আমি সত্য জানতে চাই
উনিশ শতকের বাংলার গুণী নারীদের মধ্যে যিনি স্বমহিমায়, স্বনামে খ্যাত -তিনি হচ্ছেন কানন দেবী। বিখ্যাত ভারতীয় বাঙালি অভিনেত্রী কানন দেবী যিনি কানন বালা নামেও সু-পরিচিত। বাংলা ছবির প্রথম হার্টথ্রব নায়িকা-গায়িকা বলা হয় এই কানন দেবীকে। চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত দুটি মাধ্যমে তিনি ছিলেন অনন্যা। অভিনয় ও সুকণ্ঠের করণেই কাননবালা থেকে তিনি কানন দেবী হতে পেরেছিলেন-আর এজন্যই তিনি কিংবদন্তি।
অতি সামন্য অবস্থা থেকে ভারতীয় চলচিত্রে কিংবদন্তী গাইয়া-নায়িকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
মাত্র দশ বছর বয়সে নির্বাক ছবি ‘জয়দেবে’ রাঁধার ভূমিকায় অভিনয় করে প্রথম পাঁচ টাকা সম্মানী লাভ করেন। বড় হয়ে কানন দেবী রবীন্দ্র সংগীতের পাঠ নেন। কানন দেবী ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি ও আধুনিক গানের সফল গায়িকা । তার কন্ঠে ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’ এবং নজরুল সঙ্গীত ‘ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে আমি বনফুল গো’ এই গান দু’টি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
এইগুনী শিল্পী ১৯৯২ সালের ১৭ জুলাই কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। আজ তাঁর মৃত্যুদিন, মৃত্যুদিনে তাকে স্মরন করছি গভীর শ্রদ্ধায়।
কানন দেবী ১৯১৬ সালের ২২ এপ্রিল ভারতের হাওড়াতে জন্মগ্রহণ করেন। কানন দেবীর ছিলেন একজন রক্ষিতার সন্তান। তার বাবার নাম রতন চন্দ্র দাস।
জন্মের পরপরই তিনি বাবাকে হারান। বড় হয়ে জানতে পারনে, বাবা তার মাকে বিয়ে করেনি। তাঁর বাবা ছিলেন সওদাগর অফিসের একজন ছোট কেরানি। তার একটি ছোট দোকানও ছিল। কিন্তু কাননের বয়স যখন ৯ বছর তখন তিনি মারা যান।
কাননের মা তখন তার ২ কন্যাকে নিয়ে এক দুরসম্পর্কের আত্নীয়ের বাড়িতে রাঁধুনী ও ঝিয়ের কাজ নেন। দারিদ্রের কারনে কানন দেবী মাত্র বার-তের বছর বয়সে ম্যাডানের স্টুডিওতে হাজির হন অভিনয় করতে। তিনি সেই বয়সে নির্বাক ছায়াছবি জয়দেবে অভিনয় করেন নায়িকা হিসেবে।
কানন দেবী ছিলেন সমাজের নিচের তলা থেকে আসা শেষ বড় অভিনেত্রী। অভাবের কারণে কিশোর বয়স থেকেই তাকে পর্দায় নগ্নতার অভিনয় করতে হয়েছে।
নায়ক ও পরিচালকের লোলুপতার শিকার হতে হয়েছে। কেউ হাত ধরে টানাটানি করেছে, কেউ কেউ পিঠে তাত বুলিয়ে আদর করেছে। কারো কারো কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ার তারা প্রতিশোধও নেয় তার ওপর। ১৯৩১ সালের ছবি 'জোর বরাতের' একটি দৃশ্যে নায়ক তাকে জড়িয়ে ধরে ঠোটে চুমু খান যা তাকে অপমানিত ও ব্যাথিত করে। পরিচালকের নির্দেশেই নায়ক এই কাজ করেন তাকে আগে না জানিয়েই।
অভিভাবকহীন নিচু ঘরের মেয়ে হওয়ায় তাকে টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে নগ্ন দৃশ্যে বাধ্য করা হয়। এ রকম একটি ছবি হলো 'বাসব দত্তা'। এ ছবিতে তার অনিচ্ছায় নগ্নতার প্রদর্শন ছিল। সম্ভবত সে কারণে এই ছবি সফল হয়নি। এছাড়া পরিচালকেরা তার অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে টাকা পয়সার ব্যাপারে ঠকাতো।
কানন দেবীর সত্যিকারের অভিনয় জীবন শুরু হয় ১৯৩০ সালে। ১৯৩১ সালে থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত কানন দেবী ছিলেন নায়িকা-গায়িকা। ১৯৩১ সালে পূর্ণাঙ্গ সবাক চলচ্চিত্র ‘জোর বরাতে’ নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৯৩৫ সালে মুক্তি পাওয়া 'মানময়ী গার্লস স্কুল' তাকে প্রতিষ্ঠা দেয় চলচ্চিত্র জগতে। ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে চলার সময় কান দেবীর অভিনয় দেখতে বহু তরুণ পাগলের মতো ছুটে যেতেন সিনেমার পর্দায় তাকে স্পর্শ করতে।
১৯৩৭ সালে মুক্তি পাওয়া 'মুক্তি' নামের চলচ্চিত্র তাঁকে প্রথম জীবনে খ্যাতি এনে দেয়। ৪০-এর দশকের 'পরিচয় এবং শেষ উত্তর' ছবির জন্য তিনি পরপর দু’বার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী পুরস্কার পান।
‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ ছবিতে তার গাওয়া ‘মেঘ নগরের অন্ধকারে এবং কেন অকারণে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়। প্রথথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে ‘মুক্তি’ ছবিতে অভিনয় করেই তিনি পেলেন তারকার মর্যাদা। তখন কলকাতার টালিগঞ্জের ফিল্ম স্টুডিওর কত শত দর্শক কানন দেবীকে এক নজর দেখার জন্য উত্তেজনা চেপে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করত।
‘স্ট্রিট সিংগার (১৯৩৮), সাথী (১৯৩৮), পরাজয় (১৯৪০), জওয়ানি কি রাত (১৯৪০), বিদ্যাপতি (১৯৩৮), সাপুড়ে (১৯৩৯) ছবিতে কানন দেবীর নাচ-গান-অভিনয় এক কথায় ছিল অনবদ্য। তার শেষ ছবি হলো ‘ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্ত ও অন্নদা দিদি (১৯৫৭)।
বহু প্রতিভার অধিকারিণী ছিলেন কানন দেবী। অভিনয়, নাচ, গান-এই তিন প্রতিভাসহ অসংখ্য গুণের সমন্বয় ঘটেছিল তার মধ্যে। বিজ্ঞাপন চিত্রেও দেখা যায় কানন দেবীকে।
সব মিলিয়ে প্রায় ৭০টি ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। কানন দেবী যেসব নায়কের বিপরীতে অভিনয় করেন তারা হলেন, জয় নারায়ন, হীরেন বসু, জহর গাঙ্গুলী, ধীরাজ ভট্টাচার্য, জাল মার্চেন্ট, প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়া, কুন্দন লাল সায়গল, পাহাড়ী সান্যাল, ছবি বিশ্বাস, ভান বন্দ্যোপাধ্যায় (বড়), নওয়াব, নাজাম, পরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধামোহন ভট্টাচার্য, বিকাশ রায়, কমল মিত্র, অশোক কুমার, ইফতেখার প্রমুখ।
১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত কানন দেবীর জন্য সবচেয়ে বেশি খ্যাতির সময় ছিল। তিনি এ সময় সম্ভ্রান্ত কানন দেবীতে পরিণত হন কানন বালা থেকে। তিনি তখন রোমান্টিক নায়িকার বদলে স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকাতেই বেশী অভিনয় করেন।
১৯৪৮ সালে তিনি শ্রীমতি পিকচার্স গড়ে তোলেন যার বেশির ভাগ ছবিই ছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে। এই কোম্পানীর ছবিতে তিনি কেবল অভিনয় ও প্রযোজনাই করেন নি, তিনি পরিচালনাও করেন। তার ছবির পরিচালকের একটি তিন সদস্য বিশিষ্ট দল ছিল যার নাম সব্যসাচী। তিনি তিন জনের একজন ছিলেন।
সিনেমার বাইরেও তার গানের রেকর্ড ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়।
তিনি ওস্তাদ আল্লারাখার কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিক্ষা নেন। এছাড়াও তিনি ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, রাইচাঁদ বড়াল, কাজী নজরুল ইসলাম,অনাদি দস্তিদার ও পঙ্কজ কুমার মল্লিকদের কাছেও তালিম নেন। তিনি আধুনিক গান ছাড়াও রবীন্দ্র সঙ্গীতও গেয়েছিলেন, যা রবীন্দ্রনাথকেও খুশি করে তুলেছিল। এ গানকে তিনি ভদ্রঘর থেকে বাংলার সাধারণ ঘরেও জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। কবি গুরু রবী ঠাকুর তার গান শুনে দারুন মুগ্ধ হন।
সেজন্যই ১৯৩৮ সালে কানন দেবীর প্রথম বিয়েতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নাম সই করা একখানি ছবিসহ একগুচ্ছ রজনীগন্ধা পাঠিয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালে মেজ দিদি করার সময় নেভাল এডিসি হরি দাস ভট্টাচার্যের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তারপর ঘনিষ্ঠতা এভাবে একে অপরের প্রেমে জড়িয়ে পরেন। কয়েক মাস যেতেই তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এ বিয়ে বেশী দিন না টিকলেও কানন দেবীর দ্বিতীয় বিয়ে সুখের হয়েছিল।
কানন দেবীর আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’ এক প্রামাণ্য দলিল। শিল্প মাধ্যমে অসাধারণ অবদানের জন্য ভারত সরকার তাঁকে ১৯৬৪ সালে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধীতে ভূষিত করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন।
এইগুনী শিল্পী ১৯৯২ সালের ১৭ জুলাই কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। আজ তাঁর মৃত্যুদিন, মৃত্যুদিনে তাকে স্মরন করছি গভীর শ্রদ্ধায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।