কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!! প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
(এই লেখাটা ফেসবুকে প্রকাশের পর অনেকের ভালবাসামাখা কমেন্ট পেয়েছিলাম। সেই সাহসে ব্লগে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্ব প্রকাশের পর এই শেষ পর্ব পোস্ট করলাম। ধন্যবাদ। )
খুন করে ফেলার পর সে সোজা চলে যাবে মানবাধিকার সংস্থার অফিসে। সেখান থেকে টিভি ক্রু এবং পত্রিকার লোকজনকে নিয়ে সে সবার সামনে শুরু করবে আমরণ অনশন।
তাকে খুঁজতে খুঁজতে পুলিশ, ইয়োহান ক্রুইফের দলবল, অ্যানাটমি ল্যাবের কর্মচারীদের কয়েকজন, আকরামদের গ্রুপের প্রায় পঞ্চাশটা পোলাপান এবং আরও অনেক মানুষ, যারা দুদিন আগেই ফেসবুকে তাকে নিয়ে লেখা অসাধারণ একটা গল্প পড়েছে ও পাগলের মত শেয়ার দিয়েছে তারা তাকে দেখতে আসবে। সৃষ্টি হবে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির, তার মৃত্যুর কপিরাইট নিয়ে মারামারি বেঁধে যাবে সব গ্রুপের মধ্যে।
পুলিশ বলবে, সে খুনি। তাকে আমাদের হাতে ছেড়ে দিন।
ক্রুইফ বলবেন, এটা কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট।
এই টাকার একটা অংশ দিয়ে তোমাদের পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্ট কিনে ফেলা যায়। ওকে আমরা নিয়ে যাব।
আকরাম বলবে, তার আজকে এই অবস্থা কেন? কারণ সে অপোজিট গ্রুপের কাছে মাইর খাইছে। ওরে আমাদের দরকার। ও খুনি হইলে অপোজিট গ্রুপের নেতাও খুনি, তারে ধরেন আগে।
আহারে বেচারা তো ক্যান্সারে দুই দিন পর এমনিতেই মারা যাবে।
অ্যানাটমি ল্যাবের মামারা বলবে, সে তো এমনিও মারা যাবে অমনিও মারা যাবে এত টানাহেঁচড়া করে কি লাভ? ও যেভাবেই মরুক, বডিটা যেন পোস্টমর্টেমের জন্য আমাদের মেডিকেলে পাঠানো হয়।
মানবাধিকার সংস্থার লোকজন বলবে, ও কোথাও যাবে না। ও আমাদের সম্পত্তি। ওর কারণে আমরা যে ফান্ড পাব সেটা দিয়ে বাংলাদেশকেও কিনে ফেলা যাবে।
আর ঠিক তখনই উপস্থিত জনতার মধ্যে শুরু হয়ে যাবে গোলমাল, মারামারি, কামড়াকামড়ি। হাজার হাজার মানুষ মারামারি করতে করতে এগিয়ে আসতে থাকবে তার দিকে। সে তখন স্মিত হাস্যে অনশনে মগ্ন।
একদল ধরবে তার এক হাত, এক দল আরেক হাত। দু পা ধরবে আরও দুটি দল।
মাথার দিকে কেউ একজন ধরবে। তারপর চলবে প্রচণ্ড টানাটানি।
একসময় প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে কেউ একজন বলে উঠবে, আমি দেখেছি, ধড় থেকে মাথাটা আলাদা হবার আগেও ওর মুখে স্মিত হাসি ছিল।
আর তার কদিন পরই, তার আলমারি থেকে বের হবে গোপন সেই ডায়েরি। ডায়েরি দেখে গ্রেফতার করা হবে প্রথিতযশা সেই ব্যক্তিকে।
বড় শত্রুকে খুন করার মদদ প্রদানের অপরাধে”।
-শুনলেন?
-হুম।
-অনেস্টলি, আপনার ফিনিশিং আমার ভালো লাগে নি। লাস্টে কোন কারণ ছাড়াই দুইজনকে মেরে ফেললেন।
-ইট হ্যাড টু বি ডান।
-মানে? আপনি কি আসলেই এরকম কোন প্ল্যান করছেন নাকি?
-তেমন কিছু না। এখন একটা কাজ করুন, লেখাটা ফেসবুকে আপলোড দিন।
-এখনই?
-হুম।
-তারপর?
