এসো ভাই , তোলো হাই , শুয়ে পড়ো চিত, অনিশ্চিত এ সংসারে এ কথা নিশ্চিত - জগতে সকলই মিথ্যা , সব মায়াময়, স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয়। ঘড়ির কাটায় তখন বেলা প্রায় সাড়ে তিনটা। অফিসে কাজ করছিলাম। কাজ মোটামুটি শেষের দিকে জাস্ট শুধু রেন্ডার দিয়ে বের হব। তখনো লাঞ্চ করা হয়নি।
ঠিক সে সময় সেল ফোনে ভাবীর কল কোথায় আছি, লাঞ্চ করেছি কিনা জানার জন্য। তখনো পর্যন্ত লাঞ্চ করিনি শুনে চিরাচরিত নিয়মে কিছুক্ষণ আন্তরিকভাবে বকাঝকা দিলেন। তারপর বললেন সোজা দ্রুত বাসায় চলে যেতে। তিনি খাবার রেডি করে রেখেছেন। বাসায় শুক্রবারের স্পেশাল মেন্যুর কথা মনে পড়াতে আমিও রাজি হয়ে গেলাম।
অফিস থেকে বের হয়ে দেখলাম মৃদু বাতাস বইছে। আকাশ একটু মন খারাপ করে আছে। পরিবেশটা আমার মূহুর্তেই ভাল লেগে গেল। কয়েক কদম হেঁটে সামনে যেতেই প্রায় আমার সমবয়সী একজন রিক্সাচালককে পেলাম। বেচারা খালি রিক্সা নিয়ে উদাস গলায় গান ধরেছে- "আল্লা মেগ দে ফানি দে ছায়া দেরে তুই....।
" ততক্ষণে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ছুটির দিনের ফাঁকা রাস্তায় আমার ইচ্ছে হল রিক্সায় চড়ি। ওই গায়ক রিক্সাওয়ালাকে ডাক দিলাম-
:মামা যাবা নাকি?
- কই যাইবেন
: বাংলাবাজার
- হুম যাব
: কত?
- শাইট ট্যাকা
: চল্লিশ টাকায় যাবা?
- না মামা, গেলে একদাম ফনচাইশ ট্যাকা দিয়েন
: পয়তাল্লিশ টাকায় যাবা কিনা বলেই আমি হাঁটা দিলাম।
- আইচ্ছা উডেন।
রিক্সায় চড়া মাত্রই বৃষ্টির গতি বাড়তে শুরু করেছে।
তাকে জিজ্ঞেশ করলাম প্লাস্টিক আছে কিনা। না মামা, বৃষ্টি হইবোতো যানতাম না, বইলাই সে আবার গান ধরলো- আল্লা মেগ দে ফানি দে.....। উচ্চারণ এবং সুরের গরমিল থাকলেও তার গলাটা বেশ। আমি আনমনে রিক্সাওয়ালার গান শুনছি। পল্টন মোড় ফেলে রিক্সা জিরো পয়েন্ট এর কাছাকাছি আসতেই ঝুম বৃষ্টি নামলো।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভাল লাগলেও আমার হাতে এক টেরাবাইটের একটা হার্ডডিস্ক সাথে দুই পকেটে তিনটা মোবাইল সেট ভিজে যাচ্ছে দেখে গায়ক রিক্সাওয়ালাকে বললাম মামা পাশে কোথাও দাঁড়াও, বৃষ্টি একটু কমুক। সে আমার কথামত জিরো পয়েন্টের পাশে খদ্দের বাজার শপিং কমপ্লেক্সের সামনে রিক্সা থামালো। আমি লাফ দিয়ে নেমে মার্কেটের পশ্চিম গেইটে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে আমার কোমর থেকে নিচের দিকে পুরো ভিজে গেছে।
আমাদের রিক্সার পেছন পেছন আরো একটা রিক্সাও এসে থামলো।
সে রিক্সা থেকে নেমে এলেন দুজন মাঝ বয়সী মহিলা এবং একটা ছোট মেয়ে। তারাও প্রায় ভিজে গেছে। রিক্সা থেকে নামতে নামতেই দুজন ভদ্র মহিলার একজন তেলে বেগুনে গরম হয়ে তাদের রিক্সাওয়ালার চৌদ্দগোষ্ঠির পূর্বের গোষ্ঠিও উদ্ধার করা শুরু করেছেন। ওই রিক্সাওয়ালার অপরাধ- সে প্লাস্টিক কেন রাখেনাই। আশপাশের কয়েকজন উক্ত ভদ্রমহিলাকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন যে, সকালে তো আর বৃষ্টি ছিলনা কিংবা বৃষ্টি হবে এমনওতো কোন পূর্বাভাস ছিলনা, তাই সে প্লাস্টিক নিয়ে বের হয়নি।
ভদ্রমহিলা এবার আরো ক্ষেপে গিয়ে বললেন- কেন, সকাল থেকেই তো মেঘলা আবহাওয়া ছিল। বেটা স্টুপিডের বাচ্চা প্লাস্টিক নিয়ে বের হবেনা?
