রমজান মাসে একের পর এক হরতালে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ। ঈদকেন্দ্রিক বাজারেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। হরতাল চলাকালে গতকাল মঙ্গলবার পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আরও চারজন নিহত হয়েছে। আগের দিন পাঁচজনসহ দুই দিনে নয়জনের প্রাণ গেল।
টানা দুই দিনের হরতাল শেষে জামায়াতে ইসলামী আজ বুধবার আবারও সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে।
জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের মামলার রায়কে কেন্দ্র করে দুই দিন এবং সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের মামলার রায়কে কেন্দ্র করে আজ হরতাল ডাকা হয়।
হরতালের দ্বিতীয় দিনে গতকালও দেশের বিভিন্ন স্থানে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরসহ ব্যাপক সহিংসতা চালান জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলায় গতকাল পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষে জামায়াত-শিবিরের দুজন কর্মী নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ছয়জন। গাজীপুরে হরতালকারীদের তাণ্ডব থেকে বাঁচতে গিয়ে এক পথচারী শিশুকে চাপা দেয় একটি মিনিবাস।
দিনাজপুরের রানীরবন্দরেও ঘটেছে প্রায় একই রকম ঘটনা। পিকেটারদের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে একটি ট্যাংকলরি যাত্রীবাহী একটি ভ্যানকে চাপা দেয়। এতে ভ্যানের আরোহী মারা যান।
ছাত্রশিবিরের কর্মীরা গতকাল বেলা দুইটার দিকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় পুলিশের ওপর হামলা চালান। এ সময় পুলিশের রাইফেল কেড়ে নিয়ে তাঁরা পুলিশকে পেটান।
এতে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) বাশারসহ সাতজন আহত হন। এ সময় দুটি ট্যাংকলরি ও একটি ট্রাকে অগ্নিসংযোগ এবং ১০-১২টি যানবাহন ভাঙচুর করা হয়।
এদিকে গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তির (ফাঁসি) দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চও গতকাল হরতাল পালন করে। আজ জামায়াতের ডাকা হরতাল প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ।
রোজায় হরতাল, অবরোধসহ বড় ধরনের কর্মসূচি সচরাচর এড়িয়ে চলে রাজনৈতিক দলগুলো।
কিন্তু হঠাৎ রমজান মাসে জামায়াতের টানা হরতালে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে কর্মজীবী মানুষ। দুই দিনের হরতালে রাজধানী ঢাকায় কিছু যানবাহন চলাচল করলেও মূলত সারা দেশের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে জনদুর্ভোগের পাশাপাশি রোজার শুরুতে যেসব ব্যবসায়ী রাজধানী থেকে ঈদের মালামাল কেনাকাটা করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেন, তাঁরাও বিপাকে পড়েছেন। এর রেশ পড়েছে নগরের বিপণিবিতান, ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে কম রোজগারের খেটে খাওয়া মানুষজনের ওপর।
রাজধানীতে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা: রাজধানীতে ঢিলেঢালা হরতালে জামায়াত-শিবির বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ককটেল বিস্ফোরণ, গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা চালায়।
সকাল সাতটার দিকে ডেমরার রানীমহল সিনেমা হলের সামনে ঝটিকা মিছিল থেকে একটি মাইক্রোবাসে আগুন দেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। এ ছাড়া রামপুরা, পল্লবী, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, মগবাজার এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে জামায়াত-শিবিরের ঝটিকা মিছিল বের হয়। পুলিশ বাধা দিলে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে রাজধানীর পান্থপথে শিবিরের একটি ঝটিকা মিছিল থেকে অন্তত ১৫টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। পান্থপথের ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন কার্যালয়ের নিচে রাখা পাঁচটি অটোরিকশা ও দুটি গাড়ি ভাঙচুর করে হামলাকারীরা।
সেখানে দৈনিক ইত্তেফাক-এর নির্বাহী সম্পাদক ও মুজাহিদের মামলার সাক্ষী শাহীন রেজা নূরের গাড়িও ভাঙচুর করা হয়।
শাহীন রেজা নূর শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের বড় ছেলে। তিনি জানান, মিছিলকারীদের হাতে লাঠি-রড ও ইটপাটকেল ছিল। ভাঙচুরের সময় তিনি গাড়ি থেকে নেমে পাশের একটি গলিতে আশ্রয় নেন।