-ইউ উইল সি।
জনপ্রিয় লেখক সালেহ তিয়াস তার সামনে দাঁড়ানো আপাতদৃষ্ট সাইকো মানুষটির কথায় বড় গল্পটার প্রথম চার পঞ্চমাংশ ফেসবুকে আপলোড দিলেন।
ব্লগে আপলোড দিলেন। তারপর বললেন, আপনার নাম দিব?
মানুষটি বলল, দেয়াটা ইম্পরট্যান্ট।
সালেহ তিয়াস পুনশ্চতে লিখলেন, এই গল্পের সমস্ত আইডিয়া জনৈক হাসান আহমেদের কাছ থেকে পাওয়া। হাসান আহমেদ দাবি করেন, এই সমস্তই তার নিজের জীবনের ঘটনা। এই মুহূর্তে তিনি আমার পাশেই বসে আছেন।
এই চমৎকার গল্পের শেষটা জানতে চাইলে চোখ রাখুন আগামী বইমেলায়, “একজন মৃত্যু বিক্রেতা” শিরোনামে একটা জমজমাট উপন্যাস আসছে আমার লেখা। অথবা সরাসরি ফোন করুন ০১৭১৭৪২০৪২০ নাম্বারে, ওটা হাসান আহমেদের নাম্বার।
-হয়েছে?
-আমার একটা ছবি দিয়ে দেন।
সালেহ তিয়াস তার মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে হাসান আহমেদের একটা ছবি তুললেন। অতঃপর সেটা আপলোড করে দিলেন গল্পের একদম শেষে।
-আমার কাজ শেষ। নাউ, লেট মি গো।
-কিন্তু আমার কাজ তো শেষ হয় নি।
-হয়েছে। আপনি হুট করে আমার ঘরে ঢুকে...
-স্টপ!!! কি শর্ত ছিল?
-সরি।
সরি।
হাসান আহমেদ তার কোল্ট ০০৭ রিভলভারটার বাঁট দিয়ে সালেহ তিয়াসের মাথার পিছনের বাবরি চুল ঠিক করে দিতে লাগল। সালেহ তিয়াস ভয়ে কেঁপে উঠলেন আরও একবার।
এক ঘণ্টা পর হাসান বলল, কয়টা লাইক পড়ল দেখেন।
সালেহ তিয়াস দেখলেন।
১০৯৮ টা।
হিসহিসে কণ্ঠে হাসান বলল, তো, মিস্টার সালেহ তিয়াস। এখনও আমার প্ল্যানের শেষ অংশ বাকি। আই থিংক ইউ নো।
-হোয়াট!
-আপনি কি মিজান রহমানকে চিনেন?
-কে? কাউয়া মিজান?
-হ্যাঁ।
আধুনিক কবি। বিমূর্ত কবি। যার আধুনিক কবিতা পড়ে কিছু না বুঝেই লোকজন জোস জোস করে।
-চিনি তো।
-কাউয়ার উপর আপনার অনেক দিনের রাগ।
তার বিরুদ্ধে, তার লেখার বিরুদ্ধে আপনি ফেসবুকে অনেক লেখালেখি করেছেন, লাভ হয় নি। উল্টো কাউয়া মিজান আরও বেশি জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছে।
-হুম।
-কাউয়া মিজান দু বছর আগে আপনাকে প্রকাশ্যে অপমান করেছে। সেই অপমানের শোধ নেবার জন্য আপনি কাউয়াকে পচিয়ে একটা উপন্যাস লিখেছেন “কাউয়া গু খায়” শিরোনামে।
কাউয়াও আপনাকে ছাড়ে নি, আপনার বিরুদ্ধে নিক্ষেপ করেছে একের পর এক প্রাণঘাতী কবিতা। এভাবে আপনারা অচিরেই একে অপরের চরম শত্রু হয়ে গেছেন।
-হুম। আপনি দেখি সবই জানেন।
-আপনার কাছে আসার আগে আমার সাথে কে ছিল জানেন?
-কে ছিল?
-কাউয়া মিজান।
মদ্যপ।
-ও।
-আজকে যে আপনি বাসায় একা এই তথ্য আমাকে কে দিল জানেন?
-কে?
-কাউয়া মিজান। ক্যান্সারের পেশেন্ট বললেই যে আপনি দরজা খুলে দেবেন এটা আমায় কে বলল জানেন?
-কাউয়া মিজান?
-না এটা আমার নিজের অনুমান। আমার অনুমানশক্তি ভালো, কি বলেন?
