আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

Part-4) 'ট্রানজিট'-এর সহজপাঠ। ট্রানজিট ও করিডোর কি, ভারতকে ট্রানজিট না করিডোর দেওয়া হলো?

7.ট্রানসিট স্বাধীনতার আগে ও পরে: বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিজ দীপু মনি এবং এ দেশের ভারতপন্থী বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদ ও সুশীল (?) শ্রেণীর হালের প্রিয় শব্দ কানেক্টিভিটি। ইংরেজি connectivity শব্দটি connect থেকে এসেছে। কানেক্ট-এর বাংলা আভিধানিক অর্থ সংযুক্ত করা বা সম্বন্ধ স্থাপন করা। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিটের মাধ্যমে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্বের সাত রাজ্যের যোগাযোগের ব্যবস্থা বা পড়হহবপঃ করা আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রটির দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা। সাবেক পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান যেমন ভৌগোলিকভাবে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিল, সাত রাজ্যের সঙ্গে দিল্লির অবস্থাটা সেরকম বিপজ্জনক না হলেও নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিবেচনায় যোগাযোগের একটা বড় সমস্যা তাদেরও জন্মাবধি রয়েছে।

বর্তমান অবস্থায় শিলিগুড়ির কথিত চিকেন নেক (chicken neck) অংশটি কোনো কারণে কাটা পড়লে সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাত রাজ্য দিল্লি থেকে সাবেক পাকিস্তানের দুই অংশের মতোই পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাছাড়া বর্তমান অবস্থাতেও বিদ্রোহকবলিত সাত রাজ্যের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যয়বহুল, বিপজ্জনক এবং সামরিক কৌশলগত বিবেচনায় সর্বদাই ঝুঁকিপূর্ণ। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভেঙে দুটো আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভারতের শাসকশ্রেণী তাদের গুরুতর এই সমস্যার সমাধানে নানারকম কৌশল প্রয়োগ করে চলেছে। ১৯৭১ সালে ভারতের সহায়তায় উপমহাদেশে বাংলাদেশ নামক তৃতীয় স্বাধীন ভূখণ্ডের অভ্যুদয় তাদের দীর্ঘদিনের মাথা ব্যথা নিরাময়ের এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। পাকিস্তানি পরাজিত দখলদার বাহিনী ভারত ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে।

আমাদের বিজয়ের সাড়ে ছয় মাসের মাথায় ভারত তত্কালীন বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে বন্যাকবলিত কাছাড় জেলায় জরুরি পণ্য পরিবহনের জন্য সর্বপ্রথম নৌ-ট্রানজিট সুবিধাটি আদায় করে নেয়। সেই সময় আসামে ভয়াবহ বন্যার ফলে কাছাড়ের সঙ্গে রাজ্যের বাকি অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসের ১ তারিখে ভারত সরকার নৌ-ট্রানজিট সংক্রান্ত নিম্নোক্ত প্রেসনোট জারি করে : "Press note issued by the Government of India declaring that essential supplies to Cachar district will be allowed through Bangladesh waterways. New Delhi, July 1, 1972 Transit facilities to Indian steamers from Calcutta or Gauhati to Cachar district in Assam through Bangladesh waterways have been made available following clearance by the Government of Bangladesh. The Union Ministry of Shipping and Transport has directed the Central Inland Water Transport Corporation Ltd., a public sector undertaking, to arrange movement of essential supplies to the region. The Government of India have greatly appreciated the gesture of the Bangladesh Government. It may be recalled that surface communications between Cachar district and the rest of the country have been virtually cut off due to the devastating floods caused by the Brahmaputra and Barak rivers in Assam. The use of Bangladesh waterways will facilitate the movement of essential supplies to the flood-affected region." (কাছাড় জেলায় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য পরিবহনের নিমিত্ত বাংলাদেশের নৌপথ ব্যবহারের সম্মতি লাভের বিষয়ে ভারত সরকারের প্রেসনোট। নয়াদিল্লি, জুলাই ১, ১৯৭২ বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিপ্রাপ্ত হওয়ায় ভারতীয় জাহাজ কলকাতা অথবা গৌহাটি থেকে আসামের কাছাড় জেলায় চলাচলের জন্য বাংলাদেশের নৌপথ ব্যবহারের ট্রানজিট সুবিধা লাভ করেছে। কেন্দ্রীয় শিপিং ও ট্রান্সপোর্ট মন্ত্রণালয় সরকারি খাতের প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন লিমিটেডকে ওই এলাকায় অত্যাবশকীয় পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে।

