3.বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান
বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান এবং মানচিত্রের দিকে তাকালে আমরা হয়ত খুবই হতাশ হই এই ভেবে বাংলাদেশ তিন দিক থেকে ভারত কর্তৃক পরিবেষ্টিত, কেবল শুধু এক দিকে বঙ্গপোসাগর ও মিয়ানমার । কিন্তু একটু সুক্ষ ভাবে থাকান দেখুন বাংলাদেশ-ভারতের এই জয়েন্টটুকু দেখলে আবার আরেকটি দৃশ্য ভেসে উঠে –
ভারতের সেভেন সিস্টার খ্যাত সাতটি রাজ্যা (লাল দাগ দিয়ে চিন্নিত) বা এভাবে বলা যায় ভারতের একটি ডানা বাংলাদেশ নামক বস্তু খামচে ধরে আছে। অবশ্য এ কথাটা একটি শক্তিশালী বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য, যা ভারতের ভু-রাজনীতিবিদরা ভাল করে বুঝেন। তাই আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করে ভারত নিজের স্বার্থে কখনো একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে চায় না । তারপরও ভারতের দৃষ্ট্রিতে একটি হত দরিদ্র স্বাধীন- স্বার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীন পরাষ্টনীতি কোন বিশেষ মূহুর্তে ভারতের অখণ্ডতার জন্য হুমকি হয়ে যেতে পারে, এই বিষয়টির ব্যাখ্যা পরবর্তীতে আপনারা পর্যায় ক্রমে পাবেন ।
4.ভারত কেন ট্রানসিট চাচ্ছে ?
ভারতের মূল ভূখণ্ড হচ্ছে আমাদের পশ্চিমে। কিন্তু আমাদের পূর্বেও ভারতের একটি বড় অংশ রয়েছে। ভাল করে বলতে গেলে সাতটি রাজ্য রয়েছে আমাদের পূর্বে। কিন্তু কোন রাজ্যের সাথেই সমুদ্রের সম্পর্ক নেই। এর কারন নিচ দিক দিয়ে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের অবস্থান (ছবিতে দেখুন।
)
এখন কথা হচ্ছে, ভারতের বেশিরভাগ পণ্য তৈরি হয় ভারতের মূল ভূখণ্ডে। একই কথা প্রযোজ্য আমদানিকৃত পণ্য গুলোর খেত্রেও, যেহেতু সব ভারতে আসে আমাদের পশ্চিমের বন্দর দিয়ে। তো, এই পণ্য গুলো এই সাতটি রাজ্যে যায় বাংলাদেশের উপর দিয়ে। ভাল ভাবে বলতে গেলে, বাংলাদেশ-নেপাল যে করিডর আছে, সেখান দিয়ে, ভূটান, সিকিমের নিচ দিয়ে তারপর সেই রাজ্য গুলোতে প্রবেশ করে... সেক্ষেত্রে পুর বাংলাদেশ টোপকে যেতে হয়(ছবিটি দেখুন)। তাছাড়া উপরের এলাকাটি একটা পাহারি এলাকা।
সেখানে প্রায়ি ভুমিধশ হয়, যার ফলে অনেক সময় যাতায়াত বন্ধ থাকে। ফলে যা হয়, ভারতের ওই অংশের মানুষগুলো ভারতের মূল ভূখণ্ডের সুবিধাগুলো থেকে পিছিয়ে পরে! এখন আসুন দেখি ভারত কেন ট্রান্সিট চাচ্ছে। আপনি যদি প্রথম ম্যাপটি দেখেন, তাহলে বুঝবেন, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ঢুকলে অনেকটাই পথ কমে যায় তাদের জন্য। তাছারা বাংলাদেশের ভিতরে ভুমিধশের ভয় নেই যে মালামাল যাতায়াত বন্ধ থাকবে।