-আপনি আসলে কি বলতে চাচ্ছেন আমাকে?
-আমি বলতে চাচ্ছি ঠিক এই মুহূর্তে আমি আপনাকে খুন করব।
কাউয়া মিজান আমাকে খুনের মদদ দিয়েছে সেটার রেকর্ড করা ভয়েস আমার কাছে আছে। আপনার মৃত্যুর পরে ঐ ভয়েস শুনেই গ্রেফতার করা হবে কাউয়া মিজানকে। শাস্তি হিসেবে কেড়ে নেয়া হবে তার লেখালেখি করার অধিকার। মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ শাস্তি, কি বলেন?
-প্লিজ, আই হ্যাভ অ্যা ফ্যামিলি। হ্যাভ মার্সি।
-ইয়া আই অ্যাম মার্সিফুল। এইজন্য আপনাকে একেবারে শেষ করে দিচ্ছি।
-প্লিজ।
একটা ক্লিকের শব্দ। তারপর ঠাস করে গুলি করার শব্দ।
প্রচণ্ড ব্যথা। চিৎকার। অন্ধকার।
চ্যাপ্টার ২
-এখন আমি আপনাকে আমার জীবনের কিছু কাহিনী শোনাব। আপনি শুনবেন, শুনে কম্পিউটারে লিখে ফেলবেন।
এখনই।
-আগের আমার কথাটা শুনুন...
-আমার একটা শর্ত আছে। যতক্ষণ আমি এখানে থাকব আমার সাথে এই রিভলভার সংক্রান্ত কোন কথা বলা যাবে না, বাঁচাও বাঁচাও ছেড়ে দাও এই টাইপ কোন কথা বলা যাবে, আমার ফ্যামিলি আছে হ্যাংত্যাং এগুলোও বলা যাবে না। কথা হবে শুধু গল্প নিয়ে, ওকে?
-প্লিজ...
-এই রিভলভারে গুলি আছে পাঁচটা। শর্ত না মানলে আপনার জন্য একটা, স্ত্রীর জন্য একটা, ছেলের জন্য একটা আর অনেক অপ্রকাশিত লেখা সম্বলিত হার্ডডিস্কের জন্য দুটি গুলি খরচ করতে প্রস্তুত আছি আমি।
আর শর্ত মানলে, ভেরি গুড।
-প্লিজ...
-এখন মন দিয়ে শুনুন। আমার কথার মধ্যে কথা বলবেন না, কনসেন্ট্রেশন নষ্ট হয়।
চ্যাপ্টার ১
নিজের অনেক সাধের ডেল ল্যাপটপটা টেবিলের উপর রেখে রকিং চেয়ারে আয়েশ করে দোল খাচ্ছিলেন বিখ্যাত লেখক সালেহ তিয়াস। বইমেলা সামনে, মাত্র দু মাস পর, বিভিন্ন প্রকাশনী এরই মধ্যে ধর্না দেওয়া শুরু করেছে।
অগ্রিম হিসাব করলে ত্রিশ লাখ মত ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে।
সালেহ চিন্তা করছেন, কিন্তু প্লট পাচ্ছেন না। পুতুপুতু প্রেমের গল্প তিনি লেখেন না, তার জেনার টুইস্ট আর সাইকো থ্রিলার। কিন্তু একটানা এইসব সাইকো গল্প লিখতে আর কতই বা ভালো লাগে?
ফেসবুক ওপেন করলেন সালেহ তিয়াস। দেখলেন, তার এবং তার চিরশত্রু কাউয়া মিজানের অহি নকুল সম্পর্ক নিয়ে Troll বানিয়েছে একটা অখ্যাত পেজ।
সব শালার খালি হিট পাবার ধান্দা। যত্তোসব।
কাউয়া মিজানের কথা মনে পড়তেই মুখের ভিতরটা কেমন তেতো হয়ে গেল সালেহ তিয়াসের। এই শালা কাউয়া আধুনিক কবিতা লেখে, কবিতার আগামাথা বালছাল কিছুই বোঝা যায় না। একবার তিনি কাউয়ার একটা কবিতা দেখলেন এরকম,
তু মি
শুধু আমার শুধু আমার শুধু আমার
নিস্তব্ধ গ হি ন অ র ণ্যে
আমার-র--র---র
গীতিকাব্য!