এই পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য, ব্রহ্মপুত্র এবং বরাক নদীর ভয়াবহ বন্যার ফলে কাছাড় জেলার সঙ্গে দেশের বাকি অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের নৌপথের এই ব্যবহার বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলে জরুরি ত্রাণসামগ্রী পরিবহনে সহায়তা করবে। ) একই বছর নভেম্বরের ১ তারিখে ঢাকায় চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ভারতকে বাংলাদেশের অভ্যন্তর দিয়ে অন্যান্য রুটে তাদের পণ্য চলাচলের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে নৌ ট্রানজিট প্রদান করা হয়। 'Protocol between the Government of India and the Government of Bangladesh on Inland Water Transit and Trade' শিরোনামের চুক্তিতে বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষে স্বাক্ষর করেন দুই দেশের তত্কালীন নৌ মন্ত্রণালয় সচিব যথাক্রমে এস জেড খান (S. Z. Khan) এবং এমজি পিম্পুটকার (M. G. Pimputkar)।

নৌ ট্রানজিট চুক্তিতে দুই দেশের মধ্যকার ১৯৭২ সালের ২৯ মার্চ তারিখে সম্পাদিত বাণিজ্য চুক্তির অনুচ্ছেদ ৫-এর উল্লেখের বিষয়টি তাত্পর্যপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী। নয়াদিল্লিতে স্বাক্ষরিত 'Trade Agreement between the Government of India and the Government of Bangladesh' শিরোনামের সেই চুক্তির Article 5 অর্থাত্ ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে— 'The two Governments agree to make mutually beneficial arrangements for the use of their waterways, railways and roadways for commerce between the two countries and for passage of goods between two places in one country through the territory of the other.' অনুচ্ছেদ -৫ (দুই সরকার এই মর্মে সম্মত হচ্ছে যে, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে সহায়তা প্রদান এবং একটি দেশের এক অংশ থেকে পার্শ্ববর্তী দেশের ভেতর দিয়ে সেই দেশের অপর অংশে পণ্য পরিবহনের লক্ষ্যে উভয় সরকার পারস্পরিক লাভালাভের ভিত্তিতে যার যার দেশের নৌপথ, রেলপথ এবং সড়কপথ ব্যবহারোপযোগী করবে। ) ভারতের একতরফা স্বার্থপূরণে প্রণীত উপরিউক্ত চুক্তিতে ভারত ও বাংলাদেশের দুই তত্কালীন বাণিজ্যমন্ত্রী এল. এন. মিশ্র (L. N. Misra) ও এম আর সিদ্দিকী (M. R. Siddiqui) স্বাক্ষর করেছিলেন। বাংলাদেশের এক অংশ থেকে অপর অংশে ভারতের মধ্য দিয়ে যাওয়ার কোনোরকম ভৌগোলিক প্রয়োজনীয়তা না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনগণকে ধোঁকা দিয়ে কেবল ভারতের স্বার্থ মেটানোর জন্যই বাণিজ্য চুক্তিতে এই উদ্ভট অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করা হয়। পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, ১৯৭২ সালে প্রণীত তিনটি উল্লিখিত চুক্তির কোনোটিতেই কানেক্টিভিটি শব্দটি কোথাও ব্যবহার করা হয়নি।

