আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কতো বড়ো হয়ে যাই আমি, সেই প্রথমবার

কিছুক্ষণ আগে আমি ঘুম থেকে জেগে উঠেছি। জানালায় দাঁড়িয়ে দেখি, বাইরে বৃষ্টির ধারা শেষ হলো। মনে হলো যেন আমি তাকে স্বপ্নে দেখেছি। পাঁচ বছর আগে, এমনই দিনে, কী মধুর কণ্ঠে সেদিন তুমি গান গেয়েছিলে! সে কথাই আবার মনে দোলা দিয়ে গেলো। হাতে হাত রেখে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে আমরা... আমি সেই কথাগুলোই ভাবছি।

দূরের তারারা যদি আমার কথা শুনতে পেত, সেকি কানে কানে বলতো না, কী ভালোই না আমি তাকে বেসেছি? বাতাসের সঙ্গে বয়ে যাওয়া সেই স্মৃতিগুলো আজও মনের গভীর কোণে লুকিয়ে আছে। আমি অস্তগামী সূর্যে পরিণত হতে চাই, তবুও যদি তার একজন হিসেবে সব জায়গায় তার কাছাকাছি থাকতে পারি, তাকে অপরিবর্তিত উষ্ণতা দিতে পারি। আমি জোছনা হতে চাই, যাতে তাকে নিবিড় করে টেনে নিতে পারি। যার কথা বলছি সে মন্দারমণি, অথবা কে জানে সে হয়তো সে, যাকে স্বপ্নে দেখে এই মাঝ রাতে ধরমড়িয়ে ঘুম ভেঙে গেল। জানি না আজ কেনো মন্দারমনি আর তাকে এক মনে হয়।

মহাকালের মিনার হয়ে ফিওে ফিওে আসে, বালি-ফেনায় মাখা গর্জনের নির্জনতায় এক ফালি অবহেলিত বালুভূমি। অনেকটা বড়োবাড়ির কিশোরী কাজের মেয়ের মতো। যার কুমারী স্তন বেড়ে উঠেছিল সকলের আগোচরেই। শুধু আমি যেন এক লম্পট গৃহপুত্র, দেখে ফেলেছিলাম জীর্ণ আঁচলের তলায় তার মৃদুমন্দ দোলা। তাও প্রায় বছর পাঁচেক আগে।

ফলে এখনকার সঙ্গে তার আর হয়তো কোনো মিলই নেই। থাকার কথাও নয়। সময় বড়ো দ্রুতই বদলে যাচ্ছে। তার চেয়ে দ্রুত বদলে যাচ্ছে সভ্যতার আগ্রাসনের সীমা। তবুও ভাবতে ভালো লাগে এই সমুদ্র গায়ে মেখে একদিন নিজেকে কতো ধন্য ভেবেছিলাম আমি।

সেই প্রথমবার। সেই আমার প্রথম সমুদ্রস্নান। মন্দারমণিতে। মান্দারমণি সমুদ্র সৈকত। বেড়ানোর আজব ঠিকানা।

কাঁথি-দিঘা রাস্তায় চাউলখোলা স্টপেজ থেকে বাম দিকে ২০ কিমি গেলেই অন্ত সৌন্দর্যখনি, ঢেউ ও পাখিদের কলরবে মুখর ধু... ধু... সমুদ্রসৈকত। কক্সবাজারের নাম অনেক শুনেছি, কিন্তু সেখানে আমার যাওয়া হয়নি তখনও। বাংলাদেশের গর্ব যে সুবিস্তৃত সমুদ্রসৈকত, তাকেই দেখা হয়নি। তাই এইভাবে চলে আসা মন্দারমণিতে। বাড়ি থেকে পালিয়ে।

প্রস্তুতি ছাড়াই। ফলে ঢেউ ভেঙে ভেঙে খুব বেশিদূর এগুতে পারি না। অনভ্যস্ত পা। কষ্ট করে যাও বা এগুই ঢেউ আমাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে আসে ডাঙায়, যেন ফিরিয়ে দিয়ে যায়। বলে, ‘ওরে কোথায় যাচ্ছিস, যুবে যাবি যে’? আমি ভাবি, বড় বড় সৈকতের কথা―পুরী, গোয়া, কোভালম আর না দেখেও যে সব থেকে আপন, কক্সবাজার।

আচ্ছা এর চেয়ে কতো বিশাল সেগুলো (!)? অনেক নিশ্চয়? ঢেউ বুঝি আরো মস্ত প্রলঙ্কর কিছু। পরে কোভালম ছাড়া আর সবেরই স্বাদ নিয়েছি। ছোটো কাউকেই করছি না। তবু মন্দারমণির তুলনা যে আর কারও সাথে হতে পারে সে কথাও মনে আনতে পারি না। মন্দারমনির ঢেউয়ের হার্দ আলিঙ্গন, সে কখনো ভোলার নয়।

বিশাল এক ঢেউয়ের তলায় চাপা পড়ি আমি, নোনা জলে চোখ জ্বালা করে ওঠে। একই তো সমুদ্র, পড়ে থাকা বালি, দূরে তটরেখা বরাবর ঝাউ। আমি যেন কতো দেখেছি! সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে এক করে নিই। চোখে বালি ঢোকে কিচকিচ। আচ্ছা হবে হয়তো আলাদা, সেরা কোনো একটা কিছু হবে, এতো যে কবিতা-টবিতা লেখা হলো, গান-টান আরো কতো কী, সে কি আর এমনি।