এই কবিতার আগামাথা কিছুই তিনি বুঝতে পারলেন না।
অথচ বইমেলায় দেখা গেল এই রকম অসংখ্য কবিতা অলা কাউয়ার “এক ঝাঁক বিমূর্ত লাভোসাবা” নামক বই মারমার কাটকাট বিক্রি হচ্ছে।
তিনি ফেসবুকে লিখলেন, মিজানের লেখার মর্ম আমি অনেক সাধনা করেও উদ্ধার করতে পারলাম না।
সাথে সাথে কাউয়া মিজানের কাউয়া ফ্যানের দল কমেন্টের তোড়ে ভাসিয়ে তাকে আমেরিকা পাঠিয়ে দিল। তাদের বক্তব্য হচ্ছে এরকম, কবিতা কি বোঝার জিনিস? কবিতা হচ্ছে অনুভবের জিনিস। কবি লিখবেন, আমরা আবছা আবছা বুঝব, আবার বুঝব না, একেক জন একেক অর্থ করবে, এটাই তো আধুনিক কবিতার নিয়ম।
ছন্দ মিলিয়ে সরল অর্থের ছড়া লেখার দিন শেষ।
আর ঠিক সেদিন থেকেই সালেহ তিয়াস প্রতিজ্ঞা করলেন, সাহিত্য থেকে এই বিমূর্ত অংশটিকে ঝেটিয়ে বিদায় করবেন।
যাই হোক, তারপর থেকেই তার আর কাউয়া মিজানের মধ্যে অহি নকুল সম্পর্ক।
হঠাৎ দরজায় করাঘাত। টক টক টক টক।
কে?
স্যার আমার নাম হাসান, খুব দরকারে আপনার কাছে এসেছি স্যার।
কই তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে বলে তো আমার মনে হয় না।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই স্যার, খুব আর্জেন্ট স্যার, আমি ক্যান্সারের পেশেন্ট স্যার।
ওহ...
প্লিজ স্যার একটু দয়া করুন স্যার। খুলুন স্যার।
সালেহ তিয়াস উঠে গিয়ে দরজা খুললেন। হাসান নামক মানুষটা রুমে ঢুকে তার দিকে একটা পিস্তল তাক করল।
দি ফাইনাল চ্যাপ্টার
২৩ ফেব্রুয়ারি। বইমেলা।
“একজন মৃত্যু বিক্রেতা” নামক বইটা হাতে নিয়ে হাসিহাসি মুখে স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বর্তমান সময়ের প্রখ্যাত লেখক সালেহ তিয়াস।
“একজন মৃত্যু বিক্রেতা” মারমার কাটকাট বিক্রি হচ্ছে। ছেলে মেয়ে বুড়ো খোকা সবাই হামলে পড়ে কিনছে। সালেহ একা অটোগ্রাফ দিয়ে কুলাতে পারছেন না। তার অটোগ্রাফের সিল তৈরির অর্ডার দেয়া হয়েছে।
এই ফাঁকে একটা মেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, হাসান আহমেদ কি সত্যিই আছেন?
হ্যাঁ আছেন।
আপনি যা লিখেছেন সব উনার জীবনের কাহিনী।
হ্যাঁ ঠিক তাই।
উনি কি বেঁচে আছেন না মারা গেছেন?
তোমার কি মনে হয়?