এই শব্দটি ভারতের বাংলাদেশীয় দালালদের সাম্প্রতিক আবিষ্কার। আমার কাছে এসব চুক্তির যে কাগজপত্র রয়েছে, সেখানে তারিখ সংক্রান্ত একটি বিভ্রান্তিও আমি খুঁজে পেয়েছি, যার উল্লেখ সঠিক ইতিহাস রচনার স্বার্থেই প্রয়োজন বিবেচনা করছি। নভেম্বরের নৌ-ট্রানজিট চুক্তিতে আগের বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের তারিখ ২৯ মার্চ, ১৯৭২ উল্লেখ থাকলেও দিল্লিতে সেই চুক্তি প্রকৃতপক্ষে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২৮ মার্চ। ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যমন্ত্রী ললিত নারায়ণ মিশ্র ২৯ মার্চ ভারতীয় লোকসভায় বাংলাদেশের সঙ্গে তার দেশের আগের দিনের চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে বিবৃতি প্রদান করেছিলেন মাত্র। আমার ধারণা, নৌ-ট্রানজিট চুক্তির খসড়া প্রণয়নকারীরা পরবর্তীকালে তারিখ গুলিয়ে ফেলেছিলেন।

8.ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ইশতেহারে ট্রানজিট: দিল্লির দীর্ঘদিনের চাওয়া ছিল ঢাকার কাছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের জল ও স্থলভাগ ব্যবহারের সুযোগ। তবে রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেয়নি ঢাকা। বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতা গ্রহণের পর দিলি্লর সঙ্গে ঢাকার বরফ গলতে শুরু করে। বিশেষত রাজখোয়াসহ আসামের শীর্ষ উলফা নেতাদের ভারতের কাছে প্রত্যর্পণ করার পর দিলি্ল-ঢাকার সম্পর্কে যে বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। চলতি বছরের গোড়ার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন।

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময়, ১১ জানুয়ারি, দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ৫০ দফা যৌথ ইশতেহারে উভয় দেশ স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশের কাছ থেকে ভারতের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ_দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের জল ও স্থলভাগ ব্যবহারের অনুমতি। ভারতের সেই কাঙ্ক্ষিত উদ্বেগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশমন করেছেন যৌথ ইশতেহারে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের জল ও স্থলভাগের অনুমতি প্রদান করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আশুগঞ্জকে 'পোর্ট অব কল' ঘোষণা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ভারতকে ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে বাংলাদেশ দিলি্লর টেনশন প্রশমন করেছে।

বিগত বিএনপি আমলে ভারত আশুগঞ্জ নদীবন্দরকে ত্রিপুরায় পণ্য পাঠানোর জন্য ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছিল, তবে খালেদা সরকার ভারতের সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। সেবার ভারত ত্রিপুরার পালটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ভারী সরঞ্জামবাহিত কনটেইনার, যা ওডিসি (ওভার ডাইমেনশনাল কনসাইনমেন্ট) নামে খ্যাত, পাঠানোর অনুমতি নাকচ হয়ে যায়। ভারতের দাবি ছিল, ওডিসি পণ্য আশুগঞ্জ বন্দর দিয়ে নদীপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। এরপর বাংলাদেশের সড়কব্যবস্থা ব্যবহার করে ত্রিপুরায় পেঁৗছে যাবে। তবে সে সময় দিল্লির প্রস্তাবে রাজি হয়নি ঢাকা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে বোঝা যাচ্ছিল, দিল্লি-ঢাকা সম্পর্ক আগের হিসাব-নিকাশের মধ্যে থাকবে না। তার ফল দেখা গেল ৫০ দফা মনমোহন-হাসিনা যৌথ ইশতেহারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-মহমোহন সমঝোতা স্মারকের ২৩ নম্বর দফা আশুগঞ্জকে শুধু ওডিসি সুবিধাই দেয়নি, বরং এই নদীবন্দরটিকে পোর্ট অব কল ঘোষণা করে সার্বক্ষণিক পণ্য পরিবহনের সুযোগ প্রদান করা হয়েছে। আর এ জন্য দেশের মধ্যকার বিদ্যমান সব নদীপথের ট্রানজিটের আইনি বাধা অপসারণের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। আইনি বাধা অপসারণের পাশাপাশি আশুগঞ্জ থেকে ত্রিপুরার সড়কপথ প্রশস্ত করা হচ্ছে।