ওপারের বাসিন্দা হয়েও শক্তির চোখে কক্সবাজারের যে রূপ, সম্ভুনাথ গোয়াকে যে চোখে দেখেছেন, আর রবীন্দ্রসাহিত্যের বিরাট অংশ নিয়ে যে কাশি, এছাড়াও আরো আরো সবার চোখে সমুদ্রের যে রূপের কথা এতোদিন পড়েছি, সে দিকে মন দিই না আমি। যেন খুঁজে নিতে চাই আরো আলাদা কিছুর স্বাদ, এই মন্দারমণির সৈকতে। কিন্তু আমিতো এখানে নতুন, তাই কিছুই চিনি না। আর ওর নাড়ি-নক্ষত্র সব জানা। ও-ই বলছিলো, ‘ছোট ছোট চারটি গ্রাম নিয়ে এই মন্দারমণি।

দাদনপাত্রবার, সোনামুই, মন্দারমণি...। ’ চতুর্থ গ্রামের নামটি ভুলে গেছি। কতোদিনই আর হবে, এর মধ্যেই ভুলে গেলাম। আশ্চর্য। স্মৃতি বড়োই বিশ্বাসঘাতক।

সেদিন মোহিতর সাথে গল্পকরার সময় হড়হড় করে বলে গেলাম সব গ্রামের নাম, অথচ আজ লিখবার বেলায় কিছুতেই মনে পড়ছে না। এই তো বেশ চোখের সামনে ভাসছে পাশাপাশি ছোট্ট ছোট্ট সব গ্রামগুলো। ও বলছিল, আগে সমুদ্র বেশ দূরে ছিল এই গ্রামগুলো থেকে, ফসলী জমি থেকে, পুকুরভরা মাছেদের থেকে। ধীরে ধীরে সমুদ্র এগিয়েছে। জনপদের দিকে।

ফসলের মাঠ, গৃহস্থের সংসার ঘর-বাড়ি-পুকুর, গোয়ালের গরু, ছাগল একে একে সব সব গেছে সমুদ্রের পেটে যেটুকু বাকি আছে, এখন তাতে মানুষের বসতি, তবে এও কদিন আছে বলা যায় না। সমুদ্রের গর্জন অহনিশি জানান দেয়, আমি আর দূরে নেই, একদম দূরে নেই। সমুদ্রতীরবর্তী সব গ্রামে স্বাভাবিকভাবেই ছিল বেশ কিছু নোনা জলের বেড়ি। রোজভ্যালির মালিকেরা মন্দারমণিতে মাছের ব্যবসা করতে গিয়েছিলেন বছর পঁচিশেক আগে। সস্তায় জমি কিনে মাছের বেড়ি করলেন তারা।

একটি দুটি ঘর তৈরি হলো, একটি গেস্টহাউস। যেখানে মাছ কিনতে আসা লোকজন রাত্রিযাপন করতো। সৈকতের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁরা নিজেদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদেরও নিয়ে আসতে লাগলো। ঘর বাড়তে লাগলো গেস্টহাউসের। আর কিছুদিনের মধ্যেই সেই গস্টেহাউস রূপ নিলো এক চারতারা হোটেলের।

সমুদ্রের একেবারে ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সেই হোটেল। মাছের ব্যবসা করতে আসা রোজভ্যালি সেখানে শুরু করলো হোটেলব্যবসা। দেখাদেখি সেখানে দাঁড়িয়ে গেলো আরও কিছু হোটেল, কটেজ। রমরমা ব্যবসা। শনি-রবি কোনো হোটেলে কটেজে একটি ঘরও খালি থাকে না এখন―জানালো গার্ডেন রিট্রিট নামের রঙচঙে কটেজের কেয়ারটেকার কাম ম্যানেজার রমেশ বাবু।

পাঁচখানা ঘর নিয়ে পাঁচমাস আগে হয়েছে এই গার্ডেন রিট্রিট কটেজ। রাস্তার ধারে খনিকটা জায়গা গোল করে ঘিরে নিয়ে মাথায় খড়ের ছাউনি দিয়ে রিসেপশন কাম সিটিংপ্লেস। পাশেই একটি লম্বাটে ঘরমতো জায়গা, তারও মাথায় খড়েরই ছাউনি। চারপাশ অর্ধেকটা ঘেরা। কাঠের খুঁটির উপরে দাঁড়িয়ে আছে এই খাওয়ার ঘরের ছাউনি।

খাওয়ার ঘরের পাশেই ডানধার ধরে একের পর এক ছোট ছোট এক কামরার ঘর, কটেজ। সাথে একফালি বাথরুম। সারি দিয়ে একের পর এক ঘর। শেষমাথার ঘর দুখানিতে আমরা ঠাই নিয়েছিলাম একবেলার জন্যে। এর চেয়ে বিলাসীতা করার সুযোগ ছিলো না।

যাওয়ার কথা ছিল না তো, হঠাৎ গিয়ে পড়া। অপরিকল্পিত সমুদ্রস্নান, সে জন্য। এই ঘরের পেছনে কাজ চলছে আরও পাঁচখানি ঘরের। তবে এই ঘরগুলি ইটের। কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, লাল ইটের ঘরগুলিও প্রায় তৈরি।

