ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হওয়া লিটনের জরুরি ভিত্তিতে আট ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। চিকিৎসকদের পরামর্শে তাই তার স্বজনরা রক্তের খোঁজে ছুটে যান হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে। তবে সেখানে প্রবেশের আগেই খোকন নামে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি এগিয়ে আসেন। রক্তের প্রয়োজন কি-না জানতে চেয়েই তিনি বলেন, বিশুদ্ধ রক্ত সরবরাহ করেন তিনি। রক্তের বিভিন্ন গ্রুপ জানিয়ে পৃথক দামও বলতে শুরু করেন।
এভাবে খোকন গ্রহীতাকে নানা প্রলোভনে নিয়ে যান অবৈধ ব্লাড ব্যাংকে। উচ্চমূল্যে দূষিত রক্ত বাণ্যিজের দালালি করেন এই খোকন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২১২ নম্বর ওয়ার্ডের সামনে খোকনের মতো বিভিন্ন বেসরকারি ব্লাড ব্যাংকের দালালরা রাতদিন ভিড় জমান মক্কেল ধরার জন্য। রাজধানীর সব সরকারি হাসপাতালের চিত্রই এমনই।
রাজধানীতে নামে-বেনামে গড়ে উঠেছে শতাধিক ব্লাড ব্যাংক।
নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না তারা। দালালদের মাধ্যমে লাল রক্তের কালো বাণিজ্য করছে এ চক্রটি। ব্লাড ব্যাংক থেকে কেনা এসব রক্ত শরীরে পরিসঞ্চালন ঘটিয়ে আপাতত বাড়ি ফিরলেও এ রক্তের মাধ্যমে রোগীরা বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন মরণব্যাধির মারাত্মক সব ভাইরাস। আর অবৈধ ব্লাড ব্যাংকগুলো থেকে রক্ত কিনে এভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে জনজীবন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রক্ত নিয়ে এমন মরণখেলা থামাতে না পারলে এদেশে রক্তবাহিত রোগ মহামারী আকার ধারণ করতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ৪০টির বেশি বেসরকারি ব্লাড ব্যাংক রয়েছে। তবে সারাদেশে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ব্লাড ব্যাংকের সংখ্যা শতাধিক। অবৈধ ব্লাড ব্যাংক তো নিয়ম মানছেই না, তার ওপর লাইসেন্স নিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে বৈধ ব্লাড ব্যাংকগুলো। রক্ত সঞ্চালনের আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত পাঁচটি ঘাতক ব্যাধির জীবাণুর উপস্থিতি পরীক্ষা করার নিয়ম থাকলেও এসব পরীক্ষা করা হয় না। শুধু পেশাদার রক্ত বিক্রেতার কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে তা প্যাকেটজাত ও ফ্রিজবন্দি করেই দায়িত্ব শেষ করা হচ্ছে।
আর এসব দূষিত রক্ত বিক্রি করা হচ্ছে চওড়া মূল্যে।
আইন অনুযায়ী ব্লাড ব্যাংকগুলোয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার, চিকিৎসক পোস্ট ডোনেশন রুম, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগার থাকার কথা থাকলেও এর কোনোটিই নেই ব্লাড ব্যাংকগুলোয়। এ ছাড়াও আইন অনুযায়ী রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রে রক্ত পরিসঞ্চালন বিশেষজ্ঞ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদ, টেকনিক্যাল সুপারভাইজার, নিবন্ধিত নার্স ও ল্যাব সহকারী থাকার নিয়ম থাকলেও এর কোনো বালাই নেই। ব্লাড ব্যাংকগুলোতে রক্তের নমুনা পরীক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদির একটি বিস্তারিত তালিকা, রক্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ প্রণালিসহ অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিস্তারিত ম্যানুয়াল সংরক্ষণ, প্রতি ব্লাড ব্যাংকে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, একজন সার্বক্ষণিক ডিউটি চিকিৎসক, দক্ষ টেকনিশিয়ান, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ, জীবনরক্ষাকারী ওষুধ ও অক্সিজেনের ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক হলেও দু'একটি ছাড়া কোনো ব্লাডব্যাংকেই এর উপস্থিতি নেই। শুধু ব্লাড ব্যাংকের মালিক, নিয়োগ করা দালাল, মার্কেটিং ম্যানেজার আর অফিস সহকারী দিয়েই চলছে সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
রক্ত সরবরাহের সময় রক্তের ব্যাগের গায়ে ডোনারের নাম, নম্বর, সংগ্রহের তারিখ ও পদ্ধতি লেখার প্রমাণিত নিয়ম থাকলেও রক্তের ব্যাগে ইচ্ছামতো তা বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রক্ত পরীক্ষায় চিকিৎসকের স্বাক্ষর আর পরিচিতির জায়গায় অফিস সহকারীরাই স্বাক্ষর করে রিপোর্ট দিচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা জানান, এসব অভিযোগ তাদের কাছে রয়েছে। তবে জনবলের অভাবে তারা অভিযান চালাতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, দেশে বছরে প্রায় ৪ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন।