দিলি্ল এখন থেকে ওডিসি পরিবহনের সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাবে। আশুগঞ্জের পর ভারতকে মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে যৌথ ইশতেহারে। ইশতেহারের ২৩ নম্বর দফায় এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ভারতের পণ্য পরিবহনের কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রেল ও সড়কপথের উন্নয়ন প্রয়োজন। বাংলাদেশের রেল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবন থেকে একটি রেললাইন অচিরেই বসতে যাচ্ছে, যা ভারতের পণ্য পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হবে।

ভারতের পণ্য পরিবহন গতিশীল রাখার জন্য যৌথ ইশতেহারের ২৪ নম্বর দফায় আখাউড়া ও আগরতলার মধ্যে ট্রেন চালুর বিষয়ে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশের এজেন্ডা হিসেবে আরেকটি ইস্যু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যৌথ ইশতেহারের ২৬ নম্বর দফায়। সেখানে বলা হয়েছে, নেপালে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহারের জন্য রোহনপুর-সিঙ্গাবাদ ব্রডগেজ রেলওয়ে লাইন ব্যবহার করা হবে। এ বিষয়ে ভারতও সম্মত, কিন্তু বাস্তবায়নে অগ্রগতি নেই। যৌথ ইশতেহারের ৩৮ নম্বর দফায় বাংলাদেশকে রেলওয়ে, নদীপথ ও সড়কপথে অবকাঠামো উন্নয়নে ভারতের ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার ঘোষণা রয়েছে।

এটা একক কোনো দেশকে ভারতের সর্বোচ্চ পরিমাণ ঋণসহায়তা। যৌথ ইশতেহারের ২৩ নম্বর দফায় ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই দুটি বন্দর ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন করতে ভারতকে সড়ক ও রেলপথ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার কথাও এই দফায় বলা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর এবং আশুগঞ্জ নদীবন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ভারত যাতে ট্রানজিট কার্যকর করতে পারে, তার বাস্তবায়নে কোনো বিলম্ব না করে কারিগরি সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে বাংলাদেশ। যেমন ট্রানজিট কিংবা ট্রান্সশিপমেন্ট চালু হলে তার জন্য বাংলাদেশকে ভাড়া বাবদ যে রাজস্ব দেবে ভারত তার হার নির্ধারণ করে সদ্যঘোষিত বাজেটের পরপরই এসআরও জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

এই ঘোষণায় প্রতি টন পণ্য ট্রানজিট কিংবা ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য রাজস্ব হার নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে এক টন লোহা পরিবহনের জন্যও এক হাজার আবার এক টন সোনা পরিবহনের জন্যও এক হাজার টাকা রাজস্ব দিলেই চলবে! এনবিআর ঘোষিত এসআরও মোতাবেক, ভারত তাদের দেশের যানবাহন ব্যবহার করে পণ্য আনা-নেওয়া করলে তাকে ট্রানজিট এবং বাংলাদেশের যানবাহন ব্যবহার করলে সেটাকে ট্রান্সশিপমেন্ট বলা হবে। উভয় ক্ষেত্রেই রাজস্বের পরিমাণ একই অর্থাৎ প্রতি টনে এক হাজার টাকা। তবে রাজনৈতিক মহলে বহুল আলোচিত করিডরের কোনো সংজ্ঞা এনবিআর না দিলেও বলা যায়, বাংলাদেশ যদি ভারতকে কোনো একটি রাস্তা ব্যবহারে অনির্দিষ্টকাল কিংবা নির্ধারিত সময়ের জন্য লিজ দিয়ে দেয় যার ওপর বাংলাদেশের কোনো সার্বভৌম অধিকার থাকে না কিংবা বাংলাদেশের যানবাহনও ওই রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে পারে না, সেটাকেই করিডর বলা হবে। সুতরাং এটা স্পষ্ট, যৌথ ইশতেহারের মাধ্যমে ভারতকে কোনোভাবেই করিডর দেওয়া হচ্ছে না।