4.a.অর্থনৈতিক কারণঃ
ভারতের এই সাতটি প্রদেশ ভারতের অপরাপর প্রদেশগুলো হতে সবচেয়ে অনুন্নত, যথেষ্ট জ্বালানি এবং শিল্পের কাচামাল থাকা সত্ত্বে ও এখানে তেমন কোন উন্নয়ন হয় নি , তাছাড়া ভারতের মূল ভূ-খণ্ড হতে শিলুগুরী বা চিকেননিক দিয়ে অতন্ত্য জটিল ও দীর্ঘ পথ অত্রিক্রম করে এই সাথটি রাজ্যের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়, যা অনেক ব্যয় সাপেক্ষ
ট্রানজিট চাওয়ার এই দুইটি অর্থনৈতিক কারণ হতে পারে
- অপেক্ষাকৃত সহজ এবং কম ব্যয়ে এই রাজ্য গূলোর সাথে যোগাযোগ রাখা ।
-আসামের গ্যাস ও খনিজ সম্পদ সহজে মূল ভূখন্ডে নিয়ে আসা ।
4.b.সামরিক ও ভূ-কৌশলগত কারণঃ
আসলে প্রকৃত পক্ষে এটাই ভারতের ট্রানজিট চাওয়ার মূল কারণ ।
আপরা জানি চীন ক্রর্মবর্ধমান সম্ভাব্য পরা শক্তি সেই সাথে ভারত তার আঞ্চলিক প্রত্বিদ্বন্ধী, আজ ভারতের পক্ষ থেকে সর্ব ক্ষেত্রে চীনের সাথে পাল্লা দিয়ে চলার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। আমরা জানি ১৯৬২ সালে ভারত চীনের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, চীন কর্তৃক ভারতের অরুণাচল প্রদেশ আক্রমণের কারণে এবং এই যুদ্ধে ভারত পরাজিত হয় । চীন-ভারত যুদ্ধ সম্পর্কে সামনে আলাদা ভাবে আলোচনা করবো , এখন শুধু এতটুকু বলি যে, এই যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল, এই বাংলাদেশ(পূর্ব পাকিস্থান ) দিয়ে ট্রানজিট না পাওয়া ।
যেহেতু শিলিগুড়ী দিয়ে যা বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যদিয়ে অতন্ত্য ছোট ও দূর্গম এক টি জায়গা যা দিয়ে ভারত
তার সেনাবাহিনীকে যথেষ্ট পরিমাণ এবং দ্রুত রশদ সরবারাহ করতে পারে নি, তাই ভারতের এখন সামরিক রসদ সরবরাহের জন্য ট্রানজিট প্রয়োজন ।
শিলিগুরী থেকে আরেকটু ওপরে রয়েছে সিকিম যা ১৯৭৪ সালের আগ পর্যন্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রছিল, বর্তমানে এটি ভারতের একটি প্রদেশ, ১৯৬২ সালে একটি নিরেপেক্ষ দেশ হিসাবে চীন সিকিমে কোন রকম আগ্রাসন চালায় নি এবং ভারতের শিলিগুড়ি দিয়ে রশদ সরবরাহেও তেমন বিঘ্ন ঘটে নি, এখন ভারতের জন্য অতন্ত্য আশংকার কারণ হচ্ছে, যেহেতু চীন অরুণাচল প্রদেশের উপরের তার দাবি এখনো অব্যাহত রেখেছে এবং ভবিষ্যতে যদি চীন আবার এ নিয়ে যুদ্ধ বাধায় ,তাহলে তখন সিকিম আক্রান্ত হলে শিলিগুরী দিয়ে সেভেন সিশটারের সেনা ছাউনি গুলোতে রশদ সরবরাহের বিঘ্ন ঘটবে, আর সেই সাথে ভারতের জন্য বাংলদেশের মধ্য দিয়ে করিডোর অপরিহার্য হয়ে পড়বে ।
4.c.বিচ্ছিন্নতাবাদী দমনঃ
