চোখ মেলে দেখি গাড়ি সাপের মতো ডানে বায়ে বাঁক ঘুরছে। উচু নিচু রাস্তা। দুই পাশে সবুজ পাহাড়। পথই বলে দেয় আমরা এখন খাগড়াছড়ি। আমার সঙ্গে ছোটবেলার দুই বন্ধু।
অনেকদিনপর তিনবন্ধু কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ভ্রমণে বেরিয়ে পরলাম। গতকাল রাতে ব্যস্ত নগরী যখন ঘুমের প্রস্তুতি নিচছে তখন আমরা খাগড়াছড়ির বাসে। পরেরদিন অনেক চড়াই উৎড়াই পেড়োতে হবে তাই বাসে উঠেই ঘুম দিলাম। গাড়ি এতবেশি বাঁক নিচ্ছিলো যে সকালের আরামের ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখি সকাল হতে শুরু করেছে।
আমাদের বাস পাহাড়ের বাঁক ঘুরছে।
হোটেল নিলয়ের ৩১৩ রুমটা আমাদের জন্য বরাদ্দ হলো। খুবই অল্পসময় হাতে নিয়ে আমরা এই পাহাড়ের দেশে এসেছি। তাই একদমই সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে হোটেলের পাশের এক রেস্তোরায় সকালের নাস্তা করে পূর্বপরিকল্পনামতে সবাই একসাথে খাগড়াছড়ি টার্মিনালে মিলিত হই। যেখানে চশমু আর বড়ভাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
মূলত চশমুর নিমন্ত্রণেই হুট করে এই পাহাড়ের দেশে আগমন। চশমু অডিটের কাজে গত সপ্তাহ তিনেক এখানেই পড়ে আছে। ওর লেজ ধরে আমরাও চলে এলাম। প্রাথমিক গন্তব্য আলুটিলা গুহা। খাগড়াছড়ি মূল শহর থেকে আলুটিলা গুহার দূরত্ব ছয় কিলোমিটার।
লোকাল এক বাসে চেপে আমরা পাঁচজনে আলুটিলা গুহায় পৌছাই। আলুটিলা গুহা প্রবেশের আগমুহুর্তে প্রত্যেকের হাতে একটা মশাল ধরিয়ে দেওয়া হলো।
[আলুটিলা গুহার ভিতরে মশাল হাতে আমরা অভিযাত্রী]
এই মশালই অন্ধকার গুহার পথের আলো। এটা নাকি রহস্যময় গুহা। কী তার রহস্য? এই রহস্যভেদ করতে প্রথমে আমাদের সিড়ি ভেঙে নিচে নামতে হলো, নিচে নামতে নামতে যখন আমরা প্রায় ক্লান্ত তখন আলুটিলা গুহামুখের দেখা মিলল।
গুহার ভিতরে হাটু সমান পানি, পথটাও পিচ্ছিল। আমাদের এত দামী জুতা কোন কাজে আসলো না। সবাই যে যার জুতা খুলে হাতে নিলো। কারণ বলা তো যায় না বেশি ভাব নিয়ে জুতা পড়ে হাটতে গেলে একটু অসাবধানতায় পা পিছলে হাত-পা ভাঙবে। গুহার ভিতরটা ভুতুরে।
এবড়ো থেবড়ো পথ। কোথাও কোথাও পথটা এতটাই সরু যে একজনে কোনরকম হাটুমুরি দিয়ে পথ চলতে হয়। কিছুদূর পর পরই পথের শাখা প্রশাখা তৈরি হয়েছে। হঠাৎ বিভ্রান্ত হতে হয় কোন পথে সামনে এগোতে হবে। আপনি একটু পথ ধরে যাবার পর দেখলেন সামনে আর পথ নেই তখন কেমন লাগবে? আর ঠিক সেই সময় যদি হাতের মশালটা নিভে যায়! মনে হয় পিছনের অন্ধকার থেকে একটা লোমশ কালো হাত আপনাকে ছুয়ে ফেলছে।
[ছবিতে অস্বাভাবিক কিছু কী চোখে পড়ছে]
অদ্ভুত ব্যাপার বেশ কয়েকবার আমাদের হাতের মশাল নিভে গেল। তখন অন্যের মশালের আলো থেকে আবার আলো জ্বালানো হলো। আলুটিলা গুহায় যতই রোমাঞ্চ থাকুক আমরা কখনই গুহাবাসী হতে চাই নাই। পথ চলতে চলতে একসময় ঠিকই মুক্ত আলোর দেখা পেলাম। আকাশ থেকে এক চিলতে আলো রশ্মি গুহার মুখে এসে পড়েছে।
[ক্যামেরার চোখে আলোকরশ্মি]