গাঢ় লাল হাফ ইটের দেওয়ালের উপর গাঢ় সবুজ দরমার বেড়া আর মাথায় সাদা খড়ের চাল দেওয়া এই কটেজগুলির পোষাকি নাম ‘গার্ডেন রিট্রিট’। কালো কাঁচের জানালার ধারগুলো সবুজে রাঙানো। কালো কাঁচের মাথা নিচু দরজা আর দুটো করে জানালা। ঘরের ভিতরে ঢুকতেই দেখা গেল খড়ের ঠিক নিচে নীল আর সাদা চৌকো চৌকো খোপকাটা ছাপওয়ালা স্যাটিন কাপড়ের শামিয়ানা টাঙানো। আধো আধো আলো আধাঁরির খেলা সেখানে।

লাল, সবুজ, নীল আর সাদা রঙের সাথে কালো কাচের দরজা জানালা। সব মিলে মিশে সৃষ্টি করেছে এক অদ্ভূত রঙ্গ। গরমটাকে উপেক্ষা করতে পারলে শুধু এই রঙের খেলা দেখেই হয়তো কাটিয়ে দেওয়া যেতো একটি বেলা। কিন্তু না। এই দোজখের ওমকে উপেক্ষা করা গেল না কিছুতেই।

আসবাব বলতে এক প্রশস্ত বিছানা, ছোটো একখানি কাঁচের সাইড টেবিল, আর দুখানি প্লাস্টিকের চেয়ার। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই চোখে পড়ে এক মরা বেগুনের বাগান। এবড়ো-খেবড়ো শুকনো ধুলোময় বালুমাটিতে বাগনসুদ্ধ গাছগুলো মরা। দাঁড়িয়ে আছে কে জানে কার, কিসের সাক্ষী হয়ে। কাদের এই বাগান? এই কটেজ মালিকেরই কি? এখানকার লোকেরা ব্যবসা দেখতে এতোটাই ব্যস্ত, এতোটাই মগ্ন যে, কারোরই একটু সময় হয়নি ঐ গাছেদের গোড়ায় একটু জল দেওয়ার।

শুকিয়ে গেছে তাই এক বাগানভর্তি বেগুনগাছ। মরা বেগুনের বাগানের পাশেই সবুজ পত্রবহুল এক নিমগাছ। নেহাত বড়ো বলে এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচেছে। কী অদ্ভূত! মন্দারমণিতে তখনও বিদ্যুৎ পৌছায়নি। তাতে কওে খুব একটা যে অসুবিধা হয়, তা না।

জেনারেটর আছে। আছে সমুদ্রের নন স্টপ সিম্ফনি। হোটেল, কটেজ সবই চলে জেনারেটরে। নামমাত্র খরচে যে যেভাবে পারে যেখানে সেখানে কটেজ তুলে দাঁড়িয়ে পড়েছে ব্যবসা করতে। দরমার বেড়া, খড়ের চালের মাথানিচু সেই সব কটেজে ঢুকলে নরকের আগুনের আঁচ খানিকটা টের পাওয়া যায়।

জেনারেটরে চলা পাখার বাতাস যেনো আগুন ছড়ায় সেই কটেজে। যারা চার অংকে বিল মেটাতে পারে তাঁরা ওঠে রোজভ্যালির চারতারা হোটেলে, সেখানে ঘরগুলো তাপানুকুল। আমাদের মতো পাতিমধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তের কলেজ পড়–য়া ঘরপালানো ছেলের সম্বল ঐ জাহান্নামসম কটেজ। অবাক হয়ে দেখলাম, একমাত্র থাকার জায়গা ছাড়া ওখানে আর সবকিছুই পাওয়া যায় বেশ সস্তায়। পাওয়া যায় কেননা, সেখানে এই করেই করে খাচ্ছে বেশকিছু মানুষ।

কেউ বা দিয়েছে বিস্কুট, সফট ড্রিংকস, চিপসের দোকান; তো কেউ কিনেছে গাড়ি। মারুতি ভ্যান, টাটাসুমো, নিদেনপক্ষে একটি অ্যাম্বাসেডর। গাড়ি কেনার টাকা এসেছে ফসলি জমি বিক্রি করে। সেইসব জমি আবার কিনে সেখানে ঢালাও চলছে মাছের ব্যবসা, তৈরি হয়েছে সব বেড়ি। বাগদা, পোনা, তেলাপিয়ারা সেখানে বড় হয় মানুষের দেওয়া খাবার খেয়ে।

জমি বিক্রি করে যাঁরা গাড়ি কিনেছে তারা ভালোই করে খাচ্ছে। প্রায় দশ কিলোমিটার রাস্তা কলকাতা দীঘা মহাসড়ক থেকে। যেতে হয় চাউলখোলায় নেমে। টেকার আর ইঞ্জিনচালিত ভ্যান রিক্সা ছাড়া যাতায়াতের একমাত্র সম্বল এই গাড়িগুলি। চড়া ভাড়ায় দল বেঁধে মানুষ চাপে এই গাড়িগুলোতে।