তবে মিলছে মাত্র আড়াই থেকে ৩ লাখ ব্যাগ রক্ত। এসব রক্তের মধ্যে বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের কার্যক্রমের আওতায় স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়ার মাধ্যমে আসছে ৮০ হাজার ব্যাগ। এর সঙ্গে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে কিছু রক্ত। চাহিদাপূরণের জন্য অবশিষ্ট রক্তের জোগান আসছে পেশাদার রক্তদাতার কাছ থেকে। যার সবটাই জোগান দেয় কথিত ব্লাড ব্যাংকগুলো।
পেশাদার রক্তদাতাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা রক্তে মিলছে মরণব্যাধির সব ভাইরাস। হেপাটাইটিস-বি ও সি, এইচআইভি (এইডস), ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, এনিমিয়াসহ নানা রোগের জীবাণু থাকে পেশাদার রক্তদাতাদের শরীরে। আর এ জীবাণুমিশ্রিত রক্ত অন্যের শরীরে প্রবেশ করে ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। বেঁচে থাকার জন্য রক্ত নিলেও অজান্তেই মরণ জীবাণু বাসা বাঁধছে রক্তগ্রহীতার শরীরে। নিজ প্রয়োজনে এ জীবাণুমিশ্রিত দূষিত রক্ত কিনতে বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
এমন পরিস্থিতিতে 'একের রক্ত অন্যের জীবন, রক্তই হোক আত্মার বাঁধন'_ এ মানবিক স্লোগান বদলে যাচ্ছে। ব্লাড ব্যাংকগুলোর অধিক বাণিজ্য মনোবৃত্তির কারণে রক্ত অন্যের জীবন না হয়ে মৃত্যুদূত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্বাস্থ্য বুলেটিন ২০০৯-এর জরিপে বাংলাদেশের রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্লাড ব্যাংকগুলো থেকে সংগৃহীত রক্তের নমুনায় হেপাটাইটিস-বি ও সি, সিফিলিস ও এইডসের জীবাণু পাওয়া গেছে। ওই বুলেটিনের তথ্যানুযায়ী, পরীক্ষা করা ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৩৪৬ ব্যাগ রক্তের মধ্যে ৩ হাজার ৪২৯ ব্যাগে বিভিন্ন রোগের জীবাণু পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ৮৭ ভাগ ব্যাগের রক্তেই ছিল হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস।
বাকি ব্যাগগুলোর মধ্যে ৩ হাজার ব্যাগে হেপাটাইটিস-সি, ১৪২ ব্যাগে সিফিলিস ও ১৩ ব্যাগে এইচআইভি জীবাণু পাওয়া যায়। যা রক্ত পরিসঞ্চালনের ক্ষেত্রে বেশ উদ্বেগের বিষয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, দেশজুড়ে অর্ধ লক্ষাধিক পেশাদার রক্তদাতা রয়েছেন। এ সংখ্যা ঢাকাতেই শুধু ২৫ হাজারের বেশি। এসব পেশাদার রক্তদাতারা নানা জটিল মরণ ভাইরাসে আক্রান্ত।
তাদের বেশির ভাগ মাদকাসক্ত, হেরোইনসেবী, পতিতা ও নানা ধরনের ভাসমান মানুষ। যাদের জীবনযাত্রার মান একেবারেই নিচে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাহিদা মেটাতে রাজধানীর অবৈধ ব্লাড ব্যাংকগুলো ভাসমান পদ্ধতিতেও রক্ত সংগ্রহ করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আশপাশে গড়ে ওঠা ব্লাড ব্যাংকগুলো রাজধানীর ওসমানী উদ্যান, চাঁনখারপুলসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ভাসমান মানুষের রক্ত সংগ্রহ করে থাকে। তাদের কাছে রাতে বা ভোরে ওসমানী উদ্যানের পুকুরপাড়ে বসে মাদকাসক্ত রক্তদাতারা রক্ত দিয়ে থাকে।
প্রতি ব্যাগ রক্তের জন্য পেশাদার দাতাকে দেওয়া হয় ১০০ টাকা করে। মাদকাসক্তদের ক্ষেত্রে তা আরও কমে আসে। তবে ব্লাড ব্যাংকগুলোতে প্রতি ব্যাগ রক্ত বিক্রি করা হয় চওড়া মূল্যে। এর মধ্যে পজেটিভ গ্রুপের প্রতি ব্যাগ রক্ত ৮০০ টাকা থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা আর নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত ২ থেকে ৩ হাজার টাকা বিক্রি করা হয়। চাহিদা বেশি হলে লাল রক্তের কালো ব্যবসায়ীরা রক্তের দাম আরও বাড়িয়ে দেয়।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, রক্তের এমন অবৈধ বাণিজ্যে বিভিন্ন সময় র্যাব রাজধানী জুড়ে অবৈধ ব্লাড ব্যাংকগুলোয় অভিযান চালিয়েছে। র্যাবের এ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এএইচএম আনোয়ার পাশা সমকালকে বলেন, গত আড়াই বছরে তিনি রাজধানীতে অন্তত ২৪টি অবৈধ ব্লাড ব্যাংকে অভিযান চালিয়েছেন। এসব ব্লাড ব্যাংকের মালিক ও কর্মকর্তাদের জেল-জরিমানা করাসহ প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দেওয়া হয়।
ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশা বলেন, ব্লাড ব্যাংকের কার্যক্রম দেখার দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদফতরের।
তবে র্যাব খবর পেলে অবৈধ ব্লাড ব্যাংকগুলোতে অভিযান চালাবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।