আলোকরশ্মি এতই মায়াকাড়া যে তার বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। গুহার শেষপ্রান্তে এমন অভুতপূর্ণ দৃশ্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। অন্ধকার পথ পেরিয়ে হঠাৎ আলোর দেখা পাওয়া এমন চিত্তাকর্ষক হতে পারে আমার ধারণা ছিল না। আমাদের সম্মানিত ফটোগ্রাফাররা সেই আলো ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করতে অনেক কারিকুরি করল। আমরা আলোর মাঝে দাড়িয়ে একেকজন একে দিকে উদাসী ভাব নিয়ে তাকিয়ে ছবি তুললাম।
ফটোসেশন ভালোই হলো কিন্তু ফেরার পথে আর পা চলে না। চড়াই উৎড়াই তো কম হলো না সামনে আরও বাকি..। আলুটিলা গুহা থেকে বের হয়ে আবারও সিড়ি ভেঙে পাহাড়ের উপরে উঠে একটুখানি বিশ্রাম নিলাম। সঙ্গে আনা বিস্কুট আর পানি খেতে খেতে দেখছিলাম ঐ দূরে পাহাড়ের নিচে খাগড়াছড়ি শহর। এই আলুটিলা গুহাকে ঘিরে পিকনিক স্পটও গড়ে উঠেছে।
সবুজ পাহাড়, মাথার উপর স্বচ্ছ নীল আকাশ, আলুটিলা গুহার রোমাঞ্চ, সব মিলিয়ে প্রকৃতির জমজমাট আয়োজন। তাই আমরা যখন ফিরে আসি তখন দেখতে পেলাম দলে দলে পিকনিক পার্টির আগমন। পিকনিক পার্টি পিকনিক করতে থাকুক এই সময়ে আমরা ঝিরাই ঝরণা দেখে আসি। আলুটিলা গুহা থেকে ঝিরাই ঝরণার দূরত্ব প্রায় চার কিলোমিটার। প্রথমে দুই কিলোমিটার লোকাল বাস, তারপরের বাকি পথ পায়ে হেটে ঝিরাই ঝরণায় পৌছাতে হয়।
আলুটিলা গুহা থেকে কিলো দুই দূরত্বে বাস আমাদের রাস্তার পাশে নামিয়ে দিলো যেখানে রাস্তার পাশের সাইনবোর্ডে বাংলায় লেখা ঝিরাই ঝরণা ২১০ কিলোমিটার আর ইংরেজিতে ২.১ কিলোমিটার। ব্যাপারখানা কী? দুই রকম ভাষায় দূরত্ব দুই রকম কেন? ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় বাংলায় দুইয়ের পরে দশমিকের ফোটা মুছে গেছে বা কেউ ইচ্ছা করে মুছে ফেলেছে। ঘটনা যাই হোক বুঝতে বাকি রইল না, আমাদের এখন ২.১ কিলোমিটার হাটতে হবে। তো শুরু হোক পদব্রজে চলা। সূর্য তখন মাথার উপরে।
শীতকালীন সূর্যের তেজ ততটা না থাকলেও তার আঁচ ঠিকই পাওয়া যায়। লাল ইটের রাস্তা মাড়িয়ে রাস্তার দুই পাশের আদিবাসী আর তাদের জীবনযাপনের খন্ড চিত্র দেখতে দেখতে আমরা পথের দূরত্ব কমাতে থাকি। হাটতে হাটতে হঠাৎ থমকে গেলাম আমি এবং আমরা পাঁচজনই। পাঁচজনের দৃষ্টি এক বিন্দুতে মিলেছে। পাহাড়ের ঢালে একটা আদিবাসী বাড়িতে।
বেশ টিপটাপ বাড়ী। মাটির দেয়াল, উপরে টিনের ছাদ। বাড়ীর সামনে ছোট্ট এক টুকরো উঠান। সেই উঠানে পরম আলস্যে চেয়ারে আধশোয়া এক যুবতী।
[পাহাড়ী মেয়েটি]
এতদূর থেকে মেয়েটির চেহারা দেখা যায় না।
কিন্তু তার ভঙিমা অসম্ভব আকর্ষণীয়। মেয়েদের অন্তর ইন্দ্রিয় আছে বলে জানতাম। দেখা গেল ঘটনা সত্য। মেয়েটি বুঝতে পারলো কতিপয় যুবক তার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের দিকে একপলক সে তাকিয়ে শরীরের আড়মোড়া ভেঙে নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় চেয়ারে শুয়ে মধ্য দুপুরের রোদে তপ্ত হচ্ছিল।
আমরা আর দাড়াতে পারলাম না। নির্লিপ্তায় একটা অহংবোধ কাজ করে যা আমরা নিতে পারলাম না। ইটের রাস্তার শেষ খুঁজতে আবারও হাটা শুরু করলাম। যখন ভাবলাম পথ শেষ, ঐ দূরে ঝরণার ঝরে পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম তখনই আসলে আমাদের পথ শুরু। আনুমানিক প্রায় দুই কিলোমিটার সমান্তরাল পথ শেষে ইটের রাস্তা একদম খাড়া হয়ে নিচে নেমে গেছে।