ট্রানজিট কিংবা ট্রান্সশিপমেন্ট দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে বাস্তবে মনে হচ্ছে, চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর এবং আশুগঞ্জ নদীবন্দর ব্যবহার করে ভারত কার্যত তাদের পণ্য ট্রান্সশিপমেন্টই করতে পারবে। এক নজরে হাসিনা-মনমোহন সিং এর যৌথ ঘোষণা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে গিয়েছেন। সেখানে বিভিন্ন পর্যায়ে ভারত সরকারের সাথে আলোচনা হয়েছে। চলছে নানা জল্পনা।

দেশ বিদেশে মানুষের দৃষ্টি এখন ভারতে দুই দেশের যৌথ ঘোষণার দিকে। উভয় পক্ষই মিলিয়ে দেখছে লাভ ক্ষতির খতিয়ান। ১১ জানুয়ারি রাতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধান মন্ত্রী মনমোহন সিং দেড় ঘন্টাব্যাপী বৈঠকে শেষে ১২ জানুয়ারি মঙ্গলবার প্রদত্ত যৌথ ঘোষণার আলোকে এক নজরে কিছু তথ্যঃ ১। ভারতকে মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেবে বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশকে রহনপুর-সিঙ্গাবাদ রেলপথ দিয়ে নেপাল যাবার ট্রানজিট দিয়েছে ভারত।

২। যোগাযোগ ও নদী ব্যবস্থাপনায় ১০০ কোটি ডলারের একটি সহযোগিতা তহবিল দেবে ভারত। তবে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে কোনও চুক্তি হয়নি। ১২ জানুয়ারি মঙ্গলবার বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বিবৃতিতে এসব কথা জানানো হয়েছে। ৩।

বাংলাদেশর ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবেলায় ভারতীয় গ্রিড থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। ৪। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে কোনও চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেনি দু'দেশ। এ প্রসঙ্গে যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, আগামী মার্চের মধ্যে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক শেষে এ বিষয়ে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ৫।

বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্র ও স্থলসীমার বিরোধ নিরসনে আশু পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে দুদেশ। ৬। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা, শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশ, বাংলাদেশর জন্য ট্যারিফ-ননট্যারিফ বাউন্ডারি তুলে দেয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে একমত হয়েছে প্রতিবেশী দু'দেশ। ৭। ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মার্ণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করবে বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন।

9.ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট কিংবা করিডরের জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতি: ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট কিংবা করিডোর- যে সুবিধাই দেয়া হোক না কেন, এ জন্য বাংলাদেশের সড়ক ও রেল অবকাঠামো কতটা প্রস্তুত সে সম্পর্কে অবশ্যই প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান সড়ক অবকাঠামো নিজস্ব পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে কীরূপ পর্যাপ্ত তা প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি। এরূপ একটি অবস্থায় প্রতিদিন নতুন করে শত শত ভারতীয় পরিবহন একই অবকাঠামোয় প্রবেশ করলে পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে? ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যাচ্ছে, কমবেশি প্রায় ১৫শ’ ট্রাক (প্রতিটি কমবেশি ১৫ টন) ‘ট্রানজিট’ বা করিডর সুবিধা পেলে প্রতিদিন বাংলাদেশ অতিক্রম করবে। ট্রানজিটের জন্য যেসব রুটের প্রস্তাব করা হচ্ছে সেখানে এখন গড়ে চলাচলকারী বাংলাদেশি পণ্যবাহী যানের সংখ্যা দৈনিক প্রায় ৭৫০টি অর্থাৎ ট্রানজিটের পর নির্দিষ্ট রুটে দৈনিক গড়ে পণ্যবাহী যানের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ২ হাজার ২৫০ যা বর্তমান পরিমাণের চেয়ে তিনগুণ বেশি। ট্রানজিট বা করিডোরের সম্ভাব্য ৮টি রুট নিয়ে ভাবনা-চিন্তা হচ্ছে বলে জানা যায়।

