দূর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার কেষ্ট ’৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী বিভিন্ন দক্ষিনপন্থী রাজনৈতিক দল, শান্তি কমিটি, আলবদর ও রাজাকাররা যোগসাজসে বাঙালিদের উপর নিধনযজ্ঞ চালিয়েছিল। এর ব্যাপকতা ও উদ্দেশ্য ‘জেনোসাইড’ হিসাবে চিহ্নিত হয় যা আন্তর্জাতিক আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যারা অপরাধী পরবর্তীতে ক্ষমতার বদৌলতে কিছু খোড়া যুক্তিতে যেমনÑ এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা, ব্যাপক নয় অথবা এসব ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরিণ গোলযোগের প্রতিক্রিয়া, অতএব জেনোসাইড নয় এবং শাস্তিযোগ্যও নয় বলে প্রচার করে এসেছে এবং এর বিচার বাধাগ্রস্ত করেছে। আমাদের দেখা প্রয়োজন, তখনকার বাস্তবতা কি ছিল।
’৭০ এর ডিসেম্বরে ইয়াহিয়া খান একটি স্বচ্ছ নির্বাচন দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু নিরঙ্কুশ বিজয়ী বাঙালিদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করেননি।
নির্বাচনের ফলাফল তাদের সব হিসাবনিকাশ পাল্টে দিলে ভদ্রলোকের মুখোশ ছুড়ে ফেলে তারা দ্রুত স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার দৃষ্টিভঙ্গী তার প্রিয়ভাজন পুর্ব বাংলার সিভিল প্রশাসনের তৎকালীন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ‘হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড্’ বইতে এভাবেই তুলে ধরেছেনÑ ‘আমি এই কালো বাস্টার্ডদের আমাদের উপর শাসন চালাতে দেবনা (পৃষ্ঠা-)। দেননিও, পরিবর্তে বাঙালিদের উপর সেনা বাহিনী লেলিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাঙালিদের প্রতি হানাদারদের দেশের মাটি থেকে উৎখাত করার আহ্বান জানান। এটা ছিল বাঙালিদের উপর পাকিস্তানীদের দুই যুগের নিষ্ঠুর সাম্রাজ্যবাদী আচরণের অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া।
দেশ ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এটা কোন গৃহযুদ্ধ ছিলনা, বাঙালিরা গোটা পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখলের জন্য বিদ্রোহ করেনি, তারা প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে এবং চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য মিত্র বাহিনী গঠন করেছে। এটা যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধ কালে দখলীকৃত ভুমিতে পাকিস্তানীদের সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সমূহ জেনোসাইড এবং অবশ্যই শাস্তিযোগ্য।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের ঐ ভয়াবহ উক্তিটির প্রসঙ্গে আসুন। ’৭১ এর প্রথম দিকে তিনি যখন বাঙালিদের সম্পর্কে কথাটি বলেন তখন বাঙালিরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, অথচ দাম্ভিক পশ্চিম পাকিস্তানীদের দৃষ্টিতে তারা ‘কালো জারজ’।
শুধু ইয়াহিয়া নন, বাঙালিদের সম্পর্কে তার পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট আয়ুবের ধারণাও কিছুমাত্র ভিন্ন ছিলনা। নিজেদের ‘বাজ’ নামে অভিহিত করতে অভ্যস্ত পাকিস্তানী জেনারেল এবং আমলারা বাঙালি মুসলমানদের সম্পর্কে যে কমন ধারণাটি পোষণ করতেন তা হল, এই কালো মানুষগুলো হিন্দু এবং ভারত ওরিয়েন্টেড। তারা এদেশীয় হিন্দু এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রভাবে ইসলাম ও পাকিস্তানী মূল্যবোধের পরিবর্তে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণা পোষণ করে। এমন ধারণার সুত্রপাত সূচনা থেকেই। ১৯৪৮ সালের ফেব্র“য়ারীতে গণপরিষদে ধীরেন্দ্র নাথ যখন বাংলাকে সংসদের অন্যতম ভাষা করার প্রস্তাব করেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের মন্তব্য ছিল, ‘এ প্রশ্ন তোলাই ভুল, এটা আমাদের জীবনমরণ সমস্যা।
পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা থেকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য (পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি- বদরুদ্দীন উমর, পৃষ্ঠা ৫১)। দীর্ঘ দুই যুগে পাকিস্তানীরা কখনো তাদের এই ধারণা থেকে সরে আসেনি। বরং পূর্ব বাংলার বাঙালিদের আবহমান সংস্কৃতি বদলে দিয়ে তারা এ সমস্যার প্রতিকার করতে চেয়েছিল।