আমার তো মনে হয় বেঁচে আছেন। আপনার বইতে লেখা উনি শাপলা চত্ত্বরে অনশন করবেন, আমার বাসা তো ওদিকেই, কই একদিনও তো দেখলাম না।
সালেহ তিয়াস একটা মুচকি হাসি দিলেন।
এই হাসির অর্থ তিনি নিজেও জানেন না।
হাসান আহমেদ বলে আসলেই কি কেউ আছেন? নাকি সেটা পুরোটাই সালেহ তিয়াসের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা? সে যেটাই হোক, পাঠক পড়ে গেছে ব্যাপক কনফিউশনে।
এই কনফিউশনটাই, প্রকাশককে বলেছিলেন সালেহ তিয়াস, সে প্রায় ছয় মাস আগের কথা, বইটা বিক্রি হতে সাহায্য করবে।
সালেহ তিয়াস তার মাথার ফুলে ওঠা জায়গাটায় একটু হাত বুলিয়ে নিলেন। উপস্থিত পাঠক আহ উহ করে উঠল।
তারা ভাবছে, আহা কি ব্যথাটাই না পেয়েছেন তাদের প্রিয় লেখক। তারা যেটা জানে না, সেটা হচ্ছে, মাথার চামড়ায় একটা ছোট্ট intra-dermal injection দিলেও ঠিক এভাবেই ফুলে ওঠা সম্ভব।
(সমাপ্ত)
খুন করে ফেলার পর সে সোজা চলে যাবে মানবাধিকার সংস্থার অফিসে। সেখান থেকে টিভি ক্রু এবং পত্রিকার লোকজনকে নিয়ে সে সবার সামনে শুরু করবে আমরণ অনশন। তাকে খুঁজতে খুঁজতে পুলিশ, ইয়োহান ক্রুইফের দলবল, অ্যানাটমি ল্যাবের কর্মচারীদের কয়েকজন, আকরামদের গ্রুপের প্রায় পঞ্চাশটা পোলাপান এবং আরও অনেক মানুষ, যারা দুদিন আগেই ফেসবুকে তাকে নিয়ে লেখা অসাধারণ একটা গল্প পড়েছে ও পাগলের মত শেয়ার দিয়েছে তারা তাকে দেখতে আসবে।
সৃষ্টি হবে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির, তার মৃত্যুর কপিরাইট নিয়ে মারামারি বেঁধে যাবে সব গ্রুপের মধ্যে।
পুলিশ বলবে, সে খুনি। তাকে আমাদের হাতে ছেড়ে দিন।
ক্রুইফ বলবেন, এটা কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট। এই টাকার একটা অংশ দিয়ে তোমাদের পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্ট কিনে ফেলা যায়।
ওকে আমরা নিয়ে যাব।
আকরাম বলবে, তার আজকে এই অবস্থা কেন? কারণ সে অপোজিট গ্রুপের কাছে মাইর খাইছে। ওরে আমাদের দরকার। ও খুনি হইলে অপোজিট গ্রুপের নেতাও খুনি, তারে ধরেন আগে। আহারে বেচারা তো ক্যান্সারে দুই দিন পর এমনিতেই মারা যাবে।
অ্যানাটমি ল্যাবের মামারা বলবে, সে তো এমনিও মারা যাবে অমনিও মারা যাবে এত টানাহেঁচড়া করে কি লাভ? ও যেভাবেই মরুক, বডিটা যেন পোস্টমর্টেমের জন্য আমাদের মেডিকেলে পাঠানো হয়।
মানবাধিকার সংস্থার লোকজন বলবে, ও কোথাও যাবে না। ও আমাদের সম্পত্তি। ওর কারণে আমরা যে ফান্ড পাব সেটা দিয়ে বাংলাদেশকেও কিনে ফেলা যাবে।
আর ঠিক তখনই উপস্থিত জনতার মধ্যে শুরু হয়ে যাবে গোলমাল, মারামারি, কামড়াকামড়ি।
হাজার হাজার মানুষ মারামারি করতে করতে এগিয়ে আসতে থাকবে তার দিকে। সে তখন স্মিত হাস্যে অনশনে মগ্ন।
একদল ধরবে তার এক হাত, এক দল আরেক হাত। দু পা ধরবে আরও দুটি দল। মাথার দিকে কেউ একজন ধরবে।
তারপর চলবে প্রচণ্ড টানাটানি।
একসময় প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে কেউ একজন বলে উঠবে, আমি দেখেছি, ধড় থেকে মাথাটা আলাদা হবার আগেও ওর মুখে স্মিত হাসি ছিল।
আর তার কদিন পরই, তার আলমারি থেকে বের হবে গোপন সেই ডায়েরি। ডায়েরি দেখে গ্রেফতার করা হবে প্রথিতযশা সেই ব্যক্তিকে। বড় শত্রুকে খুন করার মদদ প্রদানের অপরাধে”।
-শুনলেন?
-হুম।
-অনেস্টলি, আপনার ফিনিশিং আমার ভালো লাগে নি। লাস্টে কোন কারণ ছাড়াই দুইজনকে মেরে ফেললেন।
-ইট হ্যাড টু বি ডান।
-মানে? আপনি কি আসলেই এরকম কোন প্ল্যান করছেন নাকি?
-তেমন কিছু না।
এখন একটা কাজ করুন, লেখাটা ফেসবুকে আপলোড দিন।
-এখনই?
-হুম।
-তারপর?
-ইউ উইল সি।
জনপ্রিয় লেখক সালেহ তিয়াস তার সামনে দাঁড়ানো আপাতদৃষ্ট সাইকো মানুষটির কথায় বড় গল্পটার প্রথম চার পঞ্চমাংশ ফেসবুকে আপলোড দিলেন। ব্লগে আপলোড দিলেন।
তারপর বললেন, আপনার নাম দিব?
