদ্ধিশুদ্ধি তো নেই-ই, ঘেন্নাও নেই। ওর এই প্ল্যানটারও খবর আছে, আমি আছি যে। ও আমাকে ওর একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী মনে করে। কারণ একমাত্র আমিই ওর সব প্ল্যানের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি আর এসব বিষয়ে সুপরামর্শ দিয়ে থাকি।
অথচ আসলে আমিই ওর সবচেয়ে বড় শত্রু।
এবার আমাদের একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে দিই। আমি থাকি আমার নানার বাড়িতে। তিনতলা বাড়ি। দোতলায় আমরা থাকি, তিনতলায় তোকুমরা মানে জোবাইদা খাতুনরা ভাড়া থাকে।
একতলায় আপাতত টু-লেট ঝুলছে। আমি নানী, আম্মা আর একমাত্র মামুজানের সাথে থাকি। নানা নেই, আর আব্বা কুয়েতে। তোকুম থাকে ওর বাবা-মা আর দাদীর সাথে। আর আছে মরিয়ম ও তার মা।
ওর দাদী আর আমার নানীর মধ্যে খুব ভাব। ওর আম্মার ভাব আমার আম্মার সাথে আর ওর আব্বার ভাব আমার মামার সাথে, তারা দুজনেই ডাক্তার। তোকুম আর আমার মধ্যে সত্যিকারের ভাব আছে কি না বলতে পারি না, তবে আমরা দু'জন ক্লাসমেট। দুজনে একই স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ি। পড়াশোনায় দু'জনেই মোটামুটি ধরণের।
চলবে........। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।