এটা জেনোসাইড এবং পাকিস্তানের জনক মোহম্মদ আলী জিন্নাই এর মূল হোতা। ১৯৪৮ সালের ২৮ মার্চ ঢাকায় রেডিও ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি নিজেদের বাঙালি, পাঞ্জাবী, সিন্ধী ইত্যাদি মনে করে শুধু প্রসঙ্গক্রমে নিজেদেরকে পাকিস্তানী মনে করি তাহলে পাকিস্তান ধ্বংস হতে বাধ্য’ (ঐ, পৃষ্ঠা-১২৩)।
অর্থাৎ বাঙালিত্ব ভুলে যেতে হবে, শ্রেফ পাকিস্তানী হতে হবে। এর আগে রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে ২১ মার্চ রেসকোর্সের জনসভায় বাঙালিদের উপর বড় আঘাতটি হেনেছিলেনÑ ‘একথা আপনাদেরকে পরিস্কার ভাবে বলে দেওয়া দরকার যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোন ভাষা নয়। এ ব্যাপারে যদি কেউ আপনাদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে বুঝতে হবে সে হচ্ছে রাষ্ট্রের শত্র“ (ঐ, পৃষ্ঠা-১০৬)। ’ তিনি অসম্ভব বুদ্ধিমান ছিলেন, বৈচিত্রের মধ্যে উদার ফেডারেল ধরনের শক্তিশালী দেশ গড়া যে সম্ভব সেটা বুঝতেননা তা নয়। কিন্তু সব ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার বিপদজনক প্রবণতা থেকে এককেন্দ্রিক দেশ গড়ে, বাঙালিদেরকে দাস-কলোনীর বাসিন্দা বানানোর সুত্রপাত করে যান।
বাঙালিদের জাতি সত্ত্বা ধ্বংস করার অপচেষ্টা পাকিস্তানের দুই যুগে আর কখনো থামেনি। তারা সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব খাটিয়ে বাঙালিদেরকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে পঙ্গু করার উপক্রম করে। পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট ও উভয় প্রদেশের মধ্যে সংখ্যাসাম্য ব্যবস্থা চালু করে এই দুরভিসন্ধির পথ সহজ করা হয়, এর ফলে দেশের সংখ্যাগুরু বাঙালিরা কার্যত সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। কেননা বাংলার মাটিতে ইসলাম ও সংহতির নামে এবং হীনস্বার্থে বাঙালিদের সামস্টিক স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে পশ্চিমা প্রভূদের পাল্লা ভারী করার মত জো-হুকুম মোনেম খান, গোলাম আজমদের প্রাদুর্ভাব লেগেই থাকে। সৌভাগ্যক্রমে এক ব্যক্তি এক ভোটের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত’৭০ এর নির্বাচন এবং ৬- দফার পক্ষে জনসচেতনতা এই দুরভিসন্ধির পথ রুদ্ধ করে দেয়।
শেখ মুজিবের ৬-দফা ছিল স্বায়ত্ত্বশাসনের অত্যন্ত তীক্ষè ও ঋজু ফর্মুলা। পাকিস্তানীরা এর স্বরূপ বুঝতে ভুল করেনি। আয়ুব খান ৬-দফার বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগের হুমকি দেন। পরপরই এখানে আসেন একজন পাকিস্তানী কর্নেল রাও ফরমান আলী খান। কাজ দেখিয়ে দ্রুত মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন।
তাকে পাকিস্তান আর্মির একজন তাত্ত্বিক বলে ধারণা করা হত। বিশেষ উদ্দেশ্যে তাকে এখানে প্লান্ট করা হয়। তার মিশন ছিল যেভাবেই হোক বাঙালি মুসলমানদেরকে ’৪৭ এর যুগে ফিরিয়ে নেয়া, যাতে তারা পাকিস্তানের প্রতি, তাদের কথিত ইসলামের প্রতি প্রশ্নহীনভাবে অবনত হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার অতি বিশ্বাসভাজন এই জেনারেল বাইরে নিপাট ভদ্রলোক, ভিতরে ঠাণ্ডামাথার নৃশংস এক খুনি। অতএব, ইসলামপন্থীদেরকে সংগঠিত করা, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ঠেকানো থেকে শুরু করে ৬-দফার প্রশ্নে শেখ মুজিবকে নমনীয় করাÑ প্রতিটি ক্ষেত্রে তার হিনিয়াস চক্রান্ত যখন ব্যর্থ হয়, তিনিই যে ইয়াহিয়াকে গ্রীন সিগন্যাল দিয়েছিলেন এবং তার পছন্দসই ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ খ্যাত টিক্কা খানকে গভর্নর ও কোর কমান্ডার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন তাতে কোন সন্দেহ থাকেনা, বিশেষত যখন দেখি ৭ মার্চে তিনি টিক্কা খাঁকে সঙ্গে নিয়ে বিমান থেকে ঢাকার মাটিতে অবতরণ করছেন।