মধ্যাকর্ষণ শক্তি আমাদের নিচের দিকে টানছে; আমরা নিচেই নামলাম তবে মধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে যুদ্ধ করে। সারাজীবন দেখেছি নিচে নামা সহজ এখন বুঝলাম নিচে নামাটাই কঠিন। ইটের খাড়া রাস্তা শেষ হলো, কিন্তু পথ শেষ হলো না, খাড়া রাস্তা শেষে পাহাড়ী সিড়ি।
[পাহাড়ী সিড়ি]
ঝরণার দেখা এখনও পাই নি। তবে ঝরণার ঝড়ে পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
আর কয়েকধাপ সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে জঙ্গলের ফাঁক গলিয়ে অবশেষে ঝরণার দেখা পাওয়া গেল।
[ঐ দূরে ঝিরাই ঝরণা দেখা যায়]
ঝরণার আসল রুপ দেখা মেলে বর্ষাকালে। শীতের মৌসুমে ঝরণা শুধু নামেই। কোনক্রমে পাহাড়ের উপর থেকে পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। জায়গাটা একদম নির্জন।
এরকম নির্জন জায়গায় প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে ইচছা করে। কিন্তু অন্যরা রাজি হলো না। ডিজিটাল যুগে সবাই ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়েই ব্যস্ত। ঝরণাকে পিছনে রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছবি তুলতেই ব্যস্ত। ভাবখানা এমন, ঐ দূর আকাশে ঝরণা দেখা যায়।
আমি ঝরণার একটু কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করলাম ফলাফল শ্যাওলা ধরা পাথরে পা পিছলে প্রায় মাঝা ভাঙার যোগাড়। মাজা ভাঙলো না তবে পশ্চাতদেশে কাদায় মাখামাখি হয়ে বেকায়দা অবস্থা। ঝরণার উৎস খুঁজতে আমরা পাহাড়ের মাথায় উঠলাম।
না ঝরণার উৎস খুঁজে পাওয়া গেল না। পাহাড়ের মাথায় আবিস্কার করলাম দুই যুবতী আর এক যুবক।
তারা পাহাড়ের উপরে প্রকৃতির মাঝে বসে কী করে তা রহস্যই। আমাদের কাছে রহস্য রহস্যই রইল। আমরা ঝিরাই ঝরণা অভিযানের সমাপ্তি করে খাগড়াছড়ি মূল শহরে ফিরে এলাম। যখন ফিরলাম তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকাল। দুপুরের খাবার পাই কী না পাই ভাবতে ভাবতে সিস্টেমে প্রবেশ করলাম।
সিস্টেম এখানকার আদিবাসীদের পরিবেশনায় অন্যরকম একটা রেস্টুরেন্ট।
[সিস্টেম রেস্টুরেন্ট]
চাইনিজ রেস্টুরেন্টের মতো আধো আলো আধো অন্ধকার। সুন্দর গোছানো টেবিল চেয়ার। আমরা হাতমুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে বসার সাথে সাথেই খাবার আসতে লাগলো। চিংড়ি মাছের মালাইকারি, শুটকি ভর্তা, বেগুন ভর্তা, লাউঘন্ট, মাশরুম ভাজি, কাচ্চিমাছ চচ্চড়ি, ছোটমাছের ঝোল, হাস ভুনা আরও বেশ কিছু পদ যার নাম এই মুহুর্তে মনে করতে পারছি না।
এখানকার সব খাবারই আপনাকে পরিবেশন করা হবে যেইটা খুশি সেইটা চেখে দেখতে পারেন। আলাদা করে অর্ডার করার দরকার নেই। সিস্টেমের হাস ভুনার স্বাদ এখনও জিভে লেগে আছে। কাচ্চিমাছ চচ্চড়ি, শুটকি ভর্তার তুলনা হয় না। অন্যান্য খাবারের স্বাদও অনন্য।
খাগড়াছড়িতে এসে সিস্টেম রেস্টুরেন্টের খাবার যার মিস করেছেন তারা আসলেই মিস করেছেন। খাবারের পর শরীরে আলস্য এসে ভর করলো। বিকালে ঝটিকা অভিযানে খাগড়াছড়ির ঝুলন্ত ব্রীজ দেখতে গেলাম। আর তারপরের সময়টা শহরের ইতি উতি হাটাহাটি করে কাটিয়ে দিলাম। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।