বাংলাবান্ধা-তামাবিল এবং বাংলাবান্ধা-আখাউড়া ছাড়া ট্রানজিট বা করিডোরের বাকি ছয়টি প্রস্তাবিত রুটে ঢাকাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সামগ্রিকভাবে এবং বিশেষভাবে ঢাকায় আমাদের বিদ্যমান সড়ক অবকাঠামো উপরোক্ত বাড়তি পণ্যবাহী যান চলাচলের জন্য কতটা তৈরি? আমাদের যমুনা সেতু কি ভারতীয় হেভি ভেইকলগুলোর ভার বহন করতে সক্ষম? সেভাবে কি আদৌ এই সেতু নির্মাণ করা হয়েছে? ‘ট্রানজিট’ সুবিধার আওতায় ভারত যেসব হেভি মেশিনারী পরিবহন করবে তা সাধারণ ট্রাকের পরিবর্তে অনেক বড় বড় কনটেইনার ক্যারিয়ারে পরিবহন করা হবে যেগুলোর মোড় পরিবর্তনেরও সুযোগ নেই বাংলাদেশের অনেক সড়কে এবং এগুলো যখন চলাচল করবে তখন পুরো সড়কে স্থানীয় যান চলাচল বন্ধ রাখতে হবে। সম্প্রতি আশুগঞ্জের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিশাল আকৃতির ভারতীয় কনটেইনার ক্যারিয়ার যেহেতু বাংলাদেশের রাস্তায় চলাচলের অনুপযোগী সেকারণে বিপুল কৃষিজমি নষ্ট করে রাস্তাকে ‘উপযোগী’ করা হচ্ছে। এমন সব জায়গা দিয়ে সেখানে নতুনভাবে রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে যার কোন দেশজ প্রয়োজনীয়তা ছিল না। কেবল ভারতীয় প্রয়োজনেই সেখানে স্থানীয় মানুষরা কৃষি জমি খোয়াচ্ছেন।

10. ‘ট্রানজিট’ অবকাঠামোর ব্যয়ভার: ভারত ও বাংলাদেশের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে সম্প্রতি যেসব বৈঠক এবং মনত্মব্য বিনিময় হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে আশুগঞ্জের নিরীক্ষামূলক তৎপরতার পর ‘ট্রানজিট’ কার্যক্রম ব্যাপক আকারে শুরু হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যমান অবকাঠামো যেখানে স্বীয় যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে অপর্যাপ্ত বিবেচিত হচ্ছে সে একই অবকাঠামো ভারতীয় পণ্য চলাচলের জন্য দেয়া যাবে কীভাবে? এক্ষেত্রে একটি বিকল্প হতে পারে ‘সময় সমন্বয়’ অর্থাৎ আমাদের যানের যখন চাপ কম থাকবে তখন তাদের যান চলতে দেয়া। সেক্ষেত্রেও দীর্ঘ রাসত্মায় অনত্মত কয়েকটি স্থানে ভারতীয় যানের জন্য বিশাল জায়গা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পাকিং সুবিধা থাকা আবশ্যক হবে। এরূপ স্থাপনাগুলো নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং এর নিরাপত্তা কাঠামো পরিচালনার সঙ্গে বিপুল ব্যয়ভারের প্রশ্ন জড়িত। সে ব্যয় কে বহন করবে? ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে এরূপ বিশাল পাকিং স্থাপনা নির্মাণের বাস্তব সম্ভাবনা কতটুকু? ভারতীয় যানবাহন বাংলাদেশ ভূখন্ড দিয়ে যাওয়ার সময় নিশ্চিতভাবেই তাদের জ্বালানির প্রয়োজন হবে।

