“আমি নিরালায় একা খুজেঁ ফিরি তারে, স্বপ্নবিলাসী, কল্পনাপ্রবণ আমার আমিরে.........” মেডিকেল কলেজে দেখতে দেখতে কিভাবে যেন প্রায় এক বছর হয়ে গেলো। এতদিন শরীরে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরেছি, এখন সামনে যখন ইয়ার ফাইনাল চলে আসলো তখন চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলাম। আমি যে খুব খারাপ ছাত্র ছিলাম তা নয়, তারপরও কেমন যেনো নার্ভাস লাগা শুরু হলো। মেডিকেলের প্রথম পরীক্ষা থেকেই আমার ভাইভা ভীতি চলে আসছিলো।
আমাদের সময়ের মেডিকেলের পরীক্ষাগুলোর পদ্ধতি এখনকার পদ্ধতি থেকে কিছুটা ভিন্ন।
প্রথম বর্ষে আমাদের বিষয় ছিলো তিনটা। এনাটমি, ফিজিওলজী ও বায়োকেমিস্ট্রি (একসাথে, এখন আলাদা আলাদাভাবে) এবং কমিউনিটি মেডিসিন (এই একটা বিষয়ই প্রতিটি ছাত্র/ছাত্রীকে ফাইনাল বর্ষ পর্যন্ত তাড়া করে)। এনাটমিতে আমাদের ছয়টি কার্ড ছিলো, প্রত্যেকটি কার্ডে আবার অনেকগুলো আইটেম। একইভাবে ফিজিওলজী এবং বায়োকেমিস্ট্রিতেও হয়। প্রতিটি ছাত্র/ছাত্রীকে প্রত্যেকটি কার্ডের সবগুলো আইটেমে আগে পাশ করতে হবে, তারপর কার্ডে।
সবগুলো কার্ড পাশ করলেই তবে বোর্ডের প্রফেশনাল পরীক্ষায় বসা যায় (সাথে অবশ্যই ক্লাসে উপস্থিতির হার কমপক্ষে ৭৫% থাকতে হবে)।
এনাটমিতে একটা কার্ড হচ্ছে এবডুমেন (Abdomen)। ২রা ডিসেম্বর হচ্ছে আমার জন্মদিন (কৌশলে জন্মদিন জানিয়ে দিলাম), সেদিন এবডুমেনের একটা আইটেম ছিলো –টেস্টিস (Testis) এর উপর। আমি ঠিকমতো (Anatomical position) টেস্টিস ধরতে না পারায় reappear (অন্য কোনোদিন পুনরায় এই পরীক্ষা দেওয়া) করে দিলো। আমার সাথে রাসেলও ছিলো (যাকে আমরা ফিস্টু বলে ডাকতাম)।
সবার পরীক্ষা শেষ হলে স্যারকে গিয়ে বললাম, ‘স্যার, আজ আমার জন্মদিন’। স্যারের নাম ছিলো বাবুল পাল। তিনি কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে আইটেমের খাতাটা এনে আমাকে পাশ নম্বর দিয়ে দিলেন আর বললেন, ‘জন্মদিনের পুরস্কার!’ আমার সাথে রাসেলকেও পাশ করে দিলেন। প্রতিক্রিয়া হলো অন্য জায়গা থেকে। মেয়েদের সাথে দেখা হলেই বলতো, ‘কি রে, নিজের টেস্টিসটাও জানিস না কিভাবে থাকে?’ লজ্জায় মরি মরি!!!
সেই এবডুমেন কার্ড ফাইনালেই Surface Marking-এ (জীবন্ত মানুষের শরীরের উপর চক দিয়ে বিভিন্ন organ, vessels আঁকা) আমাকে abdominal aorta আঁকতে বললো।
এটা সাধারণত শরীরের সামনে দিয়ে আঁকা হয়, কিন্তু আমি সামনের লেভেলটা ভুলে গিয়েছিলাম, পিছনের লেভেলটা মনে ছিলো। কিছুক্ষন চিন্তা করে পিছন দিক দিয়েই আঁকলাম। স্যার দেখে কি যেনো চিন্তা করলেন, পাশের স্যারকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোনো বইতে কি পিছন দিক দিয়ে abdominal aorta আঁকার নিয়ম আছে? নিয়াজ তো খুব সুন্দর এঁকেছে, ওকে তো ঝাড়িও মারতে পারছি না’, এরপর আমাকে খুব শান্তভাবে বললেন, ‘সামনের দিকে এঁকে নিয়ে এসো’। আমি প্রমাদ গুনলাম, ফেল আর কেউ আটকাতে পারবে না। আমাদের মডেল ছিলেন আলী হোসেন ভাই, প্রায় ৫ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোক।
তিনি আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলেন কি আঁকতে দিয়েছে। আমি বলার পর দেখিয়ে দিলেন কোন জায়গা থেকে কত পর্যন্ত আঁকতে হবে। তাঁর উপর পূর্ণ ভরসা নিয়ে এঁকে স্যারকে দেখালাম। স্যার আমাকে লেভেল জিজ্ঞেস করলে আমি ভীত কন্ঠে বললাম, ‘সামনের দিকের লেভেল জানলেতো স্যার আগেই আঁকতাম’। স্যার আমার কথা শুনে হঠাৎ করে হেসে দিলেন, বুঝতে পারলেন কি ঘটেছে।
