আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্প-নীল জামা

আজ কলেজ থেকে ফেরার সময় কাক ভেজা হয়ে এসেছে অনামিকা। সকালে আকাশ মেঘলা থাকা সত্ত্বেও ছাতা সঙ্গে করে নিয়ে যায়নি। বৃষ্টিতে ভিজতে তার ভালোই লাগে। কিন্তু বিপত্তি ঘটালো গলির এক কালো গাড়ি। অনামিকার গোলাপী জামায় কাঁদাপানি ছিটিয়ে চলে গেলো।

নতুন জামা। আজকেই প্রথম পড়েছে। ঘরে এসেই জামাটা বালতির সাবান পানিতে ডুবিয়ে রাখল। কিছুক্ষণ পর এসে দেখলো, বালতির পানি গোলাপী হয়ে গেছে। জামাটার আয়ু স্বল্পদীর্ঘ হবে ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার।

এমনিও জামা কিনার উপলক্ষ্য হয় তার বছরে একবার। এই জামাটা তাকে তার দিদি কোন উপলক্ষ্য ছাড়াই উপহার দিয়েছিল। প্রতিদানস্বরূপ সেদিন দিদি’র প্রশংসায় মুখর ছিল সারাটা দিন। আজ মনে হলো প্রতিদান অনাবশ্যক ছিল। স্বল্পায়ু জামা তার সেদিনকার বলা প্রশংসা-বাণীগুলোকে ভৎর্সণা-বাণীতে পরিণত করতে প্রবৃত্ত করল।

অনাবশ্যক তর্ক সৃষ্টিতে ছুটে গেলো সে দিদি’র কাছে। - দিদি, তুই এমন কেন? জামা দিয়েছিস, একটা ভালো জামাও কি দেওয়া গেলনা? সস্তা জামা। এক ধোঁয়াতেই তেনা-তেনা হয়ে গেলো। - দিয়েছিই তো বেশি। তুই এতো অকৃতঞ্জ কেন রে? - ইসসসসসসসস, আবার কৃতঞ্জতা? একটু দাম দিয়েও একটা জামা আনা গেলনা, তার কাছে আবার কৃতঞ্জতা? - যাহ।

তোকে যদি আমি আর জামা দেই... - লাগবেনা আমার তোর জামা। অনামিকা গাল ফুলিয়ে চলে এলো। যদিও তার কাছে দিদি’র জামার অপ্রয়োজনীয়তার কথা মুখে বললো, তবুও মনে মনে সে খানিকটা চিন্তিত হলো। যদি সত্যি সত্যি দিদি রাগ করে তাকে আর জামা না দেয়? হোকনা সস্তা তাও তো রুটিন করে সপ্তাহে তিনটা জামা ঘুরে-ফিরে আর পড়তে হয়না!! অনামিকা’র দিদি নীলা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ইতি ঘটিয়েছে অনেক আগেই। অনামিকার সাথে তার বয়সের পার্থক্য দশ বছর।

বিয়ে হয়নি। দিনের অধিকাংশ সময়-ই তাকে দেখা যায় পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। এই বয়সেই তাকে দেখে মনে হবে, সে সংসারের ঘানি টানতে টানতে এতটাই ক্লান্ত যে বিশ্রামই তার একমাত্র উপশম। এই নিদ্রা-রাণীর আবার কখনো কখনো খেয়াল হয়, যে তা চাকরি করা আবশ্যক। অতি প্রয়োজনীয় ঘুম ফেলে সে তখন চাকরির দরখাস্ত লিখতে বসে যায়।

কখনো ডাক আসেনা কখনো ডাক আসে। তবে সে ডাক শুধু ইন্টারভিউ-বোর্ড পর্যন্তই। অফিসের অন্দরে নিজেকে স্থায়ী করার বন্দোবস্ত আর হয়না। মা-বাবাসহ ঢাকাতেই বসবাস নীলা আর অনামিকার। নীলা সম্পর্কিত অনামিকার হাজারো অভিযোগ- ১।