এতক্ষণ পাশ থেকে নিরব দর্শকের ভুমিকায় সব দেখছিলাম। এবার আমি মুখ খুললাম- আসলেই বেটা একটা স্টুপিড! সকাল বেলা মেঘলা আবহাওয়া দেখেও সে প্লাস্টিক নিয়ে বের হয়নি... বেটা গর্দভ। দুই মহিলার সাথে থাকা ছোট মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম আহারে এই ছোট মাসুম বাচ্চাটিতো একেবারে ভিজেই গেছে। আমার সাপোর্ট পেয়ে ঝগড়ারত ভদ্রমহিলার চেহারায় খুশির ঝিলিক দেখা গেল।
আমি এমন মোক্ষম সুযোগটাই খুঁজছিলাম। দেখতে খালার মত লাগলেও উনাদের বেশভূষা আর চেহারায় মেকআপের আধিক্য দেখে নিরাপত্তার খাতিরেই আপা সম্বোধন করলাম। বললাম আপা আপনারা ও কেমন মানুষ ওই মূর্খ স্টুপিডটা না হয় সকালে মেঘলা আবহাওয়া দেখেও প্লাস্টিক নিয়ে বের হলনা। কিন্তু আপনারাতো সকালবেলা এমন মেঘলা আবহাওয়া দেখে দুটো না হোক অন্তত একটা ছাতা নিয়ে বের হতে পারতেন? স্কুলের সবচাইতে সুন্দরী অহংকারী মেয়েটা পড়া শিখে না আসার কারণে ক্লাসে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকলে যেমন চেহারা হয় ভদ্রমহিলার চেহারাটা আমার কাছে তখন ঠিক তেমনই মনে হয়েছে। পাশের লোকগুলো অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসি চেপে রাখলো কোন রকমে।
ভদ্রমহিলা গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে আমাদের থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন।
বাসায় এসে কিছুক্ষণ পর টিভিটা অন করেই জানলাম যেই সময়টায় ওই রিক্সাওয়ালার উপর ভদ্রমহিলার গালাগালির টর্নেডো বয়ে যেতে দেখলাম ঠিক সেই সময়টাতেই মাত্র পনেরো মিনিটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর, আ্খাউড়া ও বিজয়নগর উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে স্মরণকালের এক ভয়াবহ টর্নেডো। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত উনিশ জন তাজা প্রাণের ঝরে যাওয়ার সংবাদ পেলাম। লন্ডভন্ড হয়ে গেছে বিশটি গ্রাম। আহত হয়েছে কয়েকশ মানুষ।
মাত্রই প্রিয় প্রেসিডেন্ট এর মৃত্যু শোক সইতে না সইতেই এতগুলো জীবন ঝরে যাওয়ার শোক ঘিরে ধরেছে আমাদের। বুকের চারপাশে নিদারুন শুন্যতার হাহাকার নির্বাক করে দিয়েছে আমাকে।
বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে নিহত লোকগুলো কি করতেছিলেন তখন? পনেরো মিনিট আগেও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল বুকে। স্বপ্নগুলো মহুর্তেই বিলীন হয়ে গেল। বেঁচে থাকলে শিশুগুলো আগামীকাল বিকেলেও হয়ত কানামাছি আর পুতুল খেলায় মেতে উঠতো।
সারাদিনের কাজ শেষে অলস বিকেলে উঠোনে বসে রমনীরা একে অপরের চুলে বেণী বাঁধার পাশাপাশি তাদের সোয়ামীদের নিয়ে গল্পে মেতে উঠতেন। পুরুষেরা সারাদিন মাঠে কাজ শেষে এই সময়ে হাতে গোনা কিছু টাকা নিয়ে হাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতেন...।
আমার হঠাৎ গায়ক রিক্সাওয়ালার গানটাই মনে পড়ে গেল- "আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দেরে তুই....। " মনে মনে বললাম তবে টর্নেডো, সিডর, আইলার মত ধ্বংসলীলা চালিয়ে এইভাবে সব শেষ করে দিসনে।
নিহত মানুষগুলির আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
আল্লাহ তাদের জান্নাত দান করুন।
আমীন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।