সাতক্ষীরায় দুজন নিহত: প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার পাওখালীতে হরতাল চলাকালে পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
এ সময় পুলিশের গুলিতে জামায়াতের কর্মী রুহুল আমিন গাজী (৩৫) ও শিবিরের সাথি আরিফুজ্জামান (১৫) নিহত এবং আরও ছয়জন আহত হন।
রুহুল কালীগঞ্জ উপজেলার রঘুরামপুর গ্রামের নূর ইসলাম গাজীর ছেলে। আর আরিফুজ্জামান বাজার গ্রামের আফতাবউদ্দিনের ছেলে। কালীগঞ্জ সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার তাজুল ইসলাম জামায়াত-শিবিরের দুজন কর্মী নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার তাজুল ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী, গতকাল ভোর পাঁচটার দিকে পাওখালীতে কালীগঞ্জ-শ্যামনগর সড়কে গাছের গুঁড়ি ও বিদ্যুতের খুঁটি ফেলে পাশেই একটি নির্জন স্থানে অবস্থান নেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা।
খবর পেয়ে ছয়টার দিকে ৩৫-৪০ জনের একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে গাছের গুঁড়ি সরানোর চেষ্টা করে। একপর্যায়ে নির্জন স্থানে লুকিয়ে থাকা জামায়াত-শিবিরের ৩০০-৪০০ কর্মী লাঠিসোঁটা নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালান। তাঁরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ১৪-১৫টি গুলিও ছোড়েন। এতে পুলিশের নয়জন সদস্য আহত হন। পুলিশও গুলি চালিয়ে পাল্টা জবাব দেয়।
গাজীপুরে শিশু নিহত: দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে গাজীপুর সদরের চান্দনা চৌরাস্তা মোড় এলাকায় গাজীপুর থেকে ভালুকাগামী একটি বাসে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। এ সময় বাসটির পাশে থাকা একটি মিনিবাস পেছনে সরতে গিয়ে পথচারী শিশু নাদিয়াকে (৯) চাপা দেয়। এতে মাথা থেঁতলে ঘটনাস্থলেই মারা যায় সে।
শিশুটির মা নূরুন্নাহার জানান, রোদের মধ্যে অনেক সময় ধরে তিনি মেয়েকে নিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ কারণে মেয়েকে একটি বাসের পেছনে ছায়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন তিনি।
দিনাজপুরে ভ্যানের আরোহী নিহত: হরতালের সমর্থনে পিকেটিংয়ের উদ্দেশ্যে সোমবার রাত থেকে দিনাজপুর-সৈয়দপুর মহাসড়কের রানীরবন্দরে অবস্থান নেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। ভোরের দিকে তাঁরা রানীরবন্দর বাজারে পিকেটিং শুরু করেন। সেখানে অন্তত ১০টি ট্রাক ভাঙচুর করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ছয়টার দিকে ওই পথ দিয়ে একটি ট্যাংকলরি যাওয়ার সময় সেটিও পিকেটারদের রোষানলে পড়ে। তারা ট্যাংকলরি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ করলে তা গিয়ে লরির চালক হাসান আলী (৩৬) ও তাঁর সহকারী রমজান আলীর (৩০) মাথায় লাগে।
এ সময় হাসান আলী নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে লরিটি যাত্রীবাহী একটি ভ্যানকে চাপা দিয়ে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে। এতে ভ্যানচালক আমিনুল ইসলাম (৩৫) ও আরোহী আবদুল কুদ্দুস (৫০) আহত হন। পরে আবদুল কুদ্দুস দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। লরির চালক, তাঁর সহকারী ও ভ্যানচালককে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১১ জন আহত: বেলা ১১টার দিকে হরতালের সমর্থনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের মসজিদপাড়া ও পুরাতন বাজারে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের করে শিবির।
মিছিল থেকে বেশ কয়েকটি ককটেল ফাটানো হয়। এতে চার শিশুসহ ১১ জন আহত হয়।
জামায়াতের বিবৃতি: সরকারের সমালোচনা করে জামায়াতে ইসলামীর বিবৃতিতে বলা হয়, সরকার রোজার মাসেও দেশবাসীকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। গত দুই দিনে সারা দেশে সাতজন নেতা-কর্মীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। শতাধিক নেতা-কর্মীকে আহত ও দুই শতাধিক কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পৃথক বিবৃতিতে দলের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ সাতক্ষীরায় পুলিশের গুলিতে জামায়াতের কর্মী রুহুল আমীন ও শিবিরের কর্মী শরিফুল নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদ জানান। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।