তিনি টিক্কার বহু প্রচারিত ‘কসাই’ ভাবমূর্তিকে বাঙালিদের ভীতিগ্রস্ত করার কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন এবং তার হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতার দ্বারা বাঙালিদের ধৃষ্টতাকে ‘মিট্টিতে লুটিয়ে’ দিতে চেয়েছিলেন। অপারেশন সার্চলাইটের আক্রমণ কৌশল তিনি সেভাবেই নির্ধারণ করেছিলেনÑ ‘আঘাত হানতে হবে সর্বোচ্চ ধূর্ততার সাথে, আচমকা, প্রতারণাপূর্ণ ভাবে, প্রচণ্ড গতিতে এবং শক সৃষ্টি করে (উইটনেস্ টু সারেণ্ডার- ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক, পৃষ্ঠা-২২৮)। ’ রাও দায়িত্ব নিয়েছিলেন ঢাকা অপারেশনের, পূর্ণমাত্রায় বাস্তবায়ন করেছিলেন। লজ্জাকর পরাজয় এবং বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতড়ন পর্যন্ত তিনি বাঙালিদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় নিবেদিত ছিলেন। তার সকল পরকল্পনা ও কুকর্মের হুকুমবরদার ছিল জামাতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘ এবং তাদের ডাইহার্ড ছাত্র-যুবকদের নিয়ে গঠিত কুখ্যাত আলবদর বাহিনী।
কেননা তার মিশনের সাথে এদের আশা আকাঙ্খার চমৎকার মিল ছিল। বস্তুত ’৭১ এ ‘রাও ফরমান, জামাত এবং আলবদর’ এই ত্রয়ী কনেকশন অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও ভয়াবহ ছিল।
রাও ফরমান ’৭০ এর মাঝামাঝিতে তার ডাইরিতে লিখেছিলেন, ‘দ্য গ্রীনস অব ইস্ট পাকিস্তান উইল হ্যাভ টু বি পেইন্টেড রেড। ’ যার সরল অর্থ পূর্ব বাংলার সবুজ ভূমিকে অবশ্যই রক্তে রঞ্জিত করা হবে। সংশি¬ষ্ট পাকিস্তানী জেনারেলরা সবাই একই নীতির অনুসারী ছিলেন এবং যথাসময়ে তা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করেছেন।
তারা বাঙালিদের রেস, বাঙালি মানস- যাকে তারা হিন্দুু মানস প্রসূত বলে প্রচার করতে অভ্যস্ত ছিলেন, ধ্বংস করার জন্য জেনোসাইডে মেতে উঠেন। হ্যা, এটা অবশ্যই জেনোসাইড ছিল। জাতিসংঘ কৃত জেনোসাইড এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, কোন ন্যাশনাল, এথনিক, রেসিয়াল অথবা রিলিজিয়াস গ্র“পের সম্পূর্ণ অথবা আংশিক ধ্বংস সাধনের উদ্দেশ্যে যদি গ্র“পের সদস্যদের হত্যা করা হয়, শারিরিক ও মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, উদ্দেশ্য মূলক ভাবে গ্র“পের সদস্যদের জীবন ধারা প্রভাবিত করা হয়, গ্র“পের মধ্যে জন্ম বাধাগ্রস্ত করা হয় এবং কোন গ্র“পের শিশুদের বলপূর্বক ভিন্ন গ্র“পে স্থানান্তর করা হয় তবে তা জেনোসাইড। পাকিস্তানীরা বাঙালি জাতির মূল ধারা বদলে দিতে চেয়েছিল, বাঙালি পুরুষ ও নারীদের অবিশ্বাস্য রকম ব্যাপক সংখ্যায় হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন করেছিল, তাদের ঘর বাড়ি ও সহায় সম্পদ লুঠ ও অগ্নি সংযোগের মাধ্যমে ধ্বংস করেছিল এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের হিন্দু জাতিকে হত্যা ও নিজ দেশ থেকে বিতাড়নের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করার ব্যবস্থা করেছিল। এর প্রতিটি অপরাধই জেনোসাইডের পর্যায়ভুক্ত।
সংশি¬ষ্ট জেনারেলরা তাদের স্থানীয় সহযোগীদের সাথে যোগসাজসে জেনেশুনেই এই অপরাধ সংঘটিত করেছেন। এগুলি এখন প্রকাশিত এবং তার অনেকখানি প্রকাশিত হয়েছে তাদের দ্বারাই।
পরাজয় ও গণহত্যার দায় এড়াতে যেয়ে পাকিস্তানী জেনারেলরা প্রকৃতপক্ষে নিজেরাই পরস্পরকে উলঙ্গ করে ছেড়েছেন। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেখুনÑ জেনারেল নিয়াজী লিখেছেন: (১) টিক্কা খান আঘাত হানলেন, শান্তিপূর্ণ রাত বিলাপ, ক্রন্দন এবং আগুনের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হল। তিনি যেন বিপথগামী দেশবাসী নয় শত্র“র বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছেন।