abdominal aorta সম্পর্কিত অন্য প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, আমি পারলাম, পাশ করে গেলাম। এরকম অনেক মজার মজার ঘটনা ছিলো আমাদের পরীক্ষাগুলোতে। এনাটমিতে আমাদের প্রফেসর ছিলেন হাই ফকির স্যার এবং দ্বিজেন্দ্র চন্দ্র দে স্যার। দ্বিজেন স্যার ছিলেন প্রচন্ডরকম নীতিবান মানুষ। পরীক্ষার সময় কখনই কোনো রকম সাহায্য করতেন না, পারলে পাশ, না পারলে ফেল।
তাঁর কাছে ছেলে মেয়ে সবাই সমান। মেয়েরা বেশী স্বাচ্ছন্দবোধ করতো হাই ফকির স্যারের কাছে পরীক্ষা দিতে।
ফিজিওলজীতে আমাদের প্রফেসর ছিলেন কিংবদন্তীতুল্য এম এ হাই স্যার। উনি যদি ভাইভা পরীক্ষার সময় কাউকে গালিগালাজ করতেন, সে ভাইভা বোর্ড থেকে বের হয়ে প্রচন্ড হাসিতে ফেটে পড়তো, কারণ স্যার যাকে গালি দিতেন, সে পাশ করবে নির্ঘাত। যাকে কড়া কিছু বলতেন না, সে সব প্রশ্নের উত্তর দিলেও খুব টেনশনে থাকতো।
বায়োকেমিস্ট্রিতে ছিলেন আরেক খ্যাতিমান প্রফেসর জলিল স্যার। উনিও অনেকটা দ্বিজেন স্যারের মতো, তবে ছাত্র/ছাত্রীদের প্রতি কিছুটা সহানুভুতিশীল ছিলেন। মিজান স্যার ছিলেন কমিউনিটি মেডিসিনে, যাঁর পরিচিতি দেশের সীমানাও ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। আসলে আমরা জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে প্রি-ক্লিনিক্যাল সাইডে এমন সব দিকপালদের পেয়েছিলাম, যাদের সাহচর্যে , ছোঁয়ায় আমাদের ডাক্তার জীবনের ভিত্তিটাই শুধু শক্ত হয়নি, একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠার মূলমন্ত্রটাও পেয়েছিলাম।
প্রথম বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার পরই আমরা মেতে উঠলাম আমাদের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান নিয়ে।
আমাকে বলা হলো কোরিওগ্রাফী করতে হবে। সরাসরি ‘না’ বলার আগে আমি জানতে চাইলাম আমার পার্টনার কে হবে। শাওনের নাম শুনে এককথায় রাজী হয়ে গেলাম। না, প্রেম করবো সে চিন্তা করে নয়, বরং ওর সাথে বোঝাপড়াটা ভালো বলেই রাজী হলাম। ‘নাম রেখেছি বনলতা, যখন দেখেছি’ গানের সাথে আমরা প্রতিদিন প্রাকটিস করতে লাগলাম।
সেই থেকে শাওন হলো আমার ‘বনলতা সেন’। জীবনের প্রথম নাচ অবশ্য খারাপ হয়নি, প্রচুর হাততালি যখন পেলাম, খুব খুব ভালো লাগছিলো, চোখ ভিজে যাচ্ছিল জলে।
শাওনের সাথে আমি-"নাম রেখেছি বনলতা, যখন দেখেছি"
Click This Link
প্রথম বর্ষপূর্তিতে আমাদের সুন্দরী মেয়েরা
প্রথম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানের পরই আমরা ব্যাচেলর ছেলেরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলাম, তখন আমরা দ্বিতীয় বর্ষের সিনিয়র ভাই (ততদিনে প্রথম বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে দিয়েছিলো, একবারেই সবগুলো বিষয় কিভাবে যেনো পাশ করে গেলাম) আর ক্যাম্পাসে মাত্রই জুনিয়র ব্যাচ আসলো (মানে আমাদের কাছে জুনিয়র কিছু সুন্দরী মেয়েরা আসলো)। একমাসের মধ্যেই নবীনবরনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হলো। জুনিয়র ব্যাচের মধ্যে যারা গান, কবিতা বা নাচ জানে তাদেরকে ডাকলাম, যে যা জানে তা করে দেখাতে বলা হলো।
এক শ্যামলা বর্নের হরিনীর মতো চপলমতি মেয়েটি যখন ‘দিয়াশলাই’ কবিতা আবৃত্তি করা শুরু করলো, মনের মধ্যে কি যেন কি ঘটে গেলো। হৈমন্তী গল্পের মতো তখনই বলতে ইচ্ছে করছিলো, ‘আমি ইহাকেই চাই, আমি ইহাকেই চাই’!
Click This Link
জে-৯ (জুনিয়র ব্যাচ)-এর নবীন বরন অনুষ্ঠানে আমরা ক'জনা (এখানে কোথায় আমি, যে দেখাতে পারবে তার জন্য ...............)
(এই লেখাটি হাই ফকির স্যার, দ্বিজেন স্যার, এম এ হাই স্যার, জলিল স্যার এবং মিজান স্যারের প্রতি উৎসর্গকৃত) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।