আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেই ক্রুসেড (তৃতীয় খন্ড)

বিশ্বের নিপীরিত মানুষের শত্রু একটাই এবং তদের ধরন একই, এরা রয়েছে অনেক দূরে। এই শত্রুরা রয়েছে যেখানে থেকে পুঁজিবাদী এলিটদের জন্ম, যেখান থেকে এরা সরকার প্রধানদের ব্যাবহার করে তাদের শক্তি প্রেরণ করে, আর ঐ সরকাররা তাদের তাঁবেদারি করে লাভবান হয়। ১১৭১ সালে সালাহ্‌উদ্দিনের সুলতান হবার পর কপিতয় মিশরিয় নেতার আহ্বানে সিসিলির নর্মান রাজ দ্বিতীয় উইলিয়াম ছয়’শ যুদ্ধজাহাজ ও ত্রিশ হাজার সৈন্যসহ মিশরের অ্যালেক্সজান্ড্রিয়া বন্দর আক্রমন করেন। সালাহ্‌উদ্দিন অবিলম্বে বিদ্রোহী নায়কগণকে ধৃত ও হত্যা করেন এবং সিসিলি রাজ্যের সম্মুখীন হন। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে উইলিয়াম স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন।

এর কয়েক বছর পরে, প্রায় ১১৭৬ সালে সিরিয়ার বালক সুলতান মালেকু শাহ ইসমাইল মন্ত্রী গুমস্তাগীনের পরামর্শে দামেশক থেকে আলেপ্পোয় রাজধানী স্থানাতরিত করেন। এই সুযোগে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী খ্রীষ্টান ক্রুসেডাররা দামেশক নগর অবরোধ করে। এই খবর শুনে সুলতান সালাহ্‌উদ্দিন মাত্র সাত’শ সৈন্য নিয়ে দামেশক উপস্থিত হন। খ্রীষ্টান ক্রুসেডাররা সালাহ্‌উদ্দিনের সাথে বিবাদে না জরিয়ে অবোরধ প্রত্যাহার করে। অপর দিকে সিরিয়ার মন্ত্রী দেখলেন তার উদ্দেশ্য চিরতার্থ হচ্ছে না।

তিনি মৌসল অধিপতি সায়েফউদ্দিন জঙ্গীর ভাতিজা মালেকু সালেহের পক্ষ দামেশক আক্রমন করলে সালাহ্‌উদ্দিনের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে সালাহ্‌উদ্দিন জয়লাভ করেন। তিনি সিরিয়ার তখ্‌তে ভাই তুরান শাহকে শাসন-কতৃত্ব প্রদান করে মিশরে ফিরে আসেন। ইসমাইলী বাতেনী সম্প্রদায়ের জৈনক ব্যাক্তি সুলতান সালাহ্‌উদ্দিনকে হত্যা করার চেষ্টা করে এবং ব্যার্থ হয়। এজন্য সুলতান বাতেনী সম্পরদায়ের বিখ্যাত দলপতি রশিদউদ্দিন সিনান ‘শেখল জবল’-এর বাসস্থান মাসইয়াদ আবরোধ করেন।

শেখল জবল উপায়ন্তুর না দেখে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং শান্তি রক্ষা করে থাকার প্রতিজ্ঞা করেন। যদিও বাতেনী সম্প্রদায় ক্রুসেডে সেভাবে জরিত ছিলো না, কিন্তু তাদের সম্পর্কে বলার লোভটা সংবরন করতে পারছি না। সৈয়দ বংশীয় ইমামদের কথা তো আমরা প্রত্যেকেই কম বেশি জানি। এই ইমামদের ভেতরে ইমাম জাফর সাদেক (রা.) ও ইমাম-এ-আজম ইমাম আবু হানিফা (রা.) সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। আমাদের দেশে যারা হানিফা (রা.) মাজহাব মেনে চলেন তাদের হানাফি বলা হয়।