নিষ্ঠুর অভিযানটি বুখারা, বাগদাদে চেঙ্গিজ খাঁ ও হালাকু খাঁর ধ্বংসযজ্ঞের চেয়েও ভয়াবহ ছিল। (২) টিক্কা খান বেসামরিক লোকদের হত্যা ও পোড়া মাটির নীতি অনুসরণ করেন। আর্মির প্রতি তার নির্দেশ ছিল, আমি মাটি চাই, মানুষ চাইনা। তার নির্দেশ রাও ফরমান আলী ও জাহানজেব আরবাব ঢাকায় উৎসাহের সাথে অক্ষরে অক্ষরে তামিল করেন। (৩) রাও ফরমান আলী ডিসেম্বর ১৫/১৬ তারিখের রাতে ঢাকা ছেড়ে বার্মা অথবা পশ্চিম পাকিস্তানে পালাতে চেয়েছিলেন এই ভয়ে যে, বাঙালি ও বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে মুক্তিবাহিনী তাকে হত্যা করবে (দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান- লে.জে. এএকে নিয়াজী, পৃষ্ঠা ৪৫, ৪৬, ১৯৩)।
তৎকালীন সিভিল প্রশাসনের মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান পাকিস্তানী মিলিটারি একশান সম্পর্কে লিখেছেন: (১) দুর্ভাগ্যক্রমে একটি হত্যামুখী মিলিটারি অপারেশন শুরু করা হয়। (২) জেনারেল নিয়াজী পূর্ব পাকিস্তানের জাতিগত কাঠামো পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ও আর্মি চীফ তার আচরণ সংশোধনের জন্য কিছুই করেননি। (৩) জেনারেল নিয়াজী পূর্ব পাকিস্তানীদেরকে শত্র“ গণ্য করতেন, দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম ব্রিফিংএ বলেছিলেন, ‘আমাকে কেন রেশন ঘাটতির কথা শুনতে হয়। আমরা যুদ্ধের মধ্যে আছি, শত্র“র ভূখণ্ডে আছি।
বার্মায় আমাদের যা কিছু প্রয়োজন হত আমরা মানুষের কাছ থেকে নিয়েছি, আপনারাও মানুষের কাছ থেকে নিয়ে নিন। ’ (৪) পূর্ব পাকিস্তানে রিইনফোর্সমেন্ট ট্রুপস আনা হয়, তাদের মধ্যে সিভিল আর্মড ফোর্সের সদস্যরা ছিল অশিক্ষিত ও ধর্মীয় ভাবাবেগে উদ্বুদ্ধ। তাদের কাছে নিশ্চয়ই ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য বাঙালিদেরকে কাফের হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, ফলে তারা ভাল আচরণ করেনি (হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেডÑ রাও ফরমান আলী খান, বঙ্গানুবাদ: বাংলাদেশের জন্ম, পৃষ্ঠা ৯২, ৯৩, ৯৪)। নিয়াজীর প্রেস সচিব, ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক লিখেছেন: (১) অপারেশন শেষে ২৬ মার্চ প্রত্যুষে ক্যান্টমেন্টে তখন ভিন্ন আমেজ। অরেঞ্জ জুসে চুমুক দিতে দিতে ক্যাপ্টেন চৌধুরী বললেন, বাঙালিদের আচ্ছামত শিক্ষা দেয়া গেছে, অন্তত এক জেনারেশনের জন্য।
মেজর মালিক যোগ করলেন, হা তারা কেবল অস্ত্রের ভাষা বোঝে, তাদের ইতিহাস তাই বলে। (২) ঢাকা আক্রমণের জন্য কেরানিগঞ্জে পাঁচ হাজার বিদ্রোহীর জমায়েত হওয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেল। সাথে সাথে বিদ্রোহীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সাঁড়াশি আক্রমণের পরিকল্পনা সম্পন্ন হল। টার্গেটকে নমনীয় করার জন্য সূর্যোদয়ের আগে কামান দাগা হল। অপারেশন শেষে নিশ্চিত হওয়া গেল যে, নিজেদের কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই টার্গেটকে নিশ্চিহ্ন করা গেছে।
সন্ধ্যায় তিনি অপারেশন কমাণ্ডারের সাথে দেখা করলেন এবং তার রক্ত হিম করা স্বীকারোক্তি শুনলেন যে, সেখানে কোন বিদ্রোহী ছিলনা, কোন অস্ত্র ছিলনা। কেবল গ্রাম্য লোকজনÑ অধিকাংশই মহিলা এবং বৃদ্ধ অবিশ্রান্ত গুলিতে রোস্টেড্ হয়েছে। তার মন্তব্য, এটা দুর্ভাগ্যজনক যে অপারেশন চালানো হয়েছিল যথাযথ গোয়েন্দা অনুসন্ধান ছাড়াই (উইটনেস টু স্যারেণ্ডারÑ সিদ্দিক সালিক, পৃষ্ঠা ৭৮, ৯৪, ৯৫)। পাকিস্তানী জেনারেলদের এই সব স্বীকারোক্তি ’৭১ এর জেনোসাইডের ব্যাপকতা কিছুটা হলেও ফুটিয়ে তোলে। যারা আরো বেশী জানেন, প্রকাশের জন্য তাদের এগিয়ে আসা উচিত।
নতুবা আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছেই ’৭১ এর ভয়াবহতা একসময় হয়ত অবিশ্বাস্য ঠেকবে।
চুকনগর অধ্যায়:
একাত্তরে হানাদার পাকিস্তানীদের দখলদারিত্বে গোটা বাংলাদেশ ছিল বধ্যভূমি। ৫৪ হাজার বর্গমাইল জোড়া এই বিশাল বধ্যভূমির বিশাল এক অংশ এখনো অনুদ্ঘাটিত রয়ে গেছে। ২০ মে’র চুকনগর ট্রাজেডি যা ’৭১ এর গণহত্যার একক বৃহত্তম ঘটনার অন্যতমÑ সে ঘটনাও প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। চুকনগর গণহত্যার প্রকৃতি ছিল কিছুটা ভিন্ন।