বাংলাদেশে এদেশীয় যানবাহনগুলো যেসব জ্বালানী ব্যবহার করে তাতে সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে। প্রশ্ন থেকে যায়, ভারতীয় যানবাহনগুলোও কি ভর্তুকিপ্রাপ্ত সেই জ্বালানীই ব্যবহার করবে? ভর্তুকি দিয়ে হোক কিংবা ভর্তুকি না দিয়ে হোক যেভাবেই ভারতীয় যানবাহনকে জ্বালানী সরবরাহ করা হোক না কেন তার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে যে বিপুল পরিমাণ বাড়তি জ্বালানীর প্রয়োজন হবে তার উৎস কি হবে? বাংলাদেশ ইতিমধ্যে গ্যাসের সংকটে ভুগছে। বিপুল পরিমাণ ভারতীয় যানকে যদি বর্তমানের সিনজি সরবরাহ করতে হয় তা হলে বাংলাদেশে গ্যাস সংকট সামাল দেয়া যাবে কীভাবে? এতসব বিবেচনা বাদ দিয়ে কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার জন্য কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার এত আগ্রহ যে, তারা বাংলাদেশের অর্থেই ভারতের জন্য প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ করে দিতে উদ্যোগী। এর একটি উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি আমরা দেখেছি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ‘ভারত ট্রানজিট সুবিধা পাবে’ কেবল এমন সম্ভাবনা অনুমান করে ২ হাজার ১০০ কোটি টাকার ১৮টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে দিয়েছে (দ্য ডেইলি স্টার, ২৯ ডিসেম্বর ২০১০)। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (অর্থ) মোশারফ হোসেনের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ‘কেবল ভারতীয় যান পার্ক করা হবে’ - এই প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখেই সেখানে ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ট্রানজিট ইয়ার্ড নির্মাণ করা হচ্ছে এবং এর জন্য সেখানে পার্শ্ববর্তী ঘনবসতিপূর্ণ একটি আবাসিক এলাকা থেকে বসবাসকারীদের উচ্ছেদও করা হচ্ছে।

২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে সেদেশের প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের সঙ্গে ট্রানজিট বিষয়ক যেসব ‘অগ্রগতি’ হয় তার একটি ছিল আশুগঞ্জকে ‘পোর্ট অব কল’ ঘোষণা এবং ভারতীয় পণ্য চলাচলের জন্য সেখানে ৩৬.২৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি ‘ইনল্যান্ড কনটেইনার রিভার পোর্ট’ স্থাপন, ১২০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ‘দ্বিতীয় ভৈরব ও দ্বিতীয় তিতাস সেতু’ নির্মাণ এবং ৩৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে আশুগঞ্জ এলাকার সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন। মূলত আগরতলাসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে বড় আকারে বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের জন্য সেসব এলাকায় ভারী যন্ত্রপাতি নেয়ার কাজে আশুগঞ্জকে ব্যবহার করবে ভারতীয়রা। এই সড়ক দিয়ে ভারতীয় ‘হেভি মেশিনারী’ নেয়ার কাজে ২৮ ও ৩২ চাকার যান ব্যবহার করা হবে- যেসব যানে এক সঙ্গে ৬০-৮০ টন ওজনের যন্ত্রপাতি ওঠানো হবে। এসব বিষয় তদারকের জন্য এমনকি আশুগঞ্জে এখনো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষের স্বতন্ত্র কোন কার্যালয়ও নেই। পুরো প্রক্রিয়াটি সেখানে ভারতীয়রাই তদারক করবে বলে স্থানীয়ভাবে অনুমিত হচ্ছে এবং দেশে গত এক দশক ধরে উচ্চারিত বড় বড় অবকাঠামোধর্মী কোন প্রকল্প আজো আলোর মুল না দেখলেও আশুগঞ্জের অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে শেষ হয়েছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ যখন নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে হলেও ট্রানজিট দেয়া (যেমন, চট্টগ্রাম বন্দর) এবং কোন অবকাঠামোগত উন্নয়নের আগেই ট্রানজিট সুবিধা দেয়া (যেমন, আশুগঞ্জ বন্দর) ইত্যাদি বহুবিধ মনসত্ত্ব কাজ করছে তখন পাশ্ববর্তী মিয়ানমারে দেখা যাচ্ছে, ট্রানজিট সুবিধা পাওয়ার আশায় ভারত শত শত ডলার খরচ করে সে দেশে পরিবহন অবকাঠামো তৈরি, সম্প্রসারণ ও তার সংস্কারে ভূমিকা রাখছে। কার্যত বাংলাদেশেও ব্যাপক ভিত্তিতে ‘ট্রানজিট’ শুরু হওয়া মাত্র প্রতিনিয়ত সড়ক ও রেল অবকাঠামো সংস্কারের প্রয়োজন পড়বে। এক্ষেত্রে নতুন জনবল নিয়োগের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত নতুন সম্পদ সমাবেশের প্রয়োজন। সরকার ট্রানজিট বিষয় পর্যালোচনার জন্য যে ‘কোর কমিটি’ গঠন করেছে তার অভিমত হলো, ভারতীয়দের প্রত্যাশামত পণ্য চলাচলের সুবিধা দিতে হলে বাংলাদেশকে জল, স'ল ও রেলপথের অবকাঠামো উন্নয়নে ৩৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। এর মধ্যে রেলপথের জন্য ব্যয় হবে ১৭ হাজার কোটি টাকা, সড়কপথের জন্য প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা, নৌ-পথে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা, মংলা বন্দর উন্নয়নে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য স'ল বন্দর উন্নয়নে প্রায় পাঁচ শত কোটি টাকা।