ভারতের সেভেন সিস্টারের সবগুলো রাষ্ট্রে কমবেশি বিচ্ছিন্নতাবাদি গেরিলা সংঘঠন রয়েছে, কিন্তু আসামের ইউনাইটেড লেবারেশন ফোর্স অব আসাম বা সংক্ষেপে ঊলফা, এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী,
আসামে এই বাহীনি আসামের স্বাধীনতার জন্য যোদ্ধে লিপ্ত, তারা মনে করে উপনিবেশী কায়দায় ভারত তাদের শোষণ করতেছে , তাই তারা ভারত থেকে পৃথক হওয়ার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত যেমনি ভাবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে করেছিল, পার্থক্য শুধু এখানে যে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী শাসকরা বাংলাদেশীদের মোকাবেলার জন্য ধারাবাহিক ভাবে বাংলাদেশে পাকিস্তানী অনূপ্রবেশ করিয়ে বাংলাদেশীদের শক্তি কমিয়ে আনার ষড়যন্ত্র করতে পারেনি কিন্তু আসামের বেলায় ভারত তার মূল ভূখণ্ড থেকে মানুষ এনে অসমীয়দের ৪৫% এর নিচে নামিয়ে এনেছে ।
উলফার জন্ম নেওয়ার কাহিনী ন্যায় ভিত্তিক কিন্তু পরবর্তীতে তারা সহিংসতার পথ বেছে নিয়ে বেসামরিক মানুষের ক্ষতি করতে নেমে পড়ে ।
এব্যাপারে নিউইয়র্ক বার্ড কলেজের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের একজন অসমীয় অধ্যাপক সঞ্জীব বড়ুয়া তার লিখা
“India Against Itself: Assam and the Politics of Nationality” নামক প্রকাশিত গ্রন্থে আসাম ও উত্তরপুর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমুহের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের স্বরূপ সন্ধান ও তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করেছেন।
“প্রত্যেকেটা রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদের দাবী এসেছে তাদের নিজস্ব ইতিহাস থেকে । উদাহরন হিসেবে আমি মনিপুরের কথা বলতে পারি- কেন্দ্রীয় ভারতের কাছে মনিপুর মাত্র ২০ লক্ষ জনসংখ্যা অধ্যুষিত অতিক্ষুদ্র এক রাজ্য । কিন্তু প্রত্যেক মনিপুরীর কাছে মনিপুর সমগ্র এশিয়ার মধ্যে এক পুরনো রাষ্ট্র,যাদের স্বাধীন রাজতন্ত্রের ইতিহাস শুরু হয়েছে ৩৩ খ্রীষ্টাব্দ থেকে । মনিপুর বৃটিশদের করায়ত্ত হয়েছে ১৮৯১ এ, তাও 'নেটিভ রাজ্য' হিসাবে । ভারতের স্বাধীনতার চারদিন আগে মনিপুরের রাজা বুদ্ধচন্দ্র সিং নিরাপত্তা,যোগাযোগ ও বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ে ভারতের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন ।
কিন্তু পরবর্তীতে 'নেটিভ রাজ্য' গুলো করায়ত্ত করার ভারতীয় আগ্রাসনের পরিনাম হিসাবেই মনিপুর ভারতের অংশ হয়ে যায় অক্টোবর ১৯৪৯ এ ।
মনিপুরের ঘটনা কাশ্মীরের মতোই । কিন্তু ক'জন ভারতীয়, এইসব ষড়যন্ত্র ও শঠতার ইতিহাস জানে?”