সেদিনের ঘটনা প্রবাহে দেখা যায় চুকনগরে পাকিস্তানী আক্রমণের মূল লক্ষ ছিল চুকনগরে আশ্রয় নেয়া লক্ষাধিক শরণার্থীর পুরুষ সদস্য যাদের প্রায় শত ভাগই ছিল হিন্দু। পাকিস্তানীরা বাংলার মাটি থেকে বাঙালি জাতির মূল পরিচয় মুছে দিয়ে সেখানে এক জগাখিচুড়ি পাকিস্তানী জাতি প্রতিস্থাপন করতে চেয়েছিল। এই লক্ষে তারা বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি বাংলাদেশের গোটা হিন্দু কমুনিটিকেও আক্রমণের লক্ষে পরিণত করে। ’৭০ এর নির্বাচনের ফলাফল থেকে তাদের ধারণা হয়েছিল হিন্দুরা বাংলাদেশে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘বাঙালি মানস’ এর পক্ষে ভোট-ব্যাংক। ব্যংকটি ভেঙ্গে দিলে গোটা পাকিস্তানে বাঙালি-চেতনা বিশ্বাসী মানুষ সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে।
শুরু থেকেই এই অপচিন্তা বিদ্যমান ছিল এবং বিভিন্ন পর্যায়ে হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। ’৭১ এ আমরা এর চূড়ান্ত রূপ দেখি। ’৪৭ এর পার্টিশন পর্বে পাঞ্জাবে যা ঘটেছিলÑ কমপ্লিট এভাকুয়েশন, একাত্তরে এসে তারা পুর্ব বাংলায় ঠিক সেটাই করতে যায়।
খুলনায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এখানে হিন্দু নিধন-বিতড়নের সুত্রপাত হয় ১ এপ্রিলের মাঝরাতে।
সাউথ সেন্ট্রাল রোডের চৌমাথার কাছাকাছি মহাদেব চক্রবর্তী, নকুলেশ্বর সাহার দুই পুত্র এবং আরো তিন ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয় যাদের আর্মিরা আগের রাতে আলোচনার নামে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এরা সবাই ছিলেন নিতান্তই সাদামাটা মানুষ। এই ঘটনা হিন্দুদের মধ্যে ভয়াবহ আতংকের জন্ম দেয় এবং করণীয় সম্পর্কে তারা গত কয়েকদিন যে প্রচণ্ড অস্থিরতার মধ্যে ছিলেন তার অবসান ঘটায়। সন্ধ্যার আগেই শহরের সব হিন্দু বাড়ি পরিত্যাক্ত হয়। তারা তখনো আজন্মের পৈতৃক ভিটেমাটি ফেলে ভারতে যাওয়ার কথা ভাবেন নি, সবাই আশ্রয় নেন নিকটবর্তী গ্রামাঞ্চলের আত্মীয়স্বজন অথবা পরিচিতজনের বাড়িতে।
কেননা কেউই তখন ভুলেও ভাবতে পারেননি যে, আগের রাতে ঠাণ্ডা মাথায় ৬ জনের হত্যাকাণ্ড প্রকৃতপক্ষে পূর্ব বাংলার মাটি থেকে একটা ‘এথনিক ক্লিনসিং’ প্রচেষ্টার রক্তাক্ত উদ্বোধন ছিল।
গ্রামে যেয়েও হিন্দুরা রেহাই পায়নি। ইতোমধ্যে অশান্তির চূড়ান্ত করে আর্মির ছত্রছায়ায় তথাকথিত ‘শান্তি কমিটি’ গঠিত হয়েছে। ‘রাজাকার’ নামে লেঠেল বাহিনী গঠিত হয়েছে। তারা আর্মি ও বিহারীদের নিভৃত পল্লীর পথ চিনিয়ে দিয়ে হিন্দু ও আওয়ামী লীগ প্রভাবিত গ্রাম চিহ্নিত করে দিচ্ছে।
চারদিকে হত্যা, লুণ্ঠন, ছিনতাই, নারী ধর্ষণ, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ শুরু হয়েছে। চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে লোকজন এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে এবং শেষ পর্যন্ত বাঁচার তাগিদে ভারতের পথে ভিটে মাটি এবং আশ্রয় ছাড়তে বাধ্য হন। চুকনগর ট্রাজেডির সুত্রপাত এভাবেই। মে’র তৃতীয় সপ্তাহে আর্মিরা বিহারী, রাজাকার এবং শান্তি কমিটির লোকদের নিয়ে নদীপথে দাকোপ, বঠিয়াঘাটা, রামপাল, ডুমুরিয়া, তেরখাদা, ফকিরহাট প্রভৃতি এলাকায় বিভিন্ন গ্রামে প্রাণঘাতী হামলা চালায়। এসব গ্রামে আগে থেকেই বৃহত্তর বরিশাল, ফরিদপুর এবং খুলনার বিভিন্ন এলাকার ছিন্নমূল হিন্দুরা আশ্রয় নিয়েছিল।
গ্রামবাসীদের সাথে তারাও এলাকা উজাড় করে ভারতের পথে চুকনগরে উপস্থিত হয়।
বস্তুত ভদ্রা, কাজীবাছা, খড়িয়া, ঘ্যাংরাইল প্রভৃতি নদী ও শাখানদী পথে এবং কাঁচা রাস্তায় দাকোপ, বটিয়াঘাটা, রামপাল, তেরখাদা ও ফকিরহাট থেকে খুলনা-ডুমুরিয়া হয়ে চুকনগর ছিল সে সময়কার বিবেচনায় ভারতমুখী সর্বাধিক নিরাপদ রুট। অসংখ্য নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন ও সংকীর্ণ কাঁচা মাটির এই পথে আর্মি কনভয় চলাচল সম্ভব ছিলনা। ফলে লোক জন এই পথ বেছে নিত। চুকনগর ছিল ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ এর মত।