হোটেল, কটেজের সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ির মালিকেরা। বেড়াতে আসা যাত্রীদের পৌঁছে দিয়ে আসে এরা কাঁথি, জুনপুট, কিংবা দীঘা পর্যন্ত। দশ কিলোমিটার দূরের চাউলখোলায় যেতে একটি মারুতী ভ্যান ভাড়া নেয় দুশো পঞ্চাশ টাকা, কাঁথি নিয়ে গেলে নেয় সাড়ে চারশো টাকা। যাঁরা ফোন করে হোটেল কটেজ বুক করে আসেন, তাঁরা চাইলে এই সব গাড়িগুলো এসে তাঁদের নিয়ে যায় কাঁথি, জুনপুট কিংবা দীঘা থেকে। ভাঙা এবড়ো-থেবড়ো রাস্তার ঝাঁকুনি কিংবা ধুলো থেকে অনেকটাই বাঁচিয়ে দেয় এই গাড়ি।

গরমের কথা বলাই বাহুল্য। এই সৈকত তখন লোকের বেশ নজরে পড়ে গেছে, ফলে স্ননাভিলাষীদের যাওয়া আসা শুরু হয়েছে ভালোভাবেই। সমুদ্র পাড়ের চেনা দৃশ্য কোথায় হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, না ট্রলার নৌকা, না শুটকির গন্ধ। স্নানাভিলাষীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে স্নান করেন সমুদ্রে। ঢেউএর পরে ঢেউ এসে ভাঙে আর উচ্ছ্বাস বাড়ে স্নানরত ছেলে-মেয়েদের।

নারী ও পুরুষদের। বাবার হাত ধরে সমুদ্রস্নান করতে আসা ছোট্ট শিশুটি হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে খেলা করে জল নিয়ে, তার খিলখিল হাসির শব্দ চাপা পড়ে সমুদ্রের গর্জনে। সৈকতময় ভাঙা-গোটা ঝিনুকদের মাঝে ইতঃস্তত দাঁড়িয়ে দু-তিনটি ডাবওয়ালা। সাইকেলের পেছনে ঝোলানো কাঁদি কাঁদি ডাব আর সামনে ঝোলানো বাজারের থলেতে বিয়ার। একটি ডাব খেতে হলে খরচ করতে হবে দশটি টাকা, আর বিয়ারের দাম আশি।

বেলা বারোটার জ্বলন্ত সূর্যের গনগনে তাপকে উপেক্ষা করে স্নানে মগ্ন কিছু মানুষ। সৈকত ধরে মাঝে মাঝেই ছুটে যাচ্ছে গাড়ি। টাটা, সুমো, কোয়ালিস, সাফারি। এমাথা থেকে ওমাথায়। কলেজ পালিয়ে কলকাতা থেকে আসা এক দল ছেলে-মেয়ে জলে হুটোপুটি করতে করতে নিজেদের মধ্যেই তামাশা করে, এখন কোন ক্লাস চলছে? আজকে কোন কোন ক্লাস ছিল? বাড়ি গিয়ে সব ঠিকঠাক বলতে হবে তো।

তাদের হাসির শব্দে চাপা পড়ে সমুদ্রের গর্জন। অবাক হয়ে দেখি ছোটো বড়ো নানা সাইজের নানা আকারের অজস্র অজস্র ঝিনুক ছড়িয়ে আছে সৈকতে। কেউ কুড়য়ে নিচ্ছে না। কুড়িয়ে নেওয়ার কেউ নেই। প্রতিটি ঢেউ-এর সাথেই আসছে আরও ঝিনুক।

ছোট্ট নুড়ির মত দেখতে আস্ত ঝিনুকও দেখলাম কিছু, অ্যাত্ত নরম যে হাতে নেওয়ামাত্রই ভেঙে যায়। সৈকতে যদ্দুর ঢেউ আছড়ে পড়ছে, তদ্দুর অব্দি বালি ঠা-া, ভেজা ভেজা। আর তারপরেই শুকনো, তপ্ত। খালি পা রাখতেই মনে হয় যেন ফোস্কা পড়ে যায়। এই গরম বালিতেও কিছু মানুষ বসে আছে।

কেউ বেড়াতে এসেছে, কেউ বা ওখানকারই লোক। দুজন মানুষকে দেখলাম খানিকটা বালি সরিয়ে তাতে প্লাষ্টিক বিছিয়ে জল ঢেলে দিয়েছে দু-তিন গামলা। ছোট্ট, খুব ছোট্ট এক পুকুর যেন। তাতে কিলবিল কিলবিল করছে ভীষণ ছোট্ট সব মাছ, ইঞ্চি দুই-তিন লম্বা সাপ। মানুষটি বসে বসে কিছু একটা বেছে আলাদা করছে আর সেই আলাদা করে তুলে রাখা অতি ক্ষুদ্র মাছগুলি তুলে রাখছে পাশেই রাখা প্লাস্টিকের গামলাভর্তি জলে।

খানিক দাঁড়িয়ে বেঝার চেষ্টা করেও বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করবো ভেবেও কিছু বললাম না, একাগ্র মানুষটির মনোযোগ নষ্ট করতে মন চাইল না বলে। ডাবওয়ালারা ভিজে গামছা গায়ে মাথায় জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে গরম বালিতে। বিচের দিকে এগুনো যেকোনো মানুষকে দেখেই এগিয়ে আসছে সাইকেল নিয়ে, ‘ডাব খান বাবু ডাব। ডাব খাবেন না? তবে বিয়ার খান’। ‘তোমরা বিয়ারও রাখো’? জানতে চাইলে জবাব এলো, ‘হ্যাঁ, রাখি।