(দেখুন, দৈনিক সংবাদ, ১ মার্চ ২০১১) গত কয়েক দশক ধরে ভারত তীব্রভাবে ট্রানজিট সুবিধা চাইলেও ভারতীয় তরফ থেকে এ দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে তেমন কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি, যেমনটি দিয়েছে চীন। সরাসরি কোনো যোগাযোগ স্বার্থ না থাকা সত্ত্বেও চীন এ পর্যন্ত ৭-৮টি বৃহৎ ব্রিজ তৈরি করে দিয়েছে বাংলাদেশে। ভারতের তরফ থেকে তেমন একটি দৃষ্টান্তও নেই বরং ২০১০ সালের আগস্টে ভারত ট্রানজিটের উপরোক্ত কাজে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশকে বিরাট অংকের এক ঋণের বোঝা গছিয়ে দিয়েছে। ভারতের এক্সিম ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ এই ঋণ নিয়েছে। ১০০ কোটি ডলারের এই ঋন দিয়ে বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্য পরিবহণের অবকাঠামো তৈরি করে দেবে, অথচ এই ঋণের সুদ-আসল সবই পরিশোধ করবে বাংলাদেশ!! উপরন্তু ঋনের শর্ত হলো, অবকাঠামো নির্মাণ কাজে বাংলাদেশ যত ধরনের যন্ত্রপাতি ক্রয় করবে সবই ভারত থেকে নিতে হবে।

বাংলাদেশ ভারত থেকে যখন এই ঋন নিতে বাধ্য হচ্ছে তখনি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় যে, অব্যবহৃত পড়ে থাকায় বাংলাদেশের সঙ্গে ১৭৫ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করছে বিশ্বব্যাংক (দেখুন, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১ ডিসেম্বর ২০১০)। উল্লেখ্য, ট্রানজিটের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ এখন ভারত থেকে এক শত কোটি টাকা ঋণ নিলেও দীর্ঘদিন বলা হচ্ছিলো যে, উপরোক্ত এক শত কোটি টাকা ভারত ‘সহায়তা’ হিসেবে দিচ্ছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের পরপরই দেখা গেল এটা আসলে ‘ঋণ সহায়তা’ এবং তা এমন ঋণ যা দিয়ে উন্নয়ন কর্মকান্ডের তাবৎ উপকরণও ঋণ দাতার কাছ থেকেই ক্রয় করতে হবে, অর্থাৎ এটা হলো ‘সাপস্নায়ার্স ক্রেডিট’। আবার এই ঋণে কমিটমেন্ট ফি বলে এমন একটি ফি ধার্য করে রাখা আছে যার তাৎপর্য হলো নির্ধারিত সময়ে (এক বছর) এই ঋণ ব্যবহার না করলে তার জন্যও বাড়তি সুদ দিতে হবে। যার কারণে এটাকে সাপস্নায়ার্স ক্রেডিট ছাড়াও ‘টাইড লোন’ হিসেবেও অভিহিত করা হচ্ছে।

চলবে...............  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.