আর একটা কথা না বললেই না, যারা আবু হানিফার থেকে বেশি ইসলাম বোঝেন তাদের মোহাম্মদী বলা হয়। সৈয়দ বংশ সম্পর্কে আরো জানতে এখানে ক্লিক করুন । উপরের ছবিটি সৈয়দ বংশের প্রথম কয়েকজন ইমামের বংশ তালিকা। সৈয়দ বংশীয় ইমাম জাফর সাদেক তার জৈষ্ঠপুত্র ইসমাঈলকে ইমাম পদে অভিষিক্ত করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু ইসমাঈল যথেষ্ঠ জ্ঞানী হওয়া সত্বেও তার অমিতাচার ও পানাসক্তির সংবাদ ইমাম জাফর সাদেক শোনেন। তিনি তার মত পরবর্তন করেন এবং তার দ্বিতীয় পুত্র মুসা আল কাজেমকে সপ্তম ইমাম পদে মনোনীত করেন।

কিন্তু ইসমাঈল-ভক্তরা বিশ্বাস করতো মদপান বা তদৃশ্য কার্জ্যে ইমাম পদে কোন ক্ষতি হয় না, এরজন্য তিনি অনুপযুক্ত বিবেচিত অথবা ইমাম পদ থেকে বিচ্যুত হতে পারেন না। তারা ইসমাঈলকে গুপ্ত ইমাম এবং তার পুত্র মুহাম্মদকে শেষ ‘প্রেরিত পুরুষ’ বা ‘আল তাম্ম’ বিবেচনা করে থাকে। তাদের মতে জগেতে আল্লাওহর পক্ষ থেকে আদম, নূহ, ইব্রাহীম, মূসা, ঈসা, মুহাম্মদ ও আল তাম্ম এই সাত জন প্রেরিত পুরুষ অবির্ভূত হয়েছেন। এদের প্রত্যেক দুই জনে মধ্যবর্তি সময়ে একজন ‘সামেৎ’ অর্থাৎ নিরব কর্মি এসেছেন। যেমন ইসমাঈল, হারূন, আলী প্রমুখ।

তারা বিশ্বাস করে যে ইসমাঈল অচিরে ঐশীশক্তিতে শক্তিমান হয়ে মেহেদি রূপে পুনঃআগমন করবেন। তাদের এই মতবাদ কে ‘আল বাতেন’ এবং মতবাদে বিশ্বাসী ব্যাক্তিদের ‘বাতেনী’ বা ‘ইসমাঈলী’ বলা হয়। এই মতবাদ যারা প্রচার করে তাদেরকে ‘দাঈ’ বলে হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে ময়মুন কতৃক বাতেনী মতবাদ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি প্রথমতঃ বসরা ও পরে সিরিয়ার সালামিয়া নামক স্থান থেকে বাতেনী মতবাদ গুপ্ত অথচ দৃঢ়ভাবে প্রচার করতে থাকেন।

৮৭৪ সালে আব্দুল্লার মৃত্যুর পর হামাদান আল কারামাৎ নামক তদীয় কুফাবাসী জৈনক শিষ্য বাতেনীদের এক ভিন্ন সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। অতপর আবু সাইদ হাসান আল জান্নাবীর নেতৃত্বে কারমাতিয়া মতবাদ সুদৃঢ় হয় এবনহ তার একান্ত প্রচেষ্টায় পারস্য উপসাগর থেকে এমামা ও ওমান পর্যন্ত ভূভাগ তার শাসনাধীন হয়। ৯০৩ সালে তার পুত্র আবু তাহের সুলাইমান আল কারমাতি দক্ষিণ ইরাক উৎসন্ন ও হজ্বের রাস্তায় বিশ হাজার হজ্বযাত্রীর প্রাণনাশ এবং জম জম কূপে মানব রক্ত দিয়ে শোনিত করে। তিনি কাবার কৃষ্ণ প্রস্থর স্থানান্তরিত করেন (৯২৯-৩০ সাল)। ইমাম গাজ্জালী (রা.)-এর সহপাঠী হাসান ইবনুল সাব্বাহ বাতেনী মতবাতে দীক্ষালাভ করে ১০৯০ সালে উত্তর পারস্যের আলবুর্জ পর্বতের ১০২০০ ফুট উপরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যপূর্ণ এক মনোরম উপত্যাকায় আলামুত (Egale’s Nest) নামক দূর্ভেদ্য দুর্গ নির্মান করে বাতেনী সম্প্রদায়ের কেন্দ্র স্থাপন করেন।