যা চান সবই পাবেন। কি চাই বলুন’। ও অন্য কিছু ইঙ্গিত করলো বুঝি। ওরা এসবও করে। আর না করেই বা উপায় কী? শুধু এই এক ব্যবসাতে পেট চলে না।

তাই ওটাই আসল, আর এটি বাড়তি হিসেবে গন্য হয়। সব বুঝেও না বোঝার ভান করতে হলো। ‘না আমার কিছুই চাই না, এমনি’; বলে চলে আসবার বেলায় শেষ কথাটার প্রতিক্রিয়া দেখলাম ওর চোখেমুখে। কিছুক্ষণ কেমন যেন কটমট করে তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে। আমার বেশ মজাই লাগছিলো, আরও কিছু বলতাম হয়তো, কিন্তু হলো না।

পেছন থেকে ও এসে এমনভাবে টানাটানি করতে লাগলো যে, চলে এলাম। দেখলাম একজন মাঝবয়সী পুরুষ ট্যক্সি ড্রাইভারের সাথে দামদর করছে আর তার স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে প্রখর রৌদ্রে অস্থির পায়চারি করছে। যাবার তাড়া আছে বোধহয়। অথচ আজ সকালেই ওদের বাস থেকে নামতে দেখেছি। এ রকম অনেকেই আছে একবেলার জন্যে এসে ঘুরে যায় মন্দারমণিতে।

গাড়ি করে সকাল সকাল এসে ঘুরে বেড়িয়ে, সমুদ্রস্নান করে আবার ফিরে যাওয়া জুনপুট, দীঘা কিংবা কলকাতায়। আসবেই বা না কেন? এমনটি আর কোথায় পাবে? চমৎকার দীর্ঘ সৈকত, প্রবল গর্জনে আছড়ে পড়া সমুদ্র আর দূরে বিস্তৃত নারকেল বন। একটু নীরবতাপ্রর্থীদের বেড়াতে আসার জন্যে আদর্শ স্থান। সাথে গাড়ি থাকলে ঘুরে আসা যায় আঠারো কিলোমিটার লম্বা এই বিচ, যার সাথে সাথেই এগিয়েছে নারকেলের বনও। গাড়ি না থাকলে চুপটি করে বসে পড়া যায় কোথাও একটা জায়গা দেখে নিয়ে।

তবে যারা রাত্রিবাস করবে না তাঁদের এখানে বেলা বেশি না করাটাই শ্রেয়। নইলে মিস করতে হতে পারে কলকাতা ফেরার সাড়ে চারটের লাস্ট বাসটি। যেমন আমরা করেছিলাম। তারপর? যেকোনো একটি গাড়ির জন্য অপেক্ষার হা পিত্যেশ। অবশ্য তা উপরে উপরে।

ভেতরে ভেতরে আমি বেশ মজাই পাচ্ছিলাম। তখন বয়স আর কতো, বিষ-একুশ। আর প্রায় সমবয়সী এক মেয়ে আছে সাথে। যেনোতেনো প্রকারে রাতটা এখানে কাটানো গেলে ভালোই হয়। ও খুব রাগ করে আছে।

গভীর রাতে জানালায় গিয়ে চুপি চুপি ডাকলে সে কি আর না করতে পারবে? তখন আপন মানুষটিকে আরও আপন করে নিয়ে নিমিষেই মিটিয়ে দেওয়া যাবে রাগ-বিরাগের দেনাপানা। যাহোক আমার চাওয়াটাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হলো। সন্ধ্যা হলো খানিক বাদেই, সময় বুঝে আকাশের কোণে দেখা দিলো ঘন, কালো মেঘ। দেখতে দেখতেই তা ছড়িয়ে যায় গোটা আকাশে, দেয়শুরু করলো গুরুগম্ভীর ডাক, আর নেমে এলো অঝোর বৃষ্টি। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে কোনোমতে দাঁড়িয়ে থাকা, টিনের চাল ভেদ করে বৃষ্টির ফোটারা এসে মাথায় পড়ে টুপটাপ টুপটাপ।