আটালিয়া ইউনিয়নের এই এলাকা ছিল খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরার মিলন বিন্দু এবং সেই আমলের সম্মৃদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্র। ভারতের পথে শ্রান্ত ক্লান্ত লোকজন বিশ্রাম, সীমান্ত পর্যন্ত পরবর্তী পথের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়া এবং গাইড ও যানবাহনের সন্ধানে এখানে থামতো। কেননা এই পথের বিভিন্নস্থানে যেমন আর্মি কনভয় চলাচল করতো তেমনই ছিল দালাল লুটেরাদের ভয়। এখান থেকে ভারতে যাওয়ার মূল রুট ছিল মঙ্গলকোট-সরসকাটি-কলারোয়া হয়ে হাটা পথে। ফলে নৌকা এবং বিভিন্ন জিনিষপত্র পানির দামে বেঁচে দিয়ে তাদের হালকা হতে হত।
চুকনগরে মানুষের কাফেলা আগে থেকেই ছিল। কিন্তু মে’র তৃতীয় সপ্তাহে দাকোপ, বটিয়াঘাটা, রামপাল, ডুমুরিয়া প্রভৃতি এলাকা প্রায় একযোগে আক্রান্ত হওয়ায় গ্রাম কি গ্রাম উজাড় করে লোকজন চলে আসতে থাকে। দেবীতলা গ্রামের (বাটিয়াঘাটা) প্রফুল্ল কুমার ঢালী এক সাক্ষাৎকারে বলেন: জ্যৈষ্ঠ মাসের ২ তারিখে (১৭ মে) তাদের পাশের গ্রাম আক্রান্ত হয়, তারা বয়ারডাঙ্গায় আশ্রয় নেন। পরদিন রামপাল ও ফকিরহাট থেকেও দলে দলে হিন্দুরা বয়ারডাঙ্গায় পালিয়ে আসে। এসময় ফুলতলা ও অন্যান্য গ্রাম সহ তাদের গ্রামও আক্রান্ত হয় এবং বহু লোকজনের সাথে তার বৃদ্ধ পঙ্গু বাবাও নিহত হন।
তিনি গ্রামে যেয়ে পার্শ্ববর্তী খালে বাবার লাশ ভাসতে দেখেন। ইতোমধ্যে বয়ারডাঙ্গাও আক্রান্ত হয়। দ্রুত বয়ারডাঙ্গা ফিরে মা, স্ত্রী ও মেয়েদের না পেয়ে উদভ্রান্ত হয়ে তিনি মাইলমারা গ্রামে যান, সেখানও তাদের পাননি। সেখান থেকে ভাই ও বোনদের সাথে নৌকায় ভারতের পথে ডুমুরিয়া বাজারে আসেন। ডুমুরিয়াতে তখন হাজার হাজার লোক, তাদের অনেকেই তার মত পাগলপারা হয়ে পরিবার পরিজনদের খুঁজে ফিরছে।
প্রায় সব পরিবারে একই অবস্থা। পরদিন ডুমুরিয়া থেকে হাঁটা পথে তারা চুকনগরের দিকে রওনা হন। পথে আর এক দলের মাঝে হঠাৎ তার স্ত্রীকে দেখেন, কিন্তু চুকনগরে গোলাগুলির সময় আবার তাকে হারিয়ে ফেলেন। তবে তিনি ছিলেন সেই সব প্রায় ভাগ্যবানদের একজন যারা মা, বৌ, মেয়ে, ভাইবোন সবাইকে ফিরে পেয়েছিলেন, তবে এজন্য তাকে ভারতের সারাকান্দায় যাওয়া পর্যন্ত উদ্বেগের মধ্যে অপেক্ষা করতে হয় (মুক্তিযুদ্ধে খুলনা ও চুয়াডাঙ্গা, সম্পাদনা- সুকুমার বিশ্বাস, পৃষ্ঠা ৭৮-৮৮)।
চুকনগরে সেদিন কত লোক লোক জমায়েত হয়েছিল তার কোন পরিসংখ্যান নেই।
অনেকের ধারণা লক্ষাধিক। ওয়াজেদ মিয়া, আটলিয়া ইউনিয়নের চৌকিদার সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তখন এখানে বহু লোক বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছিল। সোমবার থেকে লোক আসা শুরু হয়। তারা মঙ্গলবারে আসে, বুধবারে আসে, বৃহস্পতিবার সকালেও আসে। একদল আসে একদল যায়।
তখন আমাদের এখানে লোক গিজগিজ করছিল। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার সকালে এসে গেল আরো অনেক লোক। বটিয়াঘাটা, দাকোপে মনেহয় হিন্দু আর ছিলনা, সবাই এসে পড়ে (ঐ, পৃষ্ঠা- ১০৬)। বস্তুত সেদিন ২০ মে, বৃহষ্পতিবার আটলিয়া ইউনিয়নের চুকনগর বাজার, চাঁদনী, ফুটবল মাঠ, স্কুল, পুটিমারী, মালতিয়া, রায়পাড়া, দাসপাড়া, তাতিপাড়া প্রভৃতি গ্রাম, পাতাখোলার বিল এবং ভদ্রা ও ঘ্যাংরাইল নদীর পাড়ে ও নৌকায় অগুনতি মানুষ ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার জন্য গাইড এবং যানবাহনের অপেক্ষায় ছিল। পুরো এলাকাটা ছিল প্রায় এক কিলোমিটার ব্যাসার্ধের।
এখানে ঐদিন বেলা এগারোটার দিকে তারা ভয়াবহ আক্রমণের সন্মুখীন হন। আর্মিরা আসে সাতক্ষীরা থেকে জীপ ও ট্রাকে। তাদের সাথে সাদা পোষাকে মুখঢাকা লোকজনও আসে। কেউ তাদের সনাক্ত করার সুযোগ পায়নি। যারা তাদের সরাসরি দেখেছিলেন মালতিয়া গ্রমের বৃদ্ধ চেকন মিয়া ও সুরেন কুণ্ডু মুহূর্তেই গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন।