মানুষটি বলল, দেয়াটা ইম্পরট্যান্ট।
সালেহ তিয়াস পুনশ্চতে লিখলেন, এই গল্পের সমস্ত আইডিয়া জনৈক হাসান আহমেদের কাছ থেকে পাওয়া। হাসান আহমেদ দাবি করেন, এই সমস্তই তার নিজের জীবনের ঘটনা। এই মুহূর্তে তিনি আমার পাশেই বসে আছেন। এই চমৎকার গল্পের শেষটা জানতে চাইলে চোখ রাখুন আগামী বইমেলায়, “একজন মৃত্যু বিক্রেতা” শিরোনামে একটা জমজমাট উপন্যাস আসছে আমার লেখা।
অথবা সরাসরি ফোন করুন ০১৭১৭৪২০৪২০ নাম্বারে, ওটা হাসান আহমেদের নাম্বার।
-হয়েছে?
-আমার একটা ছবি দিয়ে দেন।
সালেহ তিয়াস তার মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে হাসান আহমেদের একটা ছবি তুললেন। অতঃপর সেটা আপলোড করে দিলেন গল্পের একদম শেষে।
-আমার কাজ শেষ।
নাউ, লেট মি গো।
-কিন্তু আমার কাজ তো শেষ হয় নি।
-হয়েছে। আপনি হুট করে আমার ঘরে ঢুকে...
-স্টপ!!! কি শর্ত ছিল?
-সরি। সরি।
হাসান আহমেদ তার কোল্ট ০০৭ রিভলভারটার বাঁট দিয়ে সালেহ তিয়াসের মাথার পিছনের বাবরি চুল ঠিক করে দিতে লাগল। সালেহ তিয়াস ভয়ে কেঁপে উঠলেন আরও একবার।
এক ঘণ্টা পর হাসান বলল, কয়টা লাইক পড়ল দেখেন।
সালেহ তিয়াস দেখলেন। ১০৯৮ টা।
হিসহিসে কণ্ঠে হাসান বলল, তো, মিস্টার সালেহ তিয়াস। এখনও আমার প্ল্যানের শেষ অংশ বাকি। আই থিংক ইউ নো।
-হোয়াট!
-আপনি কি মিজান রহমানকে চিনেন?
-কে? কাউয়া মিজান?
-হ্যাঁ। আধুনিক কবি।
বিমূর্ত কবি। যার আধুনিক কবিতা পড়ে কিছু না বুঝেই লোকজন জোস জোস করে।
-চিনি তো।
-কাউয়ার উপর আপনার অনেক দিনের রাগ। তার বিরুদ্ধে, তার লেখার বিরুদ্ধে আপনি ফেসবুকে অনেক লেখালেখি করেছেন, লাভ হয় নি।
উল্টো কাউয়া মিজান আরও বেশি জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছে।
-হুম।
-কাউয়া মিজান দু বছর আগে আপনাকে প্রকাশ্যে অপমান করেছে। সেই অপমানের শোধ নেবার জন্য আপনি কাউয়াকে পচিয়ে একটা উপন্যাস লিখেছেন “কাউয়া গু খায়” শিরোনামে। কাউয়াও আপনাকে ছাড়ে নি, আপনার বিরুদ্ধে নিক্ষেপ করেছে একের পর এক প্রাণঘাতী কবিতা।
এভাবে আপনারা অচিরেই একে অপরের চরম শত্রু হয়ে গেছেন।
-হুম। আপনি দেখি সবই জানেন।
-আপনার কাছে আসার আগে আমার সাথে কে ছিল জানেন?
-কে ছিল?
-কাউয়া মিজান। মদ্যপ।
-ও।
-আজকে যে আপনি বাসায় একা এই তথ্য আমাকে কে দিল জানেন?
-কে?
-কাউয়া মিজান। ক্যান্সারের পেশেন্ট বললেই যে আপনি দরজা খুলে দেবেন এটা আমায় কে বলল জানেন?
-কাউয়া মিজান?
-না এটা আমার নিজের অনুমান। আমার অনুমানশক্তি ভালো, কি বলেন?
-আপনি আসলে কি বলতে চাচ্ছেন আমাকে?