অনেক রাতে (প্রায় একটা দেড়টার কম নয়) দুজন গা জুড়াতে চলে গেলাম সৈকতে। একেবারে সমুদ্রের ধার ঘেষে দাঁড়ালাম। একদিকে সমুদ্র, দুধারে বন আর পেছনে কিছুটা দূরে লোকালয়; পায়ের নিচে নির্জন সৈকতের প্রবাল আর পাথরে সেই সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে সফেদ ফেনা তুলে গর্জে উঠছে সাপের মতো, আর এখানে কেয়া আর নিশিন্দার ঝোপ, বালুর মাঝখানে শ্যাওলা সবুজ এক ডোবা, ডোবার ধারে ঠেসমূলগুলো দাঁড়িয়ে আছে অনবদ্য ভাস্কর্যের মতো, বালুর ওপর ছোটাছুটি করছে লাল কাঁকড়া, গিরগিটি, পড়ে আছে রঙিন শামুক, মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে গাঙচিল আর সেই অপরূপ জনমানবহীন সৈকতে আমি অনেকক্ষণ হেঁটে বেড়ালাম ওর হাত ধরে। এখানকার সমুদ্র কক্সবাজারের মতো শান্ত, বাধ্য আর একই ভঙ্গিতে বালুর ওপর বারবার ফিরে আসা জলরাশি নয়, এখানে সমুদ্র মুহুর্তে মুহুর্তে তার রূপ পাল্টায়। সকালে মন্দারমণির অপরিসর পাথুরে সৈকতে পা ফেলে ফেলে হেঁটে আসা আর বুড়ো চাচার বাঁশের দোকানে পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি ডাবের পানি খাওয়ার স্মৃতি, আবিশ্বাস্য মনে হয় রাতে।

তার একটু পরই বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে দেখি, এই রাতে কোথায় সেই পাথুরে সৈকত আর কোথায়ই বা বুড়ো চাচার দোকান? সব কিছু ভেঙেচুরে অসম্ভব রাগে গর্জে উঠতে উঠতে ততক্ষণে একেবারে নীড়ের পায়ের কাছে চলে এসেছে সমুদ্র, যেন এখনই গিলে খাবে গোটা জনবসতি, আর রাতের অন্ধকারে ঢেউয়ের মাথায় লাফিয়ে ওঠা সফেদ শুভ্র ফেলা ধুন্দুমারের মতো এগিয়ে আসতে আসতে এমনকি অনেক ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা পা দুটো ভিজিয়ে দেয় সরোষে। সাগরের এমন রূপ এর আগে তো কখনো দেখিনি। আর তার গর্জনও এমন শুনিনি আগে কখনো। টর্চের আলো নিভিয়ে ফেলি। অমনি সমস্ত চরাচর বেষ্টন করে আলোয় আলোকময় হয়ে ওঠে তারাগুলো।

তারার আলোয় কেমন রহস্যময় এক আবহের সৃষ্টি হয়। মনটাও বেশ বেয়াড়া হয়ে ওঠে। তেমনি বেয়াড়া এক আবদার করে ওর কাছে প্রত্যাখ্যাত হই। মনে হয়, ও ইচ্ছা করেই এমনটি করলো বুঝি। এমন কী বলেছি আমি! চাইলেই কি পারতো না সে আমার কথা রাখতে? খুব খারাপ লাগে, ও আমাকে ইচ্ছা করে অপমান করেছে ভেবে।

ভেতরে কি এক পশু জেগে ওঠে। রাগ করে ওকে চলে যেতে বলি। ও চলেও যায়। আমি অপলক তাকিয়ে থাকি ওর গমনপথের দিকে। পেছন থেকে অভিমানি ওকে দেখতে ঠিক পার্বতীর মতো লাগে।

দেবদাস কঞ্চির আঁচড়ে কপাল কেটে দিয়েছে, অভিমানি মানস মুরারী আমার ধীর পায়ে চলে যাচ্ছে। বারবার মনে হয়, ও শেষ পর্যন্ত ফিরে আসবে বুঝি। কিছুদূর যাবার পর ওর গতি আরও খানিকটা শ্লথ হয়ে আসে। হয়তো সে আমার আহ্বানের প্রতীক্ষা করে। একবার ডাকলেই ফিরতো বুঝি।

এখন বুঝি, সেদিন বুঝিনি। শেষ পর্যন্ত ও চলে গেলে মনটা খুব খারাপ হয়। একা অনেক্ষণ বসে থাকি নির্জন সৈকতে। তারপর ঘরে ফিরে মন্দারমণির সমুদ্রের গান শুনতে শুনতে প্রশান্ত এক ঘুম ঘুমিয়ে নিয়ে খুব সকালে উঠেই তৈরি হয়ে নেই। ওর আর খোজ করি না।

দরকার কি? প্রয়োজন মনে করলে সেই আমাকে খুজে নিক। ওর দরজার সামনে দিয়ে আসবার বেলা দেখি দরজায় তালা ঝুলছে। সে আমাকে না ডেকেই বেরিয়ে গেছে। এতো দেমাগ ওর। মনটা বিষিয়ে ওঠে, একা একা বেরিয়ে পড়ি সৈকতে।

পর্যটকের ভিড় না থাকায় মনে হয়, এখন আমিই মন্দারমণির একমাত্র মানবসন্তান। এভাবে অনেকক্ষণ কারো সাথে দেখা নেই। একা নির্জন সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে মনটা ভালো হয়ে যায়। কখন যেন ক্ষমা করে দিই ওকে। মনে হয় ওর আর দোষ কি।

আমার আবদারটা তো সত্যিই বড়ো বেশি বেয়াড়া ছিলো। ওকে খুজতে খুজতে নিশিন্দা ঝোপের কাছে, সমুদ্রের একবারে বুকের ভেতর চলে আসি। কতো লক্ষ-কোটি কিলোমিটার পেরিয়ে আসা হাওয়া লাগে গায়ে। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিই, দুই হাত দুই দিকে বাড়িয়ে আকাশটাকে ধরার চেষ্টা করি। এমন নির্জন প্রকৃতি সচরাচর মেলে না।