আর আসামের বেলায় ঠিক এরকমই তিনি আলাদা ভাবে বর্ণনা করেছেন
যেভাবে গড়ে উঠলো অসমের স্বাধীনতার লড়াই
“অসমের জনগণের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ের বয়স প্রায় একশ ত্রিশ বছরেরও বেশি হয়ে গেছে। মোগলরা সতেরো বার হামলা করেও যাদের পরাস্ত করতে পারে নাই; সে অসমীয়রা আঠারশ ছাব্বিশ সালের চব্বিশ ফেব্র“য়ারি ইংরেজ ও মায়ানমারের মধ্যে ‘ইয়ান্দাবু চুক্তি’র ফলেই পরাধীন হয়ে গেল।
তাদের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইটা শুরু হয় তখন থেকেই।
ইংরেজ চলে গেলে স্বাধীন হল ইনডিয়া, কিন্তু ঔপনিবেশিক পরাধীনতা থেকে অসমের জনগণ মুক্তি পায় নাই। অসম এখন সম্প্রসারণবাদী ইনডিয়ার অংশ। শোষণের যাতাকলে পড়ে অসমের জনগণ আজ নিঃস্বপ্রায়। সমস্ত কলকারখানা চলে গেছে শাসকদের কব্জায়। বঞ্চিত করা হয়েছে সমস্ত সরকারি চাকরি, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা হতে।
তাদের বলা হতে লাগল ইনডিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি। সাতচল্লিশের পর ইনডিয়ার মূলভূমি থেকে কয়েক লাখ এবং অনেক অ-ইনডিয়ানকেও রাজ্যটিতে ঢোকানো হল আদিবাসী অসমীদের সংখ্যালঘু বানাতে। বিশেষ করে ইনডিয়া-পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাওয়ার পর যে সকল হিন্দু বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে গেছে তাদের অন্য কোথাও পুনর্বাসন না করে অসমে ঠেলে দেওয়া হল। যার দরুন আদিবাসী অসমীয়দের সংখ্যা এখন চল্লিশ শতাংশে নেমে এসেছে।
অসামের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনো নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য রাখা হয় নাই।
পুরাপুরি চাকরিমুখি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছে অসম সরকার। ফলে অসমের ভাষা, সমাজ, সাংস্কৃতিক নিজস্বতা হারিয়ে যাচ্ছে। অসমের জনগণের মধ্যে কোন্দল তৈরি করতেও তারা নানারকম চক্রান্ত চালাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপট ধরে ১৯৭৯ সালের সাত এপ্রিল সশস্ত্র বিল্পবী সংগঠন উলফা’র জন্ম নেয়। যার পুরা নাম ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ অসম।
উলফা অসমকে একটা স্বাধীন-সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিশাবে দেখতে চায়। আর সেটা দেখতে হলে অসমকে ইনডিয়ার দখলদার মুক্ত করতে হবে। এর বাইরে অন্য কোনো পথ তাদের কাছে আপতত খোলা নাই। ”
আমার জানা নেই মুক্তিযোদ্ধার জাতি বাংলাদেশের কতজন মানুষ উলফার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি নৈতিক সমর্থন দেন, কিন্তু আমি যতজন সেনা সদস্যের সাথে পরিচিত হয়েছি, দেখেছি তাদের প্রতি জন মনে প্রাণে স্বাধীন আসামের স্বপ্ন দেখে। ( আমার বাড়ি ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ার কাছে)
কিন্তু আমাদের জাতীয় ভাবে কোন পক্ষে যাওয়া দিক হবে না আর আমরা বাংলাদেশীরা এ ব্যাপারে কোন পক্ষে জড়াতে চাই না, ভারত তার অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিজে নিজে সামাধান করুক এ ব্যাপারে সহিংস গেরলার টার্গেটের শিকার ও আমরা হতে চাই না
কিন্তু ভারত সম্ভবত ট্রানজিট ব্যাবহার করে অস্ত্র-সশস্ত্র আসামে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশের রাস্তা ঘাট উলফার টার্গেটে পরিণত করতে চায় ।
চলবে.........
'ট্রানজিট'-এর সহজপাঠ। ট্রানজিট ও করিডোর কি, ভারতকে ট্রানজিট না করিডোর দেওয়া হলো? (Part-1) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।