-আমি বলতে চাচ্ছি ঠিক এই মুহূর্তে আমি আপনাকে খুন করব। কাউয়া মিজান আমাকে খুনের মদদ দিয়েছে সেটার রেকর্ড করা ভয়েস আমার কাছে আছে।
আপনার মৃত্যুর পরে ঐ ভয়েস শুনেই গ্রেফতার করা হবে কাউয়া মিজানকে। শাস্তি হিসেবে কেড়ে নেয়া হবে তার লেখালেখি করার অধিকার। মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ শাস্তি, কি বলেন?
-প্লিজ, আই হ্যাভ অ্যা ফ্যামিলি। হ্যাভ মার্সি।
-ইয়া আই অ্যাম মার্সিফুল।
এইজন্য আপনাকে একেবারে শেষ করে দিচ্ছি।
-প্লিজ।
একটা ক্লিকের শব্দ। তারপর ঠাস করে গুলি করার শব্দ। প্রচণ্ড ব্যথা।
চিৎকার। অন্ধকার।
চ্যাপ্টার ২
-এখন আমি আপনাকে আমার জীবনের কিছু কাহিনী শোনাব। আপনি শুনবেন, শুনে কম্পিউটারে লিখে ফেলবেন। এখনই।
-আগের আমার কথাটা শুনুন...
-আমার একটা শর্ত আছে। যতক্ষণ আমি এখানে থাকব আমার সাথে এই রিভলভার সংক্রান্ত কোন কথা বলা যাবে না, বাঁচাও বাঁচাও ছেড়ে দাও এই টাইপ কোন কথা বলা যাবে, আমার ফ্যামিলি আছে হ্যাংত্যাং এগুলোও বলা যাবে না। কথা হবে শুধু গল্প নিয়ে, ওকে?
-প্লিজ...
-এই রিভলভারে গুলি আছে পাঁচটা। শর্ত না মানলে আপনার জন্য একটা, স্ত্রীর জন্য একটা, ছেলের জন্য একটা আর অনেক অপ্রকাশিত লেখা সম্বলিত হার্ডডিস্কের জন্য দুটি গুলি খরচ করতে প্রস্তুত আছি আমি। আর শর্ত মানলে, ভেরি গুড।
-প্লিজ...
-এখন মন দিয়ে শুনুন। আমার কথার মধ্যে কথা বলবেন না, কনসেন্ট্রেশন নষ্ট হয়।
চ্যাপ্টার ১
নিজের অনেক সাধের ডেল ল্যাপটপটা টেবিলের উপর রেখে রকিং চেয়ারে আয়েশ করে দোল খাচ্ছিলেন বিখ্যাত লেখক সালেহ তিয়াস। বইমেলা সামনে, মাত্র দু মাস পর, বিভিন্ন প্রকাশনী এরই মধ্যে ধর্না দেওয়া শুরু করেছে। অগ্রিম হিসাব করলে ত্রিশ লাখ মত ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে।
সালেহ চিন্তা করছেন, কিন্তু প্লট পাচ্ছেন না। পুতুপুতু প্রেমের গল্প তিনি লেখেন না, তার জেনার টুইস্ট আর সাইকো থ্রিলার। কিন্তু একটানা এইসব সাইকো গল্প লিখতে আর কতই বা ভালো লাগে?
ফেসবুক ওপেন করলেন সালেহ তিয়াস। দেখলেন, তার এবং তার চিরশত্রু কাউয়া মিজানের অহি নকুল সম্পর্ক নিয়ে Troll বানিয়েছে একটা অখ্যাত পেজ। সব শালার খালি হিট পাবার ধান্দা।
যত্তোসব।
কাউয়া মিজানের কথা মনে পড়তেই মুখের ভিতরটা কেমন তেতো হয়ে গেল সালেহ তিয়াসের। এই শালা কাউয়া আধুনিক কবিতা লেখে, কবিতার আগামাথা বালছাল কিছুই বোঝা যায় না। একবার তিনি কাউয়ার একটা কবিতা দেখলেন এরকম,
তু মি
শুধু আমার শুধু আমার শুধু আমার
নিস্তব্ধ গ হি ন অ র ণ্যে
আমার-র--র---র
গীতিকাব্য!