ঐ দুর্গে হাসান ও পরবর্তি বাতেনী নেতৃবিন্দের যত্নে স্বর্গীয় নন্দন-কানন সদৃশ্য এক আপরূপ বাগান নির্মাণ করে ওটাকেই কুরানে বর্ণিত বেহেশত বলে ঘোষনা করা হয়। দরিঞ্জার নামক ক্ষুদ্র নদী আলবুর্জের বরফগলা জলিরাশি বহন করে দুর্গের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হত। বাতেনী মতবাদে দীক্ষিত অনুচরগণ বা ফেদায়ী দ্বারা নানা দেশ থেকে অপহৃতা সুন্দরী রমনীদের ঐ উদ্যানে রাখা হয়েছিলো। তাদেরকে স্বর্গিয় হুর বলা হত। উদ্যানের স্থানে স্থানে স্বর্ণ, রৌপ, হীরক তৈরি অট্টলিকা নির্মিত হয়েছিলো।

যদিও এর বেশির ভাগই ছিলো গিল্টি। গাছে গাছে পাখি গুলো মধুর কন্ঠে কুরানের ‘সালামু আলায়কুম তিবতম ফাদখুলুহা খালিদিন’,’সালামুন কাওলাম্‌মির রাব্বির রাহীম’ ইত্যাদি বাক্য সমূহ উচ্চারণকরে নব আগন্তুকগণকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করতো। বাতেনী মতবাদে নবদিক্ষিত কয়েকজন ব্যাক্তিকে একত্রে মাদকদ্রব্য মিশ্রিত শরবত পান করিয়ে সংজ্ঞালোপ অবস্থায় গাধার পিঠে বা অন্য কোন বাহনে কাজভিন থেকে গভীর অরন্যে, দুর্গম গিরিসঙ্কট ও পার্বত্য সুরঙ্গের ভিতর দিয়ে ঐ বেহেশতে নিয়ে আসা হত। নবদিক্ষিত ফেদিয়াগণ সেখানে ঐ হুর্ব গেলমানদের সহবাসে মত্ত থাকত। তাদের পুনঃ সংজ্ঞাহীন করে কাজভিন নগরে আনা হত।

ঐ বেহেশ্ত সুখের আশায় ফেদিয়াগণ দলপতির আদেশ পালন করতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করতো না। ফেদিয়াদের বিভিন্ন গুপ্তকর্ম এই সকল মানুষদের দ্বারায় করানো হত। এদের হাতেই মন্ত্রী নিজামুল মুলক, নিশাপুরের নজমুদ্দিন কুবরা ও তাতার রাজ মঙ্গু খাঁ নিহত হয়েছিলেন। দীর্ঘ্যকাল পর্যন্ত তাদের আশ্রয়স্থল অক্ষুণ্ন ছিলো। অবশেষে ১২৫৬ সালে তাতার দলপতি হালাকু খাঁ আলামুত ও পার্শ্ববর্তি দুর্গ সমূহ ধ্বংশস্তুপে পরিণত করে বাতেনী সম্প্রদায়ের মূল উৎখাত করেন।

অন্যান্য বাতেনীগন বিভিন্ন মুসলিম জগতে বিভিন্ন জনপদে ছত্রভঙ্গ বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। ১২৭১-৭২ সালে ইতালিয়ান পর্যটক মার্কোপোলো ঐ দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখেন এবং তা ভ্রমনবৃত্তান্তে লিখে রাখেন। জেরুজালেমের রাজা হেনেরী একবার শেখুল জবলের সাথে একবার সাক্ষাত করেন শেখুল জবল তার অনুচরদের বিশ্বস্ততা প্রদর্শনের জন্য দুইজন অনুচরকে প্রাসাদের চূড়া থেকে লাফ দেয়ার আদেশ করেন। অনুচরেরা সাথে সাথে লাফ দিয়ে প্রান ত্যাগ করে তিনি পোষা কবিতরের মাধ্যমে দুরের অনুচরদের কাছে সংবাদ প্রেরন করতেন। (Hitti’s History of the Arabs) চলবে.. পুর্বের খন্ড ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।