দিদি সবসময় তার চাইতে বেশি বেশি জামা পায়। ২। দিদি কোন কাজ করেনা, দিদির কর্মহীনতার কারনে রাতের ভাত-টা তাকেই বসাতে হয়। ৩। দিদি বেশি বেশি মোবাইল-এ কথা বলে, অনেক সময় রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় দিদির মোবাইল এর রিংটোনে।

৪। দিদি কেমন জানি নিষ্ঠুর, বন্ধু-বান্ধব এর সাথে কি মিষ্টি করে কথা বলে। কিন্তু তার সাথে কেমন কেমন জানি করে... ৫। ইত্যাদি ইত্যাদি... এতো অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও সে দিদিকে ছাড়া একচুলও চলতে পারেনা। যেখানেই বেড়াতে যায়না কেন দিদি সঙ্গে থাকা চাই ই চাই।

অনামিকা আর নীলা বাইরে বেড়াতে যাওয়ার আগেকার একটা সাধারন দৃশ্যপট হচ্ছে, আয়নার সামনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দু’জনের দু’জনকে প্রশ্ন করা- “কাকে বেশি সুন্দর লাগছে?” নীলা বলে – “অনামিকা তোর চেহারাটা যে কি সুন্দর?” আর অনামিকা বলে- “দিদি তোকে যে কি সুন্দর লাগছে”। যদিও অনামিকা নিজের মুখশ্রী নিয়ে বেশ সচেতন এবং গর্বিত। কিন্তু রাস্তায় যখন দেখে, পথচারীরা নীলার দিকেই বেশি দৃষ্টিপাত করছে তখন তার এই গর্ব কিছুক্ষণের জন্য হলেও আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনা। ভ্রমণ পর্বের শেষেও আরো একটি সাধারণ দৃশ্যের অবতারণা হয়। অনামিকা প্রশ্ন করে- “আচ্ছা আজকে যত মেয়ে দেখলি সব চাইতে আমি সুন্দর না”? নীলা বলে- “তুই বড় হলে অনেক সুন্দর হবি।

তুই তো এখনো ছোট”। এই “ছোট ছোট” কথাটা শুনতে শুনতে অনামিকা অতিষ্ঠ। বয়সের সমানুপাতে তার শরীর বেড়ে উঠেনি বলে তাকে দেখতে তার সমবয়সীদের চাইতেও তাকে অল্পবয়সী মনে হয়। বড়(!!) হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার মনে প্রবল। সে স্বপ্ন দেখে, কবে যে তার দিদির জামাগুলো সে ও পড়তে পারবে।

অনামিকার আর বড় হওয়া হয়না। এরই মধ্যে ভাগ্যরাণী নীলার উপর প্রসন্ন কি ক্ষুন্ন হলো জানিনা, নীলার নিদ্রারাজ্যে কর্মের প্রবেশ ঘটলো। কুমিল্লার একটা হাই-স্কুলে চাকরি হয়ে গেলো তার। প্রথমেই সবাই আপত্তি জানালো নীলার ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তাবে। অনেক অশান্তির ঝড় অতিক্রম করার পর নীলার কুমিল্লা যাওয়ায় সবাই সম্মতি জানালো, শুধু অনামিকা বাদে।

অতিকষ্টে অশ্রু সংবরণকারী অনামিকা ধরা গলায় বললো, “দিদি তুই চলে গেলে আমি কি করব......”? নীলা হেসে বললো- “আমি গেলে তো তোর ভালোই হয়। তুই তো আমাকে দেখতেই পারিসনা...”। দেখতে দেখতে নীলার চলে যাওয়ার দিন চলে এলো। অনামিকা তার অনেক দিনের জমানো টাকা দিয়ে দিদি’কে এই প্রথম একটা নীল জামা উপহার দিল......  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।