চেকন মিয়ার হাতে কাস্তে ছিল, তিনি চেঁচিয়ে সবাইকে সতর্ক করেছিলেন। সুরেন কুণ্ডুর গলার রুদ্রাক্ষের মালা তাকে চিহ্নিত করে দিয়েছিল। বেঁচে যাওয়া যেসব মহিলা অসহায়ভাবে আক্রমণকারীদের দেখেছেন তারা বহু দূরের লোক, স্থানীয় লোকদের তাদের চেনার কথা নয়। স্থানীয় লোকজন বলেছেন অবশ্যই চেনাজানা লোকজন আর্মিদের নিয়ে আসে। নইলে মালতিয়া ও বিভিন্ন গ্রামের আঁকাবাঁকা ভাঙ্গাচোরা সংকীর্ণ মাটির পথ চিনে আর্মিদের এক ভাগ পাতোখোলার বিল, ঘ্যাংরাইল নদী ও হিন্দু গ্রাম বেড় দিয়ে এসব জাগায় আশ্রয় নেয়া হাজার হাজার শরণার্থীর উপর হামলে পড়বে কিভাবে! আর্মিদের আর এক ভাগ চুকনগর মোড় ছাড়িয়ে খুলনাগামী রাস্তা ও ভদ্রার কূল জুড়ে বিবেকহীন নির্দয় ব্রাশ ফায়ার করতে করতে অগ্রসর হয়, যা স্থায়ী হয় তিন ঘন্টারও বেশী।
সহসাই চুকনগরের আকাশ বাতাস লক্ষ মানুষের আর্তনাদে অসম্ভব ভারী হয়ে উঠে। সে আর্তনাদ হানাদার পাকিস্তানীদের পৈশাচিক উল্ল¬াস ও অস্ত্রের ঝনঝনানিতে মাথাকুটে ফিরে এসেছিল সেই হতভাগ্য মানুষগুলোর কাছেই, মে ডে’র বিপদ সংকেত কোথাও পৌঁছায়নি। অসহায় মৃত্যু অথবা সবকিছু এমনকি সন্তান ফেলে ছন্নছাড়া পলায়ন ছাড়া সেদিন দ্বিতীয় কোন পথ খোলা ছিলনা চুকনগরে জমায়েত ভাগ্যবিড়ম্বিত লক্ষাধিক মানুষের জীবনে। অগুন্তি মানুষের ভীড় এবং হৈচৈ এর মধ্যে অনেকে বুঝতেই পারেনি, অনেকে বুঝতে পেরেও পালাতে পারেনিÑ পথঘাট চিনতো না, রাঁধতে অথবা খেতে বসেছিল কেউকেউ, অনেকেই ছিল পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন- তাদের একত্র করে পলায়ন সম্ভব ছিলনা। চুকনগর জেনোসাইডে কত লোক শহীদ হয়েছিল তার কোন পরিসংখান নেই।
পাকিস্তানীদের ভয়ংকর নৃশংস ‘উড়া দো, জ্বালা দো, তাবা করদো’ নীতি এবং অক্ষরে অক্ষরে তার প্রয়োগ এতদূর আতংক সৃষ্টি করেছিল যে তখন স্থানীয় সরকার ও সিভিল প্রশাসন আদৌ কার্যকর ছিলনা। যারা আটলিয়া ইউনিয়নের পাতাখোলার বিল থেকে ভদ্রা নদী এবং সাতক্ষীরা রোড থেকে ঘ্যাংরাইল নদী পর্যন্ত বিস্তৃত এক কিলোমিটার ব্যাসার্ধ জোড়া বধ্যভূমি থেকে লাশ সরানোর কাজে ব্যস্ত ছিল সেই ওয়াজেদ মিয়া প্রমুখ ৪০/৪২ জন লোক সোমবার দুপুর পর্যন্ত চার হাজার লাশ গুনে শেষপর্যন্ত হাল ছেড়ে দেয়। এই গননার মধ্যে নদী, পুকুর, ডোবা, জলায় ভাসমান হাজার হাজার লাশ অন্তর্ভুক্ত ছিলনা। লাশ ফেলার সময় তারা বেশ কিছু সোনাদানা, টাকাপয়সা পেয়েছিল বলে জানিয়েছে। তার কিছু ইউনিয়ন কাউন্সিলে জমা দেয়, কিছু অন্যদের কাছে গচ্ছিত রাখে যা পরে আর ফেরত পায়নি (ঐ, পৃষ্ঠা ১০৯, ১১২)।
প্রাণভয়ে মানুষ সেদিন পুকুরে, ডোবায়, ভদ্রাপাড়ের বিশাল ঘন গাবগাছে, কালীমন্দিরে, কালীবাড়ির বটের শেকড়ের নিচে বড় গর্তে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল, বাঁচেনি। বটের আড়ালে থাকা মানুষগুলোকে আর্মিরা নৌকা থেকে গুলি করে মারে, গাবগাছের মানুষগুলোকে মারে পাখি মারার মত। সর্বত্র লাশের স্তুপ। দেবীতলার প্রফুল্ল কুমার ঢালীর ভাষায়, ‘সেদিন কত লোক দেখিলাম বলা মুশকিল। আমি ওখানে কয়েক বিঘা এলাকা ঘুরিছি।
সব জায়গায় শুধু লাশ আর লাশ। গায়ে গায়ে লাশ। লাশের উপরে লাশ। সব মরি পড়ি আছে। কোথাও পা দেয়ার জায়গা নাই।
অনেক সময় লাশ পারায় যাইতে হইছে। নদীর পাশ দিয়াও অনেক লাশ। নদীর ভিতরেও অনেক লাশ ভাসতিছে। রক্তে চারদিক লাল হয়া গেছে। মাটি-জল সব লাল (ঐ, পৃষ্ঠা ৮৩, ৮৪)।
’ হত্যাযজ্ঞের ব্যপকতা সম্পর্কে চুকনগর কলেজের অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম, একাত্তরে ১৬ বছরের তরুণ, বলেছেন, গোলাগুলি শুরু হলে অনেকের সাথে তিনিও নৌকায় ভদ্রার ওপারে অনেক দূরে পালিয়ে যান। তিনি যখন মাঝ নদীতে এক ডুবন্ত মহিলার আর্তনাদ শুনে হাত বাড়িয়েও ভদ্রার প্রবল স্রোতের মুখে তাকে ধরে রাখতে পারেননি। গোলাগুলি থেমে গেলে বিকাল সাড়ে চারটায় চুকনগর বাজারে ফিরে আসেন। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য! নদীর পানি রক্তে লাল, চারদিকে শুধু লাশÑ হাজার হাজার লাশ, শত শত না। গুলিবিদ্ধ অনেকেই তখনো বেঁচে, অথচ সেবা নেই, চিকিৎসা নেইÑ ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে অসহায় ভাবে।
শহীদের সংখ্যা আট-দশ হাজারের কম হবেনা মোটেও। একই অভিমত শহীদ চেকন মোড়লের পুত্র মালতিয়া গ্রামের আরশাদ আলী এবং বাবু রামের পুত্র শ্যামল কান্তি বিশ্বাসের, একাত্তরে তারা এই হত্যাযজ্ঞের যন্ত্রণাবিদ্ধ প্রত্যক্ষদর্শী।