এই কবিতার আগামাথা কিছুই তিনি বুঝতে পারলেন না। অথচ বইমেলায় দেখা গেল এই রকম অসংখ্য কবিতা অলা কাউয়ার “এক ঝাঁক বিমূর্ত লাভোসাবা” নামক বই মারমার কাটকাট বিক্রি হচ্ছে।
তিনি ফেসবুকে লিখলেন, মিজানের লেখার মর্ম আমি অনেক সাধনা করেও উদ্ধার করতে পারলাম না।
সাথে সাথে কাউয়া মিজানের কাউয়া ফ্যানের দল কমেন্টের তোড়ে ভাসিয়ে তাকে আমেরিকা পাঠিয়ে দিল। তাদের বক্তব্য হচ্ছে এরকম, কবিতা কি বোঝার জিনিস? কবিতা হচ্ছে অনুভবের জিনিস। কবি লিখবেন, আমরা আবছা আবছা বুঝব, আবার বুঝব না, একেক জন একেক অর্থ করবে, এটাই তো আধুনিক কবিতার নিয়ম। ছন্দ মিলিয়ে সরল অর্থের ছড়া লেখার দিন শেষ।
আর ঠিক সেদিন থেকেই সালেহ তিয়াস প্রতিজ্ঞা করলেন, সাহিত্য থেকে এই বিমূর্ত অংশটিকে ঝেটিয়ে বিদায় করবেন।
যাই হোক, তারপর থেকেই তার আর কাউয়া মিজানের মধ্যে অহি নকুল সম্পর্ক।
হঠাৎ দরজায় করাঘাত। টক টক টক টক।
কে?
স্যার আমার নাম হাসান, খুব দরকারে আপনার কাছে এসেছি স্যার।
কই তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে বলে তো আমার মনে হয় না।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই স্যার, খুব আর্জেন্ট স্যার, আমি ক্যান্সারের পেশেন্ট স্যার।
ওহ...
প্লিজ স্যার একটু দয়া করুন স্যার। খুলুন স্যার।
সালেহ তিয়াস উঠে গিয়ে দরজা খুললেন।
হাসান নামক মানুষটা রুমে ঢুকে তার দিকে একটা পিস্তল তাক করল।
দি ফাইনাল চ্যাপ্টার
২৩ ফেব্রুয়ারি। বইমেলা।
“একজন মৃত্যু বিক্রেতা” নামক বইটা হাতে নিয়ে হাসিহাসি মুখে স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বর্তমান সময়ের প্রখ্যাত লেখক সালেহ তিয়াস।
“একজন মৃত্যু বিক্রেতা” মারমার কাটকাট বিক্রি হচ্ছে।
ছেলে মেয়ে বুড়ো খোকা সবাই হামলে পড়ে কিনছে। সালেহ একা অটোগ্রাফ দিয়ে কুলাতে পারছেন না। তার অটোগ্রাফের সিল তৈরির অর্ডার দেয়া হয়েছে।
এই ফাঁকে একটা মেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, হাসান আহমেদ কি সত্যিই আছেন?
হ্যাঁ আছেন।
আপনি যা লিখেছেন সব উনার জীবনের কাহিনী।
হ্যাঁ ঠিক তাই।
উনি কি বেঁচে আছেন না মারা গেছেন?
তোমার কি মনে হয়?
আমার তো মনে হয় বেঁচে আছেন। আপনার বইতে লেখা উনি শাপলা চত্ত্বরে অনশন করবেন, আমার বাসা তো ওদিকেই, কই একদিনও তো দেখলাম না।
সালেহ তিয়াস একটা মুচকি হাসি দিলেন। এই হাসির অর্থ তিনি নিজেও জানেন না।
হাসান আহমেদ বলে আসলেই কি কেউ আছেন? নাকি সেটা পুরোটাই সালেহ তিয়াসের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা? সে যেটাই হোক, পাঠক পড়ে গেছে ব্যাপক কনফিউশনে।
এই কনফিউশনটাই, প্রকাশককে বলেছিলেন সালেহ তিয়াস, সে প্রায় ছয় মাস আগের কথা, বইটা বিক্রি হতে সাহায্য করবে।
সালেহ তিয়াস তার মাথার ফুলে ওঠা জায়গাটায় একটু হাত বুলিয়ে নিলেন। উপস্থিত পাঠক আহ উহ করে উঠল। তারা ভাবছে, আহা কি ব্যথাটাই না পেয়েছেন তাদের প্রিয় লেখক।
তারা যেটা জানে না, সেটা হচ্ছে, মাথার চামড়ায় একটা ছোট্ট intra-dermal injection দিলেও ঠিক এভাবেই ফুলে ওঠা সম্ভব।
(সমাপ্ত) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।