গোটা মন্দারমণি ঘুরে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসতে আধঘণ্টাও লাগে না। সমুদ্রের কিনার ঘেঁষে ঘুরতে ঘুরতে মন্দারমণির মধ্যবর্তি অংশে একবার ঢুঁ মারতে গিয়ে পিলে চমকে যায়। এখানে কেয়া ঝোপের আড়ালে রয়েছে শ্যাওলা সবুজ এক জলাশয়, লতাগুল্ম আর বুনোঝোপের মধ্যে ঠিক বিদেশি ছবিতে দেখা কোনো গা ছমছম করা জংলা চোরাবালির মতো দেখতে। জোয়ার ভাটার খেলায় চোখের সামনে ভেসে আর ডুবে যেতে দেখি প্রবাল আর পাথরগুলোকে। তারপর অনেকক্ষণ এদিক সেদিক ওর খোজ করি।

খুজে না পেয়ে একবার একাই ডিঙ্গি নৌকায় মাঝ সমুদ্রে বেড়াতে যাই। উত্তাল সাগরে নৌকায় চড়ার অনভিজ্ঞতা রীতিমত ভয় পাইয়ে দেয়। যখন বিশাল বিশাল ঢেউ ছুটে এসে গোটা নৌকাটাকে গিলে ফেলতে চায় বা উথাল-পাথাল করে দেয়, আমার প্রাণ চলে যায় হাতের মুঠোয়, গুলুইয়ের কাঠ শক্ত করে চেপে ধরে কোনো মতে প্রাণ রক্ষা করি। অথচ নৌকার মাঝি হেসেই উড়িয়ে দেয়, ‘শহরের রাস্তায় উঁচা-নিচা থাকে না? ধইরা নেন এইডাও তাই। আরে ঢেউ না থাকলি আবার সমুদ্র কিয়ের?’ অবাক হই প্রাণঘাতি ঢেউ-এর প্রতি মানুষের এমন নিস্পৃহতায়।

মানুষ যে কেনো মানুষ তখন যেন বেশ বুঝতে পারি! বেলা বাড়ার সাথে সাথেই দেখা যায়, চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু মানুষ। কেউ বসে আছে একেবারে জলের ধারটি ঘেঁষে, কোলে একেবারেই ছোট বাচ্চা। কর্তা গিন্নি দুজনেই জলের ধারে বসে আছে। ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিলে যেটুকু স্নান হয় ওটুকুতেই তারা খুশি। স্কুল পড়–য়া তিনটি ছেলে হাতে একটা বল নিয়ে নেমে গেছে অনেকটা জলে।

ঢেউএর সাথে সাথে ওরা ডুবছে ভাসছে। হাতের বল ছুড়ে দিচ্ছে এক অন্যের দিকে, গায়ে না পড়ে বল পড়ে যাচ্ছে জলে আর ঢেউ এর মাথায় চড়ে সেই বল সরে যাচ্ছে ছেলেগুলোর থেকে দূরে। ওরা হুল্লোড় করতে করতে জলের উপর গা ভাসিয়ে পৌছানার চেষ্টা করছে বলের কাছে। বল হাতে এলেই আবার ছুড়ে দিচ্ছে কখনও সঙ্গীর দিকে তো কখনও আরেকটু দুরে গভীর জলের দিকে। আর তারপর মহানন্দে ঢেউ-এর মাথায় চড়ে চড়ে যাচ্ছে সেই বল আনতে।

মাঝে মাঝে দেখাও যাচ্ছে না ওদের। আবার দেখা যায় ঐ যে! ওরা লাফাচ্ছে বলের পেছনে! আমার মনে হলো এভাবে সমুদ্র স্নান করতে এসে ডুবে যায় অনেকে। মাঝে মাঝে খবরের কাগজে থাকে সেই সব খবর। কিন্তু ঐ বাচ্চাগুলোর কোনোদিকে কোনো খেয়ালই নেই। বিশাল উঁচু উঁচু ঢেউ-এর মাথায় চেপে চেপে তারা চলে যাচ্ছে দূরে আরও দূরে।

মায়ের হাত ধরে পুকুরে নামতেই ভয় পায় যে বাচ্চারা তারা এখানে কত্তো সাহসী! ভাবতে অবাক লাগে, সমুদ্র কেমন নিমিষেই মানুষকে আমুল বদলে দিতে পারে। কতো দুর্বার করে তোলে। সেদিনও ফেরা হল না। রাত নেমে এলো। জীবনানন্দের কবিতার মতো গাঢ় ম্যাটম্যাটে কালো রাত।

তখন প্রায় দশটা। অথচও তখনো ওর দরজায় তালা ঝুলছে। একাকী মেয়েটা গেল কোথায়? খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো আর খারাপ লাগছিল। তাই রাতের খাবার অল্প খেয়েই হোটেলের পেছনে চলে যাই একাকী। আঁকাশে চাঁদ নেই।

চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার, পায়ের নিচে বালি, উপরে রাতের তারা ভরা আকাশ, পেছনে আমাদের অবকাশস্থল আর সামনে মন্দারমনি। আমি দাঁড়িয়ে আছি সমুদ্র সৈকতে। এখানকার সমুদ্র কক্সবাজারের মতো গর্জন না করলেও কী এক তীব্র আর্তনাদ করে অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে সৈকতে। আঁধারে দেখা যাচ্ছে না, তবে ওদের আগমন অনুভব করতে পারছি। আমি যেদিকে তাকিয়ে আছি, সেদিক বরাবর যদি যেতে পারতাম তবে মন্দারমণি অতিক্রম করে ভারত মহাসাগরের উপর দিয়ে ওপারে এন্টার্টিকাতে পৌছতাম।

খোলা আকাশের দিকে তাকালাম। মেঘমুক্ত আকাশে তারা মিট মিট করছে, পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি আমাদের নিহারিকা আকাশগঙ্গাকে। এই আকাশ আমাদের সময়ের আকাশ নয়। এ কোটি কোটি বছর আগের আকাশ। অথবা তারও বেশি।

আমাদের সময়ের আকাশ দেখতে চাইলে, আরো কয়েক কোটি বছর অপেক্ষা করতে হবে। কি বৈচিত্র্যময় এ জগৎ! অতীত বর্তমান একই সাথে চলছে! পায়ের নিচে সৈকতের বালিকনা। রসায়ন পড়েছি বলে জানি, এ বালিকনা আসলে সিলিকন-ডাই-অক্সাইড। একটি সিলিকন পরমানুর কথা চিন্তা করলেই, জগতের সবকিছু নাই হয়ে যায়। চোখের সামনে ভেসে উঠে পরমানুটির কক্ষপথে পরিভ্রমনরত ইলেকট্রন ও কেন্দ্রের নিউক্লিয়াস।

জগতের সবকিছুই এর সামনে কেমন অর্থহীন মনে হয। সামনের বিশাল সমুদ্র আর পায়ের নিচের সিলিকন পরমানুর কথা ভেবে সেই প্রথম মনে হয় মহাবিশ্বের তুলনায় কতো ক্ষুদ্রই না আমার অস্তিত্ব। এই সিলিকন কনার চেয়েও ক্ষুদ্র কি? হবে হয়তো! তবুও তো এই অতিক্ষুদ্র অংশেরই অতিক্ষুদ্র কিছু বিষয় নিয়ে মেতে থাকি সারাদিন, সারারাত, এমন কী সারাটি জীবন। জগতের এতো সব বৈচিত্র্যকে ছাপিয়ে কী সব তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে আমার জীবন। ঐ বিষয়গুলোও এক এক সময় এক এক রকম।

কখনও ক্যারিয়ার ভাবনা, কখনও নারীর প্রেম, আবার কখনও সেই নারীরই হটকারিতা, কখনও গোষ্ঠিগত স্বার্থ, কখনও সাময়িক ভালোলাগা বা লালসা, অথবা কখনও বা কোনো অজানা কারণে মন খারাপ থাকা। সামগ্রিক জগতের সামনে এই বিষয়গুলো কতোই না ক্ষুদ্র! নিজের উপরই হাসি আসছিল, বোধহয় হেসেও উঠছিলাম একাকী। তারপর একটু উঁচু একটা জায়গা দেখে চটি রেখে এগিয়ে যাই জলের দিকে। ঝিনুক কুড়োতে কুড়োতে। দুহাত ভরে উঠে নিমিষেই।

এতো ঝিনুক, এতো এতো ঝিনুক! যেটি পছন্দ হয় না ফেলে দিয়ে আরেকটা নিই, সেটি ফেলে দিয়ে আবার আরেকটা। বাছা বাছা ঝিনুকে হাত ভরে ওঠে। এভাবে ঝিনুক কুড়াতে কুড়াতে একসময় মনে হয়― থাক, কী হবে ঝিনুক দিয়ে! কটা ঝিনুক আমি সাজিয়ে রাখব? সামনে অপার সমুদ্র, বিছিয়ে আছে এক সাগর জল নিয়ে। শুয়ে আছে। ঘোলাটে জল নিয়ে ধুসর সমুদ্র বিছিয়ে আছে দৃষ্টিসীমার বাইরে অব্দি।

এই সমুদ্রকে, এই বিছিয়ে থাকা বিস্তীর্ন জলরাশিকে এখানে হাত বাড়ালেই ছোয়া যায়! সত্যি সত্যি ছোয়া যায়! হাতে নেওয়া যায় আজলা ভর্তি জল! যদিও নিমিষেই আবার তা গড়িয়ে নেমে যায় সাগরেই! একমুঠো বালি তুলে আনি আমি জলের ভেতর থেকে, মুঠো খোলার আগেই বালি নেমে যায় জলের সাথে। আমি দেখতে পাই আমার হাতে ছোট্ট এক নুড়ি আর একটা ছোট্ট ঝিনুক, জ্যান্ত! আমি ওকে আবার জলেই ফিরিয়ে দিই, নুড়িটিকেও। সমুদ্রের সন্তান ওরা, থাক ওরা এখানেই। নিজের ভেতরে কী এক হয়ে যায় যেন, সীমাহীন সমুদ্র, চিরচেনা এই আমাকে আমুল বদলে দেয়, বুক ভরে শ্বাস নিই, দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়াই সমুদ্রের মুখোমুখি। এই সমুদ্র গায়ে মেখে কতো বড়ো হয়ে যাই আমি, সেই প্রথমবার।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।