চুকনগর ট্রাজেডি ছিল বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদারদের কৃত গণহত্যার একক বৃহত্তম ঘটনা। অথচ এই ঘটনার কথা অজানা থেকে গেছে দেশবাসী এবং বিশ্ববাসীর কাছে। এমনকি এত বড় ট্রাজেডির কথা ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ- দলিলপত্রেও’ বিবৃত হয়নি।
এ এক অদ্ভুৎ ব্যাপার। বস্তুত ’৭১ সালে চুকনগর ছিল দুর্গম, সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার বাইরে এমন এক এলাকা যেখান থেকে, বিশেষ করে ’৭১ এর পরিস্থিতিতে, সংবাদ আদান প্রদান অসম্ভব ব্যাপার ছিল। তদুপরি, ২০ মে’র শহীদদের মধ্যে ঘটনাস্থল আটলিয়া ইউনিয়নের ভিকটিম ছিল হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র। ভিকটিমদের প্রায় শতভাগই ছিল দূরদূরান্তরের খুলনা, বাগেরহাট এবং বরিশালের বিভিন্ন অজ পাড়াগাঁর অতি সরল সাদাসিধা মানুষ। তারা সাংবাদিক চেনেনা, দেন দরবার জানেনা।
তারা যে শুধু চুকনগরেই আক্রান্ত হয়েছে তা নয়, প্রথমে নিজ গ্রামে আক্রান্ত হয়ে আশ্রয় নেয় অপেক্ষাকৃত ভিতরের ভিন গ্রামে, সেখানেও আক্রান্ত হয়ে দল কি দল ভারতের পথে আশ্রয় নেয় চুকনগরে। সেখানে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া মানূষ আবারও আক্রান্ত হয় কলারোয়া, ঝাউডাঙ্গায়। স্বাধীনতার পর হতাবশিষ্ঠ যারা ছিল তারা যে যার গ্রামে ফিরে আসে। তারা ছিল বিচ্ছিন্ন, হতাশ। ফলে নিজেরা যেমন উদ্যোগী হয়নি, তেমনি তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য এগিয়ে আসেনি কেউ।
চুকনগর ট্রাজেডি এভাবেই লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র’ পড়তে যেয়ে চুকনগর গণহত্যার বিবরণ না পেয়ে হতবাক হন। এরই প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠে ‘চুকনগর গণহত্যা স্মৃতি রক্ষা কমিটি’। ধীরে ধীরে লাইমলাইটে আসতে থাকে চুকনগরের গণহত্যার ব্যাপকতার বিষয়টি এবং ২০০৬ সালে সরকারী উদ্যোগে পাতাখোলা বিলের দক্ষিন প্রান্তে শহীদদের স্মরণে গড়ে ওঠে শহীদ স্মৃতিসৌধ।
চুকনগর ট্রাজেডি ছিল পাকিস্তানীদের বিবেকবর্জিত অজস্র হত্যাযজ্ঞের অন্যতম।
কিন্তু পাকিস্তানী জেনারেলদের বইতে এর উল্লেখ নেই। আসলে পাকিস্তানীরা ’৭১ সালে তাদের হাতে গোটা বাংলাদেশ জুড়ে ৩০ লক্ষ মানুষের হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য অপরাধকে আদৌ স্বীকার করতে চায় না। তথাপি কোন কোন সামরিক কর্মকর্তার লেখায় এ ধরণের দু’ একটি ঘটনা কথা অকষ্মাৎ এসে গেছে। এমনই এক ঘটনার কথা লিখেছেন ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেণ্ডার’ বইতে যার কথা আগেই বলা হয়েছে। কেরানিগঞ্জের এই অপারেশন চালানো হয়েছিল যথাযথ গোয়েন্দা অনুসন্ধান ছাড়াই, এখানে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ নিহত হয়।
তথাপি এ অপরাধে জন্য পাকিস্তানীরা কাউকে বিচারের সম্মুখীন করেনি। কেননা তারা আগেই ফিল্ড অফিসারদের ব্রীফ করেছিল: গো অ্যাহেড, তোমাদের কাজের জন্য কোন প্রশ্ন করা হবেনা। চুকনগর বহু দূরের নিভৃত এক গঞ্জ, সেখানকার ২০ মে’র ঘটনাও একই ফরমুলায় বিচার এড়িয়ে গেছে। তারা অনুসন্ধান করে দেখেনি সেখানে প্রকৃতই বিদ্রেহীরা ছিল কিনা অথবা বিদ্রোহ প্রস্তুতির কোন ব্যাপার ছিল কিনা। কি তথ্যের ভিত্তিতে তারা পরিকল্পিত ভাবে নিরীহ সাদাসিধা পুরুষদের ইতস্তত ভাবে অথবা লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করেছিল তা আজো অজানাই রয়ে গেছে।
ড. মুনতাসির মামুনের বই ‘চুকনগর গণহত্যা ৭১’ এ বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এসেছে: মেয়েরা স্বামী সন্তান হারিয়ে আর্মিদের বলেছিল, ‘আমাদের বাঁচায়ে রাখছ ক্যান্, আমাদেরও মারো, মাইরা ফ্যালাও। ’ আর্মিরা তাদের মারেনি, বলেছিল- ‘নেহি, তোমলোগ ঘর যাও, আউর কোই সাচ্চা মুসলমানকো সাদি করো। ’ রেস বদলে দেয়ার ধারণা সাধারণ সৈন্যদের পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ’৭১ এ ব্যাপক নারী ধর্ষণের লক্ষও ছিল তাই। তারপরেও ’৭১ এ গণহত্যা হয়নি, এমন সাফাই গাওয়ার মত লোক আছে এদেশে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।